মানুষের জীবনধারাগত সমস্যাদির সুরাহা এবং সামগ্রিকভাবে জনকল্যাণ সাধনের ব্যাপারে চিন্তাবিদদের মধ্যে ভাবনাচিন্তার অন্ত নেই। এ ক্ষেত্রে সমাজব্যবস্থা ও রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রকৃতি-পরিধি সম্পর্কিত বিচার বিবেচনা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সংশ্লিষ্ট সমস্যাদির সমাধানের ব্যাপারে বিকল্প ব্যবস্থাদি কি হতে পারে এবং রাজনীতিক জগৎটিকে কিভাবে সংগঠিত করা যায় বা করা উচিত—এ বিষয়ে রাষ্ট্রদার্শনিকরা সুদীর্ঘকাল ধরে আলোচনা করে আসছেন। সাধারণভাবে বলা যায় যে, এ ক্ষেত্রে চিন্তাভাবনা দুটি সমান্তরাল ধারায় প্রবাহিত। একটি চিন্তাধারা হল উদারনীতিক এবং আর একটি চিন্তাধারা হল মার্কসীয়। প্রথম ধারার চিন্তাবিদদের মধ্যে মূলত জন স্টুয়ার্ট মিল-এর নাম এবং দ্বিতীয় ধারার চিন্তাবিদদের মধ্যে স্বয়ং কার্ল মার্কস-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

মানুষ ও মানবসমাজ সম্পর্কে উদারনীতিবাদী ও মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। স্বভাবতই রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব এবং মানুষের ব্যক্তিত্বের মধ্যে সম্পর্কের বিষয়ে এই দুই মতবাদের বক্তব্য পরস্পর বিরোধী।

রাষ্ট্রনীতির অর্থ প্রসঙ্গে উদারনীতিবাদী ও মার্কসবাদী বক্তব্যের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান বর্তমান। উদারনীতিক বক্তব্য অনুযায়ী রাষ্ট্রনীতি হল রাষ্ট্র, সরকার এবং ক্ষমতা বা বলপ্রয়োগের উপায় সম্পর্কিত আলোচনা। মার্কসবাদী বক্তব্য অনুযায়ী রাষ্ট্রনীতি হল কেবলমাত্র রাজনীতিক, আর্থনীতিক ও মতাদর্শমূলক ক্ষমতার আলোচনা। উদারনীতিবাদে ক্ষমতাকে বলপ্রয়োগের সঙ্গে সঙ্গে জনকল্যাণ সাধনের উপায় হিসাবে দেখা হয়। অপরদিকে মার্কসবাদে ক্ষমতাকে কেবলমাত্র শ্রেণীশোষণ ও শ্রেণী-শাসনের মাধ্যম হিসাবে দেখা হয়।

উদারনীতিবাদীরা ব্যক্তি মানুষের নিজস্ব ব্যক্তিত্বের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের মাধ্যমে এই ব্যক্তিত্বকে আঘাত করা অনুচিত। ব্যক্তির মূল্য ও মর্যাদার উপর উদারনীতিবাদে গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এদিক থেকে বলা হয় যে, সমাজ হল একটি মুক্ত ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ক্ষেত্র। এই ক্ষেত্রটি পরিচালিত হয় স্বাধীন চুক্তি, বিনিময় ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা সম্পর্কিত বিধি-ব্যবস্থার দ্বারা। সমাজ হল একটি সংগঠন। এই সমাজের মধ্যে ব্যক্তিবর্গ তাদের যোগ্যতা ও ক্ষমতা অনুসারে পরস্পরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। ম্যাক্ফারসন (C. B. Macpherson) একে বলেছেন ‘অধিকারসূচক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ’ (Possessive individualism)। ম্যাক্ফারসন তাঁর The Political Theory of Possessive Individualism শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “Its possessive quality is found in its conception of the individual as essentially the proprietor of his own person or capacities owing nothing to society for them. The individual is seen neither as a moral whole, nor as a part of a large social whole, but as an owner of himself.”

সামাজিক ও রাজনী চিত্তাবিদদের মধ্যে অনেকেই উদারনীতিবাদের প্রবক্তা হিসাবে পরিচিত। এঁরা হলেন হবস্, লক্, বার্ক, বেথাম, হবহাউস, মিল, বার্কার, ল্যাস্কি, গ্রীণ, স্পেনসার, ম্যাকাইভার প্রমুখ। উদারনীতিবাদীদের মতামতের মধ্যে অল্পবিস্তর পার্থক্য বর্তমান। মিল ও স্পেনসার ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের স্বাধিকারে বিশ্বাসী। অপরদিকে হবহাউস ও ল্যাস্কি মানুষের ব্যক্তিগত স্বার্থের সঙ্গে সমাজের সামগ্রিক স্বার্থের সামঞ্জস্য সাধনের পক্ষপাতী।

