রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃতি ও পরিধি সম্পর্কিত আলোচনার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা সংক্রান্ত আলোচনা অপরিহার্য। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা দেওয়া সহজ নয়। জেলিনেক (Jellinek) যথার্থই বলেছেন : ‘সঠিক নামকরণের সমস্যা নিয়ে অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের তুলনায় রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধিক বিব্রত’ (“There is no science which is so much in need of a good terminology as is Political Science.”)। মানুষের রাজনীতিক জীবনের ব্যাপক বিকাশ ঘটেছে। তাছাড়া এই রাজনীতিক জীবন বিশেষভাবে গতিশীলও বটে। তারফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু ও সংজ্ঞা অতিমাত্রায় বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়ে পড়েছে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্পর্কে ধারণার বিবর্তন

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা ও ধারণা তার আলোচনাক্ষেত্রের পরিধির দ্বারাই নির্ধারিত হয়। মানুষের রাজনীতিক জীবনের সমস্যাদি ক্রমশঃ বাড়ছে। তারফলে মানুষের রাজনীতিক চিন্তা-ভাবনা অধিকতর বিকশিত হচ্ছে এবং রাজনীতিক ক্রিয়াকলাপের পরিধি ক্রমান্বয়ে প্রসারিত হচ্ছে। অর্থাৎ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়বস্তু নিরবচ্ছিন্নভাবে বেড়েই চলেছে। এবং এই ধারার সঙ্গে সঙ্গতি বজায় রেখে ক্রমান্বয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞার সংখ্যা ও বৈচিত্র্য বাড়ছে। প্রকৃত প্রস্তাবে কোন সমাজবিজ্ঞানেই চরম সত্য বলে কোন তত্ত্ব নেই। এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানও হল একটি সমাজবিজ্ঞান বিশেষ। সুতরাং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য। অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের ন্যায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানও হল একটি গতিশীল বিজ্ঞান। মানুষের সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার পরিধিও পরিমার্জিত ও পরিবর্তিত হয়েছে। তার ফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্বন্ধে ধারণারও বিবর্তন ঘটেছে। এই কারণে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিভিন্ন সংজ্ঞার সৃষ্টি হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ওয়াস্বী (S. L. Wasby)-র অভিমত হ’ল: ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্পর্কে মতপার্থক্য ও বিভ্রান্তি এবং সেই সঙ্গে এর পরিবর্তনশীল প্রকৃতি ও অনিশ্চিত আলোচনাক্ষেত্রের জন্য কোন একটি নির্দিষ্ট সংজ্ঞা যথার্থ হতে পারে না’ (“Confusion and disagreement about Political Science as well as its changing nature and uncertain boundaries, make a single fixed definition inaccurate.”)।

রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলোচনা

বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছেন। প্রখ্যাত সুইস দার্শনিক ব্লন্টস্‌লি (Bluntschli) সহজভাবে বলেছেন যে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল রাষ্ট্রের বিজ্ঞান (Science of the State)। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উদ্দেশ্য হল রাষ্ট্র, তার মৌলিক অবস্থা, প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য এবং তার বিকাশ ও অগ্রগতি সম্পর্কে আলোচনা করা। অনুরূপভাবে অধ্যাপক গার্নার (Garner) -ও বলেছেন : ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শুরু ও সমাপ্তি রাষ্ট্রকে নিয়েই’ (Political Science begins and ends with the state.”)। তাঁর মতানুসারে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দায়িত্ব হল কতকগুলি বিষয়ে সূত্র নির্ধারণ। এই বিষয়গুলি হল রাষ্ট্রের সৃষ্টি ও স্বরূপ; রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানের আকৃতি, প্রকৃতি ও ইতিহাস এবং রাষ্ট্রনীতিক অগ্রগতি ও বিকাশ অর্থাৎ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার পরিধি রাষ্ট্রের উৎপত্তি, প্রকৃতি, আদর্শ, লক্ষ্য প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। জার্মান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী গ্যারিস (Gareis), ইউরোপের জেলিনেক, ইংল্যাণ্ডের গেটেল প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরাও সমমত পোষণ করেন। গ্যারিস-এর মতানুসারে ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্রের উদ্ভব, বিন্যাস, উদ্দেশ্য, নৈতিক তাৎপর্য, অর্থনৈতিক সমস্যা প্রভৃতির পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রকে ক্ষমতার এক প্রতিষ্ঠান হিসাবে বিচার করে।’ জেলিনেকের মতানুসারে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের লক্ষ্য হল রাষ্ট্রের তত্ত্ব ও ব্যবহারিক জীবনে রাষ্ট্রের গতি-প্রকৃতি পর্যালোচনা করা। গেটেল (R. G. Gettell) বলেছেনঃ ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল রাষ্ট্র কি হয়েছে তার ঐতিহাসিক অনুসন্ধান, রাষ্ট্র কি তার বিশ্লেষণমূলক আলোচনা এবং রাষ্ট্রের কি হওয়া উচিত তার রাজনীতিক ও নীতিগত আলোচনা’ (“Political Science is a historical investigation of what the state has been, an analytical study of what the state is and a politico-ethical discussion of what the state should be.”) I

সরকারের বিজ্ঞান

সীলি (Seeley), ক্যাটলিন (Catlin) প্রমুখ দার্শনিক সম্পূর্ণ ভিন্ন মত পোষণ করেন। তাঁদের অভিমত হল, সরকার বা শাসনযন্ত্রই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একমাত্র আলোচ্য বিষয়। সীলি বলেছেন : ‘রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি যেমন সম্পদ, জীববিদ্যা যেমন জীবন, বীজগণিত যেমন সংখ্যা এবং জ্যামিতি যেমন আয়তন ও বিস্তৃতি সম্পর্কে আলোচনা করে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান তেমনি সরকার সম্পর্কিত বিষয়ে অনুসন্ধান চালায়’ (“Political Science investigates the phenomena of government as political economy deals with wealth, biology with life, algebra with numbers and geometry with space and magnitude. “)।

রাষ্ট্র ও সরকারের বিজ্ঞান

তবে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের অধিকাংশের মতে রাষ্ট্র ও সরকার উভয়ই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার অন্তর্ভুক্ত। অধ্যাপক গিলক্রাইস্ট (Gilchrist)-এর মতে ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্র ও সরকার নিয়ে আলোচনা করে’ (Political Science deals with the State and Government.”)। পল জানে (Paul Janet) বলেছেন: ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল সমাজ-বিজ্ঞানের সেই অংশ যা রাষ্ট্রের ভিত্তি ও সরকারের নীতিসমূহের আলোচনা করে’(“Political Science is that part of social science which treats of the foundations of the state and principles of the government.”)। রাষ্ট্র ও নাগরিকদের বহুবিধ পারস্পরিক সম্পর্কের যথার্থ বিশ্লেষণের জন্য সরকার সম্পর্কে আলোচনাও আবশ্যক। কারণ সরকারই হল রাষ্ট্রের মূর্ত প্রকাশ। প্রকৃত প্রস্তাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়ের কিছুটা তত্ত্বগত এবং বাকিটা প্রতিষ্ঠানগত। রাষ্ট্রের তত্ত্বগত আলোচনার সঙ্গে সরকারের প্রতিষ্ঠানগত আলোচনার সামঞ্জস্য বিধানের মধ্যেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সার্থকতা প্রতিপন্ন হয়।

