বিভিন্ন দিক থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গীর সমালোচনা করা হয়।
(১) পরিমাপ ও সংখ্যাতত্ত্বের অতি-প্রয়োগ অর্থহীন: আধুনিক বিশ্লেষণধারায় পরিমাপ, পরিসংখ্যান, রেখাচিত্র প্রভৃতির ব্যাপক প্রয়োগ পরিলক্ষিত হয়। এ সবের উদ্দেশ্য হল আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনাকে বিজ্ঞানসম্মত করে তোলা। এই সমস্ত পন্থা-পদ্ধতির মাধ্যমে ভৌত বিজ্ঞানের সুনির্দিষ্ট এবং সর্বজনগ্রাহ্য সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়। একথা ঠিক। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় ভৌত বিজ্ঞানের এই সমস্ত বিশ্লেষণধারার কার্যকারিতা বিতর্ক ও সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। এভাবে রাজনীতিক অভিজ্ঞতাকে যথাযথভাবে প্রতিপন্ন করা যায় না। সমাজবদ্ধ মানুষের রাজনীতিক জীবনধারার বিভিন্ন দিক আছে। এক্ষেত্রে পরিমাপ ও সংখ্যাতত্ত্বের সাহায্যে সংগৃহীত তথ্যাদি কতদূর নির্ভরযোগ্য সে বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। অনেকের মতানুসারে মাত্রাতিরিক্ত তত্ত্ব গঠনের উদ্যোগ এবং পরিমাপের প্রয়োগ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনাকে অবাস্তব ও বিদ্রূপাত্মক করে তুলেছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনাকে বিজ্ঞানসম্মত করে তোলার পরিবর্তে একে বাস্তব জীবনের সঙ্গে সম্পর্ক রহিত ও হাস্যকর করে তুলেছে।
(২) রক্ষণশীল: মানুষের রাজনীতিক জীবন হল পরিবর্তনশীল এবং গতিশীল— মোটেই স্থিতিশীল নয়। কিন্তু আধুনিক বিশ্লেষণধারাগুলি বিশেষভাবে রক্ষণশীল। এই সমস্ত মতবাদ কেবল স্থিতাবস্থার ব্যাপারেই অধিক আগ্রহ দেখায়। তাই এর দ্বারা রাজনীতিক পরিবর্তনকে ব্যাখ্যা করা যায় না। অথচ পরিবর্তন ও গতিশীলতা হল রাজনীতিক জীবন ও ব্যবস্থার ধর্ম। আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গীতে একে অস্বীকার করা হয়েছে। বস্তুত আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গীগুলি উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে নিয়েই ব্যস্ত। এই সমস্ত দৃষ্টিভঙ্গীর প্রবক্তাদের মধ্যে যাবতীয় উদ্যোগ আয়োজনের উদ্দেশ্য হল একটি বিশেষ রাজনীতিক ব্যবস্থাটির পৃষ্ঠপোষকতা।
(৩) রাষ্ট্রহীন ও দর্শনহীন আলোচনা: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গীগুলিতে রাজনীতিক ব্যবস্থা, রাজনীতিক প্রক্রিয়া প্রভৃতির উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এই সমস্ত বিশ্লেষণধারায় রাষ্ট্র, রাজনীতিক প্রতিষ্ঠান প্রভৃতিকে অবহেলা করা হয়। এই বিশ্লেষণধারাগুলিতে রাষ্ট্রহীন ও দর্শনহীন আলোচনার প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। সমালোচকদের মতানুসারে এই দর্শনহীনতা উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক মতবাদকে সংরক্ষণের কৌশল বিশেষ।
(৪) জটিলতা: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনাকে বিজ্ঞানসম্মত করার নামে আধুনিক বিশ্লেষণধারায় নানা নতুন ও কঠিন পরিভাষা প্রয়োগ করা হয়। এর ফলে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা অকারণে জটিল হয়ে পড়েছে।
(৫) রাজনীতিক মূল্যবোধহীন আলোচনা হয় না: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গীতে মূল্যবোধহীন রাজনীতির উপর জোর দেওয়া হয়। এই সমস্ত মতবাদে মূল্যবোধকে উপেক্ষা করা হয়। এবং মতবাদগুলিতে সংখ্যাতত্ত্ব ও ভৌত বিজ্ঞানের কলাকৌশলের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। নতুন দৃষ্টিভঙ্গীতে পরিমাপ ও সংখ্যাতত্ত্বের উপর গুরুত্ব আরোপের উদ্দেশ্য হল মূল্যবোধকে বর্জন করা। কিন্তু রাজনীতিক আলোচনার ক্ষেত্রে মূল্যবোধকে পুরোপুরি বাদ দেওয়া যায় না। সকল রাজনীতিক মতাদর্শের রাজনীতিক মূল্যবোধের নির্দিষ্ট একটি কাঠামো থাকে। তাই রাজনীতিক ক্ষেত্রে মূল্যবোধহীন আলোচনার পদ্ধতি সার্বজনীনভাবে প্রয়োগ করা কঠিন। বিরুদ্ধবাদীদের মতানুসারে নতুন দৃষ্টিভঙ্গীর প্রবক্তারাও মূল্যবোধহীন নন। তাঁরা উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূল্যবোধের প্রতি বিশেষভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ। আসলে একটি বিশেষ মূল্যবোধের প্রতি অঙ্গীকারকে আড়াল করার জন্যই মূল্যবোধহীনতার অপকৌশল গ্রহণ করা হয়েছে। বিরোধী মূল্যবোধকে পরিহার করার জন্যই তথাকথিত মূল্যবোধহীনতার আশ্রয় গ্রহণ করা হয়েছে।
