মূল্য বক্তব্য: নূতন রাষ্ট্রনৈতিক-অর্থনৈতিক মতবাদে রাষ্ট্রনৈতিক ক্রিয়াকলাপকে অর্থনীতির বিনিময় ব্যবস্থার সঙ্গে তুলনা করা হয়। রাজনীতিক বিষয়কেই এই মতবাদের প্রবক্তারা তাঁদের মুখ্য আলোচ্য বিষয় হিসাবে গণ্য করেছেন। তবে রাজনীতিক বিষয়কে বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তাঁরা অর্থনীতির আলোচনার পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন। এই তত্ত্বে মুখ্য আলোচ্য বিষয়সমূহ হল সরকারের বাজেট, দ্রব্য ও সেবা, জাতীয় আয়, জাতীয় আয়ের বণ্টন ও পুনর্বণ্টন, শ্রমিকদের রাজনীতিক মতামত সংগঠন প্রভৃতি। এক্ষেত্রে ব্যক্তিকে আলোচনার কেন্দ্র হিসাবে গণ্য করা হয়। প্রত্যেক ব্যক্তি ও সংগঠন নিজের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য লেনদেন বা বিনিময় ব্যবস্থার আশ্রয় গ্রহণ করে। এই লেনদেন চলে নিজেদের মধ্যে এবং রাজনীতিক দল ও সরকারের সঙ্গে। লেনদেন-এর ক্ষেত্রে দর-কষাকষির ক্ষমতা বৃদ্ধি করার জন্য প্রত্যেক ব্যক্তির কাজ ও পছন্দ অন্যান্যের কাজ ও পছন্দের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। প্রত্যেকে তার ব্যয়ের পরিমাণ হ্রাস করে লাভের অঙ্ক বৃদ্ধি করতে চেষ্টা করে। ব্যক্তির কার্য সহযোগিতামূলক বা প্রতিযোগিতামূলক হতে পারে। ব্যক্তি নিজের স্বার্থ রক্ষার জন্য অপরের সঙ্গে সহযোগিতা করে। আবার দরকষাকষির শর্ত নিয়ে ব্যক্তি প্রতিযোগিতা করে। যে-কোন ব্যক্তির কাজ ও পছন্দ নির্ভর করে অন্যান্য ব্যক্তির কাজ ও পছন্দের উপর। বস্তুত বিনিয়োগ অথবা লেনদেনের ক্ষেত্রে যে-কোন ব্যক্তির কাজ ও পছন্দ অপরের কাজ ও পছন্দের উপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ এক্ষেত্রে ব্যক্তির কাজ ও পছন্দ স্ব-নির্ভর বা সম্পূর্ণ স্বাধীন নয়। ভোটও হল টাকার মত বিনিময়ের এক পদ্ধতি বিশেষ। ভোটের মাধ্যমে ভোটদাতা ও ভোটপ্রার্থীর স্বার্থের বিনিময় হয়ে থাকে। আর সরকারের উদ্দেশ্য হল অধিক সম্পদ ও সমর্থন সংগ্রহ করা। সামঞ্জস্য বিধানও হল সরকারের একটি অন্যতম লক্ষ্য। এই তত্ত্বে সামাজিক কল্যাণ সাধন সম্পর্কেও আলোচনা করা হয়।
এই মতবাদের মুখ্য প্রবক্তাদের মধ্যে বুচানন (Buchanan), ডেভিস (Davis), ব্ল্যাক (Black), টুলক (Tullock), রথেনবার্গ (Rothenberg), মিচেল (William C. Mitchel) প্রমুখ ব্যক্তির নাম উল্লেখযোগ্য। মিচেল রাজনীতিক পর্যালোচনার ক্ষেত্রে অর্থনীতির পদ্ধতিসমূহের প্রয়োগকে ‘নতুন রাজনীতিক অর্থতত্ত্ব’ (New Political Economy) হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। মিচেল সরকারের বাজেটকে রাজনীতিক দলিল হিসাবে বিবেচনা করার পক্ষপাতী। প্রতিযোগিতামূলক বিভিন্ন উদ্দেশ্যের মধ্যে রাজনীতিক ব্যবস্থা ও ব্যক্তি সীমাবদ্ধ সম্পদের বণ্টনের ক্ষেত্রে তাদের পছন্দকে প্রয়োগ করে। মিচেল এই বিষয়টিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষপাতী। The Calculas of Consent শীর্ষক গ্রন্থে বুচানান ও টুলক রাজনীতিক পদ্ধতিকে বিনিময়ের পদ্ধতি হিসাবে প্রতিপন্ন করেছেন।