উদ্দেশ্যমূলক আলোচনা

রাষ্ট্রবিজ্ঞান কেবল অতীত ও বর্তমানকে নিয়ে আলোচনা করে না। অতীত ও বর্তমানের আলোচনার আলোকে রাষ্ট্রীয় জীবনের গতিপথ নির্ধারণেও রাষ্ট্রবিজ্ঞান সাহায্য করে। এই কারণে গেটেল বলেছেন: ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্রের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করে’ (“Political Science is the study of the state in the past, present and future….”)। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে রাষ্ট্র ও সরকার সম্পর্কে যে আলোচনা থাকে তার কিছু ঐতিহাসিক, কিছু সমসাময়িক। আবার অতীতের আলোচনা এবং বর্তমানের সমালোচনার ভিত্তিতে ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও ইঙ্গিত থাকে। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা উদ্দেশ্যমূলক।

তবে বুন্টস্‌লি, গার্ণার, গেটেল প্রভৃতি দার্শনিকগণ কর্তৃক প্রদত্ত উপরিউক্ত সংজ্ঞাগুলি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গতিশীল প্রকৃতিকে ধরতে পারেনি।

বস্তুত ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ অবধি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা ছিল নিতান্তই রাষ্ট্রকেন্দ্রিক। এতদিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃতি ও পরিধি রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করেই নির্ধারিত হত। রাজনীতিক জীবনের চরম লক্ষ্য রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যেই নিহিত ছিল। এই সময় রাষ্ট্রবিজ্ঞান একটি প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক সমাজ বিজ্ঞানের রূপ ধারণ করে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা রাষ্ট্রের উদ্ভব, বিকাশ, কার্যাবলী, প্রকৃতি ও আনুষঙ্গিক প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক বিষয়াদির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এই সময় রাজনীতিক জীবন ও যাবতীয় রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানের আলোচনা রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হত। গ্রীক রাষ্ট্রচিন্তার আমল থেকে শুরু করে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় এই ধারা অব্যাহত ছিল।

বিংশ শতাব্দীতে বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মূলতঃ আচরণবাদীরা রাষ্ট্রকেন্দ্রিক ধারার বিরুদ্ধে তীব্র বিরূপ‌ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। এই শ্রেণীর রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের বক্তব্য হল রাজনীতিক জীবনের গতিশীল প্রকৃতি রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলোচনার মধ্যে ধরা পড়ে না। রাজনীতিক জীবনের আলোচনাকে পরিপূর্ণতা প্রদানের জন্য‌ বর্তমানে নিম্নলিখিত বিষয়সমূহের আলোচনাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। এই সমস্ত বিষয়গুলি হল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিবেশ-পরিমণ্ডলের মধ্যে রাজনীতিক বিরোধের সৃষ্টি ও সমাধান; রাজনীতিক জীবনধারার উপর মানুষের আচার-আচরণের প্রভাব; ক্ষমতা, কর্তৃত্ব, রাজনীতিক অংশগ্রহণ, রাজনীতিক স্থিতিশীলতা, রাজনীতিক পরিবর্তন; বিভিন্ন রাজনীতিক ব্যবস্থায় নীতি নির্ধারণ ও প্রতিক্রিয়া প্রকাশ প্রভৃতি। আগেকার রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলোচনার মাধ্যমে রাজনীতিক জীবনের এই সমস্ত দিকগুলিকে ধরা যায় না। বিংশ শতাব্দীতে বিভিন্ন সামাজিক বিজ্ঞানের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা বেড়েছে এবং পারস্পরিক সহযোগিতার সম্পর্ক প্রসারিত হয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। এই অবস্থায় রাজনীতিক জীবনের যাবতীয় সমস্যাদির বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা জরুরী হয়ে পড়ে।

