প্রাচীন ও আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মনস্তাত্ত্বিক আলোচনা আছে: লর্ড ব্রাইস বলেছেন: ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভিত্তি মনোবিজ্ঞানের মধ্যেই নিহিত আছে’ (Political Science has its roots in Psychology.”)। প্লেটো তাঁর Republic গ্রন্থে অভিভাবক ও শাসকশ্রেণীর অভিপ্রেত মানসিকতা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। অ্যারিস্টটল মানুষকে ‘সামাজিক জীব’ হিসাবে অভিহিত করেছেন। হবস্ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি হিসাবে স্বার্থবুদ্ধি, হিংসা ও ক্ষমতার কথা বলেছেন। মেকিয়াভেলী শাসকের গুণাবলীর মধ্যে সিংহের বিক্রম ও শৃগালের চাতুর্যের সমন্বয়ের কথা বলেছেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বর্তমান আলোচনাও নানাভাবে মনোবিদ্যার উপর নির্ভরশীল। মনোবিজ্ঞানমূলক পদ্ধতির ভিত্তিতে রাষ্ট্রনৈতিক আলোচনার সমর্থকদের মধ্যে বেজহট (Bagehot), স্পেনসার (Spencer), গ্রাহাম ওয়ালাস (Graham Wallas), ম্যাকডুগাল (McDougall), লেব (Le Bon), টার্ডে (Tarde) প্রমুখ মনীষীর নাম উল্লেখযোগ্য।

মনস্তাত্ত্বিক সূত্রের প্রয়োগ বর্তমান রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি রীতি: বর্তমানে মনোবিজ্ঞানের আলোকে রাষ্ট্রীয় সমস্যা পর্যালোচনার প্রবণতা যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। এই প্রবণতার সূত্রপাত ঘটে বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে। ব্যক্তিজীবন ও সমাজজীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতি প্রয়োগের ব্যাপারে আধুনিক চিন্তাবিদদের মধ্যে আগ্রহ দেখা যায়। বার্কার বলেছেন: ‘মানুষের জটিল কার্যাবলী বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে মনস্তাত্ত্বিক সূত্রের ব্যবহার যেন বর্তমান দিনের রীতিতে পরিণত হয়েছে। আমাদের পূর্ব পুরুষদের চিন্তা যদি জীববিজ্ঞানের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে, আমাদের চিন্তা মনোবিজ্ঞানের দ্বারা প্রভাবিত’ (“The application of psychological clue to the riddles of human activity has indeed become the fashion of the day. If our forefathers thought biologically, we think psychologically.”)। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তুর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে মনস্তাত্ত্বিক সূত্রের প্রয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন সামাজিক পরিবেশে মানুষের আচার-আচরণ সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভের জন্য মনস্তাত্ত্বিক প্রতিপাদ্য বিষয়ে জ্ঞান থাকা দরকার।

আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা মনোবিজ্ঞানের কাছে নানাভাবে ঋণী।

(১) রাষ্ট্রবিজ্ঞান মনোবিজ্ঞানের কাছে ঋণী | এখনকার রাষ্ট্রকাঠামোগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনমতের ভূমিকাই হল প্রধান। কারণ গণতন্ত্র বলতে জনমতের অনুগামী শাসনকে বোঝায়। এই জনমত সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভের জন্য ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত মনস্তত্ত্বের পর্যালোচনা প্রয়োজন। এদিক থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আধুনিক আলোচনা মনোবিজ্ঞানের কাছে ঋণী।

(২) মনোবিজ্ঞানের জ্ঞান ছাড়া রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অনেক বিষয় আলোচনা করা যায় না: রাষ্ট্রের কর্ণধারগণ জাতীয় সংকটের সময় দেশবাসীর আবেগ-অনুভূতির কাছে আবেদন-নিবেদন করেন। রাষ্ট্রনেতাদের এই পন্থা-পদ্ধতি মনোবিজ্ঞানের দ্বারা প্রভাবিত হয়। রাজনীতিক দলগুলি নির্বাচনী প্রচারে জনমানসকে প্রভাবিত করার জন্য মনস্তাত্ত্বিক বিভিন্ন পন্থা-পদ্ধতি অবলম্বন করে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই সমস্ত বিষয় আলোচনার জন্য মনোবিজ্ঞানের জ্ঞান দরকার।

