রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনাক্ষেত্র ব্যাপক

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনাক্ষেত্রের সীমানা বা বিষয়বস্তুর ব্যাপ্তি নির্ধারণ মোটেই সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। রোডি ও অন্যান্যদের (C. C. Rodee etal.) মত হল: “No precise and definite boundaries can be placed around Political Science.” রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল একটি গতিশীল সামাজিক বিজ্ঞান। এর আলোচ্য বিষয়বস্তু স্থির নয়; মানবসমাজ পরিবর্তনশীল। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনাক্ষেত্রও পরিবর্তনশীল। প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনাক্ষেত্রের সীমানা অতিমাত্রায় ব্যাপক। আগেকার দিনে কেবল রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলোচনাকেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু হিসাবে ধরা হত। এখন কিন্তু আলোচ্য শাস্ত্রের বিষয়বস্তুর ব্যাপ্তির জন্য আলোচনাক্ষেত্রের পরিধি বিশেষভাবে ব্যাপক। বর্তমানে রাষ্ট্র এবং অন্য যে-কোন বিষয় যা মানুষের রাজনীতিক জীবনকে স্পর্শ করে তা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার অন্তর্ভুক্ত। সংক্ষেপে সমাজবদ্ধ মানুষের রাজনীতিক জীবনের সর্বাঙ্গীণ আলোচনাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মুখ্য বিষয়বস্তু।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মুখ্য বিষয়

সমাজবদ্ধ মানুষের রাজনীতিক জীবনের আলোচনাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কেন্দ্রীয় বিষয়। মানুষের সমাজ-প্রবণতার ভিত্তিতেই গোষ্ঠীবদ্ধ বা সমাজবদ্ধ জীবনের সৃষ্টি। আর রাষ্ট্রই হল সমাজবদ্ধ জীবনের চরম অভিব্যক্তি। রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করেই মানুষের রাজনীতিক জীবন আবর্তিত হয়। তার ফলেই সমাজবাসীদের ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে এবং শান্তিপূর্ণ সমাজজীবন সম্ভব হয়। নাগরিক জীবনের সুখস্বাচ্ছন্দ্য বিধান ও জনসমাজের সর্বতোমুখী বিকাশের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের অবদানই প্রধান। সুতরাং রাষ্ট্রই যে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কেন্দ্রীয় বিষয় এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্র ও ব্যক্তির বিভিন্ন দিক ও সম্পর্ক বিষয়ে আলোচনা করে।

সরকারের আলোচনা

এই রাষ্ট্র আবার মূর্ত হয়ে ওঠে সরকারের মাধ্যমে। সরকার ছাড়া রাষ্ট্রের কল্পনা করা যায় না। কারণ সরকারের মাধ্যমেই রাষ্ট্র তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে বাস্তবে রূপায়িত করে। তাই রাষ্ট্রের আলোচনার সময় সরকারের আলোচনাও স্বাভাবিকভাবেই এসে পড়ে। তবে সরকারের আলোচনা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তুর অন্তর্ভুক্ত হবে কিনা এ বিষয়ে অনেকের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। অধ্যাপক গার্নার, বুন্টস্‌লি প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা সরকারকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত করার বিরুদ্ধে। তবে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের অধিকাংশই সরকারের আলোচনাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষপাতী। এ বিষয়ে গিলক্রাইস্ট, গেটেল, পল জাঁনে, ল্যাস্কি প্রমুখ চিন্তাবিদদের সুস্পষ্ট অভিমত আছে। বস্তুতঃ রাষ্ট্রবিজ্ঞানে রাষ্ট্র ও সরকার উভয়কে নিয়েই আলোচনা করা হয়।

তত্ত্বগত রাষ্ট্রনীতি ও ব্যবহারিক রাষ্ট্রনীতি

জেলিনেক, সিজউইক, পোলক প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার বিষয়বস্তুসমূহকে দুভাগে বিভক্ত করার পক্ষপাতী। একটি ভাগ হল তত্ত্বগত রাষ্ট্রনীতি (Theoretical Politics) এবং অপর ভাগটি হল ব্যবহারিক বা ফলিত রাষ্ট্রনীতি (Applied Politics)। রাষ্ট্রের উৎপত্তি, প্রকৃতি, আদর্শ, লক্ষ্য, স্বাধীনতা, আইন প্রভৃতিকে দিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তত্ত্বগত আলোচনা হয়। অপরপক্ষে সরকারের শ্রেণীবিভাগ, কার্যাবলী, আইন প্রণয়ন, রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ, আন্তর্জাতিক রীতিনীতি, চুক্তি ও কূটনীতি প্রভৃতি হল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ব্যবহারিক আলোচনার মুখ্য বিষয়বস্তু। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ‘রাজনীতি’ (Politics) এবং ‘রাষ্ট্রদর্শন’ (Political Philosophy) -এর সহাবস্থান ঘটে। রাষ্ট্রের তত্ত্বগত আলোচনার সঙ্গে সরকারের প্রতিষ্ঠানগত আলোচনার সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পরিপূর্ণতা লাভ করে।

আইনের আলোচনা

রাষ্ট্র এবং সরকার ছাড়াও সরকার প্রণীত আইনও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার অন্তর্ভুক্ত। রাষ্ট্রের পক্ষে সরকারই আইন প্রণয়ন করে এবং শাসনকার্য পরিচালনা ও শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করে। তাই আইনের আলোচনাও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আর একটি বিষয়। সুতরাং রাষ্ট্র, সরকার এবং সরকার প্রণীত আইন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত।

আন্তর্জাতিক বিষয়

বর্তমানকালে নাগরিক ও রাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্পর্ক বহুবিধ বিষয়ের দ্বারা প্রভাবিত হয়। আন্তর্জাতিক ঘটনাপ্রবাহ জাতীয় জীবনের উপর প্রভাব বিস্তার করে। বর্তমান যুগ আন্তর্জাতিকতাবাদের যুগ। তাই রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপ আন্তর্জাতিক রীতিনীতি-নিরপেক্ষ হতে পারে না। সুতরাং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও রীতিনীতিও স্বাভাবিকভাবে এসে পড়ে।

