প্রশ্নঃ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাথে ভূগােলের সম্পর্ক আলােচনা কর।
অথবা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ভূগােলের মধ্যে সম্পর্ক বর্ণনা কর।
ভূমিকাঃ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাথে প্রায় প্রত্যেকটি মানবিক বিজ্ঞানের রয়েছে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ও গভীর সংযােগ। ভূগােল তার বাইরে নয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মূল আলােচ্য বিষয় হচ্ছে রাষ্ট্র। আর রাষ্ট্রের একটি অপরিহার্য উপাদান হচ্ছে নির্দিষ্ট ভূখণ্ড। সুতরাং রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে রাষ্ট্রসম্পর্কিত আলােচনা করতে হলে ভূখণ্ড নিয়েও আলােচনা করতে হয়। আর এ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ভূগােলের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এজন্য মানুষ ও প্রকৃতি সম্পর্কে যত বিজ্ঞান আছে সেগুলাের সাথে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। রাষ্ট্রের ভৌগােলিক অবস্থান, ভূমির প্রকৃতি, আবহাওয়া, জলবায়ু প্রভৃতি বিষয় রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের মানুষকে প্রভাবিত করে এবং সেভাবেই রাষ্ট্রদর্শন গড়ে ওঠে। আর এ কারণেই ভূগােলের সাথে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাথে ভূগােলের সম্পর্কঃ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাথে ভূগােলের সম্পর্ক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধিকে বিস্তৃত করেছে। নিম্নে উভয়ের মধ্যে সম্পর্কের বর্ণনা তুলে ধরা হলো-
(১) রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের অভিমতঃ এরিস্টটল, বােডিন, মন্টেস্কু, বার্কলে প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর বিভিন্ন মন্তব্যে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাথে ভূগােলের সম্পর্ক পরিষ্কার হয়ে ওঠে। তারা সবাই রাষ্ট্রের প্রকৃতির ভৌগােলিক ব্যাখ্যা করেছেন। তারা বলেন, রাষ্ট্রের প্রকৃতি, কার্যাবলি অনেকাংশে তার ভৌগােলিক পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে। বর্তমানে আবহাওয়া, জলবায়ু, প্রাকৃতিক সম্পদ প্রভৃতি ভৌগােলিক উপাদান দ্বারা রাষ্ট্রের কার্যাবলি, গতি-প্রকৃতি অনেকাংশে নিয়ন্ত্রিত হয়।
(২) ঘনিষ্ঠতাঃ ভূগােল হচ্ছে ভূ-প্রকৃতি, আবহাওয়া, জলবায়ু ইত্যাদির সুসামঞ্জস্য অধ্যয়ন। অন্যদিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান হচ্ছে রাষ্ট্রের কার্যাবলি, প্রকৃতি, নাগরিক অধিকার, কর্তব্য, সরকার ইত্যাদির সুসামঞ্জস্য অধ্যয়ন। রাষ্ট্রের সমৃদ্ধি নির্ভর করে ভূমির উৎকর্ষ, উর্বরতা, খনিজ সম্পদ ইত্যাদির ওপর। নাগরিকের চরিত্র গঠনে আবার আবহাওয়া, জলবায়ু, নদী, পাহাড়, পর্বত ইত্যাদির ভূমিকা রয়েছে। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যয়ন ভূগােলের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত।
(৩) রাষ্ট্রের প্রকৃতি ও অবস্থানঃ মন্টেস্কু মনে করেন যে, শীতপ্রধান দেশে মানুষ কর্মঠ হয়, গরম অঞ্চলের মানুষ অলস হয়। আবার শীতপ্রধান অঞ্চলের মানুষ স্বাধীনতা রক্ষায় সমর্থ হয় এবং রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে জনগণের মৌলিক অধিকারগুলাে অধিক সংরক্ষিত হয়। আবার সমতল ভূমিতে অবস্থিত রাষ্ট্র সহজেই পরাধীন হয়ে পড়ে। কারণ সমতল ভূমিতে দেশ রক্ষার সুবিধা সীমিত। আবার পার্বত্য দেশে দেশ রক্ষার সুবিধা বেশি।
(৪) সামাজিক ভূগােল ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানঃ সামাজিক ভূগােলের আলােচ্য বিষয়গুলাে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচ্য বিষয়ের খুবই কাছাকাছি। সামাজিক ভূগােলের আলােচ্য বিষয় রাষ্ট্রের আয়তন, কৃষি ও খনিজ সম্পদ এগুলাের সাথে সমাজের মানুষের সম্পর্ক, নগরীর উৎপত্তি, প্রকৃতি ইত্যাদি বিষয়গুলাে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনার অন্যতম বিষয়বস্তু। ফলে সামাজিক ভূগােল ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সম্পর্ক অত্যন্ত কাছাকাছি ও ঘনিষ্ঠ।
