যুক্তরাষ্ট্রীয় বা এককেন্দ্রিক যে-কোন শাসনব্যবস্থার মধ্যে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের পারস্পরিক সম্পর্কজনিত সরকারের ভিন্ন ভিন্ন রূপ দেখা যায়। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য শাসন-বিভাগ ও আইন বিভাগের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে গঠিত সরকারের দু’টি প্রধান রূপ: (ক) রাষ্ট্রপতি-শাসিত সরকার এবং (খ) মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার বা পার্লামেন্টীয় সরকার। শাসন-বিভাগ ও আইন-বিভাগের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের ভিত্তিতে পরিচালিত শাসনব্যবস্থাকে পার্লামেন্টীয় সরকার বলে। আর শাসন বিভাগ ও আইন-বিভাগের মধ্যে একপ্রকার ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়োগের ভিত্তিতে সৃষ্টি হয় রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের।

রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থা:

রাষ্ট্রপতি-শাসিত শাসনব্যবস্থায় শাসন-বিভাগ ও আইন-বিভাগ পরস্পর পৃথক থেকে নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পাদন করে। সংসদীয় শাসনব্যবস্থার মত এখানে শাসন-বিভাগ ও আইন বিভাগের মধ্যে কোন ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ অনুপস্থিত। রাষ্ট্রপতি-শাসিত সরকারে আইন-বিভাগের প্রভাবমুক্ত অবস্থায় শাসন-বিভাগ স্বাধীনভাবে এবং সংবিধানসম্মতভাবে কাজকর্ম পরিচালনা করে। শাসনব্যবস্থায় শাসনবিভাগের শীর্ষে থাকেন একজন রাষ্ট্রপতি। তাঁর পদ নির্বাচনমূলক। প্রশাসনিক চরম কর্তৃত্ব তাঁর হাতেই ন্যস্ত থাকে। তিনি একাধারে রাষ্ট্রপ্রধান এবং শাসন-বিভাগের প্রধান কর্তা। শাসন-বিভাগের প্রধান রাষ্ট্রপতি আইনসভার সদস্য নন। আইনসভার কাছে তাঁর কোন দায়-দায়িত্বও নেই। আইনসভার আস্থা অনাস্থার উপর তার কার্যকাল নির্ভরশীল নয়। তিনি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হন। কার্যকাল অতিক্রান্ত হওয়ার আগে তাঁকে সহজে পদচ্যুত করা যায় না। তবে সংবিধানভঙ্গ, দেশদ্রোহিতা, দুর্নীতি প্রভৃতি অভিযোগের ভিত্তিতে তাঁকে পদচ্যুত করা যায়। কিন্তু তার জন্য এক বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয়। রাষ্ট্রপতি প্রকৃতপক্ষে জনগণের কাছেই দায়িত্বশীল থাকেন। এই দায়িত্ব আবার কেবল নির্বাচনের প্রাক্কালেই কার্যকর হয়।

একটি মন্ত্রিপরিষদ থাকতে পারে: রাষ্ট্রপতি-শাসিত শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতিকে প্রশাসনিক বিষয়ে পরামর্শ দান ও সাহায্য করার জন্য একটি মন্ত্রিপরিষদ থাকতে পারে। রাষ্ট্রপতিই মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের মনোনীত ও নিযুক্ত করেন। মন্ত্রিগণ রাষ্ট্রপতির সহকর্মী নন, অধস্তন কর্মচারী মাত্র। রাষ্ট্রপতিই শাসন বিভাগীয় উচ্চতম কর্তৃপক্ষ। মন্ত্রীদের সঙ্গে পরামর্শ করেন বটে, কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তিনি নিজেই। মন্ত্রীদের সঙ্গে পরামর্শ করতে বা পরামর্শ গ্রহণ করতে তিনি বাধ্য নন। রাষ্ট্রপতির মত মন্ত্রিগণও আইনসভার সদস্য নন। আইনসভার কাছে তাঁরা দায়িত্বশীলও নন। মন্ত্রিগণ তাঁদের সকল কাজের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে দায়িত্বশীল থাকেন। রাষ্ট্রপতির সন্তুষ্টির উপর তাঁদের কার্যকাল নির্ভরশীল।