রাষ্ট্রের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ

আবার বর্তমান রাষ্ট্র সম্পর্কে আমাদের ধারণা অসম্পূর্ণ থেকে যায় যদি রাষ্ট্রের অতীত ইতিহাস সম্পর্কে আমরা সম্যক আলোচনা না করি। রাষ্ট্রের অতীত ও বর্তমান আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে দেখতে হয় কিভাবে এই প্রতিষ্ঠান অতীত থেকে বিবর্তনের পথ বেয়ে বর্তমান রূপ ধারণ করেছে। ল্যাস্কির অভিমত হল, ইতিহাসের ক্রমবিকাশের ধারাবাহিক বিশ্লেষণ ব্যতিরেকে আমাদের অনুসন্ধান ক্ষেত্রকে সঠিকভাবে অনুধাবন করা যায় না’ (“Nothing in the field of investigation is capable of being rightly understood save as it is illustrated by the process of its development.”)। আবার রাষ্ট্র সম্পর্কে অতীতের আলোচনা ও বর্তমানের পর্যালোচনার মধ্যেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা শেষ হয় না। এর মধ্যে ভবিষ্যতের ইঙ্গিতবাহী আলোচনাও স্থান পায়। রাষ্ট্রের অতীত ও বর্তমান আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্রীয় জীবনের গতিপথ নির্ধারণ করে এবং ভবিষ্যৎ আদর্শ রাষ্ট্রের ছবি তুলে ধরে। তাই আলোচ্য শাস্ত্রের আলোচনা উদ্দেশ্যমূলকও বটে। বার্ণস (Burns)- এর মতানুসারে রাষ্ট্রের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ এবং এর স্বরূপ ও ভবিষ্যৎ প্রকৃতি নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পর্যালোচনা করে। তিনি বলেছেন: “We are interested in what has occured chiefly because we want to understand what is occuring; and we want this again chiefly in order to influence what will occur. “

রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলোচনার সীমাবদ্ধতা

আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই সনাতন রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলোচনার ধারাকে সমর্থন করেন না। ম্যাকেঞ্জি (W.J. M. Mackenzie) তাঁর The Study of Political Science Today শীর্ষক গ্রন্থে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলোচনার বিরোধিতা করেছেন। তিনি রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলোচনাকে ‘State Craft’ হিসাবে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে সমাজের সকল স্তরে রাজনীতি দেখা যায়। এ কেবল রাষ্ট্র ও তার সংগঠনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় না। ম্যাকেঞ্জির মতানুসারে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই সাবেকী আলোচনা অতিমাত্রায় আইনমুখী (legalistic), কৃত্রিম (artificial) ও খামখেয়ালীপূর্ণ (arbitrary)। রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলোচনাকে বিভিন্ন দিক থেকে সমালোচনা করা হয়।

(১) পশ্চিমী দেশগুলিতে রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে আগেকার সম্পর্ক এখন আর নেই। সেই সাবেকী সম্পর্কের আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। তার ফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের চলে আসা ধারণা ক্রমশ অর্থহীন হয়ে পড়ছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আগেকার ধারণার ভিত্তিতে রাষ্ট্র ও জনগণের সংগঠনসমূহের মধ্যে সম্পর্ক ব্যাখ্যা করা যায় না।

(২) ডেভিড ইস্টন-এর মতানুসারে যে সকল উপাদানের দ্বারা কোন ঘটনা রাজনীতিক উৎকর্ষ লাভ করে তা রাষ্ট্রকেন্দ্রিক ধারণার দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না। সাম্প্রতিককালের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় সামাজিক মনস্তত্ত্ব, সামাজিক নৃতত্ত্ব, সামাজিক ভাষাতত্ত্ব, ব্যক্তিকেন্দ্রিক সমাজতত্ত্ব প্রভৃতি অনুসন্ধানের পদ্ধতি প্রয়োগ করেছেন। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠীর আলোচনা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তার ফলে রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলোচনা অচল হয়ে পড়েছে।

(৩) আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের বিষয়বস্তুকে বিভিন্নভাবে গ্রহণ করেছে। বর্তমানে সমাজতাত্ত্বিক, সামাজিক, নৃতাত্ত্বিক, সামাজিক মনস্তাত্ত্বিক প্রভৃতি বিষয়বস্তুর অন্তর্ভুক্তির ফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উপর আইনশাস্ত্রের প্রভাব বিশেষভাবে হ্রাস পেয়েছে। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার পরিধি এখন নিতান্তই রাষ্ট্রকেন্দ্রিক ও সংকীর্ণ নয়; বিশেষভাবে বিস্তৃত।

(৪) সাম্প্রতিককালে অনেক নতুন রাষ্ট্রের সঙ্গে সাবেকী পশ্চিমী রাষ্ট্রগুলির আলোচনা চলে না। অনেক আধুনিক রাষ্ট্র পশ্চিমী রাষ্ট্রব্যবস্থার মত দেশের ভিতর থেকে উদ্ভূত হয়নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই সমস্ত রাষ্ট্রব্যবস্থা জোর করে চাপিয়ে দেওয়া বা বাছাই করা। তাই কাঠামো ও প্রকৃতিগত বিচারে এগুলি স্বতন্ত্র প্রকৃতির।

(৫) অত্যাধুনিক আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরাও রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলোচনার বিপক্ষে। আচরণবাদীরা রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানের বদলে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর আচরণের বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।

কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা রাষ্ট্রহীন হতে পারে না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয় এখন মূলতঃ রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানগুলিকে কেন্দ্র করেই নির্ধারিত হয়ে থাকে। তবে এও ঠিক যে রাষ্ট্রীয় কাজকর্ম অ-রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও আচার-আচরণের দ্বারা প্রভাবিত হয়। রাষ্ট্রকেন্দ্রিক গতানুগতিক আলোচনায় এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।

প্রভাব ও প্রভাবশালীদের আলোচনা

আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ তাই মনে করেন যে বর্তমানে রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্র ছাড়াও বেসরকারী প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর রাজনীতিক কার্যকলাপ, রাজনীতিক দল ও চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী প্রভৃতিকে নিয়ে আলোচনা করে। রবার্ট ডাল ও লাসওয়েল-এর মতানুসারে সমাজের প্রভাব ও প্রভাবশালীদের আলোচনা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত। লাসওয়েল তাঁর Politics শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন যে, প্রভাব ও প্রভাবশালীদের পর্যালোচনাই হল রাজনীতি (“The study of politics is the study of influence and the influential.”)।

অনেক সময় কোন ব্যক্তি নিজের ইচ্ছার অনুকূলে অন্য ব্যক্তিকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেয়। এক্ষেত্রে যে ব্যক্তি কাজ করিয়ে নিল তাকে প্রভাবশালী (Influential) এবং প্রভাবশালীর ক্ষমতাকে প্রভাব (Influence) বলে। রবার্ট ডাল-এর মতানুসারে ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সংগঠন ও রাষ্ট্রের মধ্যে একটা বিশেষ সম্পর্ককে প্রভাব বলে। ডাল তাঁর Modern Political Analysis শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “Influence is a relation among actors in which one actor induces other actors to act in some way they would not otherwise act.” আধুনিককালে অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয় হিসাবে প্রভাবের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এই শ্রেণীর রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা অভিজ্ঞতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গী থেকে রাজনীতিক প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের (Behaviouralists) মধ্যে এই প্রবণতা বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। এই শ্রেণীর রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা প্রভাবের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা ও উপজীব্য বিষয় নির্ধারণ করতে চান। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় এই ধারার সমর্থকদের মতানুসারে সমাজের প্রভাবশালীরাই বস্তু বা মূল্যের বণ্টনকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। এই কারণে প্রভাব ও প্রভাবশালীদের নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আলোচনা করা দরকার।