আধুনিক ধারণা

আন্তর্জাতিক ঘটনাপ্রবাহ এখন ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনের উপর নানাক্ষেত্রে কার্যকরী প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এই কারণে রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপ আন্তর্জাতিক ঘটনাপ্রবাহ ও আন্তর্জাতিক রীতিনীতি নিরপেক্ষ হতে পারে না। আবার সমাজবদ্ধ মানুষের সামাজিক ও রাজনীতিক সম্বন্ধ বা রাষ্ট্রের অধীনে ব্যক্তির সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক, ব্যক্তির সঙ্গে বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্য পরিধির অন্তর্ভুক্ত। ডেভিড ইস্টন (David Easton)-এর মতানুসারে, রাজনীতিক দিককে সমাজের অন্যান্য দিক থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান অবাস্তব হতে বাধ্য। এই আধুনিক লেখক রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের আলোচনা হিসাবে না দেখে এই শাস্ত্রটিকে রাজনীতিক ব্যবস্থা বা প্রক্রিয়ার (Political system or process) আলোচনা হিসাবে উপস্থাপিত করতে চান।

আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মত

আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের অনেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উপরিউক্ত সংজ্ঞাগুলিকে সমর্থন করেন না। অধ্যাপক অ্যালান বল (Alan R. Ball), লাসওয়েল (Lasswell), রবসন (Robson) প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতানুসারে এই সমস্ত সংজ্ঞা রাষ্ট্রকেন্দ্রিক এবং সংকীর্ণতা দোষে দুষ্ট।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলোচনার ধারাকে ম্যাকেঞ্জি (W. J. M. Mackenzie) ‘আইনমুখী’, ‘কৃত্রিম’ এবং ‘খামখেয়ালীপূর্ণ’ বলে অভিযুক্ত করেছেন। ম্যাকেঞ্জি তাঁর The Study of Political Science Today শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলোচনাকে তিনি ‘Statecraft’ বলার পক্ষপাতী। এই আলোচনার পরিধি নিতান্তই সীমাবদ্ধ। ম্যাকেঞ্জির মতানুসারে আলোচ্য বিষয়, পদ্ধতি এবং উদ্দেশ্যগত বিচারে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধি পুরোপুরি নির্দিষ্ট করে দেওয়া যায় না। রাজনীতিক ক্রিয়াকলাপ সমাজের সর্বস্তরে দেখা যায়। কেবলমাত্র রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় সংগঠনের মধ্যে রাজনীতিক ক্রিয়াকলাপ সীমাবদ্ধ থাকে না। আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরাও রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলোচনাকে সমর্থন করেন না। কারণ এই ধরনের আলোচনায় ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর আচরণকে কোন গুরুত্ব দেওয়া হয় না। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্র ছাড়াও বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর রাজনীতিক কার্যকলাপ ও আচার-আচরণ, রাজনীতিক দল, চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী প্রভৃতিকে নিয়ে আলোচনা করে।

ইস্টন ও রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলোচনার বিরোধিতা করেছেন। তাঁর মতানুসারে এ ধরনের আলোচনার গণ্ডী অতিমাত্রায় সীমিত। রাষ্ট্র ছাড়া অন্য কোন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সম্পাদিত কার্যাবলী রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলোচনার আওতায় আসে না। কয়েকটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মধ্যেই রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকে। ইস্টন তাঁর The Political System গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানহীন সমাজেও এমন অনেক কার্যাবলী সংঘটিত হতে দেখা যায় যার রাজনীতিক তাৎপর্য অপরিসীম। রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলোচনা হল কেবল রাষ্ট্রের সঙ্গে সংযুক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের আলোচনা। এ ধরনের আলোচনা ঘটনার উদাহরণ তুলে ধরতে পারে; তার সাধারণ বৈশিষ্ট্য বা গুণাবলী উপস্থাপন করতে পারে না। ইস্টনের মতানুসারে রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল ‘ক্ষমতার বণ্টন ও ব্যবহারের দ্বারা প্রভাবিত মূল্যের কর্তৃত্বসম্পন্ন বণ্টনের আলোচনা।’ অ্যালান বল-এর অভিমত অনুসারে সমাজের বিরোধ, বিরোধ মীমাংসা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব সম্পর্কিত কার্যাবলীর আলোচনা রাষ্ট্রবিজ্ঞান হিসাবে গণ্য হতে পারে।

