ভূমিকা: ভারতীয় সংবিধানে ব্রিটিশ সংসদীয় ব্যবস্থার অনুসরণে পার্লামেন্টীয় বা ক্যাবিনেট পরিচালিত শাসনব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই ভারতীয় রাষ্ট্রপতি ব্রিটিশ রাজা বা রানির মতাে রাজত্ব করেন কিন্তু শাসন করেন না। ব্রিটেনের ন্যায় ভারতের প্রকৃত শাসনক্ষমতা ভােগ করেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা। ভারতের সংবিধানে কেন্দ্রীয় শাসন বিভাগের সর্বোচ্চ পদাধিকারী হলেন রাষ্ট্রপতি। শাসন বিভাগের শীর্ষে রাষ্ট্রপতির অবস্থান। সংবিধানের ৫৩ নং ধারায় বলা হয়েছে যে, ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের শাসনক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত থাকবে। রাষ্ট্রপতির পদমর্যাদাকে কেন্দ্র করে সংবিধানের বিশেষজ্ঞদের দুটি পরস্পরবিরােধী মত পরিলক্ষিত হয়। কেউ কেউ বলেন, ভারতের রাষ্ট্রপতি হলেন নামসর্বস্ব শাসক।
(১) ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দ ৪২ তম সংবিধান-সংশোধনী আইন: কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার সঙ্গে রাষ্ট্রপতির সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতির পদমর্যাদাকে কেন্দ্র করে প্রভূত বিতর্ক আছে। তবে সংবিধানের ৪২তম সংবিধান-সংশােধনে ৭৪ (১) নং ধারা এমনভাবে সংশােধন করা হয় যাতে রাষ্ট্রপতি নিছক আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রপ্রধান ছাড়া অন্য কোনাে কিছুর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে না পারেন। মূল সংবিধানের ৭৪ (১) নং ধারায় ছিল প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি মন্ত্রীসভা থাকবে এবং রাষ্ট্রপতি মন্ত্রীসভার পরামর্শ অনুসারে কাজ করেন। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে ৪২তম সংশােধনী আইনে বলা হয় রাষ্ট্রপতি মন্ত্রীসভার পরামর্শ অনুসারে অবশ্যই কাজ করতে বাধ্য থাকবেন, যা রাষ্ট্রপতিকে নামসর্বস্ব শাসকে পরিণত করে।
(২) রাষ্ট্রপতির মন্ত্রীসভার সিদ্ধান্ত অমান্য না করা: ৭৪ (১) নং ধারা সংশােধনের পর ভারতের কোন রাষ্ট্রপতি মন্ত্রীসভার সিদ্ধান্ত অমান্য করেননি। রাষ্ট্রপতি মন্ত্রীসভার পরামর্শ মেনে কাজ করতে বাধ্য, তবে প্রয়ােজন বােধ করলে তিনি কোনাে পরামর্শকে পুনর্বিবেচনার জন্য মন্ত্রীসভার নিকট ফেরত পাঠাতে পারেন।
(৩) মন্ত্রিসভার রাষ্ট্রপতির কাছে দায়ী থাকে না: সংবিধানের ৫৩নং ধারা অনুসারে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা যৌথভাবে লোকসভার নিকট দায়ী থাকে। কোথাও বলা নেই যে, মন্ত্রীসভা রাষ্ট্রপতির কাছে দায়ী থাকবে।
(৪) ক্যাবিনেট ও প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়া নিয়ােগ করতে পারেন না: রাষ্ট্রপতি বিভিন্ন পদে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে নিয়ােগ করেন, কিন্তু তিনি ক্যাবিনেটের ও প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়া কাউকে নিয়োগ করতে পারেন না।
(৫) রাষ্ট্রপতি আনুষ্ঠানিক শাসকপ্রধান: রাষ্ট্রপতি আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের জাতীয় প্রতিরক্ষা কমিটির সর্বাধিনায়ক। তবে তিনি প্রতিরক্ষা বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হলেও প্রতিরক্ষা বাহিনীর কুচকাওয়াজের অভিবাদন গ্রহণ করা ছাড়া বাস্তবে কোনাে ভূমিকাই পালন করতে পারেন না।