মার্কিন দৃষ্টান্ত: রাষ্ট্রপতি-শাসিত সরকারের যথার্থ উদাহরণ হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থার কথা বলা হয়। বল তাঁর Modern Politics and Government শীর্ষক গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে বলেছেন: “The outstanding example of the presidential type of government is that of the United States. Most other examples are limitations of the American system, found chiefly in Central and South America. ” মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের দ্বারা চার বছরের জন্য নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিই হলেন শাসন-বিভাগীয় উচ্চতম কর্তৃপক্ষ। তিনি আইনসভার সদস্য নন। আবার আইনসভার কাছে তিনি দায়িত্বশীলও নন। নির্দিষ্ট চার বছরের কার্যকাল শেষ হওয়ার আগেই আইনসভা সংবিধানভঙ্গ, দুর্নীতি, দেশদ্রোহিতা প্রভৃতি অভিযোগের ভিত্তিতে তাঁকে পদচ্যুত করতে পারে; তবে তার জন্য একটি বিশেষ জটিল পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয়। তাকে ইমপিচমেন্ট (impeachment) বলে। রাষ্ট্রপতিকে শাসন বিষয়ে সাহায্য করার জন্য এখানেও একটি মন্ত্রিপরিষদ আছে। মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের রাষ্ট্রপতিই নিযুক্ত করেন। মন্ত্রিগণ তাঁর অধীনস্থ কর্মচারী মাত্র। তাঁরাও আইনসভার সদস্য নন। আইনসভার কাছে তাদের দায়-দায়িত্বও নেই। রাষ্ট্রপতির কাছে তাঁরা দায়িত্বশীল থাকেন। রাষ্ট্রপতিই তাঁদের নিযুক্ত করেন, তিনিই তাঁদের পদচ্যুত করতে পারেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও দক্ষিণ কোরিয়া, লাতিন আমেরিকার কয়েকটি দেশ, লাইবেরিয়া প্রভৃতি দেশে এ ধরনের শাসনব্যবস্থা দেখা যায়।

রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের বৈশিষ্ট্যসমূহ

উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতি-শাসিত সরকারের কতকগুলি বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়।

(১) ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ: শাসন-বিভাগ ও আইন-বিভাগের মধ্যে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়োগের ভিত্তিতেই রাষ্ট্রপতি-শাসিত সরকারের সৃষ্টি হয়। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি অনুসৃত হয় বলেই এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় আইন-বিভাগ ও শাসন-বিভাগ পরস্পরের নিয়ন্ত্রণমুক্ত থাকে। শাসন বিভাগের প্রধান রাষ্ট্রপতি আইন-বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। আইন-বিভাগও তেমনি রাষ্ট্রপতিকে প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। রাষ্ট্রপতি বা তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যগণ কেউই আইনসভার সদস্য নন এবং আইন প্রণয়নে অংশগ্রহণের সুযোগ মন্ত্রীদের থাকে না। বল রাষ্ট্রপতি-শাসিত সরকারের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন: “The president is not elected by the legislative, but directly elected by the total electorate. There is an electoral college in the United States, but it is of little political significance.”

