আগে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ছিল নীতিশাস্ত্রের শাখা মাত্র: ম্যাকেঞ্জি (Mackenzie)-র মতানুসারে ‘আচার আচরণের ভালমন্দের আলোচনাই হল নীতিশাস্ত্র’ (Ethics may be defined as the study of what is right or good in conduct.”)। অপরপক্ষে, লর্ড অ্যাকটন (Lord Acton)-এর অভিমত অনুসারে, ‘সরকারের কার্যাবলীর ঔচিত্য-অনৌচিত্য সংক্রান্ত আলোচনা হল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মুখ্য বিষয়’ (“The great question is to discover not what governments prescribe but what they ought to prescribe.”)। এদিক থেকে বিচার করলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও নীতিশাস্ত্রের মধ্যে অঙ্গাঙ্গী সম্পর্কের অস্তিত্ব সহজেই বোঝা যায়। বস্তুত প্রাচীন পণ্ডিতগণ অনেকেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে নীতিশাস্ত্রের অন্যতম শাখা হিসাবে গণ্য করতেন। এ প্রসঙ্গে গ্রীক দার্শনিকদের কথা উল্লেখ করা যায়। তাঁরা অনেকেই নৈতিক আদর্শের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রনৈতিক কার্যকলাপের মূল্যায়ন করতেন। এই গ্রীকৃ পণ্ডিতদের মতে জনগণের জন্য মঙ্গলময় সুন্দর জীবন সম্ভব করে তোলাই হল রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য (‘‘The end of the state is happy and honourable life, perfect and self-sufficing life. “)। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য রাষ্ট্রনৈতিক পরিকল্পনা নৈতিক আদর্শের পরিপ্রেক্ষিতে নির্ধারিত হওয়া দরকার। প্লেটোর ‘রিপাবলিক’ এবং অ্যারিস্টটলের ‘পলিটিক্স’ গ্রন্থে এর পরিচয় পাওয়া যায়। প্রাচীন ভারতে, রামায়ণ-মহাভারতের যুগে রাজকার্যকে ধর্মীয় ও নৈতিক অনুশাসনের উপর প্রতিষ্ঠিত করার কথা বলা হয়েছে।

নীতিশাস্ত্র থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পৃথকীকরণ: ইতালীর দার্শনিক ম্যাকিয়াভেলী রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে নীতিশাস্ত্রের আওতা থেকে মুক্ত করেছেন এবং পৃথক শাস্ত্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এ ক্ষেত্রে পরবর্তীকালে চুক্তিবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হস (Hobbes), লক্ (Locke) ও রুশো (Rousseau)-র নাম উল্লেখযোগ্য। এ বিষয়ে ভারতীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কৌটিল্যের অবদানও কম নয়। এই সব নগণ নৈতিক আদর্শের পরিবর্তে নূতন দৃষ্টিভঙ্গীর পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ক্রমে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও নীতিশাস্ত্রের বিষয়বস্তু ও আলোচনাক্ষেত্রের পরিধি পৃথক হয়ে পড়েছে। বর্তমানে এই দুই শাস্ত্রের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পার্থক্য দেখা যায়।

(১) নীতিশাস্ত্রের পরিধি ব্যাপকতর: মানুষের মনের চিন্তা ও বাহ্যিক আচার-আচরণ উভয়ই নীতিশাস্ত্রের আলোচনার বিষয়। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞান কেবল মানুষের বাহ্যিক কার্যকলাপ নিয়ে আলোচনা করে। মানুষের মানসিক চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কোন যোগ নেই। আবার সকল বাহ্যিক কার্যকলাপ নয়, মানুষের রাষ্ট্রনৈতিক আচরণের গণ্ডীর মধ্যেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনাক্ষেত্র সীমাবদ্ধ। নীতিশাস্ত্র কিন্তু মানুষের কোন আচরণকেই বাদ দেয় না।

(২) বে-আইনী কাজ সব সময় নীতিবিরুদ্ধ নয়: নীতিশাস্ত্রের নির্দেশ ন্যায়ভিত্তিক। ন্যায়-অন্যায় বা উচিত-অনুচিত বোধ থেকে নীতিশাস্ত্রের প্রতিপাদ্য সূত্রগুলি রচিত হয়। মানুষের চিত্তকে শুদ্ধ করার উদ্দেশ্যেই এ সবের সৃষ্টি। অপরদিকে রাষ্ট্রের নির্দেশ, যা আইন হিসাবে পরিচিত, তা সুবিধা-অসুবিধার বিবেচনার ভিত্তিতে রচিত হয়। সামাজিক কল্যাণের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রীয় আইন মানুষের বাহ্যিক আচরণকেই নিয়ন্ত্রণ করে। সেইজন্য যা আইনসম্মত তা নীতিসম্মত হবে এবং যা বে-আইনী তা নীতি-বিরুদ্ধ হবে, এমন কথা বলা যায় না।

(৩) রাষ্ট্রীয় আইন বাধ্যতামূলক; নৈতিক বিধান নয়: নীতিশাস্ত্রের নির্দেশ অবশ্য পালনীয় নয়। এই সব নির্দেশ পালন না করলে তার জন্য কোন দৈহিক শাস্তির ব্যবস্থা থাকে না। কিন্তু রাষ্ট্রীয় আইন মান্য করা বাধ্যতামূলক। এই আইন অমান্য করলে দৈহিক এবং অন্য কোন ধরনের শাস্তি ভোগ করতে হয়। রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে রাষ্ট্রীয় আইন মান্য করে চলতে হয়। বৃদ্ধ পিতামাতার সেবাযত্ন করা সম্ভানমাত্রেরই নৈতিক কর্তব্য। এই কর্তব্য পালন না করলে বা অবহেলা করলে দৈহিক শাস্তি ভোগ করতে হয় না। কিন্তু রাষ্ট্রীয় আইন লঙ্ঘন করলে শাস্তি ভোগ করতে হয়।