প্রকৃত প্রস্তাবে প্রভাব বলতে এক ধরনের সম্পর্ককে বোঝায়। কোন বা কয়েকজন কর্মকর্তা (actors) অন্যান্য কর্মকর্তার কাজকর্ম, আচার-আচরণ বা দৃষ্টিভঙ্গীকে নিয়ন্ত্রণ বা পরিচালিত করলে তা প্রভাব হিসাবে প্রতিপন্ন হয়। প্রভাব দু’ভাবে কার্যকর হতে পারে। এক হল প্রকাশ্য প্রভাব এবং আর একটি হল অ-প্রকাশ্য প্রভাব। প্রত্যক্ষ নির্দেশের মাধ্যমে প্রভাব কার্যকর করাকে প্রকাশ্য প্রভাব বলা হয়। আবার প্রভাবশালীর ইচ্ছা-অনিচ্ছা অনুধাবন সূত্রে প্রভাব কার্যকর হলে তা হল অ-প্রকাশ্য প্রভাব।

রাষ্ট্রনীতি ও প্রভাব একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কযুক্ত। রাষ্ট্রনীতিতে প্রভাবশালীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে সতত সক্রিয় থাকেন। প্রকৃতিগত বিচারে রাষ্ট্রনীতি হল জটিল ও পরিবর্তনশীল। অনুরূপভাবে প্রভাব বিস্তারের কলাকৌশলগুলিও বহুলাংশে জটিল ও পরিবর্তনশীল। উদারনৈতিক রাজনীতিক ব্যবস্থাতেই প্রভাব বিস্তারের বিষয়টি বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। এ ধরনের রাজনীতিক ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ক্ষমতাশালী শ্রেণী দেশের আর্থ-রাজনীতিক ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করতে উদ্যোগী হয়। রাজনীতিক দলগুলি নানাভাবে নির্বাচকদের প্রভাবিত করতে উদ্যোগী হয়। দেশের স্বার্থগোষ্ঠীগুলিও সরকারের বিভিন্ন বিভাগ এবং বিভাগগুলির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিবর্গকে প্রভাবিত করার জন্য নানা রকম উপায় পদ্ধতি অবলম্বন করে।

কিন্তু প্রভাব শব্দটি বিশেষভাবে ব্যাপক। সব রকম প্রভাবকে রাজনীতিক বলা যায় না। রাজনীতিক প্রভাব হল রাজনীতিক পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবহৃত প্রভাব। কিন্তু প্রভাব ও প্রভাবশালীদের মধ্যে রাজনীতিকে সীমাবদ্ধ করলে সমাজের একটি সংখ্যালঘু অংশের কার্যকলাপের মধ্যে রাজনীতি আবদ্ধ বলে প্রতিপন্ন হবে। তাই এ প্রসঙ্গে ডেভিড ইস্টন মন্তব্য করেছেন যে, লাসওয়েলের বক্তব্যের মাধ্যমে অল্প কিছু রাজনীতিক ক্ষমতাধিকারীর ক্ষমতার উৎসের কথা ব্যক্ত হয়েছে। প্রকৃত প্রস্তাবে প্রভাব ও প্রভাবশালীদের আলোচনার মাধ্যমে রাজনীতিক বিচার-বিশ্লেষণের ব্যবস্থা সংকীর্ণতাদোষে দুষ্ট হতে বাধ্য।

বিরোধ ও সংঘাতের আলোচনা

বর্তমানে অনেকে মতবিরোধ ও সংঘাতকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উপজীব্য বিষয় হিসাবে প্রতিপন্ন করার পক্ষপাতী। মতানৈক্য ও বিরোধকে কেন্দ্র করেই রাজনীতির সৃষ্টি হয়। যে বিষয়ে মতবিরোধ আছে তেমন কাজ সংঘটিত হলে একটি রাজনীতিক অবস্থার সৃষ্টি হয়। তখনই প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন এবং প্রণীত আইন প্রয়োগ করা দরকার হয়ে পড়ে। এইভাবে মতবিরোধ ও সংঘাত, এই অবস্থার প্রকাশ ও প্রচার এবং তার প্রতিবিধানের ব্যবস্থা—এসবকে কেন্দ্র করেই সৃষ্টি হয় রাজনীতির। তাই যেখানে মতবিরোধ ও সংঘাত থাকে না সেখানে রাজনীতিরও সৃষ্টি হয় না। অধ্যাপক মিলার (J. D. B. Miller) তাঁর The Nature of Politics গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন যে, মতবিরোধ বা সংঘাত হল রাজনীতির মর্মবস্তু। সর্বজনবাদী মতৈক্য যেখানে বর্তমান সেখানে রাজনীতি থাকে না’ (Conflict lies at the heart of Politics. In a world of universal agreement, there would be no room for it.”)।

সাম্প্রতিককালের উন্নত ও জটিল রাষ্ট্রব্যবস্থার একটি অন্যতম অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হল রাজনীতি। আধুনিক সমাজে মানুষের স্বার্থচেতনা, রাজনীতিক সচেতনতা ও অহংবোধ বেড়েছে। তার ফলে মতবিরোধ ও সংঘাত সমাজের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হিসাবে দেখা দিয়েছে। বর্তমানে কোন ক্ষেত্রে বিভিন্ন ব্যক্তির সমাবেশের সৃষ্টি হলে মতানৈক্য ও সংঘর্ষের সৃষ্টি হবেই এবং তখনই অনিবার্যভাবে রাজনীতির উদ্ভব ঘটবে। কারণ মতবিরোধ ও সংঘাতকে নিয়েই সমাজে রাজনীতির সৃষ্টি হয়। যেখানে কোন দ্বিমত নেই, নেই কোন সংঘাত, রাজনীতি সেখানে অনুপস্থিত। মিলার মন্তব্য করেছেন : Politics is a variety of perpetual disagreements which arise from fundamental differences of condition status power, opinion and aim.” মিলারের মতানুসারে মতবিরোধ থেকেই সৃষ্টি হয় রাজনীতিক পরিবর্তন। এবং রাষ্ট্রনীতি গঠিত হয় মতবিরোধ ও সংঘাতকে নিয়ে।

সমাজে মতবিরোধ সব সময়েই থাকে, তাই সংঘাত-সংঘর্ষ ও সবসময় থাকে। এই কারণে সমাজে রাজনীতিও সব সময় থাকে। সমাজের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা যত জটিল থেকে জটিলতর হয়, সমাজের বৈপরীত্য ও সংঘাতের সম্ভাবনা তত বাড়ে। এবং মতানৈক্য ও দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হলেই রাজনীতিক সংস্থাকে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থাদি গ্রহণ করতে হয়। সুতরাং রাজনীতির অব্যাহত অস্তিত্ব আটকানো যায় না। ব্যক্তিবর্গ দ্বন্দ্ব-বিরোধের নতুন সূত্র নিত্য সৃষ্টি করে। মীমাংসা ও সমঝোতারও প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু বহু বিরোধের মীমাংসা হয় না। এই সমস্ত অমীমাংসিত বিরোধের থেকে আবার নতুন বিরোধের সৃষ্টি হয়। যে সমস্ত বিরোধের মীমাংসা হয় তাদের থেকেও নতুন বিরোধ ও সংঘর্ষের সৃষ্টি হতে পারে। অর্থাৎ সমাজে মতবিরোধ ও সংঘাত সব সময় থাকে। তাই সমাজে রাজনীতির নিরবিচ্ছিন্ন অস্তিত্ব অনস্বীকার্য। মিলারের মতে, “Politics will never stop because social reconciliation and agreement will never be complete.”

