যোগাযোগতত্ত্বের ভিত্তি: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অনুশীলনে যোগাযোগ তত্ত্বের প্রধান প্রবক্তা হিসাবে জার্মান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ডয়েট্স (Karl Deutsch)-এর নাম প্রখ্যাত। এ বিষয়ে ডয়েট্স-এর দুটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল : The Nerves of Government এবং Nationalism and Social Communication, এই মতবাদের ভিত্তি হল তথ্য সরবরাহ ব্যবস্থা। আত্মনিয়ন্ত্রণকারী যন্ত্রপাতি, কম্পিউটার এবং স্নায়বিক ব্যবস্থার শারীরবৃত্ত সম্পর্কিত তত্ত্ব (a theory of information, self-regulating machines, computers and physiology of the nervous system)। এখানে মানবদেহের মস্তিষ্ক এবং স্বয়ং নিয়ন্ত্রিত বৈদ্যুতিক কম্পিউটারের মধ্যে সাদৃশ্যমূলক বৈশিষ্ট্যের আলোচনা করা হয়। বলা হয় যে, উভয়ই তথ্য সংগ্রহ ও প্রেরণ করতে পারে এবং বিভিন্ন তথ্য ও তত্ত্ব স্মরণ করতে পারে।
সাইবারনেটিক্স: ডয়েট্স তাঁর যোগাযোগ তত্ত্বের প্রেরণা পেয়েছেন ‘সাইবারনেটিকস্’ (Cybernetics) থেকে। রাজনীতিক ব্যবস্থার স্তিত্ব সংরক্ষণ, রাজনীতিক ব্যবস্থার পরিবর্ধন বিশ্লেষণ, রাজনীতিক ব্যবস্থার কাঠামোকে প্রভাবিত করতে সক্ষম সকল পরিবর্তন সম্পর্কে পূর্বাভাস প্রদান প্রভৃতি ক্ষেত্রে ডয়েট্স সাইবারনেটিক্সের ধারণা ও পদ্ধতি প্রয়োগের পক্ষপাতী। এ ক্ষেত্রে তাঁর অন্যতম উদ্দেশ্য হল রাজনীতির সংজ্ঞার অংশ হিসাবে ও রাজনীতিক কার্যকলাপের উপাদান হিসাবে ক্ষমতার গুরুত্বকে খর্ব করা। সামাজিক সংযোগসাধনের সুযোগ-সুবিধার মধ্যেই রাজনীতিক ক্ষমতার মূল উৎস বর্তমান। পেইন (J. P. Paine) এর মতানুসারে সাইবারনেটিক্স হল সংবাদ আদান-প্রদানকারী এক স্বয়ংনিয়ন্ত্রিত গণকযন্ত্র এবং মস্তিস্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের শারীরবৃত্ত সংক্রান্ত মতবাদ। তাঁর কথায়: “….a theory of information, self-regulating machines, computers and the physiology of the nervous system.”
মূল প্রতিপাদ্য বিষয়: এই মতবাদ অনুসারে রাষ্ট্রনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং অন্য যে-কোন প্রতিষ্ঠান যোগাযোগ ব্যবস্থার দ্বারা সীমাবদ্ধ। তথ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থার দ্বারাই সরকার পরিচালিত হয়। ডয়েট্সের মতে সরকার সম্পর্কিত আলোচনা মূলতঃ পরিচালনার বিষয় সম্পর্কিত আলোচনা। আর পরিচালনার সমস্যা যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল। তিনি মানুষের স্নায়ুতন্ত্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের যোগাযোগ ব্যবস্থার সাদৃশ্যমূলক আলোচনা করেছেন। তিনি যোগাযোগের সূত্রকে রাজনীতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ, জনসংযোগ সংরক্ষণমূলক ব্যবস্থা, রাজনীতিক ব্যবস্থার অস্তিত্ব সংরক্ষণ, রাজনীতিক ব্যবস্থার পরিবর্ধন, বিশ্লেষণ, মূল্যায়ন, মূল্যবোধ প্রভৃতি ক্ষেত্রে প্রয়োগের ব্যাপারে উৎসাহী। যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে রাষ্ট্রনৈতিক ব্যবস্থা কিভাবে তার উদ্দেশ্য পূরণ করে এবং কিভাবে তার অস্তিত্ব ও স্থায়িত্ব সংরক্ষণের চেষ্টা করে তার পর্যালোচনা করাই এই তত্ত্বের মুখ্য লক্ষ্য।