মতবাদটির ব্যাখ্যা: ধনবিজ্ঞানের মত রাষ্ট্রবিজ্ঞানেও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল সম্পদের বণ্টন ও সামাজিক কল্যাণ সাধন। আলোচ্য তত্ত্বে সমষ্টিগতভাবে রাজনীতিক ব্যবস্থার আয়, সুযোগ-সুবিধা, সম্পদের বণ্টন, সর্বাধিক সামাজিক কল্যাণ প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা করা হয়। এই তত্ত্বের প্রবক্তাদের মতে রাজনীতিক সিদ্ধান্ত পণ্য বিনিময়ের মতই। কারণ তার জন্য অর্থ ব্যয় করতে হয় এবং তার মাধ্যমে স্বার্থসিদ্ধ হয়। তাই রাজনীতিক কাঠামোর উপর রাজস্ব, বাজেট প্রভৃতি বিষয়ের প্রতিক্রিয়া ও সে-বিষয়ে সরকারী সিদ্ধান্তের ফল রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আলোচনা করা হয়ে থাকে। মিচেল-এর মতানুসারে সরকারের উদ্দেশ্য হল সমর্থন, আনুগত্য ও সম্পদ লাভ। অপরদিকে নাগরিকের উদ্দেশ্য হল সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি এবং কষ্ট লাঘব করা।
সমালোচনা (Criticism): এই মতবাদও সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। আলোচ্য মতবাদটির সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে নানা কথা বলা হয়।
(১) অসম্পূর্ণ মতবাদ: রাষ্ট্রনৈতিক ক্ষেত্রে এই তত্ত্ব প্রয়োগ করার সুযোগ আছে ঠিকই, কিন্তু সকল রাষ্ট্রনৈতিক ক্রিয়াকলাপকে পণ্যবিনিময় ব্যবস্থার সঙ্গে তুলনা করা অসঙ্গত।
(২) রাজনীতিক কার্যমাত্রেই পণ্য বিনিময় নয়: মিচেলও এই মন্তব্যটির সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। এই পদ্ধতিতে সকল রাষ্ট্রনৈতিক ব্যবস্থার প্রকৃতি বিশ্লেষণ করা যায় না। এই তত্ত্বে কেবল গণতান্ত্রিক রীতিনীতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। অন্যান্য রাজনীতিক ব্যবস্থায় এই মতবাদ প্রয়োগ করা যায় কিনা, তা আলোচনা করা হয়নি। কার্যতঃ রাষ্ট্রনৈতিক ক্ষেত্রে এ হল এক অসম্পূর্ণ ও সংকীর্ণ তত্ত্ব।
(৩) রাষ্ট্রবিজ্ঞানের স্বাতন্ত্র্য হ্রাস: ধনবিজ্ঞানের ধারণাগুলির ভিত্তিতে সহজ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এভাবে সব সময় সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব নয়। সকল রাজনীতিক কার্যকে পণ্য বিনিময়ের সমান হিসাবে গণ্য করা যায় না। নির্বাচক ও বাজারের ক্রেতার উদ্দেশ্য এবং পছন্দের সমস্যা এক রকমের নয়।
(৪) ম্যাকেঞ্জীও এই মতবাদের সমালোচনা করেছেন। এই দৃষ্টিভঙ্গীতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্য বস্তুর এক উল্লেখযোগ্য অংশ অর্থনীতির অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছে। তার ফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের স্বাতন্ত্র্য হ্রাস পেয়েছে। এই কারণে এক অদ্ভুত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
(৫) বলও আলোচ্য মতবাদটির সমালোচনা করেছেন। রাজনীতিক বিচার-বিশ্লেষণের তত্ত্বের প্রয়োগ রাজনীতিক সমাজতত্ত্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতা হিসাবে প্রতিপন্ন হয়। তারফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক অস্তিত্বের ক্ষেত্রে এক শ্লেষাত্মক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে।
সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও মতবাদটির গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। এর আগে কখনো ব্যক্তিগত বা রাজনীতিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে চাহিদা যোগানের আলোচনার প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয় না। সুতরাং এক্ষেত্রে নতুন রাজনীতিক অর্থতত্ত্বের উদ্যোগ হল অভিনব। এই মতবাদে ব্যক্তিগত স্তরেও সম্পদ বণ্টনের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তা ছাড়া রাজনীতিক স্থায়িত্ব, সামঞ্জস্য সাধন, অর্থনৈতি দায়িত্বের বণ্টন, সুযোগ-সুবিধার বণ্টন, আয় ও মর্যাদা প্রভৃতি বিষয়কেও এই মতবাদের আলোচ্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
Leave a comment