(৩) সরকারের স্থায়িত্বের স্বার্থে জনগণের মনস্তত্ত্ব অনুধাবন করা দরকার: গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকারের স্থায়িত্বের জন্য জনগণের মানসিক গঠন ও নৈতিক বিশ্বাসের সঙ্গে সরকারের উদ্দেশ্য ও আদর্শের সামঞ্জস্য বিধান করা দরকার। তার জন্য প্রয়োজন হল জনগণের মনস্তত্ত্বের বিচার-বিশ্লেষণ ও অনুধাবন। তা না হলে সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার সঙ্গে জনসাধারণের অভাব-অভিযোগের মধ্যে ব্যবধান দেখা দেবে। তখন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব দুর্বল হয়ে পড়বে।

(৪) রাজনীতিক সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে মনস্তাত্ত্বিক সূত্রের প্রয়োগ: এখন দেশের মধ্যে বিভিন্ন সামাজিক, রাজনীতিক, আর্থনীতিক প্রভৃতি সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে মনস্তাত্ত্বিক সূত্রের প্রয়োগ কার্যকর ও মূল্যবান বলে মনে করা হয়। মানবগোষ্ঠীর মধ্যে এমন অনেক জটিল সমস্যা দেখা যায় যেগুলির রাজনীতিক সমাধান সহজ পথে সম্ভব নয়। এরকম ক্ষেত্রে মনস্তাত্ত্বিক প্রতিপাদ্য বিষয়ের সাহায্যে সমস্যার মূল কারণ অনুধাবন করা যায় এবং এই পথে সমস্যার সমাধান সহজ হয়।

(৫) মনোবিজ্ঞানের অনেক বিষয় মনস্তত্ত্বের বিচারে অনুধাবন করতে হয়: রাজনীতিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের উৎস, রাজনীতিক কার্যকলাপ এবং তার সাফল্য-অসাফল্য সম্পর্কিত বিচার-বিশ্লেষণ মনোবিজ্ঞানের জ্ঞান ছাড়া অসম্ভব। নির্বাচকমণ্ডলীর আচার-আচরণ, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মানসিকতা, আমলাদের আচরণ প্রভৃতি মনস্তত্ত্বের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। রাষ্ট্রনেতাদের ঝোঁক, জনগণের প্রতিক্রিয়া, স্বার্থগোষ্ঠীর প্রবণতা প্রভৃতি মনস্তত্ত্বের বিচারেই অনুধাবন করা যায়।

(৬) আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় মনো-বিজ্ঞানের প্রভাব অধিক: জাতি ও জাতীয়তাবাদ হল আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই জাতীয়তাবাদের মূল উপাদানসমূহ হল অভিন্ন ঐতিহাসিক ঐতিহ্য, সমধর্মীয় বিশ্বাস, ভাবপ্রবণতা প্রভৃতি বিষয়। এই বিষয়গুলি মনোবিজ্ঞানের আলোচনার অন্তর্ভুক্ত। তা ছাড়া বর্তমানে রাজনীতিক দল, প্রতিরক্ষা বাহিনী, রাষ্ট্রকৃত্যক কমিশন ও অন্যান্য রাষ্ট্রনৈতিক প্রতিষ্ঠানের গঠন ও পরিচালনার ক্ষেত্রে মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতির ব্যাপক প্রয়োগ দেখা যায়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বর্তমান আলোচনা নানাভাবে মনোবিদ্যার উপর নির্ভরশীল।

রাষ্ট্রবিজ্ঞনের উপরও মনোবিজ্ঞান নির্ভরশীল: মনোবিজ্ঞানের উপর রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাবও অস্বীকার করা যায় না। বর্তমানে মনোবিজ্ঞানীরা ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর রাজনীতিক অংশগ্রহণ ও রাজনীতিক সামাজিকীকরণের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর মানসিক বৃত্তির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে থাকেন। রাজনীতিক ঘটনা প্রবাহকে মনোবিজ্ঞানী উপেক্ষা করতে পারেন না। কারণ ব্যক্তিগত ও জাতির মানসিকতার উপর এর প্রভাবকে অস্বীকার করা যায় না। বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের মানসিকতা, রাজনীতিক ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা, তাদের সাংস্কৃতিক ও মানসিক স্তরবিন্যাস প্রভৃতি সামাজিক মনোবিজ্ঞানীকে বিচার-বিশ্লেষণ করতে হয়। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জ্ঞান সাহায্য করে।