(২) রাষ্ট্রপতি হলেন রাষ্ট্রপ্রধান ও শাসক প্রধান: রাষ্ট্রপতি-শাসিত শাসনব্যবস্থায় প্রশাসনিক চরম কর্তৃত্ব রাষ্ট্রপতির হাতেই ন্যস্ত থাকে। তিনি হলেন একাধারে রাষ্ট্রপ্রধান এবং শাসন বিভাগের প্রধান কর্তা। বল বলেছেন: “The president is both nominal and political head of state.” এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় নিয়মতান্ত্রিক বা নামসর্বস্ব কোন শাসকপ্রধানের পদ থাকে না। রাষ্ট্রপতিই তত্ত্বগতভাবে এবং বাস্তবেও প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী।

(৩) নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি জনগণের কাছেই দায়িত্বশীল: রাষ্ট্রপতির পদ নির্বাচনমূলক। রাষ্ট্রপতি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হন। তিনি আইনসভার সদস্য নন। আইনসভার আস্থা-অনাস্থার উপর তাঁর কার্যকাল নির্ভরশীল নয়। বল বলেছেন: “The president is not part of the legislature and he cannot be removed from office by the legislature except through the legal process of impeachment.” রাষ্ট্রপতি কার্যত জনগণের নিকটই দায়িত্বশীল থাকেন। নির্দিষ্ট কার্যকাল অতিক্রান্ত হওয়ার আগে তাঁকে সহজে পদচ্যুত করা যায় না। গার্নার বলেছেন: “Presidential Government….is the system in which the executive (including both head of the state and his ministers) is constitutionally independent of the legislature in respect to the duration of his or their tenure and irresponsible to it for his or their political policies.”

(৪) আইনসভায় রাষ্ট্রপতির দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নাও থাকতে পারে: রাষ্ট্রপতি যে রাজনীতিক দলের সদস্য, দেশের আইনসভায় সেই দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নাও থাকতে পারে। রাষ্ট্রপতির নির্বাচন ও আইনসভার নির্বাচন পৃথকভাবে অনুষ্ঠিত হয়। তার ফলে যে রাজনীতিক দলের প্রার্থী হিসাবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন, তাঁর বিরোধী দল আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থায় দেখা যায় যে রাষ্ট্রপতি গণতন্ত্রী দল (Democratic Party) থেকে নির্বাচিত হলেও কংগ্রেসে বিশেষত উচ্চকক্ষ সিনেটে সাধারণতন্ত্রী দল (Republican Party) সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। আবার ঠিক এর বিপরীত ঘটনাও ঘটে।

(৫) একটি মন্ত্রীপরিষদ: রাষ্ট্রপতি-শাসিত শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতির একটি মন্ত্রিসভা থাকে। রাষ্ট্রপতিই মন্ত্রিসভার সদস্যদের মনোনীত ও নিযুক্ত করেন। মন্ত্রিগণ রাষ্ট্রপতির অর্ধস্তন কর্মচারী, সহকর্মী নন। মন্ত্রীদের সঙ্গে তিনি পরামর্শ করলেও সিদ্ধান্ত তিনি নিজেই গ্রহণ করেন। মন্ত্রীরাও আইনসভার সদস্য নন এবং আইনসভার কাছে দায়িত্বশীল নন। মন্ত্রীরা রাষ্ট্রপতির কাছে দায়িত্বশীল। রাষ্ট্রপতির সন্তুষ্টির উপর মন্ত্রীদের কার্যকাল নির্ভরশীল। রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের মন্ত্রিগণ কর্মসচিব (Secretary) হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন।

(৬) রাষ্ট্রপতি-শাসিত সরকারে সংবিধানই হল রাষ্ট্রপতির সকল ক্ষমতার উৎস। 

(৭) সংসদীয় সরকারের রাষ্ট্রপ্রধানের মত রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের রাষ্ট্রপ্রধান রাষ্ট্রপতি আইনসভার নিম্নকক্ষকে ভেঙ্গে দিতে পারেন না। এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় আইনসভা আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে অনন্য ক্ষমতার অধিকারী। বল বলেছেন: “The president cannot dissolve the legislature and call a general election. Usually the president and the legislature are elected for mixed terms.”