(৬) রাষ্ট্রপতি নীতি রচনা করেন না: রাষ্ট্রপতি পার্লামেন্টের যৌথ অধিবেশনে যে ভাষণ দেন বা বাজেট পেশ করার সময় যে ভাষণ দেন কিংবা ২৬ জানুয়ারি ও ১৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশে যে ভাষণ দেন, সেই ভাষণের মৌলিক নীতি বা অংশ ক্যাবিনেটের অনুমােদনসাপেক্ষ, কারণ তিনি শুধুমাত্র উক্ত ভাষণ পাঠ করে থাকেন।
(৭) সামরিক ক্ষমতা সীমাবদ্ধ: রাষ্ট্রপতি সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হলেও তার ক্ষমতা সংসদীয় আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এ ছাড়া ভারতের রাষ্ট্রপতির সামরিক ক্ষমতা প্রয়ােগ করে থাকেন জাতীয় প্রতিরক্ষা কমিটির (National Defence Committee) সিদ্ধান্ত সাপেক্ষে।
(৮) পরােক্ষ নির্বাচন: জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন না। রাষ্ট্রপতি পরােক্ষভাবে নির্বাচিত হন বলেই সংবিধান প্রণেতারা মনে করেন রাষ্ট্রপতির পরিবর্তে জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত মন্ত্রীসভাই প্রকৃত শাসক বলে স্বীকৃতি পেয়েছে। এরজন্যই রাষ্ট্রপতিকে নামসর্বস্ব শাসক বলে অভিহিত করা হয়।
(৯) গণপরিষদে সংবিধান-প্রণেতাদের অভিমত: গণপরিষদে সংবিধান-প্রণেতাদের মধ্যে অন্যতম হলেন কে এম মুন্সী। তিনি মন্তব্য পেশ করেছেন, প্রথম থেকেই এটা ঠিক ছিল যে, ভারতের কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা ইংল্যান্ডের শাসনব্যবস্থার অনুকরণে গঠিত হবে। এ প্রসঙ্গে ড. আম্বেদকরও বলেছিলেন যে, ব্রিটিশ সংবিধানের রাজা-রানি যেরূপ মর্যাদা ভোগ করে থাকেন, ভারতের রাষ্ট্রপতি ও অনুরূপ পদমর্যাদার অধিকারী।
(১০) রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি উপলব্ধি: ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে চণ্ডীগড়ে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন যে, নীতিহীন রাজনীতি (Politics without Principle) এবং বিনা পরিশ্রমে সম্পদ লাভ (Wealth without Work) ইত্যাদি হল ভারতীয় সমাজজীবনের এক চিরন্তন বৈশিষ্ট্য। এই সত্য আজও সমানভাবে বহমান রয়েছে।
উপসংহার: উপরােক্ত আলােচনার আলােকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, ভারতের রাষ্ট্রপতি ইংল্যান্ডের রানির ন্যায় ক্ষমতাহীন নন, আবার আমেরিকার রাষ্ট্রপতির মতাে প্রবল ক্ষমতাশালীও নন। সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ প্রাধান্য অর্জনকারী রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীকে তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়ােগ করতে যেমন বাধ্য তেমনি তার পরামর্শ উপেক্ষা করে কাজ করার কোনাে ক্ষমতা তার নেই। ড. আম্বেদকরের কথায়, “ব্রিটিশ সংবিধানে রাজার যা ভূমিকা আমাদের সংবিধানে রাষ্ট্রপতির ভূমিকাও তাই। তিনি রাষ্ট্রের প্রধান বটে, কিন্তু শাসন বিভাগের প্রধান নন। নেহরু মন্তব্য করেছিলেন যে, রাষ্ট্রপতিকে কোনাে প্রকৃত ক্ষমতা দেওয়া হয়নি তাকে সম্মান দেওয়া হয়েছে মাত্র। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি (রাজেন্দ্র প্রসাদ) চমৎকার বলেছেন যে, রাষ্ট্রপতি জাতীয় উদ্দেশ্য ও জাতীয় ঐক্যের প্রতীক এবং তিনি স্থিতিশীলতা ও প্রগতির উপর একটি বিরাট প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম। ভারতের সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় এখানেই রাষ্ট্রপতির প্রকৃত অবস্থানটি সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, রাষ্ট্রপতি হলেন নামসর্বস্ব শাসক, প্রকৃত শাসক নন।
Leave a comment