অস্টিন রেনী, অ্যালান বল প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ‘বিরোধ ও অনৈক্য’কে আলোচনা করে। মতবিরোধ ও সংঘাতকে নিয়েই রাজনীতি। রবার্ট ডাল তাঁর Modern Political Analysis গ্রন্থে বলেছেন যে, প্রত্যক্ষ রাজনীতিক ব্যবস্থায় অবিরাম বিরোধ বর্তমান (“In every political system there is a perpetual and unceasing conflict.”)। অস্টিন রেনীর মতানুসারে মানবজীবনের ক্ষেত্রে যেমন ব্যক্তিবর্গের মধ্যে সংঘাত অপরিহার্য, তেমনি মানবসমাজে রাজনীতিক বিরোধ অনস্বীকার্য (Just as interpersonal conflict is an inescapable part of human life, then political conflict is an inescapable part of human society.”)। রেনী তাঁর Government – An Introduction to Political Science শীর্ষক গ্রন্থে বিরোধের মাধ্যমে রাজনীতিকে ব্যাখ্যা করেছেন। বলের মতানুসারে রাজনীতিক কার্যাবলীর মধ্যে মতানৈক্য নিরসনের প্রয়াস বর্তমান থাকে। তাই সকল পর্যায়েই রাজনীতিক কার্যাবলী সংঘটিত হওয়া সম্ভব। তিনি তাঁর Modern Politics and Government গ্রন্থে বলেছেন : “In (politics) involves disagreements and the reconciliation of those agreements….”

মনীষী মার্কস (Karl Marx) ও বৈষম্যমূলক এবং শ্রেণী বিভক্ত সমাজের রাজনীতি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বিরোধ ও সংঘর্ষের কথা বলেছেন। এই বিরোধ ও সংঘর্ষই হল মার্কসীয় রাজনীতির মৌলিক বিষয়। তবে এ ক্ষেত্রে উপরিউক্ত আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের ধ্যান-ধারণার সঙ্গে মার্কসীয় ধারণার মৌলিক পার্থক্য বর্তমান। মার্কসবাদীরা রাজনীতিতে বিরোধের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। বৈষম্যমূলক শ্রেণীবিভক্ত ও শ্রেণী-শাসিত সমাজের স্বরূপ বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তারা শ্রেণী-সংগ্রামের উপর জোর দেন। উৎপাদিকা শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে বিরোধ ব্যাখ্যার মাধ্যমে মার্কসবাদীরা মানবসমাজের বৈপ্লবিক রূপান্তর ও ক্রমবিকাশের ধারা ব্যাখ্যা করেন। তাঁদের মতানুসারে প্রভুত্ব ও অধীনতার ব্যবস্থা বিরোধের মধ্যে বর্তমান থাকে। এই অবস্থার সৃষ্টির পিছনে কতকগুলি কারণ থাকে। সেই সমস্ত কারণের সামগ্রিক রূপান্তর ছাড়া এই বিরোধের অবস্থার অবসান অসম্ভব।

বিরোধ ও সংঘাতের এই ধারণা পুরোপুরি মেনে নেওয়া যায় না। মতবিরোধ ও সংঘাত মানেই রাজনীতি এ কথা ঠিক নয়। রাজনীতি ছাড়াও বিরোধ ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটতে পারে। সমাজের অনেক ক্ষেত্রেই এমন অনেক বিরোধ দেখা যায় যেখানে রাজনীতির অস্তিত্ব থাকে না। তা ছাড়া রাজনীতিক জীবনে সংঘাতের সঙ্গে সঙ্গে সম্মতির অস্তিত্বকেও অস্বীকার করা যায় না। রাজনীতিক জীবনের মৌল উৎপাদন হল বিরোধ ও সংঘাত—এ কথা ঠিক নয়।

নৈতিক সমস্যার আলোচনা

রবসন (Robson)-এর বক্তব্য হল, কি আছে কেবল তা নিয়েই রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলোচনা করে না, কি হওয়া উচিত তাও স্থির করে দেয়। তাঁর কথায় : ‘It is concerned both with what is and also with what should be.” অর্থাৎ মানুষের নৈতিক সমস্যা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয় হিসাবে গণ্য হয়। কেবল নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে আলোচনা নয়, রাষ্ট্রবিজ্ঞান মানুষের সামাজিক-রাজনীতিক জীবনের বিভিন্ন বিষয়ের ঔচিত্য-অনৌচিত্য, ভালমন্দ প্রভৃতির মূল্যমান নিয়েও আলোচনা করে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীকে মানুষের নৈতিক সমস্যা নিয়েও ভাবনা-চিন্তা করতে হয়। কারণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অন্যতম উদ্দেশ্য হল মানবজীবনে সমষ্টিগত নীতিসূত্র প্রতিষ্ঠা করা। তা ছাড়া সমাজের তত্ত্বকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রের কোন তত্ত্ব গড়ে উঠতে পারে না। তাই এ বিষয়েও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীকে বিচার-বিবেচনা করতে হয়। আবার সমাজবদ্ধ মানুষের মনোজগৎ সম্পর্কেও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর ধারণা থাকা দরকার। সমাজের মনস্তত্ত্বকে উপেক্ষা করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তাঁর দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারেন না। রাষ্ট্রদার্শনিক হবস্ থেকে শুরু করে আধুনিককালের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী গ্রাহাম ওয়ালাস পর্যন্ত বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর রচনা থেকে এ সত্য স্পষ্টত প্রতিপন্ন হয়।

ক্ষমতার আলোচনা

অনেক আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ক্ষমতার আলোচনাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত করতে চান। একশ্রেণীর আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতানুসারে সমাজে ক্ষমতার ভিত্তি ক্ষমতার দ্বারা প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠার পদ্ধতি ও ক্ষমতা প্রয়োগের ফলাফল অনুসন্ধান করাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মুখ্য উদ্দেশ্য। অর্থাৎ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু হল ক্ষমতা।

ক্ষমতার আলোচনা আগেও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তবে আধুনিককালের অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ক্ষমতাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একমাত্র আলোচ্য বিষয় হিসাবে গুরুত্ব প্রদানের পক্ষপাতী। এই শ্রেণীর রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতানুসারে ক্ষমতা ও ক্ষমতার জন্য দ্বন্দ্বই হল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মূল বিষয়। সমাজের ক্ষেত্রে ক্ষমতার অধ্যয়ন ও অনুধাবনই হল রাষ্ট্রবিজ্ঞান। বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নানা ক্ষেত্রে এবং নানা বিষয়ে অধ্যয়ন ও অনুধাবনের চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁরা সকলেই কোন-না-কোনভাবে ক্ষমতারই প্রকাশকে পর্যালোচনা করার চেষ্টা করেন। এই কারণে অধ্যাপক রবসনের অভিমত হল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখাকে এই মূল সূত্রটি ঐক্যবদ্ধ করতে পারে। রবসন (W. A. Robson) তাঁর The University Teaching of Social Sciences, Political Science: UNESCO শীর্ষক রচনায় বলেছেন: (“Political Science) centres on the struggle to gain or retain power, to exercise power or influence over others or to resist that exercise.”