রাষ্ট্রপতি-শাসিত সরকারের গুণাগুণ

(১) স্থায়িত্ব: সরকারের স্থায়িত্ব রাষ্ট্রপতি-শাসিত শাসনব্যবস্থার সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য গুণ হিসাবে বিবেচিত হয়। আইনসভার আস্থা-অনাস্থার উপর সরকারের স্থায়িত্ব নির্ভরশীল নয়। নির্দিষ্ট কার্যকাল অতিক্রান্ত হওয়ার আগে সরকারের পতন ঘটার আশঙ্কা থাকে না। নির্বাচকমণ্ডলী কর্তৃক নির্বাচিত হওয়ার পর রাষ্ট্রপতির নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি শাসনকার্য পরিচালনা করে থাকেন। এতে সরকারের স্থায়িত্ব অনেক নিশ্চিত হয়।

(২) জনকল্যাণ: স্থায়িত্বের ব্যাপারে নিশ্চয়তা থাকে বলে রাষ্ট্রপতি নিশ্চিন্ত মনে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে আত্মনিয়োগ করতে পারেন। আইনসভার সদস্যদের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সময়ের অপব্যয় ঘটে না। সরকার জনকল্যাণে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবে রূপায়িত করতে পারে। সরকারের অনুসৃত নীতি ও কার্যক্রমের মধ্যে নিরবচ্ছিন্নতা বজায় থাকে। সরকারের দৃঢ়তা বৃদ্ধি পায়। এর ফলে দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়।

(৩) জরুরি অবস্থার উপযোগী: রাষ্ট্রপতি-শাসিত শাসনব্যবস্থা জরুরি অবস্থার উপযোগী। সাফল্যের সঙ্গে আপৎকালীন বা জরুরি অবস্থার মোকাবিলা করার ব্যাপারে রাষ্ট্রপতি-শাসিত শাসব্যবস্থা বিশেষভাবে উপযোগী। শাসন-বিভাগের চূড়ান্ত কর্তৃত্ব রাষ্ট্রপতির উপর ন্যস্ত থাকে। তিনি এককভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তাকে কার্যকর করতে পারেন। মন্ত্রীদের সঙ্গে পরামর্শ করতে বা পরামর্শ গ্রহণ করতে তিনি বাধ্য নন। ফলে দেশ বৈদেশিক আক্রমণ, গৃহযুদ্ধ প্রভৃতি জরুরি অবস্থার সম্মুখীন হলে রাষ্ট্রপতি তৎপরতার সঙ্গে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে এবং দৃঢ়তার সঙ্গে তা কার্যকর করতে পারেন। এতে জরুরি অবস্থার মোকাবিলার ব্যাপারে সাফল্য অর্জন করা যায়। দেশের স্বার্থ সংরক্ষিত হয়। প্রসঙ্গক্রমে গত দু’টি মহাযুদ্ধের সময়কার মার্কিন সেনাপতি উইলসন (Woodrow Wilson) এবং ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট (Roosevelt)-এর ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

(৪) ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের সুবিধা: ক্ষমতা পৃথকীকরণ নীতির প্রয়োগের ভিত্তিতেই রাষ্ট্রপতি-শাসিত শাসনব্যবস্থার সৃষ্টি হয়। এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় আইন-বিভাগ ও শাসন-বিভাগ পরস্পর স্বতন্ত্র থেকে নিজ নিজ এলাকায় কর্তৃত্ব কায়েম করে। এর ফলে আইন এবং শাসন-বিভাগের মধ্যে সংঘর্ষের আশঙ্কা থাকে না। শান্তিপূর্ণভাবে দেশের শাসনকার্য পরিচালিত হয়। তা ছাড়া, ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়োগ এই শাসনব্যবস্থায় স্বৈরাচারী প্রবণতা রোধ করে এবং নাগরিকদের স্বাধীনতা সংরক্ষণে সাহায্য করে।

