গোষ্ঠীগত দৃষ্টিভঙ্গীতে গোষ্ঠী (Group)-কে কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয় হিসাবে গণ্য করা হয়। অর্থাৎ এই তত্ত্বে ব্যক্তি ও সমাজকে আলোচ্য বিষয় হিসাবে বিবেচনা করা হয় না। এই কারণে বহুত্ববাদীদের (Pluralists) বক্তব্যের মধ্যেই গোষ্ঠীগত দৃষ্টিভঙ্গীর মূল নিহিত আছে।

মূল বক্তব্য: গোষ্ঠীগত দৃষ্টিভঙ্গীতে রাষ্ট্রনৈতিক চলমান অবস্থা বা ক্রমাগ্রসরণকে গোষ্ঠীসমূহের পারস্পরিক প্রতিক্রিয়া হিসাবে গণ্য করা হয়। এবং রাষ্ট্রনৈতিক জীবনকে গোষ্ঠীজীবন হিসাবে ব্যাখ্যা করা হয়। বলা হয় যে, গোষ্ঠীকে বিশ্লেষণ করা হলে সব কিছুই স্পষ্ট হয়ে উঠবে। সরকারের সকল বিষয়ই গোষ্ঠীগত বিষয়। বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পরিক প্রতিক্রিয়া; নতুন গোষ্ঠীসমূহের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের প্রয়াস—এ সবই সরকার সম্পর্কিত যাবতীয় ঘটনার অঙ্গীভূত। রাজনীতিক জীবন বলতে গোষ্ঠী জীবনকে বোঝায়। বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠী বিশেষতঃ স্বার্থান্বেষী বা চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলির ভূমিকা পর্যালোচনা না করলে বোঝা যাবে না কি অবস্থার মধ্যে সরকার নীতি প্রণীত ও প্রযুক্ত হয়। রাজনীতিক আচরণ, কার্যাবলী ও বিষয়ের আলোচনা বিভিন্ন গোষ্ঠী বা সংঘের কার্যাবলীর পর্যালোচনার মাধ্যমে করা যেতে পারে। এই মতবাদের প্রবক্তারাও আচরণবাদীদের মতই সামাজিক অস্তিত্ব ও ভারসাম্য রক্ষার ব্যাপারে আগ্রহী। এই শ্রেণীর রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে স্বয়ংক্রিয় এক ব্যবস্থার কথা বলেছেন। তাঁরা দেখিয়েছেন যে সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠী সংকীর্ণ আত্মস্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতে নিরন্তর দ্বন্দ্বের সামিল হয়। এরই মধ্যে সমাজের অস্তিত্ব ও ভারসাম্য বজায় থাকে।

এই মতবাদের প্রবক্তা হিসাবে আর্থার বেন্টলি, ডেভিড ট্রুম্যান, কী (V. O. Key) এবং লোথাম-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

বেন্টলির ব্যাখ্যা: আর্থার বেন্টলি ১৯০৮ সালে প্রকাশিত তাঁর The Process of Government শীর্ষক গ্রন্থে এই পদ্ধতি ব্যাখ্যা করেছেন। বেন্টলি গোষ্ঠীগত আলোচনার ক্ষেত্রে সংখ্যায়ন (quanti-fication) -এর উপর জোর দিয়েছেন। তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় নতুন বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি প্রয়োগের পক্ষপাতী। তথ্য ও পরিমাপের সাহায্যে তিনি রাজনীতিক প্রক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন। তাঁর মতানুসারে গোষ্ঠীর কাজকর্মের মধ্যে পরিমাপযোগ্য (measurable) বিষয় অনুসন্ধান করতে হবে।