সুতরাং ক্ষমতাই হল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মূল বিষয়। ইস্টন তাঁর The Political System গ্রন্থে বলেছেন: “Power appeared to be the central datum of Political Science.” ক্ষমতার একটি ভিত্তিগত দিক আছে, তেমনি ক্ষমতার একটি প্রায়োগিক বা ব্যবহারিক দিক আছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ক্ষমতার এই দুটি দিকের আলোচনাই গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষমতার ভিত্তি, প্রকৃতি ও পরিধি, প্রয়োগ-প্রক্রিয়া ও পরিণতি—সবই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উপজীব্য বিষয়। ক্ষমতার আলোচনা কেবল সরকারী বিভাগ ও সংগঠনগুলির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বাণিজ্যিক সংস্থা, শ্রমিক সংগঠন, ব্যবসায়ীদের সংগঠন, ধর্মীয় সংস্থা প্রভৃতি বে-সরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের আলোচনাও এর মধ্যে আসে। সরকারী বে-সরকারী নির্বিশেষে ক্ষমতার সঙ্গে সংযুক্ত সকল সংগঠনের আলোচনাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মুখ্য বৈশিষ্ট্য হল বাস্তবমুখী। সাম্প্রতিককালের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিশেষভাবে বাস্তবমুখী হয়ে পড়েছে। তাই এখন কেবল ক্ষমতার বিমূর্ত দিকটি নয়, ক্ষমতার প্রায়োগিক দিকটির উপরও বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের অনুসন্ধান আনুষ্ঠানিক সরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। সরকারী-বেসরকারী নির্বিশেষে সমাজের প্রতিষ্ঠানসমূহ কিভাবে বাস্তবক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করে সে বিষয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা অনুসন্ধান ও অনুধাবনের চেষ্টা করেন।

ম্যাকেঞ্জী (Mackenzie)-র মতানুসারে রাষ্ট্রনীতির মূল বিষয় হল ক্ষমতা (Power is the key to Politics)। বল (Alan R. Ball) বলেছেন: ‘It (political power) is a key concept in the study of Politics…..’. ‘ক্ষমতা’ কাকে বলে এ প্রসঙ্গে বলের অভিমত হল যে, ভয় দেখিয়ে বা অন্য কোন রকম সমর্থনের মাধ্যমে অপরের আচার-আচরণকে প্রভাবিত করার সামর্থ্যই হল ক্ষমতা (“Political power is the capacity to affect another’s behaviour by the threat or some form of sanction.”)। লাসওয়েল-এর মতানুসারে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ক্ষমতার গড়ে উঠা এবং ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনা করে (The study of shaping and sharing of power)। রবার্ট ডাল-এর মতানুসারে ক্ষমতা, শাসন ও কর্তৃত্ব রাজনীতিক আলোচনার অন্তর্ভুক্ত (Political analysis deals with power, rule or authority) তিনি তাঁর Modern Political Analysis শীর্ষ গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “A political system is any persistent pattern of human relationship that involves power, rule or authority.” লাসওয়েল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের নির্ভরযোগ্য তথ্য হিসাবে একমাত্র ক্ষমতার কথা বলেছেন। মানবসমাজের নৈতিক প্রভাবও এই ক্ষমতার অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হয়।

কিন্তু ক্ষমতার তত্ত্বও সমালোচিত হয়েছে। ক্ষমতার ধারণা সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতপার্থক্য বর্তমান। সকল ক্ষমতা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয় হতে পারে না। কারণ রাজনীতিক ক্ষেত্র ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রেও ক্ষমতা আছে। আবার রাজনীতিক ও অন্যান্য ক্ষমতা ওতপ্রোতভাবে যুক্ত থাকতে পারে। তা ছাড়া রাজনীতিক ক্ষমতার অবস্থান ও বণ্টন সম্পর্কিত সমস্যাটিও জটিল।

সাম্প্রতিককালের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মত

প্রকৃত প্রস্তাবে দৃষ্টিভঙ্গীর বৈচিত্র্যহেতু রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সীমানা ক্রমশঃ সম্প্রসারিত হচ্ছে। বর্তমানে রাজনীতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তার পিছনে ক্রিয়াশীল বিভিন্ন প্রভাবের বিচার-বিশ্লেষণও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু হিসাবে গণ্য হয়। কাপলান (Kaplan), মেরিয়াম (Merriam), লাসওয়েল প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় ক্ষমতা (power) বা প্রভাব (influence) এর উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেন। আধুনিক লেখকদের অনেকে ‘বিরোধ ও মতানৈক্য (conflict and disagreement)-কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় গুরুত্ব দেওয়ার পক্ষপাতী। এঁদের মধ্যে অ্যালান বল ও মিলার-এর নাম উল্লেখযোগ্য। আবার ইস্টন ‘মূল্যের কর্তৃত্বপূর্ণ বণ্টন’ (authoritative allocation of (values)-এর উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।

আধুনিক ধারণার সমালোচনা

সাম্প্রতিককালের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের উপরিউক্ত ধারণাসমূহও সমালোচনাযোগ্য।

(১) রাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা মুখ্য বিষয়কে বাদ দিয়ে উপলক্ষকে নিয়ে বেসাতি করার সামিল। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী র‍্যাফেল (Raphael)-এর মতানুসারে সরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ সমাজের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে এবং সমস্ত প্রতিষ্ঠান কেন্দ্র করেই রাজনীতিক আচার-আচরণের ধারা গঠিত হয়। এই কারণে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের যে-কোন আলোচনা রাষ্ট্র ও সরকারকে বাদ দিলে অর্থহীন হয়ে পড়বে।

(২) আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের অনেকে প্রভাব ও প্রভাবশালীদের আলোচনাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষপাতী। এবং এই শ্রেণীর রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা অত্যন্ত ব্যাপক অর্থে ‘প্রভাব’ শব্দটিকে ব্যবহার করেন। কিন্তু একমাত্র রাজনীতিক প্রভাবই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার মধ্যে আসে। সমাজের যে-কোন প্রভাবকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত করা অর্থহীন। সন্তান-সন্ততির উপর পিতা-মাতার প্রভাব রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু হতে পারে না।

(৩) তেমনি সমাজের সকল বিরোধকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত করা সমীচীন নয়। দুই সতীনের বিরোধ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয় হতে পারে না। 