(৫) দলব্যবস্থার ত্রুটি থেকে মুক্ত: রাষ্ট্রপতি-শাসিত শাসনব্যবস্থা দলব্যবস্থার ত্রুটি থেকে মুক্ত। বহুদল সমন্বিত-রাষ্ট্রে অনেক সময় কোন রাজনীতিক দল এককভাবে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারে না। তখন বহুদলীয় কোয়ালিশন বা যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। এ ধরনের যুক্তফ্রন্ট সরকার দুর্বল ও অস্থায়ী হয়। তা ছাড়া, দলত্যাগ রোধ এবং দলীয় সমর্থন অটুট রাখার জন্য সরকারকে অনেক সময় স্বজনপোষণ এবং দুর্নীতিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। এতে সরকারের নৈতিক মান ক্ষুণ্ন হয়। সরকারের উপর জনগণের অনাস্থা সূচিত হয়। পার্লামেন্টীয় শাসনে এই সকল ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়। রাষ্ট্রপতি-শাসিত শাসনে এইসব কুফল দেখা যায় না। কারণ এক্ষেত্রে সরকারের স্থায়িত্ব দলীয় সমর্থনের উপর নির্ভরশীল নয়।

(৬) বহুদলীয় রাষ্ট্রে কাম্য: আবার বহুদলীয় ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতি-শাসিত শাসনব্যবস্থা বিশেষভাবে উপযোগী বলে মনে করা হয়। বহুদলবিশিষ্ট রাষ্ট্রে কোন বিশেষ রাজনীতিক দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভাবে অনেক সময় বহুদলীয় কোয়ালিশন বা যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। এ ধরনের যুক্তফ্রন্ট সরকার বিশেষভাবে দুর্বল ও অস্থায়ী হয়। রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থা এই ত্রুটি থেকে মুক্ত। কারণ এখানে আইনসভার সমর্থনের উপর সরকারের স্থায়িত্ব নির্ভরশীল নয়। তাই বহুদলীয় রাষ্ট্রে এ ধরনের শাসনব্যবস্থা কাম্য। আবার বলা হয় যে, স্বার্থগত, সম্প্রদায়গত, অঞ্চলগত এবং রাজনীতিক পার্থক্য ও বৈচিত্র্যযুক্ত রাজনীতিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি-শাসিত শাসনব্যবস্থা বিশেষভাবে উপযোগী।

(৭) জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদের শাসন: রাষ্ট্রপতি-শাসিত শাসনব্যবস্থায় দলমত নির্বিশেষে দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তিদের প্রশাসনিক কাজে নিযুক্ত করা যায়। রাষ্ট্রপতি নিজ দলের বাইরে থেকেও উপযুক্ত ব্যক্তিদের মন্ত্রিসভার সদস্য বা প্রশাসনিক গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত করতে পারেন। তার ফলে দলনিরপেক্ষভাবে দেশের জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিরা দেশের সেবায় আত্মনিয়োগ করতে পারেন। দেশ জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদের সেবার দ্বারা উন্নত ও সমৃদ্ধশালী হয়। প্রশাসনিক উৎকর্ষ বৃদ্ধি পায়। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণতন্ত্রী দলের রাষ্ট্রপতি থিয়োডর রুজভেল্ট (Theodore Roosevelt) ও ট্যফ্ট (Toft) গণতান্ত্রিক দলের সদস্যকে যুদ্ধ-সচিব পদে বসিয়েছিলেন। তেমনি গণতন্ত্রী দলের রাষ্ট্রপতি ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট (Franklin Roosevelt) সাধারণতন্ত্রী দলের সদস্য স্টিমসনকে যুদ্ধ-সচিব করেছিলেন।

(৮) দায়িত্বশীলতা বৃদ্ধি: রাষ্ট্রপতি-শাসিত সরকারে বিভিন্ন বিভাগগুলির দায়িত্বশীলতা বৃদ্ধি পায়। কারণ এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় সরকারের বিভাগগুলির ক্ষমতা ও দায়িত্বের এলাকা নির্দিষ্ট থাকে। ফলে বিভাগগুলি নিজেদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকে। এই একই কারণের জন্য সরকারের বিভাগগুলির মধ্যে সংঘর্ষের আশংকাও থাকে না।