সাবেকী রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলোচনার সীমাবদ্ধতা অস্বীকার করা যায় না। রাষ্ট্রীয় কার্যাবলী অ-রাজনৈতিক আচার-আচরণ ও অ-রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের দ্বারা প্রভাবিত হয়। এ বিষয়ে দ্বিমতের অবকাশ নেই। তবুও রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলোচনার গুরুত্বকে একেবারে অস্বীকার করা যায় না। মানুষের রাজনীতিক জীবনের আলোচনা রাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে সম্পূর্ণ হতে পারে না। সমাজবদ্ধ মানুষের রাজনীতিক জীবন এবং আর্থ-সামাজিক সম্পর্ক ও ক্ষমতার প্রতীক হল এই রাষ্ট্র। এখনও মূলতঃ রাষ্ট্র ও তার প্রতিষ্ঠানসমূহকে কেন্দ্র করেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধি নির্ধারিত হয়। তবে বর্তমানে ব্যাপক ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে এই সমস্ত আলোচনা করা হয়।

সাম্প্রতিককালের মার্কিন লেখক ওয়াস্‌বি (S. L. Wasby)-র মতানুসারে, রাজনীতি, সরকার এবং সরকার সম্পর্কিত প্রাসঙ্গিক বিষয়াদি ও তার আলোচনা থেকে উদ্ভূত সহায়ক বিষয়সমূহের আলোচনা হল রাষ্ট্রবিজ্ঞান। আবার মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গী অনুসারে সমাজের আর্থনীতিক দৃষ্টিভঙ্গীর পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রনীতি ও সরকারের আলোচনা করা দরকার। সুতরাং মার্কসীয় দৃষ্টিতে সংক্ষেপে রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল সমাজের শ্রেণী সম্পর্ক এবং শ্রেণী-সংগ্রাম সম্পর্কিত আলোচনা ও বিচার-বিশ্লেষণ।

সাম্প্রতিক ধারণা অনুসারে রাষ্ট্র এবং অন্য যে কোন বিষয় যা মানুষের রাজনীতিক জীবনকে প্রভাবিত করে তা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু হিসাবে বিবেচিত হয়। লাওয়েল (Lasswell) বলেন, ‘সমাজের অন্তর্ভুক্ত প্রভাব ও প্রভাবশালীদের ক্রিয়াকলাপের বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনাই হল রাষ্ট্রবিজ্ঞান’ (“Politics is the study of Influence and the Influential.”)। অন্যদিকে ল্যাস্কির মতে: “সংগঠিত রাষ্ট্রের পরিপ্রেক্ষিতে মানবজীবনের আলোচনাই রাষ্ট্রবিজ্ঞান।” তিনি বলেছেন: “Political Science concerns itself with the life of men in relation to organised state.”

উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিবর্তনশীল পরিধির কথা স্মরণ করে একটি ব্যাপকতর সংজ্ঞা দেওয়া যেতে পারে: ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল এমন এক সামাজিক বিজ্ঞান যেখানে রাষ্ট্র ও রাজনীতির দার্শনিক, সাংগঠনিক, প্রশাসনিক প্রসঙ্গ, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইন ও সাংগঠনিক সম্পর্কের প্রসঙ্গ এবং বহুবিধ রাজনীতিক ব্যবস্থার তুলনামূলক প্রসঙ্গের বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা ও পর্যালোচনা চলে।

বর্তমানে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সঙ্গে সামাজিক বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখা-প্রশাখার বিশেষ সংযোগ সাধিত হয়েছে। তারফলে এই সামাজিক বিজ্ঞানটির প্রকৃতি ও পরিধি পরিবর্তিত হয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই পরিবর্তনশীল প্রকৃতি হল সদা পরিবর্তনশীল ইতিহাস ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের ফল।