বেন্টলির অভিমত অনুসারে নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তির মধ্যে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার উপাদান পাওয়া যাবে না। সংঘবদ্ধ ব্যক্তিবর্গের মধ্যেই এই সমস্ত উপাদান বর্তমান। সংঘবদ্ধ কার্যকলাপ (mass activity) -এর মধ্যেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার উপাদান থাকে। আবার গোষ্ঠীই হল সংঘবদ্ধ কার্যকলাপ। ব্যক্তির আচরণের ফল হল কার্যকলাপ। কার্যকলাপকে মানুষের মধ্যে এক বিশেষ সম্পর্ক হিসাবে দেখা হয়। বেণ্টলি গোষ্ঠীকে ব্যক্তির সমষ্টি হিসাবে দেখেননি। তিনি গোষ্ঠীকে কার্যকলাপের সমষ্টি হিসাবে দেখেছেন। তিনি রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানের উপর জোর দেননি। রাজনীতিক প্রক্রিয়া (political process) ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের উপর জোর দিয়েছেন। বেণ্টলি গোষ্ঠীকে একটি প্রক্রিয়ার প্রতিনিধি হিসাবে বিবেচনা করেছেন। গোষ্ঠী যেমন কোন স্থায়ী সংস্থা নয়, তেমনি এর গঠনের ধরনও অপরিবর্তনীয় নয়।

বেণ্টলির মতানুসারে সকল ক্রিয়াকলাপের নিয়ন্ত্রণকারী শক্তি হল স্বার্থ (Interest)। স্বার্থ বলতে তিনি অংশীদারী মনোভাব (shared attitude)-কে বুঝিয়েছেন যা কোন সামাজিক ব্যবস্থার মধ্যে এক গোষ্ঠীর উপর আর এক গোষ্ঠীর দাবির সঙ্গে যুক্ত। বিভিন্ন গোষ্ঠী গড়ে ওঠার মূলে এই স্বার্থ কাজ করে।

বেন্টলির মতানুসারে গোষ্ঠীর পারস্পরিক প্রতিক্রিয়ার উপর রাজনীতিক ধারা নির্ভরশীল। এই দৃষ্টিভঙ্গী অনুসারে রাজনীতিক জীবন হল একটি গোষ্ঠীজীবন। বেন্টলি গোষ্ঠীকে স্বার্থের দ্বারা পরিচালিত কার্যকলাপের সমষ্টি হিসাবে দেখেছেন। সমাজের সকল স্বার্থই গোষ্ঠীর মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। গোষ্ঠীর সৃষ্টি হয় স্বার্থকে কেন্দ্র করেই এবং সমাজের মধ্যে বর্তমান প্রতিটি স্বার্থই কোন-না-কোন গোষ্ঠীর মাধ্যমে ব্যক্ত হয়। বেন্টলির মতে সমাজ, সরকার, প্রশাসন, আইন প্রণয়ন, রাজনীতি প্রভৃতি হল বিভিন্ন গোষ্ঠীর কার্যকলাপ ও প্রতিক্রিয়ার ফল। তাঁর অভিমত হল, গোষ্ঠীকে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করলে সব কিছুই বিশ্লেষণ করা হয়ে যায় (when groups are adequately stated, everything is stated.)। প্রত্যেক গোষ্ঠী অপরাপর গোষ্ঠীসমূহের কার্যকলাপের পরিপ্রেক্ষিতে স্ব স্ব কার্যধারা ও নীতি নির্ধারণ করে এবং প্রতিটি গোষ্ঠী অন্যান্য গোষ্ঠীর উপর স্বার্থগত চাপ সৃষ্টি করে থাকে। বিভিন্ন গোষ্ঠীর ক্ষমতার মধ্যে এইভাবে এক ভারসাম্যের সৃষ্টি হয়। তার ফলে সমাজের ভারসাম্য বজায় থাকে। এই ভারসাম্যকে বেন্টলি ‘গোষ্ঠী-চাপের ভারসাম্য’ (balance of the group pressures) বলেছেন। গোষ্ঠীকেন্দ্রিক আলোচনার ক্ষেত্রে বেণ্টলি সংখ্যায়ন (quantification) -এর উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।