(৬) আর্থ-সামাজিক ও রাজনীতিক ব্যাখ্যা অবহেলিত: আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গীগুলিতে দৃষ্টবাদের প্রতি গভীর অনুরাগ দেখা যায়। এই সমস্ত মতবাদে তথ্যাদি ও ঘটনার উপর জোর দেওয়া হয় এবং অভিজ্ঞতাবাদী ধারণা ও তত্ত্ব গড়ে তোলা হয়। কিন্তু ঘটনা ও তথ্যের আর্থ-সামাজিক ও রাজনীতিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণকে অবহেলা করা হয়। সুতরাং এ ধরনের উদ্যোগ বাস্তব বা বিজ্ঞানসম্মত বলে বিবেচিত হতে পারে না।
(৭) রাজনীতিক ব্যবস্থার কেবল উপকরণ নিয়ে আলোচনা করে: আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গীগুলিতে রাজনীতিক ব্যবস্থার বিভিন্ন উপকরণের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। কিন্তু আইন, শাসন ও বিচার-বিভাগীয় কাজকর্ম প্রভৃতি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর তেমন জোর দেওয়া হয় না। আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গী নির্দিষ্ট কিছু বিষয়বস্তুর আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। এই সমস্ত বিষয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল নির্বাচন, নির্বাচনী আচরণ, নির্বাচনী রাজনীতিক দল, স্বার্থগোষ্ঠী, রাজনীতিক মতামত ও সংযোগ সাধন প্রভৃতি।
(৮) ভৌত বিজ্ঞানের কলাকৌশল অন্ধভাবে অনুসরণ: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় কেবল ভৌত বিজ্ঞানের কলাকৌশলগুলি অন্ধভাবে প্রয়োগ করা উচিত নয়। কারণ প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের অনুশীলন পদ্ধতি অনুসরণ করলেই কোন সামাজিক বিজ্ঞানের আলোচনা সম্পূর্ণ বিজ্ঞানসম্মত হয়ে যায় না। কোন আলোচনার বিশ্বাসযোগ্যতা কেবলমাত্র কলাকৌশলের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয় না। কোন একটি সামাজিক বিজ্ঞান সমাজের বাস্তব চিত্র কতটা সঠিকভাবে চিত্রিত করতে সক্ষম তার উপর সামাজিক বিজ্ঞানের সার্থকতা ও বৈজ্ঞানিক চরিত্র নির্ভরশীল।
(৯) রাষ্ট্রবিজ্ঞানের স্বাতন্ত্র্যের বিরোধী: আধুনিক বিশ্লেষণধারায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনাকে বিজ্ঞানভিত্তিক করার চেষ্টা করা হয়। এবং তারজন্য আন্তঃ-সামাজিক বিজ্ঞানকেন্দ্রিক আলোচনার উপর জোর দেওয়া হয়। সমাজতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, পরিসংখ্যানতত্ত্ব, মনোবিদ্যা প্রভৃতি শাস্ত্রের সাহায্য গ্রহণ অপরিহার্য মনে করা হয়। এর ফলে স্বতন্ত্র সামাজিক বিজ্ঞান হিসাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পৃথক অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ে। অর্থাৎ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরনির্ভরশীল একটি সামাজিক বিজ্ঞানে পরিণত হওয়ার আশংকা দেখা দেয়।
মূল্যায়ন: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আধুনিক বিশ্লেষণধারার সীমাবদ্ধতাকে অস্বীকার করা যাবে না। তবে সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আধুনিক বিশ্লেষণধারা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অনুশীলনের ক্ষেত্রে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেছে। এর গুরুত্ব ও প্রভাবকে অস্বীকার করা যায় না। আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গীর কোন কোন কলাকৌশল রাজনীতিক আলোচনাকেও সমৃদ্ধ করেছে। প্রকৃত প্রস্তাবে নতুন দৃষ্টিভঙ্গী আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গবেষণাকে সাহায্য করতে সক্ষম। তবে আধুনিক বিশ্লেষণধারায় মাত্রাতিরিক্ত ঘটনা ও তথ্যকেন্দ্রিকতা এবং বৈজ্ঞানিকতার ব্যাপারে সতর্ক হওয়া দরকার।
Leave a comment