রাষ্ট্রবিজ্ঞান, রাষ্ট্রনীতি, রাষ্ট্রদর্শন এবং রাষ্ট্রতত্ত্ব

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা ও আলোচনাক্ষেত্রের পরিপ্রেক্ষিতে ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞান’ এই নামকরণের সমস্যাটিও স্বাভাবিকভাবে প্রতিপন্ন হয়। বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বিভিন্ন সময়ে লেখকগণ আলোচ্য শাস্ত্রটিকে কখনও ‘রাষ্ট্রনীতি’ (Politics), কখনও ‘রাষ্ট্রদর্শন’ (Political Philosophy), কখনও ‘রাষ্ট্রতত্ত্ব’ (Political Theory), আবার কখনও ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞান’ (Political Science)—এইসব নামে অভিহিত করেছেন। এইসব পারিভাষিক শব্দের বিভিন্নতার পরিপ্রেক্ষিতে জ্ঞানের আলোচনাক্ষেত্রের পরিধি সম্পর্কে বিভ্রান্তির আশংকা থাকে। ইউরোপীয় সাংবাদিক তথা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জেলিনেক-এর মতানুসারে ‘অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের তুলনায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সঠিক নামকরণের সমস্যা অধিক’ (“There is no science which is so much in need of a good terminology as in Political Science.”)

(১) রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রদর্শন: রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে অনেকে ‘রাষ্ট্রদর্শন’ (Political Philosophy) নামে অভিহিত করে থাকেন। তত্ত্বগতভাবে রাষ্ট্রের দার্শনিক তাৎপর্য বিশ্লেষণই হল রাষ্ট্রদর্শনের উদ্দেশ্য। রাজনীতিক জীবনের ব্যবহারিক বিষয় সম্পর্কে কোন আলোচনা এই শাস্ত্রে থাকে না। রাষ্ট্রের উদ্ভব, বিবর্তন, প্রকৃতি, কার্যাবলী, সংগঠন, রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিক সম্পর্ক, নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্য প্রভৃতি তত্ত্বগত আলোচনার মধ্যেই রাষ্ট্রদর্শনের আলোচনা সীমাবদ্ধ। রাষ্ট্রনৈতিক সংগঠন, তাদের কার্যাবলী, কার্যপদ্ধতি প্রভৃতি বিষয় এর এক্তিয়ারের বাইরে। বস্তুত রাষ্ট্রদর্শনের আলোচনা ভাবভিত্তিক। রাষ্ট্রের ব্যবহারিক আলোচনা রাষ্ট্রদর্শনের অন্তর্ভুক্ত হয় না। রাষ্ট্রদর্শনের আলোচনায় ঔচিত্য-অনৌচিত্যের নীতিমূলক বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়। রাষ্ট্রের প্রকৃতির ভাল-মন্দের দিক, রাষ্ট্রের কি করা উচিত, কি করা উচিত নয়, নীতিশাস্ত্রের মত এরকম নির্দেশমূলক বিষয়ও রাষ্ট্রদর্শনে বর্তমান থাকে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে যারা রাষ্ট্রদর্শন বলতে চান না, তাদের মতানুসারে রাষ্ট্রদর্শন রাষ্ট্রবিজ্ঞানেরই অন্তর্ভুক্ত বিষয়মাত্র। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনাক্ষেত্র অনেক বেশী ব্যাপক। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে রাষ্ট্রের মৌলিক প্রকৃতি, আদর্শ, লক্ষ্য, বিবর্তন প্রভৃতি দার্শনিক বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গে সরকার গঠন, কার্যাবলী পরিচালনা, নানারকম প্রশাসনিক বিষয়ের সমস্যা প্রভৃতি ব্যবহারিক রাষ্ট্রনীতির বিষয়ও থাকে। রাষ্ট্রের দার্শনিক আলোচনার সঙ্গে ব্যবহারিক রাষ্ট্রনীতিকে সংযুক্ত করলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পরিপূর্ণতা লাভ করে। অর্থাৎ দার্শনিক বিচার-বিশ্লেষণ ছাড়াও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটা ব্যবহারিক বর্ণনামূলক দিকও বর্তমান। তাই আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের অনেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার বিষয়কে দু’ভাগে বিভক্ত করে থাকেন। এই দুটি ভাগ হল: দার্শনিক বা উদ্দেশ্যমূলক (prescriptive) এবং বর্ণনামূলক (descriptive)। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বর্ণনামূলক আলোচনা বস্তুগত, নৈর্ব্যক্তিক ও বৈজ্ঞানিক। অপরদিকে উদ্দেশ্যমূলক বা নির্দেশমূলক আলোচনায় নৈতিক বা ঔচিত্য-অনৌচিত্যের আধিক্য দেখা যায়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় উভয় ধরনের বিষয়বস্তু আছে। রাষ্ট্রদর্শন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বর্ণনামূলক বিষয়গুলি রাষ্ট্রদর্শনের এক্তিয়ারের বাইরে থাকে। অর্থাৎ রাষ্ট্রদর্শনের আলোচ্য বিষয়ের সবকিছুই রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বর্তমান; কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সবকিছু রাষ্ট্রদর্শনের অন্তর্ভুক্ত নয়। সুতরাং রাষ্ট্রদর্শন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অংশ মাত্র।