(৪) ন্যায়-নীতির নির্দেশ দেশভেদে বড় একটা বদলায় না। ন্যায়-অন্যায় বোধের ধারণা বিভিন্ন দেশে একেবারে একরকম না হলেও, বহুলাংশে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু রাষ্ট্রীয় আইন দেশভেদে ভিন্ন রকমের হয়।

(৫) রাষ্ট্রবিজ্ঞান অপেক্ষাকৃত নবীন: নীতিশাস্ত্র রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তুলনায় প্রাচীন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান অপেক্ষাকৃত নবীন। নীতিশাস্ত্র মানুষকে মানুষ হিসাবেই বিচার-বিবেচনা করে। অপরপক্ষে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান মানুষকে দেখে নাগরিক হিসাবে।

উভয় শাস্ত্রের মধ্যে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ: রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও নীতিশাস্ত্রের মধ্যে পার্থক্য আছে। তবুও রাজনীতিক আদর্শকে নৈতিক আদর্শ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করা যায়। রাষ্ট্রের মুখ্য উদ্দেশ্য হল জনগণের ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশের স্বার্থে সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করা। দুর্নীতিমূলক পথে রাষ্ট্র এ কাজ করতে পারে না। এই উদ্দেশ্যকে বাস্তবে রূপায়িত করার জন্য রাষ্ট্রনৈতিক আদর্শের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রকে তার কার্যক্রম স্থির করতে হয়। সুতরাং উদ্দেশ্যগত বিচারে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও নীতিশাস্ত্রের পারস্পরিক সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। উভয়েরই উদ্দেশ্য হল মানুষের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ সাধন করা। উদ্দেশ্যগত অভিন্নতার জন্য উভয়েই উভয়ের দ্বারা প্রভাবিত হয়। রাষ্ট্রনৈতিক আদর্শ রূপায়ণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উপর নীতিশাস্ত্রের যেমন প্রভাব পরিলক্ষিত হয়, তেমনি ক্ষেত্রবিশেষে নীতিশাস্ত্রের উপরও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাব দেখা যায়। রাষ্ট্র তার সার্বভৌম কর্তৃত্বের দ্বারা সমাজ থেকে কু-নীতি দূর করে এবং সু-নীতি প্রতিষ্ঠিত করে।

রাষ্ট্রীয় আইন নীতিবিরুদ্ধ হয় না: সামাজিক মঙ্গলবিধান রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও নীতিশাস্ত্র উভয়েরই লক্ষ্য। তাই চুরি-ডাকাতি প্রভৃতি কাজ শুধু দুর্নীতিমূলক নয়, বে-আইনীও বটে। অধিকাংশ আইনের ভিত্তিতে থাকে কোন-না-কোন নৈতিক বিধান। কোন রাষ্ট্রীয় আইন জনগণের নৈতিক মানদণ্ডের বিরোধী হলে তার বিরুদ্ধে গণ-অভুত্থানের আশংকা থাকে। প্রখ্যাত জার্মান দার্শনিক কাণ্ট (Kant) বলেছেন: ‘প্রকৃত রাষ্ট্রনীতি নৈতিকতার কাছে নতি স্বীকার না করে এক পাও এগোতে পারে না’ (“True politics cannot take a single step forward unless it has first done homage to morals.”)। গিলক্রিস্ট (Gilchrist)-ও অনুরূপ অভিমত পোষণ করেন। তিনি বলেছেন: ‘রাষ্ট্রনৈতিক বিধি-ব্যবস্থার বিজ্ঞান, যা রাষ্ট্রবিজ্ঞান হিসাবে পরিচিত, তার সঙ্গে নৈতিক বিধি-বিধানের বিজ্ঞান হিসাবে পরিচিত নীতিশাস্ত্রের সম্পর্ক বর্তমান’ (“Political Science, the science of political order, is also connected with Ethics, the science of moral order.”)।

উপসংহার: নীতিশাস্ত্রের নির্দেশ রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের মাধ্যমে আইনে রূপান্তরিত হয়। আবার রাষ্ট্র আইন প্রণয়নের দ্বারা দুর্নীতির অবসান ঘটিয়ে সু-নীতি প্রতিষ্ঠা করে। ফলে নীতিশাস্ত্রেরও রূপান্তর ঘটে। আগে ভারতে সতীদাহ প্রথা ছিল নীতিসম্মত। পরবর্তীকালে রাষ্ট্রের আইনের দ্বারা এই প্রথা রদ হওয়ার পর এ বিষয়ে ভারতবাসীদের নীতিজ্ঞান ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হয়। গেটেল (Gettell) বলেছেন: ‘কোন নৈতিক বিধান যখনই বিস্তৃতভাবে জড়িয়ে পড়ে এবং শক্তিশালী হয়ে উঠে তখনই তা আইনে রূপান্তরিত হয়’ (“Moral ideas when they become widespread and powerful, tend inevitably to by crystalised into law.”)।