(৪) মার্কসবাদীদের মতানুসারে এই শ্রেণীর আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের ধারণা রক্ষণশীলতা দোষে দুষ্ট। তাঁরা পুঁজিবাদী সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে সংরক্ষণের স্বার্থে বুর্জোয়া রাজনীতিক মতাদর্শের প্রতি আনুগত্য দেখিয়েছেন।

মার্কসীয় ধারণা

মার্কসবাদীদের মতানুসারে রাজনীতির সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় হল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা। শ্রেণীবিভক্ত সমাজে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রতিপত্তিশালী শ্রেণী শ্রেণী-শাসন ও শ্রেণী-শোষণের স্বার্থে এই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে নিজেদের দখলে রাখে এবং ব্যবহার করে। এই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার দখল কায়েম করার জন্য বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষ অব্যাহত থাকে। বিভিন্ন শ্রেণী তাদের শ্রেণীস্বার্থ সাধনের উদ্দেশ্যে যে সকল পন্থা পদ্ধতি অনুসরণ করে রাজনীতির উপর তার প্রভাব পড়ে। তবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার আলোচনা ছাড়াও সামাজিক গোষ্ঠীসমূহ ও বিভিন্ন রাজনীতিক দলের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং বিভিন্ন জাতির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক রাজনীতির অন্তর্ভুক্ত হয়। মহামতি লেনিন (V.I Lenin) -এর মতানুসারে রাষ্ট্র ও সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন শ্রেণীর সম্পর্ক এবং শ্রেণীসমূহের পারস্পরিক সম্পর্ক হল রাজনীতির বিষয়বস্তু (“The specific feature of politics is that it is the sphere of relationships of all classes and strata to the state. and the government, the sphere of interrelationships between all classes.”)। অর্থাৎ লেনিনের মতানুসারে ‘রাষ্ট্রনীতি’ হল শ্রেণীসমূহের মধ্যে সম্পর্ক’ (“Politics is the relationships among the classes. “)। তবে মানবসমাজের ক্রমবিকাশের ধারায় যখন সাম্যবাদী সমাজের সৃষ্টি হবে, তখন শ্রেণী শোষণের হাতিয়ার অপ্রয়োজনীয় হয়ে আপনা থেকে অবলুপ্ত হবে। এই সাম্যবাদী সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতির বিষয়বস্তু ও প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটবে।

মার্কসীয় ধারণা অনুসারে রাজনীতি হল সামগ্রিকভাবে সমাজনীতিরই অংশ। সমাজের প্রচলিত অর্থব্যবস্থা, শ্রেণী-সম্পর্ক প্রভৃতি রাজনীতির মাধ্যমেই প্রতিপন্ন হয়। মার্কসবাদীরা তাই বৃহত্তর সমাজব্যবস্থার পটভূমিতে রাজনীতির আলোচনা করার পক্ষপাতী। মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গী অনুসারে রাজনীতি হল বিভিন্ন সমাজব্যবস্থায় প্রতিপত্তিশালী শাসকশ্রেণীর মতাদর্শ। কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো (Communist Manifesto) – তে মার্কস এঙ্গেলস বলেছেন: “The ruling ideas of each age have ever been the ideas of its ruling class.” মার্কসবাদীদের মতানুসারে রাজনীতিক জীবনধারা বৈষয়িক অবস্থা বা অর্থনৈতিক অবস্থার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। লেনিন বলেছেন: “Politics is a concentrated expression of economics.” শ্রেণী কাঠামো ও শ্রেণী-সম্পর্কের পটভূমিতেই রাজনীতির আলোচনা পরিচালিত হয়।

মার্কসীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাজনীতিতে বিরোধের আলোচনাকে গুরুত্ব দেন। মিলিবাণ্ড (Ralph Miliband) তাঁর Marxism and Politics গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন যে, মার্কসীয় রাজনীতির মূল কথা হল বিরোধ (At the core of Marxist Politics, there is the notion of conflict.”)। মার্কসীয় ধারণা অনুসারে বিরোধের মধ্যে প্রভুত্ব ও অধীনতার ব্যবস্থা বর্তমান। উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন-সম্পর্কের বিরোধের মাধ্যমে মার্কসবাদে মানবসমাজের বৈপ্লবিক রূপান্তরের ধারা ব্যাখ্যা করা হয়। শ্রেণীবিভক্ত সমাজের প্রকৃতি পর্যালোচনার ক্ষেত্রে শ্রেণী-সংগ্রাম ও সংঘাতের কথা বলা হয়।

উদারপন্থী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরাও রাজনীতিতে বিরোধের আলোচনা করেন। কিন্তু মার্কসবাদীদের এই আলোচনা পৃথক প্রকৃতির। উদারপন্থীরা যে-কোন বিরোধকে রাজনীতিক আলোচনার অন্তর্ভুক্ত করেন। এই প্রচেষ্টা অতি-সরলীকরণ হিসাবে প্রতিপন্ন হয়। কিন্তু মার্কসবাদীরা অতি সরলীকরণের এই ব্যবস্থায় বিশ্বাসী নন।

নৈতিক ও আর্থিক বিষয়: রাষ্ট্রবিজ্ঞান একটি গতিশীল বিজ্ঞান। এর আলোচনাক্ষেত্রের পরিধি ক্রমেই ব্যাপকতর হচ্ছে। রাষ্ট্রের কার্যক্রম নির্ধারিত হয় সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশের পরিপ্রেক্ষিতে। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা কেবল রাষ্ট্রের আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। সুতরাং সমাজের নৈতিক এবং আর্থিক বিষয়াদিও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার মধ্যে আসে। তা ছাড়া মানুষের সমাজচিত্তাও এর অঙ্গীভূত।

মূল্যের কর্তৃত্বসম্পন্ন বরাদ্দের আলোচনা

ডেভিড ইস্টন হলেন আধুনিককালের এক বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। তিনি রাষ্ট্রনীতির উপজীব্য বিষয়কে সম্পূর্ণ এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর Political System শীর্ষক গ্রন্থে তিনি এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তাঁর অভিমত অনুসারে রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল মূল্যের কর্তৃত্বসম্পন্ন বরাদ্দ (authoritative allocation of values)। তিনি বলেছেন: ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে সমাজের জন্য মূল্যের কর্তৃত্বসম্পন্ন বরাদ্দের আলোচনা হিসাবে ব্যাখ্যা করা যায়’ (“Political Science be described as the study of authoritative allocation of values for society.”)। সমাজের জন্য মূল্যের এই কর্তৃত্বসম্পন্ন বরাদ্দ প্রভাবিত হয় ক্ষমতার বণ্টন ও ব্যবহারের দ্বারা। ইস্টনের নিজের কথায়: “Political Science is the study of the authoritative allocation of values as it is influenced by the distribution and use of power.”

