অর্থবিদ্যা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অংশবিশেষ: রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতি আগে আলাদা ছিল না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আদি গুরু গ্রীক দার্শনিক অ্যারিস্টটল অর্থবিদ্যা বা ধনবিজ্ঞানকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অংশ হিসাবে গণ্য করতেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর ফরাসী ফিজিওক্র্যাটস (Physiocrats )-গণও অনুরূপ ধারণা পোষণ করতেন। বস্তুত, অর্থবিদ্যা (Economics) শব্দটি নতুন। পুরাতন পন্থীরা ‘রাজনীতিক অর্থনীতি (Political Economy) শব্দটি ব্যবহার করতেন। প্রখ্যাত ইংরাজ অর্থবিজ্ঞানী অ্যাডাম স্মিথ (Adam Smith)-এর মতানুসারে রাজনীতিক অর্থনীতির মুখ্য উদ্দেশ্য হল জনগণ ও রাষ্ট্রকে ধনশালী করে তোলা (“Political Economy proposes to enrich the people and the Sovereign.”)। জেমস স্টুয়ার্ট (Sir James Stuart ) পারিবারিক অর্থ ব্যবস্থার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় অর্থব্যবস্থার তুলনা করেছেন। ভারতীয় দার্শনিক কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রেও রাজনীতি ও অর্থনীতির উল্লেখ দেখা যায়। তাঁর মতানুসারে রাষ্ট্রের প্রগতির স্বার্থে রাজনীতি ও অর্থনীতি উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ। বস্তুত অ্যারিস্টটলের আমল থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ধনবিজ্ঞান রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অংশ হিসাবে গণ্য হত।
অর্থবিদ্যা এমন একটি পৃথক শাস্ত্র: ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গীতে ধনবিজ্ঞানের আলোচনা শুরু হয়। এই সময় অর্থবিদ্যা (Economics) শব্দটির ব্যবহার আরম্ভ হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে সর্বপ্রথম অ্যাডাম স্মিথই অর্থবিদ্যাকে একটি স্বতন্ত্র শাস্ত্রের মর্যাদা প্রদান করেন। বর্তমানে অর্থবিদ্যা একটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র সামাজিক বিজ্ঞান। আধুনিক রাষ্ট্রের জনকল্যাণমূলক কাজকর্ম ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন তাই রাজনীতি আলাদাভাবে এই সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে। বস্তুত বিভিন্ন কারণে বর্তমানে অর্থনীতিকে রাজনীতি থেকে আলাদা করে দেখা হয়। স্বতন্ত্র একটি সামাজিক বিজ্ঞান হিসাবে অর্থনীতি এখন সুপ্রতিষ্ঠিত। এর পিছনে মার্শাল, রিকার্ডো, কেইনস, অ্যাডাম স্মিথ এবং আধুনিক কালের স্যামুয়েলসন, মিরডাল, গলব্রেথ প্রমুখ ধনবিজ্ঞানীদের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মার্কস ও এ্যঙ্গেলস সমাজব্যবস্থার বনিয়াদ হিসাবে অর্থনীতিকে আলাদা গুরুত্ব দিয়েছেন।
(১) রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমাজবাসীদের রাজনীতিক জীবনের গতি-প্রকৃতি নির্ধারণ করে। অর্থবিদ্যার আলোচনা হল সমাজবদ্ধ মানুষের অর্থনৈতিক কর্মপ্রচেষ্টার বিচার-বিশ্লেষণ। উভয় শাস্ত্রের আলোচনাক্ষেত্রের পরিধি বর্তমানে ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত।
(২) মানুষের অর্থনৈতিক কার্যকলাপের আলোচনাই হল অর্থবিদ্যা। সীমাবদ্ধ উপায়-উপকরণের দ্বারা সীমাহীন অভাব মেটানোর প্রচেষ্টাকে কেন্দ্র করেই মানুষের যাবতীয় আর্থনীতিক কার্যকলাপের সৃষ্টি হয়। ধনবিজ্ঞানী অধ্যাপক মার্শাল-এর মতানুসারে মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের সাধারণ কার্যাবলীর আলোচনাই হল অর্থবিদ্যা। তাই অর্থবিদ্যার আলোচনায় উৎপাদন, বিনিময়, ভোগ ও বণ্টন মুখ্য বিষয় হিসাবে দেখা যায়। তাই অর্থবিদ্যা হল মূলতঃ একটি বস্তুনিষ্ঠ বিজ্ঞান (positive science)। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল একটি নীতিনিষ্ঠ বিজ্ঞান (normative science)। এ যুগের কিছু রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তাঁদের আলোচনাকে জ্ঞাননিষ্ঠ ও বস্তুনিষ্ঠ (Positivist) বলে দাবী জানালেও শেষ বিচারে রাষ্ট্রবিজ্ঞান নীতিনিষ্ঠ অধ্যয়ন হিসাবেই গণ্য হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান মানবিক এবং নৈতিক মূল্যবোধের উপর গুরুত্ব আরোপ করে।