ট্রুম্যানের ব্যাখ্যা: ডেভিড ট্রুম্যান ১৯৫১ সালে প্রকাশিত তাঁর The Governmental Process শীর্ষক গ্রন্থে গোষ্ঠীকেন্দ্রিক বিশ্লেষণধারা ব্যাখ্যা করেছেন। অনেকে টুম্যানের বিশ্লেষণকে ‘রাজনীতির গোষ্ঠীগত মতবাদ’ হিসাবে উল্লেখ করেন। ডেভিড ট্রুম্যানের মতানুসারে, গোষ্ঠী হল এক বা একাধিক অংশীদারী মনোবৃত্তির দ্বারা পরিচালিত সমাজের বহুসংখ্যক ব্যক্তির সমষ্টি। তাঁর মতে রাজনীতিক প্রতিক্রিয়া গোষ্ঠীসমূহের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া মাত্র। তাই গোষ্ঠীর কার্যকলাপ পর্যালোচনার মাধ্যমে রাজনীতিক প্রক্রিয়ায় গৃহীত সিদ্ধান্ত ও নীতিসমূহের প্রকৃতি পর্যালোচনা করা যাবে। ট্রুম্যান মনে করেন যে, একই ব্যক্তি একই সঙ্গে বিভিন্ন গোষ্ঠীর সদস্য থাকে। তার ফলে গোষ্ঠীসমূহের স্বার্থের দ্বন্দ্ব তীব্র হতে পারে না। ফলে সমাজের ভারসাম্যও নষ্ট হয় না। আবার পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে গোষ্ঠীগুলি আচার-আচরণের একটা বিশেষ মান অনুসরণ করে। তার ফলেও সমাজের ভারসাম্য বজায় থাকে। টুম্যানের মতানুসারে আনুষ্ঠানিক সংগঠনের উপর গোষ্ঠী বা স্বার্থের অস্তিত্ব নির্ভরশীল নয়। গোষ্ঠীর প্রতিক্রিয়ার একটি অধ্যায় হল আনুষ্ঠানিক সংগঠন। গোষ্ঠীর গঠন ও তার আভ্যন্তরীণ বিষয়ের উপর ট্রুম্যান জোর দেননি।

লোথাম তাঁর The Group Basis of Politics গ্রন্থে গোষ্ঠীগত দৃষ্টিভঙ্গী ব্যাখ্যা করেছেন। লোথামের মতানুসারে সমাজ হল একটি গোষ্ঠীর জগৎ। এখানে বিভিন্ন গোষ্ঠী যেমন একত্রিত হয়, তেমনি আবার ভেঙে যায়। গোষ্ঠীগুলি এইভাবে অবিরাম ক্ষমতার জোট গঠন করে এবং একত্রিতভাবে সমাজে থাকে। সমাজের গতি অব্যাহত থাকে গোষ্ঠীগুলির বিরোধ ও প্রতিরোধের মাধ্যমে। আবার ভি. ও. কী তাঁর Politics, Parties and Pressure Groups গ্রন্থে গোষ্ঠীগত দৃষ্টিভঙ্গী পর্যালোচনা করেছেন। তিনি গোষ্ঠীর আনুষ্ঠানিক সংগঠনের উপর জোর দেননি।

এই দৃষ্টিভঙ্গীর সমর্থকদের মতানুসারে বিভিন্ন গোষ্ঠী যদি পারস্পরিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সফল না হয়, বা সরকার যদি গোষ্ঠীসমূহের বিরোধের মধ্যস্থতায় সফল না হয়, তা হলে নতুন গোষ্ঠীর উদ্ভব হবে এবং এই গোষ্ঠী ভারসাম্য রক্ষা করবে। সমাজের অস্তিত্ব ও ভারসাম্য অর্থাৎ স্থিতিশীলতা রক্ষার ব্যাপারে গোষ্ঠীকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গীর প্রবক্তারা অত্যন্ত আগ্রহী।

সমালোচনা (Criticism): গোষ্ঠীগত দৃষ্টিভঙ্গীর সমালোচকরা এর বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কথা বলেছেন।

(১) এই মতবাদের প্রবক্তারা গোষ্ঠীর ধারণাকে যথাযথভাবে ব্যক্ত করতে পারেননি। আর্থার বেন্টলির মতানুসারে গোষ্ঠী হল এক ধরনের সম্পর্ক। এই সম্পর্ক মানুষের সঙ্গে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে। কিন্তু এই সম্পর্কের প্রকৃতি বা ব্যাপকতা সম্পর্কে তিনি বিশদভাবে কিছু বলেন নি। আবার স্বার্থের অর্থও বেণ্টলি ব্যাখ্যা করেননি। ডেভিড ট্রুম্যান-এর মতানুসারে একটি সংগঠিত ব্যক্তি-সমষ্টি হল গোষ্ঠী। এই ব্যক্তি-সমষ্টির মধ্যে কতকগুলি সমজাতীয় বৈশিষ্ট্য থাকে। ট্রুম্যানও এই সমজাতীয় স্বার্থের ধারণাকে ব্যাখ্যা করেননি।