প্রকৃত প্রস্তাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মধ্যে রাষ্ট্রদর্শন ও রাষ্ট্রনীতি উভয়বিধ আলোচনাই থাকে। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি অংশের আলোচনা তত্ত্বগত (Ideas) এবং অপর অংশের আলোচনা প্রতিষ্ঠানগত (Institu tions)। রাষ্ট্র ও সরকার সংক্রান্ত যাবতীয় বিজ্ঞানসম্মত আলোচনাই হল রাষ্ট্রবিজ্ঞান। তাই আলোচ্য শাস্ত্রটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান নামকরণই হল সঙ্গত এবং সর্বজনগ্রাহ্য।

(২) রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রতত্ত্ব: রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের অনেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিবর্তে ‘রাষ্ট্রতত্ত্ব’ (Political Theory) নামকরণের পক্ষপাতী। রাষ্ট্রতত্ত্ব বলতে রাষ্ট্রনৈতিক বিষয় সম্পর্কিত বিভিন্ন ধারণা ও সমস্যাদি সম্পর্কে নির্দিষ্ট কিছু তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাকে বোঝায়। এই সমস্ত তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ রাষ্ট্রদর্শনের আলোচনার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। রাষ্ট্রের উৎপত্তি এবং প্রকৃতি সম্পর্কিত হেগেলীয় ও মার্কসীয় তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা ওই দুই দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গীর বিশেষ প্রয়োগ হিসাবে গণ্য হয়।

রাষ্ট্রতত্ত্বও হল রাষ্ট্রবিজ্ঞানেরই অংশ। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা শুধু তত্ত্বগত বিচার-বিশ্লেষণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। তাত্ত্বিক আলোচনা ছাড়াও রাষ্ট্রভিত্তিক সমাজব্যবস্থার ঘটনাবলীর বর্ণনামূলক ঐতিহাসিক আলোচনাও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে থাকে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটা বর্ণনামূলক বা ব্যবহারিক দিক আছে। রাষ্ট্রতত্ত্বের তা নেই। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনাক্ষেত্র অত্যন্ত ব্যাপক। রাষ্ট্রতত্ত্ব নামকরণের মাধ্যমে এই আলোচনাক্ষেত্রের পরিচয় পাওয়া যাবে না। রাষ্ট্রতত্ত্ব শব্দটির দ্বারা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সামগ্রিক রূপটি ব্যক্ত হয় না। অর্থাৎ আলোচ্য শাস্ত্রটিকে রাষ্ট্রতত্ত্বের পরিবর্তে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বলাই অধিকতর যুক্তিসঙ্গত মনে হয়।