(৫) রাষ্ট্রের ভূ-কৌশলগত অবস্থান ও নিরাপত্তাঃ বর্তমান যুগে প্রতিটি রাষ্ট্র তার নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। আর রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য রাষ্ট্রের ভূ-কৌশলগত অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আবার ভূ-কৌশলগত অবস্থান দেশের রাজনীতিকেও প্রভাবিত করে। এদিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি অন্যতম আলােচ্য বিষয় হচ্ছে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব। ফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যয়ন স্বাভাবিকভাবেই ভূগােলের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়ে।
(৬) ভূগােল, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও পরিবর্তনশীলতাঃ পরিবর্তনশীলতা রাষ্ট্র ও সমাজের অবিচ্ছেদ্য বিষয়। আর কোনাে ভূ-খণ্ডের ভৌগােলিক আকার পরিবর্তনও রাষ্ট্রনীতির ওপর প্রভাব ফেলে। যেমন গ্রিন হাউজ প্রভাবের কথা বলা যায়। ওজোন স্তরে ফুটো হওয়ার আশংকায় রাষ্ট্রনেতাগণকে ওজোন স্তর রক্ষার জন্য নানাবিধ পরিকল্পনা ও নীতি প্রণয়ন করতে দেখা যাচ্ছে। তাহলে ওজোন স্তর ভূগােলের আলােচ্য বিষয় আর রাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচ্য বিষয়। এর ফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ভূগােল এবং পরিবর্তনশীল সমাজ ও রাষ্ট্র আরাে ঘনিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে।
(৭) রাষ্ট্রের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান ও বাস্তবতাঃ একটি রাষ্ট্রের ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা রাষ্ট্রের রাজনীতিকে প্রভাবিত করে। উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশ ও ভারতের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের কথা বলা যায়। বাংলাদেশ এখানে ভূ-কৌশলগত অবস্থানে অবস্থিত। তাই ভারত বাংলাদেশের চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর ব্যবহার করতে চায় কারণ এতে সহজেই তারা সৈন্য, অস্ত্র-শস্ত্র দ্রুত সরবরাহের মাধ্যমে উত্তর পূর্বাঞ্চলের সাতবােন রাজ্যের স্বাধীনতা আন্দোলন দমন করতে পারবে।
(৮) পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানঃ ভূগােলের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা উভয়ের সম্পর্ককে আরােও ঘনিষ্ঠ করেছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ তাদের বিশ্লেষণের জন্য ভূগােলবিদের নিকট আবার ভূগােলবিদগণ তাদের নানা বিশ্লেষণের জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের শরণাপন্ন হন। উভয়ের মধ্যে পার্থক্য ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ভূগােলের মধ্যে এতাে সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও উভয়ের মধ্যে কিছু কিছু পার্থক্য রয়েছে। নিম্নে সেগুলাে উল্লেখ করা হলাে-
(১) উপাদানঃ রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্রের বিভিন্ন উপাদান-ভূখণ্ড, সরকার প্রভৃতি নিয়ে আলােচনা করে। পক্ষান্তরে পৃথিবী, জীবজন্তু, উদ্ভিদ ইত্যাদি সবই ভূগােলের উপাদান।
(২) কার্যাবলির ক্ষেত্রেঃ ভূগােল রাষ্ট্রকে কাজে দিকনির্দেশনা দেয়, কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্রকে প্রত্যক্ষভাবে কাজ করতে সাহায্য করে।
(৩) বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রেঃ রাষ্ট্রবিজ্ঞান একটি দেশের রাষ্ট্রীয় বিষয়াদি, যেমন-নাগরিক, সংবিধান, বিচারব্যবস্থা প্রভৃতি নিয়ে আলােচনা করে। কিন্তু ভূগােল সেদেশের ভূ-প্রকৃতি, আবহাওয়া, জলবায়ু প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আলােচনা করে।
পরিশেষঃ সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ভূগােল পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। উভয়ের আলােচনার বিষয়বস্তুর রয়েছে যথেষ্ট মিল। উভয় শাস্ত্র বিভিন্নভাবে একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। এই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দুটি বিষয়ের অধ্যয়নের পরিধিকে বিস্তৃত করেছে এতে কোনাে সন্দেহ নেই।
Leave a comment