(৯) রাষ্ট্রপতি স্বাধীনভাবে তার ভূমিকা পালন করে: এই ধরনের সরকারে সরকারী নীতি নির্ধারণ, সরকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং এই সমস্ত নীতি ও সিদ্ধান্ত বাস্তবে রূপায়িত করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি স্বাধীনভাবে ভূমিকা পালন করে থাকেন। তাঁর উপর দলীয় প্রভাব বা প্রাধান্য বিস্তার করা সহজে সম্ভব হয় না। বরং তিনিই দলের উপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেন। সরকারী সুযোগ-সুবিধা, রাজনীতিক উচ্চপদ, দলীয় মনোনয়ন প্রভৃতি বণ্টনের মাধ্যমে তিনি তাঁর দলের সদস্যদের উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেন। বস্তুত এই ধরনের সরকারী ব্যবস্থায় তাঁর কোন প্রতিদ্বন্দ্বী থাকে না। মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা হলেন রাষ্ট্রপতির অধস্তন কর্মচারী মাত্র।

রাষ্ট্রপতি-শাসিত সরকারের ত্রুটি

বিভিন্ন গুণাবলির অস্তিত্ব সত্ত্বেও রাষ্ট্রপতি-শাসিত শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিরূপ সমালোচনার অভাব নেই।

(ক) ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির কুফল: প্রথমেই বলা হয় ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের কুফল রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থায় পরিলক্ষিত হয়। আইন-বিভাগ এবং শাসন-বিভাগ পরস্পর পৃথক থেকে নিজ নিজ কার্য সম্পাদন করে। তাই এই দুই বিভাগের মধ্যে সহযোগিতার অভাব ঘটে। এতে উভয় বিভাগের মধ্যে সংঘর্ষের আশংকা থাকে। গেটেল বলেছেন: “When legislature and executive are of different parties, there is constant danger of deadlock.” মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থার ইতিহাসে এ ধরনের অসহযোগিতার অসংখ্য দৃষ্টাত্ত আছে। সুতরাং রাষ্ট্রপতি-শাসিত শাসনব্যবস্থাকে শান্তিপূর্ণ বলা যায় না। অনেক ক্ষেত্রে আইন ও শাসন-বিভাগের মধ্যে মতপার্থক্য হেতু প্রশাসনিক ক্ষেত্রে অচলাবস্থা দেখা দিতে পারে। এতে সুশাসন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

(খ) স্বৈরাচারমূলক: এই প্রকার শাসনব্যবস্থায় শাসন বিভাগের সকল ক্ষমতা চূড়ান্তভাবে রাষ্ট্রপতির হাতেই ন্যস্ত থাকে। রাষ্ট্রপতি আইনসভার সদস্য নন। আবার আইনসভার কাছে তিনি দায়িত্বশীলও নন। নির্দিষ্ট কার্যকাল অতিক্রান্ত হওয়ার আগে তাঁকে সহজে পদচ্যুত করা যায় না। এর ফলে রাষ্ট্রপতির পক্ষে স্বেচ্ছাচারী হওয়ার পথে কোন বাধা থাকে না। এজন্য রাষ্ট্রপতি-শাসিত শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ হল এটি স্বৈরাচারমূলক এবং গণতন্ত্রের পক্ষে বিপজ্জনক।