মনোবিজ্ঞানের সঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। তবুও উভয় শাস্ত্রের আলোচনা পদ্ধতির পার্থক্য আছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান সকল ক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞানকে অনুসরণ করে চলে না।

(ক) রাষ্ট্রবিজ্ঞান নীতিনিষ্ঠ মনোবিজ্ঞান বস্তুনিষ্ঠ: রাষ্ট্রবিজ্ঞান নীতিনিষ্ঠ বিজ্ঞান এবং মনোবিজ্ঞান বস্তুনিষ্ঠ বিজ্ঞান। মনোবিজ্ঞানের সঙ্গে ঔচিত্য-অনৌচিত্যের কোন সম্পর্ক নেই। মনোবিজ্ঞান বর্তমান অবস্থা বা সংঘটিত বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার একটা নৈতিক মানদণ্ড আছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান আদর্শ নিয়ে আলোচনা করে।

(খ) রাষ্ট্রবিজ্ঞান সকল ক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞানকে অনুসরণ করে না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়ের অনেক কিছুই মনোবিজ্ঞানের এক্তিয়ারভুক্ত নয়। সকল রাষ্ট্রনৈতিক ঘটনাকে মনস্তত্ত্বের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যায় না।

(গ) এখনকার জটিল রাষ্ট্রনৈতিক সমস্যার সমাধান মনস্তাত্ত্বিক পথে সম্ভব: মনোবিজ্ঞান মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির সাহায্যে ব্যক্তির আচার-ব্যবহার বিচার-বিশ্লেষণ করে। প্রাচীনকালের আদিম মানুষকে সহজাত প্রবৃত্তির মাধ্যমে বিচার করা যেতে পারে; কিন্তু বিংশ শতাব্দীর সভ্য ও জটিল মানুষকে এত সহজে অনুধাবন করা যায় না। অবিমিশ্র মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতি আধুনিক সভ্য সমাজব্যবস্থার রাষ্ট্রনৈতিক সমস্যার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে বহুলাংশে গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে।

(ঘ) রাষ্ট্রবিজ্ঞান কেবলমাত্র মানুষের বাহ্যিক আচার-আচরণ সম্পর্কেই আলোচনা করে। কিন্তু মনোবিজ্ঞান বাহ্যিক আচার-আচরণ এবং মানুষের মানসিক বিষয় নিয়েও আলোচনা করে।

(ঙ) মনোবিজ্ঞানে মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি পর্যালোচনা করা হয়, কিন্তু তার উৎপত্তি ব্যাখ্যা করা হয় না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ব্যক্তির রাজনীতিক আচার-আচরণের কার্যকারণ সম্পর্ক ব্যাখ্যা করা হয়।

(চ) ক্যাট্‌লিন-এর মতানুসারে বর্তমান সভ্য সমাজের রাষ্ট্রনৈতিক সমস্যাদিকে মনোবিজ্ঞান বন্য প্রবৃত্তির পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাখ্যা করে। রাষ্ট্রনৈতিক সমস্যার এই ধরনের বিচার-বিশ্লেষণ অসঙ্গত। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞান এই ভুল করেনি।

উপসংহার: উপরিউক্ত পার্থক্য সত্ত্বেও মনোবিজ্ঞানের সঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের নিকট সম্পর্ককে অস্বীকার করা যায় না। প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় মনস্তত্ত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। সরকারের স্থায়িত্ব, সাফল্য, জনপ্রিয়তা, আইনের কার্যকারিতা প্রভৃতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে সমাজবাসীদের ধ্যান-ধারণা, ন্যায়-নীতি, প্রত্যয়-বিশ্বাস প্রভৃতি অনুধাবন করা দরকার। আর এসব ক্ষেত্রে মনস্তাত্ত্বিক প্রতিপাদ্য বিষয়ের জ্ঞানের বিশেষ ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না।