প্রত্যেক সমাজেই বহু ও বিভিন্ন স্বার্থ থাকে। এই সমস্ত স্বার্থের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকে। এই দ্বন্দ্বের অবসান বা হ্রাসের জন্য কিছু সামাজিক ক্ষমতা ও সামাজিক প্রক্রিয়া আবশ্যক। এ ক্ষেত্রে যে সামাজিক ক্ষমতার সৃষ্টি হয় তা রাষ্ট্র হিসাবে পরিচিতি পায় এবং যে সামাজিক প্রক্রিয়া উদ্ভাবিত হয়, তা রাষ্ট্রনীতি হিসাবে পরিগণিত হয়। রাষ্ট্রনীতির আলোচনা রাষ্ট্র ও সরকারের সঙ্গে সম্পর্কিত। সমাজে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অবস্থা এবং আইন-শৃঙ্খলার ব্যবস্থাকে সুনিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্র এবং সরকারের অস্তিত্বের অপরিহার্যতা অনুভূত হয়। এ রকম সমাজে ব্যক্তি মানুষের ব্যক্তিত্বের যথাসম্ভব সর্বোৎকৃষ্ট বিকাশ সম্ভব। মিলার (J.D.B. Miller) (তাঁর The Nature of Politics শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “Politics, then, is about disagreement or conflict, and political activity is that which is intended to bring about or resist change in the face of possible resistance.” উলিন (S. S. Wolin) তাঁর Politics and Vision শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “Politics is, therefore viewed as a power, a social process, behaviour that is concerned with the maintenance of law and order in the society and for coordinating and conciliating diverse private interests of individuals and groups.”

উদারনীতিবাদীরা বসবাসের জন্য শাস্তি ও শৃঙ্খলার সঙ্গে সঙ্গে এমন একটি সমাজের কথা বলেন যা স্বাধীন ও মুক্ত। এ রকম ব্যক্তি মানুষ তার গুণগত যোগ্যতাসমূহের সর্বাধিক বিকাশ সাধনের সুযোগ পায়। ব্যক্তিবর্গের সমষ্টিগত জীবনধারার সঙ্গত ও স্বাভাবিক বিষয় হল সামাজিক দ্বন্দ্ব ও সামাজিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা। একে শ্রেণী-যুদ্ধ বলা যায় না। মানুষ স্বার্থপর। এ কথা ঠিক। কিন্তু নিকট জনের প্রতি ব্যক্তিবর্গের সদিচ্ছা সহানুভূতিও আছে। সুতরাং সামাজিক স্বার্থসমূহের সঙ্গে ব্যক্তিগত স্বার্থসমূহের সমন্বয় সাধন সম্ভব। রাষ্ট্রনীতির উদ্দেশ্য হল একটি স্বাধীন ও মুক্ত সমাজের অস্তিত্বকে সুনিশ্চিত করা। এবং বিবিধ স্বার্থসমূহের মধ্যে দ্বন্দ্ব মীমাংসার উপযোগী বিধি-ব্যবস্থা গড়ে তোলা।

মানুষ, সমাজ ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। মার্কসীয় দর্শন অনুযায়ী ব্যক্তি মানুষের জীবনকে সামাজিক প্রেক্ষাপটে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। মার্কসবাদ অনুসারে মানুষ হল প্রথমে সামাজিক জীব, তারপর রাজনীতিক। সমগ্র সমাজের অংশ হিসাবেই মানুষের অস্তিত্ব ও অবস্থান। সমাজের সমষ্টিগত ধারণার অন্তর্ভুক্ত হল পরিবার, পেশাগত গোষ্ঠীসমূহ ও শ্রেণীসমূহ। ব্যক্তি মানুষের সঙ্গে তার সামাজিক পটভূমির সংযোগ-সম্পর্ক যথাযথ হওয়া দরকার। বিরোধী শ্রেণীসমূহের উদ্ভবের ফলে ব্যক্তি মানুষ সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। অন্য শ্রেণীর উপর শাসন-শোষণ কায়েম করার জন্য প্রাধান্যকারী শ্রেণী সৃষ্টি করেছে রাষ্ট্র যন্ত্রের। ব্যক্তিবর্গের স্বার্থসমূহ পরস্পর বিরোধী নয়। মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা মুক্তি পেতে চায়। তারজন্য মানুষকে তার নিজের থেকে এবং তার নিকটজনের থেকে বিচ্ছিন্ন করা চলে না।

বাঁচার তাগিদে মানুষ দ্রব্যসামগ্রীর উৎপাদন ও বণ্টনের উপায় উদ্ভাবন করে। এইভাবে সৃষ্টি হয় উৎপাদন-সম্পর্কের। তারফলে সমাজ পরস্পর বিরোধী দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। উৎপাদনের উপায়সমূহের এবং বণ্টনের মালিকানা প্রাধান্যকারী শ্রেণীর হাতে থাকে। শোষিত শ্রেণী শ্রমশক্তি বিক্রয় করে তাদের অস্তিত্ব রক্ষা করে। উৎপাদন সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হিসাবে পরিগণিত হয়। শ্রম হল এর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্রত্যেক সমাজেই বিদ্যমান উৎপাদন সম্পর্কের ভিত্তিতে উৎপাদন ব্যবস্থা নির্ধারিত হয়। এই উৎপাদন ব্যবস্থাই হল বনিয়াদ। এই বনিয়াদের উপরই সমাজের রাজনীতিক, সামাজিক, সংস্কৃতিক, নৈতিক ও মতাদর্শগত উপরিকাঠামো গড়ে উঠে। সুতরাং রাষ্ট্রনীতি হল সমাজে শ্রেণী-সম্পর্ক ও শ্রেণী সংগ্রামের আলোচনা। প্রাধান্যকারী শ্রেণী হীনবল শ্রেণীর উপর শোষণ-পীড়ন কায়েমের হাতিয়ার হিসাবে রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে। সুতরাং রাষ্ট্রকে জনকল্যাণের উপায় হিসাবে বিবেচনা করা যায় না। রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সর্বজনীনতা সম্পর্কিত একটি মুখোশ থাকে। আসলে রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানগুলি প্রাধান্যকারী শ্রেণীরাই স্বার্থ সংরক্ষণের অনুকূল ভূমিকা পালন করে।

বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সামাজিক ও রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ বস্তুগত অবস্থাসমূহের ফলশ্রুতি। বস্তুগত অবস্থাসমূহই মানুষের আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণের মুখ্য বিষয়। শ্রেণীসমূহ রাষ্ট্রনীতির সাহায্যে ক্ষমতার উপর কর্তৃত্ব কায়েম করে; অর্থনীতির প্রকৃতিকে প্রভাবিত করতে উদ্যোগী হয় এবং বস্তুগত সম্পদের বণ্টন, মতাদর্শ, সংস্কৃতি, নীতিবোধ, পরিবার ও প্রাত্যহিক জীবনকে প্রভাবিত করতে উদ্যোগী হয়।

উদারনীতিবাদীরা রাষ্ট্রনীতির দ্বন্দ্ব ও সমঝোতার মডেলের কথা বলেন। কিন্তু মার্কসবাদীরা তা বাতিল করে দেন। তাঁরা রাষ্ট্রনীতির বৈপ্লবিক মডেলের কথা বলেন। রাষ্ট্রনীতির বৈপ্লবিক মডেল শ্রেণী-সংঘাতের ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত। বৈপ্লবিক প্রকৃতির মধ্যেই রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কিত মার্কসীয় ধারণার মূল নিহিত আছে। শ্রেণী-সম্পর্কসমূহের অভিব্যক্তিই হল রাজনীতি। সমাজতন্ত্রের চূড়ান্ত পর্যায়ে এর সমাপ্তি ঘটবে। কারণ এই পর্যায়ে শ্রেণীহীন সমাজ জীবন রাষ্ট্রহীন অবস্থায় উপনীত হবে। যখন শ্রেণী-সংঘাত থাকবে না এবং সমাজের প্রকৃতি হবে শ্রেণীহীন, তখন রাষ্ট্রের প্রয়োজন থাকবে না। অর্থাৎ সমাজের ক্রমবিকাশের চূড়ান্ত পর্যায়ে সাম্যবাদী স্তরে রাষ্ট্রনীতির অর্থই বদলে যাবে। বিপ্লবের মাধ্যমে শ্রমিক শ্রেণীর পক্ষে ক্ষমতার রাজনীতিক বিষয়াদির চূড়ান্তভাবে চিরতরে নিষ্পত্তি হয়ে যায়। তখন শ্রেণী-সংঘাত থাকে না, মানুষের সামাজিক অবস্থান হয় মুক্ত।

উদারনীতিবাদী বক্তব্যের ধারা I আধুনিক উদারনীতিবাদের সমৃদ্ধ ও তাৎপর্যপূর্ণ পরিচয় পাওয়া যায় জে. এস. মিলের রচনায়। মিলের উত্তরসূরীদের মাধ্যমে উদারনীতিবাদী দর্শন যেখানে উপনীত হয়েছে তার সার-সংক্ষেপ প্রতিপাদন করা যায়। উদারনীতিবাদে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের কথা বলা হয়। এ ধরনের সরকার হল দক্ষ এবং নির্বাচকদের কাছে দায়িত্বশীল। স্বাধীনতার নীতি এবং নৈতিক আত্মিক উন্নয়নের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ আইন প্রণয়নের ব্যাপারে সর্বাধিক সহায়ক সরকার হল প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক সরকার। আর্থনীতিক কল্যাণ ও আর্থনীতিক স্বাধীনতাকে সর্বাধিক করার ক্ষেত্রে সাধারণভাবে সব থেকে উপযুক্ত হল বাজারে দ্রব্য-সামগ্রীর অনিয়ন্ত্রিত লেনদেন। মিলের মতানুসারে সমাজের প্রথম প্রয়োজন এবং সরকারের প্রাথমিক লক্ষ্য হল ব্যক্তির ও সম্পত্তির নিরাপত্তা এবং ব্যক্তিবর্গের মধ্যে ন্যায়ের সমতা। এ সবের দায়িত্ব ও ক্ষমতা সর্বোচ্চ স্তরের মানুষের হাতে থাকা দরকার। অন্যথায় অব্যবস্থা ও দ্বন্দ্ব-বিবাদ দেখা দেবে। তার জন্য দরকার সর্বসাধারণের সরকার।

উদারনীতিবাদ ও উদারনীতিক গণতন্ত্রের রাজনীতিক দৃঢ়তা ও বক্তব্যের গুরুত্ব প্রসঙ্গে বিবিধ ব্যাখ্যা বর্তমান। এ ক্ষেত্রে তিনটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা বিশেষভাবে অর্থবহ। 