(২) রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় গোষ্ঠীগত পদ্ধতি একটি অসম্পূর্ণ ও সংকীর্ণ পদ্ধতি। এর কার্যকারিতা অতিমাত্রায় সীমাবদ্ধ। কেবলমাত্র গোষ্ঠীগত আলোচনার দ্বারা সমগ্রা রাষ্ট্রনৈতিক জীবনের জটিলতাকে বিশ্লেষণ করার প্রয়াস এক অসম্ভব কল্পনাবিলাস। গোষ্ঠী সমাজের অংশ বিশেষ। একটি অংশ ব্যাখ্যা করে সমগ্র জীবনের পরিচয় পাওয়া যায় না। বিভিন্ন গোষ্ঠীর পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করলেই বহুবিধ রাজনীতিক ঘাত-প্রতিঘাতের ধারণা লাভ করা সম্ভব নয়। সব রকম রাজনীতিক ঘাত প্রতিঘাতকে গোষ্ঠী-প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে বিচার-বিশ্লেষণ করা যায় না। 

(৩) এই তত্ত্বের মাধ্যমে রাষ্ট্রের প্রকৃতির পরিবর্তন সম্পর্কে ও সঠিক বিশ্লেষণ সম্ভব হয় না। এই পদ্ধতিতে সমাজ বা রাষ্ট্রের প্রকৃতিগত পরিবর্তনের কোন বিষয় পর্যালোচনা করা যায় না।

(৪) তত্ত্বটি রক্ষণশীলতা দোষেও দুষ্ট। সমাজের ভারসাম্য ও স্থিতিশীলতা রক্ষার তত্ত্বটি অত্যন্ত আগ্রহী। 

(৫) মার্কসীয় দর্শনের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সাম্যবাদী সমাজ বা যে সমাজে পরস্পর-বিরোধী স্বার্থ-গোষ্ঠী নেই তার বিচার-বিশ্লেষণ এই তত্ত্বের মাধ্যমে করা যাবে না। পরস্পর বিরোধী স্বার্থসম্পন্ন গোষ্ঠী যে সমাজে নেই তার পর্যালোচনা এই পদ্ধতির মাধ্যমে অসম্ভব। 

(৬) এই দৃষ্টিভঙ্গীতে জনমত, নেতৃত্ব, ভূমিকা (role) প্রভৃতি আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়কে উপেক্ষা করা হয়েছে।

(৭) গোষ্ঠীগত আলোচনাকে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের পরিপোষক হিসাবে অভিহিত করা হয়। এই তত্ত্বে সমাজ ও সরকারের আলোচনাকে উপেক্ষা করা হয় এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একমাত্র আলোচ্য বিষয় হিসাবে গোষ্ঠীর কথা বলা হয়।

(৮) গোষ্ঠীকেন্দ্ৰিক আলোচনায় সামাজিক ভারসাম্যের কথা বলা হয়। কিন্তু এই ভারসাম্য কার উদ্যোগে ও কিভাবে বজায় থাকবে তা বলা হয়নি। 

(৯) গোষ্ঠীকেন্দ্রিক আলোচনায় গোষ্ঠী বহির্ভূত ব্যক্তির কার্যকলাপ আসে না। জনগণের রাজনীতিক কার্যকলাপকে এই দৃষ্টিভঙ্গী ব্যাখ্যা করতে পারে না।

(১০) গোষ্ঠীকেন্দ্রিক আলোচনায় গোষ্ঠীর উদ্ভবের আর্থ-সামাজিক পটভূমি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়নি। 

(১১) গোষ্ঠীকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গীর প্রবক্তারা বিভিন্ন গোষ্ঠীর ক্রিয়াকলাপকে মূল্যবোধের একটি নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে আলোচনা করেছেন। ধরে নেওয়া হয়েছে যে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে মতভেদ বা বিরোধ নির্দিষ্ট একটি সীমাকে অতিক্রম করে না।