সমগ্র সমাজের মূল্য এবং কর্তৃত্বসম্পন্ন বরাদ্দ হল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু। সমাজের জন্য মূল্য (value) অর্থে মূল্য, বস্তু বা পুরস্কারের কথা বলা হয়েছে। এই মূল্য বা বাস্তব বরাদ্দ কর্তৃত্বসম্পন্ন (authoritative) হওয়া চাই। সরকারী নীতির (policy) মাধ্যমে মূল্য বা বস্তু বরাদ্দ করা হয়। সরকারী নীতি হল কিছু সিদ্ধান্ত ও তার বাস্তবায়ন। সুতরাং এই সরকারী নীতি কর্তৃত্বসম্পন্ন হওয়া দরকার। যাদের জন্য এই নীতি প্রণীত হয়েছে বা এই নীতি যাদের প্রভাবিত করবে তাদের সকলে যদি তা মেনে চলে বা মেনে চলতে বাধ্য হয় তাহলেই সংশ্লিষ্ট নীতি কর্তৃত্বসম্পন্ন বলে বিবেচিত হবে। ইস্টন বলেছেন: “A policy is clearly authoritative when the feeling prevails that it must or ought to be obeyed.” প্রকৃত প্রস্তাবে ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরাই মূল্য বা বস্তুর বরাদ্দ করেন। এই বরাদ্দ কর্তৃত্বসম্পন্ন হয়। কারণ তাঁরা তাঁদের সিদ্ধান্তকে অন্যদের উপর বাধ্যতামূলকভাবে কার্যকর করতে পারেন।

ইস্টনের মতানুসারে যে-কোন সমাজের অস্তিত্বের স্বার্থে মূল্য বা বাস্তব কর্তৃত্বসম্পন্ন বরাদ্দ প্রয়োজন। এই প্রয়োজন নূন্যতম, একমাত্র নয়। সমাজে কোন মূল্যবান পার্থিব বা অপার্থিব (material or spiritual) বস্তুর বণ্টনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধ বাধতে পারে। প্রথা বা ব্যক্তিগত সমঝোতার মাধ্যমে এই বিরোধের নিরসন সম্ভব নাও হতে পারে। এ রকম অবস্থায় একটি নীতি তৈরী করা হয়। সামাজিক কর্তৃত্বের সমর্থনে এই নীতি প্রণীত হয়ে থাকে। এই নীতি বা সিদ্ধান্ত সমাজে কর্তৃত্বসম্পন্ন বলে বিবেচিত হয়। প্রয়োজন হলে সামাজিক কর্তৃত্ব তার নীতি বা সিদ্ধান্তকে কার্যকর করার জন্য বলপ্রয়োগের ব্যবস্থাও করতে পারে। ক্ষমতার বণ্টন ও ব্যবহারের দ্বারা মূল্য বা বস্তুর কর্তৃত্বসম্পন্ন বরাদ্দের ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে।

বিরুদ্ধবাদীরা ইস্টনের এই মূল্যের কর্তৃত্বসম্পন্ন বরাদ্দের মতবাদকে স্বীকার করেন না। বিভিন্ন দিক থেকে এই মতবাদের আলোচনা করা হয়।

(১) ইস্টনের এই মতবাদ রাষ্ট্রনীতিক জীবনধারার গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে। রাজনীতিক কাজকর্মের পরিধিকে তিনি ভেঙ্গে ফেলেছেন। বৃহত্তর সামাজিক কাজকর্মের সঙ্গে রাজনীতিক কার্যকলাপকে এক করে ফেলেছেন।

(২) ইস্টন মূল্য বা বস্তুর বরাদ্দের কথা বলেছেন। বিভিন্ন সিদ্ধান্তের মাধ্যমে এই বরাদ্দ করা যায়। এই‌ সমস্ত সিদ্ধান্তের মধ্যে অধিকতর কাম্য কোনটি তা সবসময় নির্ধারণ করা যায় না।

(৩) রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অনেক বিষয়ের মধ্যে মূল্য বা বস্তুর কর্তৃত্বসম্পন্ন বরাদ্দ অন্যতম বিষয় হিসাবে বিবেচিত হতে পারে। মূল্যের কর্তৃত্বসম্পন্ন বরাদ্দ ও সংশ্লিষ্ট নীতি নির্ধারণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একমাত্র উপজীব্য বিষয় হতে পারে না।

(৪) ইস্টন বলপ্রয়োগের চূড়ান্ত ও একচেটিয়া অধিকার কেবল সরকারকেই দিয়েছেন। তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয় হিসাবে রাষ্ট্র এবং তার প্রতিষ্ঠানগত ধারণাকে অস্বীকার করেছেন।

(৫) মূল্য বা বস্তুর সকল বরাদ্দের সঙ্গে বলপ্রয়োগ ব্যবস্থার দরকার হয় না। সামাজিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে নির্দিষ্ট নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এবং বে-সরকারী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মধ্যে তারতম্য যাচাই করা দরকার।

(৬) ইস্টনের এই মতবাদের মাধ্যমে অপরাপর সামাজিক নিয়ন্ত্রণ থেকে রাষ্ট্রনীতিকে আলাদা করা যায় না।

(৭) রাজনীতিক দিক থেকে যাঁরা ক্ষমতাসম্পন্ন এবং সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে যাঁরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তাঁদের সেই সিদ্ধান্তই হল বৈধতাযুক্ত। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা দরকার যে, ‘কর্তৃত্বসম্পন্ন’ (authoritative) কথাটি বৈধতাযুক্ত।

(৮) সাম্প্রতিককালের বিভিন্ন রাজনীতিক ব্যবস্থায় বহু সিদ্ধান্ত সরকারী কাঠামোর বাইরে গ্রহণ করা হয়। এ রকম ক্ষেত্রে কর্তৃত্বের নির্দিষ্ট অবস্থান নির্ধারণ মুস্কিল।

আধুনিক রাষ্ট্রনীতিক চিন্তাজগতে লিপসন (Leslie Lipson) একটি বিশিষ্ট নাম। তাঁর একটি সুবিখ্যাত গ্রন্থ হল Great Issues of Politics এই গ্রন্থে লিপসন কতকগুলি বৃহৎ সমস্যার আলোচনাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উপজীব্য বিষয় হিসাবে প্রতিপন্ন করেছেন। অর্থাৎ তাঁর মতানুসারে রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল কতকগুলি বৃহৎ সমস্যার পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন। তাঁর আলোচিত সমস্যাগুলি একে একে উল্লেখ করা দরকার।

(১) প্রত্যেক সমাজেই দুইটি স্তর বর্তমান। এই দুইটি স্তর হল সরকার এবং শাসিত। সমাজের এই দুই স্তরের পারস্পরিক সম্পর্ককে কেন্দ্র করে কতকগুলি সমস্যার সৃষ্টি হয়। এগুলি হল: সকল নাগরিক প্রশাসন পরিচালনায় সমর্থ কিনা, নাগরিকদের মধ্যে দক্ষতার তারতম্য আছে কিনা, নাগরিক ও প্রজা নাগরিকদের মধ্যে এ রকম কোন শ্রেণীবিভাগ আছে কিনা, সকলে সমানাধিকারসম্পন্ন কিনা, কতকগুলি ক্ষেত্রে সমানাধিকার এবং অন্য কতকগুলি ক্ষেত্রে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা থাকা সঙ্গত কিনা প্রভৃতি। তবে মধ্যে পারস্পরিক অধিকার ও কর্তব্য বর্তমান।