(গ) দায়িত্বহীনতা: রাষ্ট্রপতি-শাসিত শাসনব্যবস্থায় আইনসভার বিভিন্ন কমিটির মাধ্যমে আইন প্রণয়নের ব্যবস্থা হয়। ফলে আইন প্রণয়নের দায়িত্ব আইনসভার বিভিন্ন কমিটির মধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই দায়িত্ব বিভক্ত হওয়া দায়িত্ব বিলুপ্তিরই সামিল। এতে শাসন-বিভাগ বা আইন-বিভাগ কাউকেই প্রশাসনিক ত্রুটির জন্য এককভাবে দায়বদ্ধ করা যায় না। উভয় বিভাগই দায়িত্ব এড়াবার চেষ্টা করে। এজন্য বিরুদ্ধবাদীদের অভিযোগ, রাষ্ট্রপতি-শাসিত শাসনব্যবস্থা হল দায়িত্বহীন শাসনব্যবস্থা। আর একটি কারণে এ ধরনের সরকারে দায়িত্বহীনতা দেখা দিতে পারে। আইনসভার কাছে রাষ্ট্রপতির কোন দায় দায়িত্ব থাকে না। কোন বিষয়ে আইনসভার কাছে জবাবদিহি করার ব্যাপারে তাঁর উপর কোন বাধ্যবাধকতা থাকে না। আইনসভা রাষ্ট্রপতির বিরূপ সমালোচনা করতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক ক্ষমতার উপর কোন সীমা টানতে পারে না। সুতরাং শাসনকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে দায়িত্বহীনতা প্রশ্রয় পাওয়ার আশংকা থাকে। এই কারণে এ ধরনের সরকার হল জনস্বার্থবিরোধী ও বিপজ্জনক।

(ঘ) বিচার বিভাগের প্রাধান্য: রাষ্ট্রপতি-শাসিত শাসনব্যবস্থায় বিচার-বিভাগের অত্যধিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হতে দেখা যায়। ক্ষমতার বিভাজন নীতির ভিত্তিতে এই প্রকার শাসনব্যবস্থার সৃষ্টি হয়। তবুও বিভিন্ন বিভাগের ক্ষমতার পরিধি ব্যাখ্যা এবং কার্যাবলীর বৈধতা বিচারের দায়িত্ব এই বিচার বিভাগের উপর ন্যস্ত থাকে। এই ক্ষমতা ব্যবহারের মাধ্যমে বিচার-বিভাগ শাসন-বিভাগ ও আইন-বিভাগের উপর অত্যধিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার সুযোগ পায়। অপর দুই বিভাগের উপর অত্যধিক প্রাধান্য অকাম্য বিবেচিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি-শাসিত শাসনব্যবস্থায় বিচার-বিভাগের এই প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়।

(ঙ) অনমনীয়তা: শাসনব্যবস্থার অনমনীয়তা রাষ্ট্রপতি-শাসিত সরকারের অন্যতম ত্রুটি হিসাবে গণ্য হয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রয়োজনে রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থার কামা পরিবর্তন সহজে সম্পাদন করা সম্ভব হয় না। এতে দেশের স্বার্থের ক্ষতি হওয়ার আশংকা থাকে। পার্লামেন্টারী শাসনব্যবস্থা নমনীয় বলে পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে সহজে সঙ্গতি সাধন সম্ভব হয়।

(চ) জাতীয় স্বার্থের ক্ষতি: রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থায় অনেক সময় জাতীয় স্বার্থ উপেক্ষিত হয়। এবং আঞ্চলিক বা গোষ্ঠী স্বার্থ প্রাধান্য পায়। এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় কমিটি ব্যবস্থার মাধ্যমে আইন প্রণীত হয়। তাই জাতীয় স্বার্থ অপেক্ষা আঞ্চলিক স্বার্থের অধিক গুরুত্ব লাভের আশঙ্কা থাকে। তার ফলে, দেশের সামগ্রিক স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হতে পারে। আবার রাষ্ট্রপতিও তাঁর রাজনীতিক স্বার্থসাধনের উদ্দেশ্যে দেশের বিশেষ কিছু অঞ্চলের স্থানীয় স্বার্থ সংরক্ষণ বা উন্নয়নের ব্যাপারে অধিক আগ্রহ-উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন। এতে আঞ্চলিকতা প্রশ্রয় পায়। এ ছাড়া রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত ক্ষমতার আধিক্য হেতু স্বজনপোষণ ও দুর্নীতি প্রশ্রয় পেতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘Spoils system’ এক্ষেত্রে উদাহরণস্বরূপ।

