সাবেকি রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা নির্দেশের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গঠন ও কার্যাবলি, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে রাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়েছেন। এজন্য সাবেকি সংজ্ঞাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক সংজ্ঞা (Institutional definition) বলা হয়।
ব্লুন্টসলির অভিমত হল, রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে আমরা রাষ্ট্রের বিজ্ঞান বলতে পারি। গার্নারের মতে, রাষ্ট্রকে নিয়েই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শুরু ও সমাপ্তি। গেটেল বলেন, রাষ্ট্র কী হয়েছে, তার ঐতিহাসিক অনুসন্ধানের পাশাপাশি রাষ্ট্র কী, তার বিশ্লেষণমূলক আলােচনা এবং রাষ্ট্রের কী হওয়া উচিত, সে-সম্বন্ধে রাজনৈতিক ও নৈতিক আলােচনা হল রাষ্ট্রবিজ্ঞান।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের রাষ্ট্রকেন্দ্রিক সীমাবদ্ধতা
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের রাষ্ট্রকেন্দ্রিক সংজ্ঞা সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত নয়, এই সংজ্ঞার বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে一
[1] সংকীর্ণ: রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রবসন, লাসওয়েল, অ্যালান বল প্রমুখের মতে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের রাষ্ট্রকেন্দ্রিক সংজ্ঞা সংকীর্ণতা দোষে দুষ্ট। শুধু রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলির বিশ্লেষণের সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে এই সংজ্ঞা সীমাবদ্ধ।
[2] কৃত্রিম, খামখেয়ালি ও আইনকেন্দ্রিক: অধ্যাপক ম্যাকেঞ্জি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের রাষ্ট্রকেন্দ্রিক সংজ্ঞাকে কৃত্রিম, খামখেয়ালিপূর্ণ এবং অতিমাত্রায় আইনকেন্দ্রিক বলেছেন।
[3] ব্যক্তি ও গােষ্ঠীর আচরণ উপেক্ষিত: আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা ঐতিহ্যবাহী রাষ্ট্রকেন্দ্রিক সংজ্ঞার তীব্র সমালােচনা করে বলেন যে, এতে ব্যক্তি বা গােষ্ঠীর আচার-আচরণ বিশ্লেষণের কোনাে সুযােগ নেই। এর ফলে রাষ্ট্রকেন্দ্রিক সংজ্ঞা অসম্পূর্ণ থেকে গেছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আধুনিক বা অ-রাষ্ট্রকেন্দ্রিক সংজ্ঞা
আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বিংশ শতাব্দীর গােড়ার দিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলােচনার ধারাকে নাকচ করে দিয়ে ব্যক্তি ও গােষ্ঠীর আচরণকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁদের মতে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে শুধু রাষ্ট্র ও তার প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত আলােচনায় সীমিত রাখলে ব্যক্তির রাজনৈতিক জীবনের সম্যক পরিচয় পাওয়া যাবে না। ডেভিড ইস্টনের মতে, রাজনৈতিক দিককে সমাজের অন্যান্য বিষয় থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান অবাস্তব হয়ে পড়বে। এজন্য তারা ব্যক্তি ও গােষ্ঠীর আচরণ, রাজনৈতিক দল ও স্বার্থগােষ্ঠীর ভূমিকা, রাজনৈতিক প্রভাব ও ক্ষমতা প্রভৃতিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
রবার্ট ডাল ও লাসওয়েল রাজনীতিকে প্রভাব ও প্রভাবশালীদের পর্যালােচনারূপে উল্লেখ করে রাজনৈতিক ক্ষমতাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু বলে চিহ্নিত করেছেন। অধ্যাপক মিলার বিরােধ ও সংঘাতকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তুর অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষপাতী। অ্যালান বল নির্বাচনি আচরণ, রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ, রাজনৈতিক সংযােগসাধন, রাজনৈতিক দল, রাজনৈতিক ধ্যানধারণা ও মতাদর্শ প্রভৃতিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অরাষ্ট্রকেন্দ্রিক সীমাবদ্ধতা
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অরাষ্ট্রকেন্দ্রিক সংজ্ঞাও ত্রুটিমুক্ত নয়। এই সংজ্ঞারও অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এগুলি হল一
[1] অসম্পূর্ণ আলােচনা: সমালােচকদের মতে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচ্য বিষয়বস্তুর মধ্যে যদি রাষ্ট্রের কোনাে স্থান না থাকে তাহলে তা নিছক অসম্পূর্ণ আলােচনা বলে পরিগণিত হয়। রাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে রাজনৈতিক জীবনের বিশ্লেষণ কখনােই সম্পূর্ণ হতে পারে না। রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করেই যাবতীয় রাজনৈতিক ক্ষমতা ও রাজনৈতিক আচার-আচরণ গড়ে ওঠে। তাই রাষ্ট্রহীন রাজনীতির আলােচনা গ্রহণযােগ্য নয়।
[2] অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য: অরাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলােচনায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তুর মধ্যে এমনসব ব্যক্তি ও গােষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যাদের রাজনীতি ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে কোনাে সম্পর্ক নেই। তা ছাড়া, অ-রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলােচনার প্রবক্তারা যেভাবে সব ধরনের বিরােধকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু হিসেবে গণ্য করেন, তাও বাস্তবসম্মত নয়। এই কারণে অরাষ্ট্রকেন্দ্রিক সংজ্ঞাকে অপ্রাসঙ্গিক আখ্যা দেওয়া হয়।
[3] মার্কসবাদীদের অভিমত: মার্কসবাদীরা মনে করেন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অ-রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলােচনা আসলে রাষ্ট্রের শ্রেণিচরিত্রকে আড়াল করার প্রচেষ্টা। পুঁজিবাদী সমাজে রাষ্ট্র যে শ্রেণিশােষণের যন্ত্র, এই বাস্তবতাকে এড়িয়ে যেতেই অরাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলােচনার অবতারণা করা হয়েছে।
উপসংহার: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাবেকি বা রাষ্ট্রকেন্দ্রিক ও আধুনিক বা অরাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলােচনা, উভয়েই সমান গুরুত্বপূর্ণ। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা নির্ধারণের ক্ষেত্রে কোনো একটি ধারাকে উপেক্ষা করা যায় না। বস্তুত, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকেন্দ্রিক ও অ রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলােচনা পরস্পরের পরিপূরক।
Leave a comment