(এক) মিল একদিকে আয়, সম্পদ ও ক্ষমতার অসাম্যের কঠোর সমালোচনা করেছেন। এ ধরনের অসাম্য শ্রমজীবী শ্রেণীসমূহের অধিকাংশ মানুষের পরিপূর্ণ উন্নয়নকে প্রতিহত করে। কিন্তু রাজনীতিক ও সামাজিক সাম্যের স্বার্থে অঙ্গীকারের ব্যাপারে তিনি এগিয়ে আসেননি। এই কারণে অনেকে মিলের উদারনীতিক বক্তব্যকে ‘শিক্ষামূলক এলিটবাদ’ হিসাবে প্রতিপন্ন করার পক্ষপাতী। কারণ এ রকম উদারনীতিবাদে জ্ঞানী, বিচক্ষণ ও প্রাজ্ঞ ব্যক্তিবর্গের বিশেষাধিকারের বিষয়টিকে সমর্থন করা হয়েছে। সমাজে নেতৃত্বমূলক রাজনীতিক ভূমিকা দেওয়া হয়েছে বুদ্ধিজীবীদের একটি শ্রেণীকে। মিলের ব্যবস্থায় এই শ্রেণীর হাতেই থাকবে অধিকাংশ সম্পদ ও বিশেষাধিকার। মিল শিক্ষার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। কারণ শিক্ষাই হল স্বাধীনতা ও শৃঙ্খল-মোচনের চাবিকাঠি। এই উদারনীতিবাদে সকলের নৈতিক বিকাশের উপর জোর দেওয়া হয়েছে, কিন্তু ক্ষমতা ও প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অসাম্যকে স্বীকার করা হয়েছে। উদারনীতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পক্ষে মিল বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ যুক্তির অবতারণা করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি এমন কিছু যুক্তি দেখিয়েছেন, যা উদারনীতিবাদের বাস্তবায়নের পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে।

(দুই) মিল মুক্ত-বাজার রাজনীতিক অর্থনীতি ও ন্যূনতম রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের কথা বলেছেন। এর ভিত্তিতে নতুন উদারনীতিক ধ্যান-ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। এই অবস্থা অনুযায়ী আইনের ব্যবস্থার মাধ্যমে নাগরিকদের স্বাধীনতা সর্বাধিক হবে এবং সম্পদ-সম্পত্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। নাগরিকরা বাধা-বিপত্তি ছাড়াই নিজেদের অভিপ্রেত লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার ব্যাপারে উদ্যোগী হতে পারবে। ব্যক্তিস্বাধীনতার সুরক্ষা যোগ্যতম ব্যক্তিদের দিতে হবে। ব্যক্তিস্বাধীনতার সুরক্ষা যোগ্যতম ব্যক্তিদের বিকাশ এবং রাজনীতিক ও আর্থনীতিক স্বাধীনতাকে সুনিশ্চিত করে। এর পরিণামে কল্যাণ হয়।

(তিন) মিল মূলত উদারনীতিক রাষ্ট্রের অবস্থানের কথা বলেছেন। ব্যক্তিকে যথাসম্ভব স্বাধীনতা দিতে হবে। ব্যক্তিবর্গের প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক লক্ষ্য ও জীবনধারার ক্ষেত্রে উদারনীতি রাষ্ট্র নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করবে। মিলের বেশ কিছু উদারনীতিক ধারণা রাজনীতির সংস্কারমূলক মতামতকে সমর্থন করে। জনসাধারণের অধিকার সংরক্ষণের ব্যাপারে উদারনীতিক রাষ্ট্রকে সক্রিয় ভূমিকা দেওয়া হয়েছে। আইনের মাধ্যমে সাধারণের অধিকার সংরক্ষিত হবে। আইনের মাধ্যমে সংখ্যালঘু জাতি-গোষ্ঠীসমূহের নিরাপত্তা নিরাপদ হবে এবং নারীজাতির অবস্থার উন্নতি সাধিত হবে। রাষ্ট্রের আইনসঙ্গত কর্মক্ষেত্রের অন্তর্ভুক্ত হবে বৃত্তিগত স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা, সাধারণ স্বাস্থ্য সংরক্ষণ, দারিদ্র্য নিবারণ প্রভৃতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের কার্যাবলী।