(৩) আধুনিক অর্থবিদ্যার সিদ্ধান্তসমূহ অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংখ্যাতত্ত্বের বৈজ্ঞানিক ভাষায় প্রকাশিত হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এ কথা এমনভাবে খাটে না। নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ মিরডাল (G. Myrdal)-এর অভিমত অনুসারে ধনবিজ্ঞানের মত রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতা নেই। তাই সঠিক বিজ্ঞান হিসাবে ধনবিজ্ঞানের দাবী রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দাবীর তুলনায় অনেক বেশী জোরদার।
(8) ব্রাউন (Ivor Brown) -এর মতানুসারে অর্থনীতি বিষয়কে নিয়ে আলোচনা করে। অপরদিকে রাজনীতি মানুষকে নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে।
(৫) অর্থবিজ্ঞানীরা কেবল অর্থনৈতিক সূত্রাদি নির্দেশ করেন ও বিভিন্ন অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সূত্রগুলির কার্যকারিতা বিচার-বিশ্লেষণ করে থাকেন। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাষ্ট্র-সংক্রান্ত যাবতীয় সমস্যা সম্পর্কে সামগ্রিকভাবে চিন্তা-ভাবনা করেন। এই কারণে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনাক্ষেত্র অধিকতর বিস্তৃত।
(৬) রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থবিদ্যা পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। অর্থবিদ্যার আলোচনা মূল্যমান-নিরপেক্ষ। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা মূল্যমান নিরপেক্ষ নয়।
যাইহোক্, বর্তমানে অর্থবিদ্যা রাষ্ট্রবিজ্ঞান থেকে স্বতন্ত্র সামাজিক বিজ্ঞান হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এতদ্সত্ত্বেও উভয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বর্তমান। উভয় শাস্ত্রই সমাজবদ্ধ মানুষের কার্যকলাপ সম্পর্কে আলোচনা করে। সমাজবাসীদের সর্বাধিক কল্যাণ সাধনই হল উভয়ের উদ্দেশ্য। সমাজজীবনের উন্নয়নের গতিকে অব্যাহত রাখার ব্যাপারে উভয় শাস্ত্রই আগ্রহী। উদ্দেশ্যগত সাদৃশ্যের কারণে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ধনবিজ্ঞান পরস্পরের উপর নির্ভরশীল।
নিম্নলিখিত বিভিন্ন কারণের জন্য অর্থনীতি রাজনীতির উপর নির্ভরশীল। বা অন্যভাবে বলতে গেলে অর্থনীতি রাজনীতির দ্বারা প্রভাবিত হয়।
(ক) আর্থনীতিক বিষয় রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন: অর্থবিদ্যার আলোচ্য বিষয়গুলি রাষ্ট্রনৈতিক কাঠামো ও সিদ্ধান্তের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়। রাষ্ট্রের ভিতর সকল প্রকার অর্থনৈতিক প্রচেষ্টা বর্তমানে রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়। উৎপাদন, বিনিয়োগ, বণ্টন, কৃষি, শিল্প, বৈদেশিক বাণিজ্য, শ্রমিক-নীতি, শুল্কব্যবস্থা, শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক প্রভৃতি সকল আর্থনীতিক বিষয় এখন রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীনে পরিচালিত হয়।
(খ) পরিকল্পিত অর্থনীতিতে অর্থব্যবস্থার উপর রাষ্ট্রের প্রভাব অধিক: ভারতের ন্যায় উন্নয়নশীল দেশে অর্থব্যবস্থার উপর প্রভাব বিশেষভাবে ব্যাপক এবং সুদূরপ্রসারী। পরিকল্পিত পথে অর্থনৈতিক প্রগতির প্রচেষ্টাই এর কারণ। রাষ্ট্রই দেশের সম্পদ-সামগ্রীকে সুপরিকল্পিত পথে ব্যবহার করে। তার ফলে দেশের সুষম ও সর্বাঙ্গীণ অর্থনৈতিক বিকাশ সম্ভব হয়। তা ছাড়া সাধারণভাবে বর্তমানে সকল দেশেই অর্থনীতির উপর রাষ্ট্রের ব্যাপক প্রভাব দেখা যায়। ধনতান্ত্রিক ইংল্যাণ্ড, আমেরিকাও এর ব্যতিক্রম নয়।