ডয়েট্স সংযোগ সাধনের সূত্র ও প্রবাহের উপর জোর দিয়েছেন। তাঁর মতবাদের মূল বক্তব্য হল এই যে সংযোগ সাধনের ব্যবস্থা প্রসারণশীল। এই ব্যবস্থায় সুষ্ঠু পরিচালনার সঙ্গে রাজনীতিক ব্যবস্থার সংহতি সম্পর্কযুক্ত। ডয়েট্স রাজনীতিক তত্ত্বের আলোচনায় ইস্টনের মত ‘ফিডব্যাক’ (feedback) বা তথ্য ও অভিজ্ঞতা প্রেরক পথের ধারণাকে সংযুক্ত করেছেন। এর উদ্দেশ্য হল মতবাদটিকে গতিশীল করা। ফিডব্যাক হল সংযোগ সাধনের একটি সূত্র। এই সূত্রের মাধ্যমে বিগত সিদ্ধান্তের ফলাফল সম্পর্কিত তথ্যাদি সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের কাছে আসে। তারফলে তাদের ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সাহায্য হয়।
সমালোচনা (Criticism): যোগাযোগ তত্ত্ব-ভিত্তিক বিশ্লেষণধারাও বিরূপ সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে।
(১) ডয়েট্সের যোগাযোগ তত্ত্ব রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় তেমন কোন মৌলিক দিক সংযুক্ত করেনি।
(২) রাষ্ট্রনৈতিক ব্যবস্থার লক্ষ্য সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে এই মতবাদ একেবারেই আলোকপাত করতে পারেনি। রাজনীতিক ব্যবস্থার উদ্দেশ্য কি হওয়া বাঞ্ছনীয় সে বিষয়ে এই মতবাদে কোন উল্লেখ নেই।
(৩) এই তত্ত্বের দ্বারা কোন রাষ্ট্রনৈতিক ব্যবস্থার স্বরূপ ব্যাখ্যা করা যায় না।
(৪) এই তত্ত্ব স্থিতাবস্থা বজায় রাখার পক্ষে। তাই এই তত্ত্ব রক্ষণশীলতা দোষেও দুষ্ট। কোন একটি রাজনীতিক ব্যবস্থা কিভাবে সাফল্যের সঙ্গে সংকটের সমাধান করে এবং অস্তিত্ব সংরক্ষণের সামর্থ অর্জন করে এই তত্ত্বে সে বিষয়েই আলোচনা করা হয়েছে। কোন কোন সমালোচক এই মতবাদটির রক্ষণশীলতার ব্যাপারে সুস্পষ্ট অভিমত জ্ঞাপন করেছেন। তাঁদের মতানুসারে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরবর্তী পর্যায়ে ইওরোপ ও আমেরিকায় আর্থ-সামাজিক ও রাজনীতিক ক্ষেত্রে তীব্র সংকটের সৃষ্টি হয়। আলোচ্য তত্ত্বটি সংশ্লিষ্ট সংকট নিবারণ ও রাজনীতিক স্থিতাবস্থা সংরক্ষণের ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছে।
(৫) কোন রাজনীতিক ব্যবস্থায় বিভিন্ন উপ-ব্যবস্থা ও বিভিন্ন গোষ্ঠীর উদ্দেশ্যের মধ্যে সংঘাতের সৃষ্টি হলে তার সমাধান সম্পর্কে বা রাজনীতিক ব্যবস্থার পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে এই তত্ত্বে কোন উল্লেখ নেই।
(৬) শাসকশ্রেণীর প্রকৃতি এবং সামাজিক শক্তির বিন্যাস রাজনীতিক কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্যকে প্রভাবিত করে এ বিষয়ে এ তত্ত্বে কোন আলোচনা নেই। কোন কোন মার্কসবাদী সমালোচকদের মতে এই তত্ত্বের অন্যতম উদ্দেশ্য হল মার্কসীয় দর্শনের সার্বজনীন আবেদনকে ক্ষুণ্ণ করা।
ডয়েট্স-এর সংযোগসাধনের তত্ত্বের সীমাবদ্ধতাকে অস্বীকার করা যায় না। এতদ্সত্ত্বেও এই তত্ত্ব রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় নতুন ধারণা ও কলাকৌশল প্রবর্তন করেছে। এ দিক থেকে মতবাদটির অবদানকে অস্বীকার করা যায় না।
Leave a comment