মার্কসীয় বক্তব্যের ধারা: অপরদিকে মার্কসীয় দর্শনে নিরপেক্ষ উদারনীতিক রাষ্ট্র ও মুক্ত বাজার আর্থনীতির ধারণার বিরূপ সমালোচনা করা হয়েছে। শিল্প পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় রাষ্ট্র কখনই নিরপেক্ষ বা অর্থনীতি-নিরপেক্ষ হতে পারে না। দাবি করা হয় যে, উদারনীতিক রাষ্ট্র সকল নাগরিকের হয়ে কাজ করে, ব্যক্তি ও সম্পত্তির নিরাপত্তা বজায় রাখে এবং ব্যক্তিবর্গের মধ্যে ন্যায়ের সমতা রক্ষা করে। উদারনীতিবাদের এই ধারণাকে মার্কসবাদে অর্থহীন বলা হয়। কারণ বাস্তবে এই সমস্ত উদারনীতিক দাবিকে কার্যকর করা অসম্ভব। মার্কসীয় দর্শন অনুযায়ী শ্রেণী-বিভক্ত সমাজে ব্যক্তিজীবনের অধিকাংশ বিষয় নির্ধারিত হয় শ্রেণীকাঠামোতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অবস্থানের দ্বারা। উদারনীতিক রাষ্ট্র ব্যক্তিগত সম্পত্তির সুরক্ষার মাধ্যমে কার্যত সম্পত্তিবান শ্রেণীর স্বার্থের সপক্ষে ভূমিকা পালন করে। আইন প্রণয়ন, প্রশাসন ও তদারকির মাধ্যমে উদারনীতিক রাষ্ট্র বিদ্যমান আর্থনীতিক জীবনধারা ও সম্পত্তি সম্পর্কের জটিল জটাজালের মধ্যে প্রবেশ করে। তদনুসারেই উদারনীতিক রাষ্ট্রের কাঠামো ও কার্যাবলী স্থিরীকৃত হয়। অর্থাৎ শ্রেণী-বিভক্ত সমাজের নিয়ন্ত্রণ ও সংহতি সাধনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় রাষ্ট্রের এই ভূমিকার অর্থ হল মূলধনের মাধ্যমে মজুরী-শ্রমিকের শোষণ। ন্যূনতম রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ সম্পর্কিত উদারনীতিক ধারণার মাধ্যমে বাস্তবে অন্য কথা বলা হয়। তথাকথিত মুক্ত বাজার নীতির পরিপ্রেক্ষিতে লাগামছাড়া অসাম্য-বৈষম্যের সৃষ্টি হয়। এসবের বিরুদ্ধে যারা প্রতিবাদ করে তাদের দমন করার জন্যই উদারনীতিক রাষ্ট্র সক্রিয় হয়। প্রয়োজন দেখা দিলে উদারনীতিক রাষ্ট্র দমন-পীড়নমূলক ভূমিকা পালন করে। এই অবস্থায় ব্যক্তির নিরাপত্তা এবং ন্যায়ের সমতার মধ্যে সামঞ্জস্য সাধন সম্ভব নয়।

তবে সাম্প্রতিককালে মার্কসীয় চিন্তাধারা একাধিক ধারা-উপধারায় বিভক্ত। এই সমস্ত মার্কসীয় চিন্তাধারার মধ্যে তিনটি ধারা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই তিনটি ধারা হল:

  • (১) মার্কসবাদী-লেনিনবাদী মূলধারা (fundamentalists),
  • (২) হার্বার্ট মারকুইস-এর ‘লিবাটারিয়ান’ (libertarians)-দের ধারা এবং
  • (৩) নিকস পোলানটাজ-এর বহুত্ববাদী (pluralists) ধারা।

মার্কস প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র ও পরিকল্পনায় প্রতিষ্ঠানসমূহে সকল স্বাধীন ও সমান শ্রমিকদের অংশগ্রহণের কথা বলেছেন। বিভিন্ন বিষয়ে মার্কসবাদী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণকে কেন্দ্র করে বিবিধ প্রশ্নের সৃষ্টি হয়। তারই পরিপ্রেক্ষিতে সাম্প্রতিককালের মার্কসবাদী আলোচনায় একাধিক ধারা উপধারার সৃষ্টি হয়। লিবারেটারিয়ান মার্কসবাদীরা দৃঢ়ভাবে এই মতবাদের প্রবক্তা যে, রাষ্ট্রের সঙ্গে কোন আপস সহাবস্থান সম্ভব নয়। কারণ সবসময় এবং সর্বত্রই রাষ্ট্র হল প্রাধান্যকারী আর্থনীতিক স্বার্থসমূহের ঘনীভূত শক্তি’ (Condensed power) এবং ‘শক্তিমূলক হাতিয়ার’ (power instrument)। এই শ্রেণীর মার্কসবাদীরা যেমন রাষ্ট্রের অস্তিত্বের বিরোধিতা করেন, তেমনি দলের অস্তিত্বেরও বিরোধিতা করেন।

অপরদিকে বহুত্ববাদী মার্কসবাদীরা ভিন্ন কথা বলেন। মার্কস দেখিয়েছেন যে, সমাজতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী স্তরে মানবসমাজের উপনীত হওয়ার বিষয়টি সকল দেশে সমভাবে হয়নি। বহুত্ববাদী মার্কসবাদীরা এই বিষয়টির উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তদনুসারে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ প্রাধান্যকারী শ্রেণীর নিয়ন্ত্রণ থেকে অনেকাংশে মুক্ত। মূলধনের স্বার্থের বিরুদ্ধে এই সমস্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে প্রয়োগ করা প্রয়োজন। কিছু দেশে উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য সুপ্রতিষ্ঠিত। এই সমস্ত দেশে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের জন্য উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের উপাদানসমূহকে ব্যবহার করা দরকার। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে প্রতিযোগিতামূলক দলব্যবস্থা, ভোট-বাক্স প্রভৃতির কথা বলা যায়। প্রথমে রাষ্ট্রের উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে হবে এবং তারপর সমাজের পুনর্গঠনের জন্য রাষ্ট্রকে ব্যবহার করতে হবে। এই শ্রেণীর মার্কসবাদীদের মতানুসারে সমাজতান্ত্রিক স্তরে উত্তরণ এবং সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার বিষয়টি হল একটি দীর্ঘ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনীতিক দলগুলি কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করবে।