(গ) সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রব্যবস্থা ও অর্থনীতি অভিন্ন: আবার ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সম্পদের উৎপাদন, বণ্টন ও বিনিময়ের ক্ষেত্রে একেবারে আলাদা নীতি অনুসৃত হবে এটাই স্বাভাবিক। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সমাজের অর্থনৈতিক উদ্যোগ রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন। চীনের মত সমাজতান্ত্রিক দেশে জাতীয় অর্থনীতি রাষ্ট্রের একটি বিভাগ মাত্র।
(ঘ) জলকল্যাণমূলক রাষ্ট্রে রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে অর্থব্যবস্থার সম্পর্ক গভীর: আধুনিক কোন রাষ্ট্রই পুলিশী রাষ্ট্র (Police State) নয়। এখন রাষ্ট্র মাত্রেই সমাজকল্যাণকর রাষ্ট্র (Social Welfare State)। বর্তমানে ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক নির্বিশেষে সকল দেশই সমাজকল্যাণমূলক রাষ্ট্র ( Social Welfare State) প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধপরিকর। জনগণের সর্বাধিক কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে উৎপাদন, বিনিয়োগ, বণ্টন প্রভৃতি জনজীবনের উপর প্রভাব বিস্তার করে এমন সকল অর্থনৈতিক বিষয়ের দিকে বর্তমানে সকল রাষ্ট্রকে দৃষ্টি দিতে হয়। তার ফলে সমাজকল্যাণমূলক আদর্শের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে অর্থব্যবস্থার পার্থক্য ক্রমশ সংকীর্ণ হয়ে আসছে। এতে উভয় শাস্ত্রের মধ্যে সম্পর্ক দিনে দিনে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে।
(ঙ) অর্থনৈতিক কাজকর্মের উপর রাজনীতিক তত্ত্বের প্রভাব: বর্তমানে রাষ্ট্রীয় আইনের মাধ্যমে যাবতীয় অর্থনৈতিক কার্যাদি সম্পাদিত হয়। তাই দেশের অর্থনৈতিক সমস্যাদির প্রকৃত সমাধানের জন্য সঠিক রাজনীতিক দৃষ্টিভঙ্গী দরকার। এইভাবে রাষ্ট্রের কার্যাবলী, প্রকৃতি ও পরিধি সম্পর্কিত মতবাদ অর্থনৈতিক কর্মসূচীকে প্রভাবিত করে।
(চ) রাজনীতিক মতাদর্শ অনুসারে দেশের অর্থব্যবস্থা নির্ধারিত: মার্কসীয় রাজনীতিক মতাদর্শ সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির পন্থা-পদ্ধতিকে প্রভাবিত করে। গণ-প্রজাতন্ত্রী চীনে মার্কসীয় রাজনীতিক আদর্শের পরিপ্রেক্ষিতে সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুঁজিবাদী অর্থনীতি বা মিশ্র অর্থনীতির পথ প্রশস্ত করে। ভারতে উদারনৈতিক গণতন্ত্র ও মিশ্র অর্থনীতি বর্তমান। এইভাবে রাজনীতিক মতাদর্শের পরিপ্রেক্ষিতে একটি দেশের আর্থনীতিক ব্যবস্থা স্থিরীকৃত হয়।
অনুরূপভাবে অর্থব্যবস্থাও দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে। অন্যভাবে বলতে গেলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতির উপর নির্ভরশীল।
(১) রাষ্ট্রের কর্মপরিধি অর্থ-ব্যবস্থার দ্বারা নির্ধারিত হয়: আর্থনীতিক সাম্য ছাড়া গণতন্ত্র অর্থহীন হয়ে পড়ে। ব্যাপক ধনবৈষম্য, নিষ্ঠুর শোষণ প্রভৃতি বর্তমান থাকলে দেশে অসন্তোষ ও বিপ্লবের হাওয়া সৃষ্টি হয়। তার ফলে দেশে রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। বস্তুত, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে রাষ্ট্রের কার্যাবলী ও ক্ষমতার পরিধি সংক্রান্ত আলোচনার অধিকাংশই হল আর্থনীতিক ব্যবস্থাগত আলোচনা। প্রকৃত প্রস্তাবে রাষ্ট্রের কর্মপরিধি ও ক্ষমতার সীমা দেশের অর্থব্যবস্থার দ্বারা স্থিরীকৃত হয়ে থাকে।
(২) আর্থনীতিক সূত্রের ভিত্তিতে রাষ্ট্রতত্ত্বের সৃষ্টি হয়: আর্থনীতিক মূল সূত্রের ভিত্তিতেই রাষ্ট্রতত্ত্বের সৃষ্টি হয়। আর্থনীতিক অগ্রগতি বা জনকল্যাণের উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করেই জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রতত্ত্বের উদ্ভব হয়েছে। ইতিহাসের বস্তুবাদী বা আর্থনীতিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের পরিপ্রেক্ষিতে মার্কস সমাজ ও রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণ করেছেন। একটি মৌল আর্থনীতিক সূত্রকে কেন্দ্র করেই ‘মার্কসবাদ’—এই সাড়া জাগানো রাষ্ট্রনৈতিক তত্ত্বের উদ্ভব হয়েছে।