(ছ) জাতীয় সংকট দেখা দিতে পারে: রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার সব সময় জরুরী অবস্থার উপযোগী নয়। কারণ গুণগত যোগ্যতার বিচারে একেবারে সাধারণ মানের বা কোন অপদার্থ ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হলে এই আশঙ্কা দেখা দেয়। জরুরি অবস্থায় দেশের সংকট মোকাবিলা করার জন্য যে ধরনের বিচক্ষণতা, দৃঢ়তা, দূরদর্শিতা প্রভৃতি গুণাবলী দরকার, তা এই রকম রাষ্ট্রপতির থাকে না। অথচ তাঁকে অপসারণও করা যায় না। এ রকম পরিস্থিতিতে জাতীয় সংকট ঘনীভূত হয়।

(জ) উপযুক্ত প্রার্থীর অভাব: রাষ্ট্রপতি-শাসিত সরকারের সাফল্য-অসাফল্য সবকিছুই রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা ও প্রশাসনিক দক্ষতার উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। পদাধিকারীর গুণগত যোগ্যতার উপর সমগ্র সরকারের গুণগত মান নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। যথোপযুক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি রাষ্ট্রপতির পদে নির্বাচিত না হলে দেশ ও দেশবাসীর স্বার্থ অবহেলিত হওয়ার আশংকা থাকে।

(ঝ) জনমত প্রতিফলিত হয় না: রাষ্ট্রপতি-শাসিত সরকারে জনসাধারণের সঙ্গে রাষ্ট্রপতির কোন প্রত্যক্ষ সংযোগ স্থাপিত হয় না। কারণ সে কম কোন সুযোগ এ ধরনের সরকারে থাকে না। গণ সংযোগের মাধ্যমগুলির সাহায্যে এই সংযোগ পরোক্ষভাবে সম্পাদিত হয়। এই কারণে রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থায় জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন পরিলক্ষিত হয় না।

(ঞ) রাষ্ট্রপতির নির্লিপ্ততা: বর্তমানে আর্থ-সামাজিক ও রাজনীতিক ক্ষেত্রে জটিল প্রকৃতির বহু ও বিভিন্ন সমস্যা পরিলক্ষিত হয়। এই সমস্ত সমস্যার সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য বহু ও বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি ও তাঁর সহযোগীদের মধ্যে এ বিষয়ে উদাসীনতা পরিলক্ষিত হয়। রাষ্ট্রপতির এই উদাসীনতা ও উদ্যোগহীনতা দেশ ও দেশবাসীর স্বার্থকে বিপন্ন করে তুলে।

(ট) জটিলতা: প্রকৃতিগত বিচারে রাষ্ট্রপতি-শাসিত সরকার অত্যন্ত জটিল। এ ধরনের সরকারী ব্যবস্থায় বহু ও বিভিন্ন কমিটি, কমিশন, দপ্তর ও সংস্থার অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। এদের নীতি, সিদ্ধান্ত ও কার্যাবলীর মধ্যে সমন্বয় সাধন আবশ্যক। কিন্তু এই কাজ সহজসাধ্য নয়। তার ফলে সরকারী ব্যবস্থায় জটিলতা দেখা যায়।

উপসংহার: উপরিউক্ত ত্রুটিগুলির অস্তিত্ব সত্ত্বেও রাষ্ট্রপতি-শাসিত সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সাফল্যের সঙ্গে বহাল আছে। তবে মার্কিন রাজনীতিক ব্যবস্থায় দলপ্রথার উদ্ভব ও বিকাশ আইন-বিভাগ ও শাসন বিভাগের মধ্যে সংযোগ ও সহযোগিতার ভিত্তি প্রস্তুত করেছে। তার ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সফল হয়েছে।