মৌলবাদী মার্কসবাদীরা মনে করেন যে, আধুনিককালের প্রতিনিধিত্বমূলক রাষ্ট্র হল বিশেষ ধরনের এক পীড়নমূলক শক্তি। এই শক্তি প্রাধান্যকারী আর্থনীতিক শ্রেণীর স্বার্থে সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করে। উদারনীতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এই বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে যে, সমাজব্যবস্থা গণতান্ত্রিকভাবে সংগঠিত হয়। উদারনীতিক গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে মুলধনের মাধ্যমে মজুরী-শ্রমিকদের শোষণের বিষয়টি সুনিশ্চিত করা হয়। নির্দিষ্ট সময় অন্তর নির্বাচনের ব্যবস্থা এই শোষণের প্রক্রিয়াকে পরিবর্তন করে না। সুতরাং গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে শুধুমাত্র রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলেই হবে না। রাষ্ট্রের পীড়নমূলক কাঠামোকে দখল করতে হবে এবং গুঁড়িয়ে দিতে হবে। এই শ্রেণীর মার্কসবাদীরা মনে করেন যে, সমাজতন্ত্রবাদ ও সাম্যবাদে উত্তরণের জন্য দরকার হল সুশৃঙ্খল বিপ্লবী ক্যাডারদের পেশাদার নেতৃত্ব। এই নেতৃত্বই প্রতিবিপ্লবী শক্তিসমূহের বিরুদ্ধে বিপ্লবের প্রতিরক্ষাকে সংগঠিত করতে পারে। এই নেতৃত্বই পারে উৎপাদনের শক্তিসমূহের প্রসারের পরিকল্পনা করতে এবং সমাজের পুনর্গঠনের তদারকি করতে। পার্থক্যমূলক স্বার্থ বলতে শ্রেণী স্বার্থসমূহকেই বোঝায়। সমাজে শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থই হল প্রগতিমূলক স্বার্থ। বিপ্লবের সময় এবং পরে এই স্বার্থের সংরক্ষণ আবশ্যক। তারজন্য অপরিহার্য হল একটি বৈপ্লবিক দল। এই দলই সমাজতন্ত্রবাদ ও সাম্যবাদের কাঠামো গড়ে তুলতে সক্ষম।

উদারনীতিক গণতান্ত্রিক এবং মার্কসীয় চিন্তাধারা উভয়েরই উদ্দেশ্য হল স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের মধ্যে মানুষের বিবিধ স্বার্থ, সামর্থ্য ও আশা-আকাঙ্ক্ষাকে বিকশিত করা। উদারনীতিবাদ এমন একটি জগৎ গড়ে তুলতে চায় যেখানে স্বাধীন ও সমান ব্যক্তিবর্গের বিকাশ ঘটবে। মার্কসবাদ মানুষের স্বাধীন ও সমান বিকাশের জন্য যাবতীয় পীড়নমূলক শক্তিকে দমন করতে চায়। এরকম সাধারণ ও তাত্ত্বিক আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে উদারনীতিবাদ ও মার্কসবাদের মধ্যে উদ্দেশ্যগত সীমাবদ্ধ সাদৃশ্য অস্পষ্টভাবে প্রতিপন্ন হয়। তবে এই দুই চিন্তাধারার মধ্যে অবস্থানগত বহু ও বিভিন্ন মৌলিক পার্থক্য বর্তমান। উদারনীতিবাদের সাধারণ উদ্দেশ্য স্বাধীনতা ও সাম্য। এই সাধারণ উদ্দেশ্যকে উদারনীতিবাদ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী রাজনীতিক, আর্থনীতিক ও নৈতিক মতবাদের সঙ্গে সংযুক্ত করে। বিপরীতক্রমে মার্কসবাদ সামাজিক ও সমষ্টিগত উদ্দেশ্য সাধনের ব্যাপারে অঙ্গীকারবদ্ধ। পুঁজিবাদী বাজার ব্যবস্থায় ব্যক্তি-মানুষের ব্যক্তিগত সন্তুষ্টি অর্জন সম্পর্কিত উদ্যোগ-আয়োজনকে মার্কসবাদে স্বীকার বা সমর্থন করা হয় না। মার্কসীয় দর্শনেও সাম্য ও স্বাধীনতার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়, কিন্তু এই সমস্ত আদর্শের বাস্তবায়নের উপায় হিসাবে ‘শ্রেণী সংগ্রাম’, ‘সর্বহারাদের একনায়কত্ব’, ‘সমাজের সম্পূর্ণ গণতন্ত্রীকরণ’ এবং চূড়ান্তভাবে ‘রাষ্ট্রের অবলুপ্তি’র উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়।

উদারনীতিবাদ ও মার্কসবাদ সাধারণভাবে কিছু ঐকান্তিক উচ্চাভিলাষের অংশীদার। কিন্তু কি অবস্থায় সংশ্লিষ্ট আগ্রহ-আকুলতা বিধিবদ্ধ করা সম্ভব এবং তার সম্প্রসারণের জন্য সহায়ক প্রতিষ্ঠানসমূহ সম্পর্কে উদারনীতিবাদ ও মার্কসবাদ উভয়েরই সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটি-বিচ্যুতি অস্বীকার করা যায় না। উদারনীতিবাদ ও মার্কসবাদের ঐকান্তিক অভিলাষ হল মানুষজনের মধ্যে সাম্য ও স্বাধীনতাযুক্ত সম্পর্কের ভিত্তিতে এক জগৎ গড়ে তোলা। এ ক্ষেত্রে কতকগুলি বিষয় সুনিশ্চিত করার ব্যাপারে আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়। 