(৩) রাজনীতিক ঘটনার পিছনে আর্থনীতিক কারণ থাকে: ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিক ঘটনাবলীর পিছনে আর্থনীতিক কারণের উপস্থিতি ও প্রভাব-প্রতিক্রিয়াকে অস্বীকার করা যায় না। ফরাসী বিপ্লব, রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক অক্টোবর বিপ্লব, চীনের গণবিপ্লব, এমনকি প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রভৃতি ঐতিহাসিক ঘটনার পিছনে যে সমস্ত শক্তি সক্রিয়ভাবে উপস্থিত তার মধ্যে আর্থনীতিক শক্তির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিটিশদের ঔপনিবেশিক বা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আর্থনীতিক শাসন-শোষণ বা দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে ভারতে ঔপনিবেশিকতাবাদ বিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন পরিচালিত হয়েছে।
(৪) অনেকের মতানুসারে অর্থনীতিবিদরা হলেন রাষ্ট্রের রূপকার। এঁদের সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া রাষ্ট্রনেতাদের পক্ষে আর্থনীতিক সমস্যার সমাধান বা উন্নয়নমূলক পরিকল্পনা প্রণয়ন অসম্ভব। মিচেল (Mitchell) মন্তব্য করেছেন: “Work by Economists will probably set the pattern for the advance of Political Science in the coming decade.”
পারস্পরিক সম্পর্ক নিবিড়: বর্তমানে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থবিদ্যা হল দুটি স্বতন্ত্র সামাজিক বিজ্ঞান। উভয়ের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পার্থক্য আছে। তবুও এদের পারস্পরিক সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। অর্থবিদ্যা ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিশেষভাবে সম্পৃক্ত। একে অপরের পরিপূরক। একটিকে ছাড়া অপরটি অসম্পূর্ণ। রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থবিদ্যার মধ্যে যে পার্থক্য তা মূলতঃ ধারণাগত বা পদ্ধতিগত। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে এই পার্থক্য নেই। সামাজিক বৈষম্যের পিছনে আর্থনীতিক ও রাজনীতিক উভয়বিধ কারণ বর্তমান থাকে। আবার অর্থনীতি ও রাজনীতি সামাজিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে। অনেক ক্ষেত্রে রাজনীতিক ও আর্থনীতিক ধ্যান-ধারণা মিলেমিশে একাকার। অধিকার, স্বাধীনতা, ক্ষমতা, কর্তৃত্ব প্রভৃতি ধারণাসমূহের রাজনীতিক তথা আর্থনীতিক তাৎপর্য বর্তমান। এমন অনেক রাষ্ট্রনৈতিক মতবাদ আছে যেগুলি আর্থনীতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক তত্ত্বের মিলিত ফল। উদাহরণ হিসাবে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, সমাজতন্ত্রবাদ, সাম্যবাদ প্রভৃতির কথা বলা যায়। তা ছাড়া আধুনিক অর্থবিদ্যার ‘কল্যাণমূলক অর্থনীতি (Welfare Economics) এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা (Social Welfare State)-র পরিপ্রেক্ষিতে উভয় শাস্ত্রের মধ্যে সম্পর্ক ক্রমশঃ ঘনিষ্ঠতর হচ্ছে।
বল (A. R. Ball) বলেছেন: “In the search for new theoretical approaches the latest enthusiasm is for the application of economic theory in politics.” মার্কসীয় দর্শন অনুসারে সমাজের আর্থনীতিক ব্যবস্থার উপর ভিত্তি করেই রাষ্ট্রনৈতিক উপরি-কাঠামো গড়ে উঠে। বস্তুতঃ সাম্প্রতিককালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় আর্থনীতিক সূত্র ও অনুশীলন পদ্ধতি অবলম্বনের এক স্বাভাবিক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। রাষ্ট্রনীতি আলোচনায় ‘নতুন রাজনীতিক অর্থতত্ত্ব’ (New Political Economy) নামে আলোচনার এক নতুন ধারার সূত্রপাত ঘটেছে। আর্থনীতিক ধ্যান-ধারণা ও প্রক্রিয়ার সাহায্যে রাজনীতিতে বিচার-বিশ্লেষণের প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে জে. এম. বুকানন, জি. টুলক প্রমুখ চিন্তাবিদদের নাম উল্লেখযোগ্য।
Leave a comment