(২) রাষ্ট্রের কার্যাবলীর পরিধিও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত একটি বড় সমস্যা। এ সমস্যা দীর্ঘদিনের। কেউ রাষ্ট্রের কাজকর্মকে সীমাবদ্ধ করার পক্ষপাতী; আবার অনেকে এর বিরুদ্ধে। একত্ববাদীরা সকল সামাজিক কাজকর্মকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের অন্তর্ভুক্ত করতে চান। অপরদিকে বহুত্ববাদীদের অভিমত হল রাষ্ট্রের কার্যাবলী সীমিত করা উচিত।

(৩) শাসক ও শাসিতের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। রাজনীতিক ক্ষমতার পরিপ্রেক্ষিতে প্রথম বিকল্প হিসাবে স্বাধীনতা এবং দ্বিতীয় বিকল্প হিসাবে একনায়কতন্ত্রের কথা বলা হয়। সরকারের মাধ্যমে রাষ্ট্রের ক্ষমতা প্রযুক্ত হয়। মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তি সরকারের কাজকর্ম পরিচালনা করেন। এঁরাই হলেন শাসক। শাসকের উদ্দেশ্য হল নিজের ক্ষমতা সংরক্ষণ। এবং যারা শাসিত হয় তারা চায় চূড়ান্ত রাজনীতিক ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করতে। শাসক ও শাসিতের (Government and the Governed) মধ্যে ক্ষমতা বণ্টনের বিন্যাস পিরামিড সদৃশ। ক্ষমতা বণ্টনের এই কাঠামোর শীর্ষে আছে সরকার। অন্যান্য সকলের অবস্থান এই কাঠামোর পাদদেশে। এই অবস্থায় জনগণের দিক থেকে অর্থাৎ ক্ষমতার বণ্টন কাঠামোর (পিরামিডের) পাদদেশ থেকে কর্তৃত্বের উৎস উৎসারিত হতে পারে। তখন জনসাধারণ সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করে। আবার ক্ষমতা সরকারের দিক থেকে অর্থাৎ পিরামিডের শীর্ষদেশ থেকে নিম্নগামী হতে পারে। তখন জনসাধারণ শাসকের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।

(৪) ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন ও বিকেন্দ্রীভবনও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত একটি সমস্যা। সকল ক্ষমতা একটিমাত্র সরকারের হাতে কেন্দ্রীভূত অবস্থায় থাকতে পারে। আবার কেন্দ্রীয়, রাজ্য ও আঞ্চলিক সরকারের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টিত ও বিকেন্দ্রীভূত অবস্থায় থাকতে পারে। তেমনি আর একটি সমস্যা হল সরকারের বিভাগসমূহের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টনের মাধ্যমে ভারসাম্য সংরক্ষণ।

(৫) আরও কতকগুলি সমস্যা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত। এই সমস্যাগুলি হল রাষ্ট্রের এক্তিয়ারের পরিধি-সংক্রান্ত বিষয়ে এবং একটি বিশ্বরাষ্ট্র অথবা বহুসংখ্যক রাষ্ট্রের অস্তিত্ব সংক্রান্ত বিষয়ে।

১৯৪৮ সালে ইউনেস্কো (UNESCO)-র এক সম্মেলনে নিম্নোক্ত বিষয়সূচীকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্য পরিধির অন্তর্ভুক্ত করা হয় : 

  • (১) রাষ্ট্রনৈতিক তত্ত্ব ও তার ইতিহাস; 

  • (২) রাষ্ট্রনৈতিক প্রতিষ্ঠান—যেমন সংবিধান, জাতীয়, প্রাদেশিক ও স্থানীয় শাসন; 

  • (৩) বিভিন্ন রাষ্ট্রের তুলনামূলক আলোচনা; 

  • (৪) রাজনীতিক মতবাদ; 

  • (৫) আন্তর্জাতিক সংস্থা ও রীতিনীতি।

উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সঙ্গত হবে যে, পরিবর্তনশীল মানবসমাজের ব্যাপক ও বহুমুখী বিস্তার এবং বিভিন্ন সমস্যার তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ও সঠিক সমাধান সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আলোচনা করা হয়। ল্যাস্কি (Laski)-র মতে “সংগঠিত রাষ্ট্রের পরিপ্রেক্ষিতে মানবজীবনের আলোচনাই রাষ্ট্রবিজ্ঞান। আমরা আলোচ্য বিষয় থেকে মানবজীবনকে প্রভাবিত করে এমন কোন কিছু বাদ দিতে পারি না।” তাঁর কথায়: “Political Science concerns itself with the life of men in relation to organised states. We cannot omit from the field of relevant interest whatever may affect that life.”

রাজনীতিক কাঠামো এবং মনবজীবনের বহুবিধ সমস্যাদির আলোচনা

বস্তুতপক্ষে, গত দু-তিন দশক ধরে নিত্য নতুন গবেষণা ও সামাজিক বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার সঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্রমবর্ধমান সহযোগিতার ফলে আলোচ্য শাস্ত্রটির আলোচনার পরিধি বিশেষভাবে প্রসারিত ও জটিল হয়েছে। সামাজিক বিজ্ঞানসমূহের প্রভাব এবং বিশেষীকরণের ফল হিসাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা ক্ষেত্রে ঐতিহ্যগত ধারণার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে রাষ্ট্র ও সরকার সংক্রান্ত আলোচনার গুরুত্ব বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। তার জায়গায় রাজনীতিক কাঠামো (political system) এবং সামগ্রিকভাবে মানবজীবনের বহুবিধ ও জটিল সমস্যাদির আলোচনা গুরুত্ব পাচ্ছে। বর্তমানে পরিবর্তনশীল মানবসমাজের ব্যাপক ও বহুমুখী বিস্তার এবং বিভিন্ন সমস্যার তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ও সঠিক সমাধান সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আলোচনা করা হয়।

বিষয়বস্তুর শ্রেণীবিভাজন: বিভিন্ন মতামত ও আলোচনার ভিত্তিতে সাধারণভাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তুর একটি শ্রেণীবিভাজন করা যেতে পারে। (ক) রাজনীতিক মতবাদ ও দর্শন; (খ) রাজনীতিক দল, চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী, রাজনীতিক আচরণ ও জনমত, (গ) সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক আইন; (ঘ) জন-প্রশাসন; (ঙ) কেন্দ্রীয়, রাজ্য ও স্থানীয় সরকার; (চ) বিভিন্ন সরকারের তুলনামূলক আলোচনা এবং (ছ) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান, আন্তর্জাতিক আইন প্রভৃতি। এ হল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তুসমূহের একটি সাধারণ শ্রেণীবিভাজন। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সীমানা নির্ধারণের ক্ষেত্রে এই শ্রেণীবিভাগ চূড়ান্ত হতে পারে না।