  • (ক) প্রত্যেকের প্রকৃতি ও বহুবিধ সামর্থ্যের সম্যক বিকাশের জন্য সর্বোন্নত পরিস্থিতি-পরিমণ্ডল গড়ে তোলা। 

  • (খ) স্বৈরাচারমূলক রাজনীতিক কর্তৃত্ব ও পীড়নমূলক ক্ষমতার হাত থেকে সংরক্ষণ ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা। 

  • (গ) জনজীবনের নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে নাগরিকদের সরাসরি ও সমান সংযোগ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত করা। 

  • (ঘ) নিয়ন্ত্রণমূলক প্রতিষ্ঠানসমূহের স্বীকৃতি ও বৈধকরণের ব্যাপারে ব্যক্তিবর্গের সম্মতির ব্যবস্থা করা। 

  • (ঙ) সম্পদসমূহের লভ্যতাকে সর্বাধিক করার উদ্দেশ্যে আর্থনীতিক সুযোগ-সুবিধার সম্প্রসারণ করা।

বস্তুত উদারনীতিবাদ ও মার্কসবাদ স্বাধিকারের নীতির ব্যাপারে অনেকাংশে অঙ্গীকারবদ্ধ। অর্থাৎ জীবনযাপনের নিয়মনীতি নির্ধারণের ব্যাপারে ব্যক্তিবর্গের স্বাধীনতা ও সমানাধিকার থাকবে। সকলে হবে সমানাধিকার সম্পন্ন এবং সম দায়িত্বযুক্ত। উদারনীতিবাদ ও মার্কসবাদ উভয় মতবাদেই স্বাধিকার বা স্বাধীনতার উপর অগ্রাধিকার আরোপ করা হয়। স্বাধিকার বা স্বাধীনতার উপর অগ্রাধিকার আরোপ করলেও এর বাস্তব রূপায়ণের উপায় পদ্ধতির ব্যাপারে উদারনীতিবাদ ও মার্কসবাদের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য বর্তমান। স্বভাবতই স্বাধিকারের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে উদারনীতিবাদ ও মার্কসবাদের মধ্যে মৌলিক পার্থক্যের অস্তিত্ব অনস্বীকার্য। ডেভিড হেল্ড তাঁর Political Theory and the Modern State শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বলেছেন: “The principle of autonomy can only be realized adequately if we take seriously some of the central prescriptions, and thus some of the central arguments, of both liberalism and Marxism. Equality and liberty- the interconnections of which the principle tries to specify-can only be advanced if one appreciates the complementarity of liberalism’s scepticism about economic power.”

উদারনীতিবাদ কতকগুলি বিষয় গড়ে তোলার ব্যাপারে আগ্রহী। এই বিষয়গুলি হল সার্বভৌম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, ক্ষমতা কেন্দ্রসমূহের বৈচিত্র্য, উন্মুক্ত ভূবন, তথাকথিত উন্মুক্ত বাজার ব্যবস্থার অস্তিত্বের মাধ্যমে। বহুত্ববাদী ব্যবস্থা ও বিতর্কের মধ্যে সম্যক সামঞ্জস্য বিধান বা আপসরফা। এই সমস্ত বিষয়ের অপরিহার্যতার সৃষ্টি হয় অন্য কতকগুলি বিষয়ের অস্তিত্বের দ্বারা। এ বিষয়গুলি হল লিপিবদ্ধ সম্মিলিত শক্তি ও বহুজাতিক সংস্থাসমূহ, বাণিজ্যিক ও ব্যাঙ্কিং সংস্থাসমূহের সংযুক্তি এবং ক্ষমতাগোষ্ঠীগুলির মধ্যে রাজনীতিক ও অর্থনীতিক প্রতিযোগিতা।

সমন্বয় সাধনের ক্ষেত্রে বাজারকে ক্ষমতাহীন উপায় হিসাবে দেখা এবং গণতন্ত্রের পরিপ্রেক্ষিতে আর্থনীতিক ক্ষমতার বিকৃতিসাধনমূলক প্রকৃতিকে অবহেলা করা যদি উদারনীতিবাদের মূল্য অসাফল্য হয়, তা হলে মার্কসবাদের মুখ্য ব্যর্থতা হিসাবে কতকগুলি বিষয় উল্লেখযোগ্য। এই বিষয়গুলি হল আর্থনীতিক ক্ষমতার কাছে রাজনীতিক ক্ষমতার খবীকরণ, কেন্দ্রীভূত রাজনীতিক ক্ষমতার বিপদসমূহকে উপেক্ষা এবং রাজনীতিক দায়বদ্ধতার সমস্যাসমূহ। আধুনিককালে পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মার্কসীয় দর্শন অনুসৃত হয়েছে। তার ফলশ্রুতিস্বরূপ কতকগুলি বিষয় প্রকট হয়ে পড়েছে। এই বিষয়গুলি হল কেন্দ্রীভূত আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার বিকাশ; প্রগতিশীল রাজনীতিক শক্তিসমূহের প্রতিনিধিত্বের ব্যাপারে দাবি ম্লান হয়ে যায় বাস্তবে আমলাতন্ত্র, নজরদারী, ঊর্ধ্বাধঃ স্তরবিন্যাস ও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে সমাজতন্ত্রের সম্পর্কের দ্বারা। সুতরাং বাজার ও আর্থনীতিক ক্ষমতার প্রকৃতি সম্পর্কিত উদারনীতিবাদের বক্তব্য বিরোধ বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। অনুরূপভাবে আবার গণতন্ত্রের প্রকৃতি সম্পর্কিত মার্কসীয় দর্শনের ভাষ্য সন্দেহাতীত নয়। হেল্ড তাঁর Political Theory and the Modern State শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “…liberalism’s account of the nature of markets and economic power must be doubted while Marxism’s account of the nature. of demoracy must be questioned”.

কতকগুলি ক্ষেত্রে উদারনীতিবাদ ও মার্কসবাদ উভয়েরই সীমাবদ্ধতা পরিলক্ষিত হয়। গণতান্ত্রিক রাজনীতিক জীবনে পরিপূর্ণ অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে কিছু প্রতিবন্ধকতা আছে। এই প্রতিবন্ধকতাগুলিকে সম্যকভাবে অনুসন্ধান ও চিহ্নিত করতে এই দুই রাজনীতিক ধারা ব্যর্থ হয়েছে। রাষ্ট্র ও আর্থনীতিক শক্তিসমূহ কর্তৃক আরোপিত বাধা-নিষেধের বিষয়টি এখানে ধরা হয় নি। ‘রাজনীতিক’ (the political) সম্পর্কিত ধারণাগত সংকীর্ণতার মধ্যেই নিহিত আছে অসুবিধার আসল কারণ। উদারনীতিক চিন্তাধারার ঐতিহ্য অনুযায়ী ‘রাজনীতিক কথাটি কেবলমাত্র সরকারী দুনিয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত। সরকারী ক্রিয়াকর্ম ও সরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের বাইরে আর কোন কিছুই রাজনীতিক এই ধারণার অন্তর্ভুক্ত হয় না। রাজনীতি অর্থনীতি ও সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্ক রহিত বলে প্রতিপন্ন হয়। রাজনীতির একটি বৃহৎ ক্ষেত্র এই ধারণার বাইরে থেকে যায়।

‘রাজনীতি’ সম্পর্কিত মার্কসীয় ধারণাও এই সীমাবদ্ধতা দোষে দুষ্ট। মার্কসবাদীরা অর্থনীতির সংগঠনকে অরাজনীতিক বলেন না। মার্কসবাদীরা এও বলেন যে, ক্ষমতার প্রকৃতি ও বণ্টনের ক্ষেত্রে উৎপাদন সম্পর্কের বিষয়টি তাৎপর্যপূর্ণ। এতদ্‌সত্ত্বেও চূড়ান্ত বিচারে রাজনীতির ধারণা প্রসঙ্গে মার্কসবাদের সীমাবদ্ধতা অনস্বীকার্য। কারণ মার্কসবাদ রাজনীতিক ও আর্থনীতিক জীবনের মধ্যে সরাসরি সম্পর্কের উপর জোর দেয়। আর্থনীতিক ক্ষমতা ও শ্রেণী-ক্ষমতার কাছে রাজনীতিক ক্ষমতাকে মার্কসবাদ খর্ব করে এবং রাজনীতির অবসানের কথা বলে। মার্কসবাদ কিছু কিছু বিষয়কে রাজনীতির এক্তিয়ারের বাইরে রাখার ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়। এ প্রসঙ্গে ডেভিড হেল্ড মন্তব্য করেছেন: “This is true of all those issues which cannot in the last analysis, be reduced to class-related matters. Classic examples of this are the domination of nature by industry (which raises ecological questions), of women by men, and of certain racial and ethnic group by others.”

‘রাজনীতিক’ সম্পর্কিত ধারণাগত সংকীর্ণতার কারণে উদারনীতিবাদ ও মার্কসবাদ স্বাধিকারের নীতি সম্যকভাবে অনুধাবনের ক্ষেত্রে সফল হয়নি। আর্থনীতিক জীবন সংগঠনের ক্ষেত্রে সমানাধিকার ও সমদায়িত্ব সম্পর্কিত শর্তাবলীর ব্যাপারে উদারনীতিবাদ নীরব। তেমনি পরিবার ব্যবস্থা, সন্তান প্রতিপালন ও আনুষঙ্গিক বিষয়াদির ব্যাপারে সমানাধিকার ও সমদায়িত্ব প্রসঙ্গে উদারনীতিবাদ বা মার্কসবাদ আগ্রহ দেখায়নি। ডেভিড হেল্ড বলেছেন: “In order to grasp the diverse conditions necessary for the adequate institutionalization of the principle of autonomy, we need a broader conception of the political’ than is found in either of these perspectives- a conception which emphasizes that politics is about power; that is to say, about the ‘transformative capacity’ of social agents, agencies and institutions, about the forces which influence and reflect its distribution and use, and about the effect of this on resource use and distribution.”