অথবা, রাষ্ট্রদর্শনে সেন্ট টমাস একুইনাসের অবদান মূল্যায়ন কর।
ভূমিকাঃ সেন্ট টমাস একুইনাস ছিলেন মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। অধিকাংশ রাজনৈতিক ভাষ্যকারের মতে, সেন্ট টমাস একুইনাস ত্রয়ােদশ শতাব্দীর তথা সমগ্র মধ্যযুগের রাষ্ট্র চিন্তার ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা সফল দার্শনিক। তিনি প্রাচীন ও মধ্যযুগের মধ্যে সমন্বয়সাধন করেন। তিনি পার্থিব ও অপার্থিব রাষ্ট্রের মধ্যেও সমন্বয়সাধন করেন।
রাষ্ট্রচিন্তায় একুইনাসের অবদানঃ রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে সেন্ট টমাস একুইনাসের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি প্রাচীন গ্রিক চিন্তাধারার সাথে খ্রিষ্টীয় যাজকদের চিন্তাধারার নিখুত সমন্বয়সাধন করেন। মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক হিসেবে তার রাষ্ট্র দর্শন ছিল নিম্নরূপঃ
(১) রাষ্ট্রের উৎপত্তিঃ রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে একুইনাস এরিস্টটলের পথ অনুসরণ করে বলেন, রাষ্ট্র একটি স্বাভাবিক সংস্থা এবং এর উৎপত্তির মূলে রয়েছে মানুষের সহজাত সামাজিক প্রবৃত্তি। এরিস্টটলের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্র হলাে সামাজিক কল্যাণসাধনের এক সঠিক প্রতিষ্ঠান এবং নাগরিকদের সৎ জীবন অর্জনই হলাে এর লক্ষ্য। আদর্শ ও উন্নত জীবনের জন্য পারস্পরিক সেবার ভিত্তিতে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত।
(২) রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য বা ভূমিকাঃ একুইনাসের মতে, রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য বা ভূমিকা হলো জনগণের অধিকতর কল্যাণ সাধন এবং রাষ্ট্রকে শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করা। রাষ্ট্র নাগরিক জীবনের শৃঙ্খলাবােধ জাগিয়ে তােলার জন্যও উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে তুলবে। সৎ ও সুন্দর জীবনযাপন এবং সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণের জন্য রাষ্ট্রের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
(৩) রাষ্ট্রের শাসকঃ ধর্মের ও পারলৌকিকতার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করার মানসে একুইনাস একজন লােকায়ত শাসকের হাতে রাষ্ট্রীয় শাসন ক্ষমতা অর্পণের কথা বলেছেন। তিনি এই লােকায়ত শাসককে জনগণের জিম্মাদার হিসেবে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেন। জনগণ যাতে লৌকিক জীবনে পুণ্য লাভ করে পারলৌকিক জীবনেও সৃষ্টিকর্তার কৃপা লাভ করতে পারে তার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখার ওপরও একইনাস গুরুত্ব প্রদান করেছেন। তবে তিনি লােকায়ত শাসকের উর্ধ্বে পােপের স্থান নির্দেশ করেছেন।
(৪) সরকারের শ্রেণী বিভাগঃ এরিস্টটলের ন্যায় সংখ্যা ও উদ্দেশ্য নীতির ওপর ভিত্তি করে একুইনাস সরকারের শ্রেণীবিভাগ করেছেন। এরিস্টটলের মত তিনিও উত্তম এবং বিকৃত সরকারের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করেছেন। একুইনাস বলেন, রাজতন্ত্রই সর্বাপেক্ষা উত্তম সরকার। তবে তিনি রাজার ক্ষমতা সীমিত করার স্বপক্ষে মত প্রকাশ করেন। এরিস্টটলের মতাে তিনিও মিশ্র প্রকৃতির সরকারের স্বপক্ষে মত প্রদান করেন।
(৫) চার্চ ও রাষ্ট্রের সম্পর্কঃ একুইনাসের মতে, রাষ্ট্র কেবল পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য মেটাতে পারে। কিন্তু আত্মার মুক্তি ও উন্নত জীবনের জন্য প্রয়ােজন খ্রিষ্ট্ৰীয় চার্চের প্রতি অনুগত থাকা। একুইনাসের মতে, চার্চ রাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দী নয় বরং তা হলাে রাষ্ট্রের সম্পূরক। চার্চ ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক নির্ণয়ে একুইনাস মধ্যযুগীয় চিন্তাধারার প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারেননি।
(৬) রাষ্ট্রের সামগ্রিকতাঃ একুইনাসের মতে, ব্যক্তি মানসে সুষ্ঠু জীবনবােধ তৈরি করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র মুখ্য ভুমিকা পালন করবে। চার্চ পারলৌকিক চিন্তা-চেতনার প্রসার ঘটিয়ে ব্যক্তি মানসে সৎ প্রবৃত্তির ও উন্নত জীবনের সংমিশ্রণ ঘটাবে। আর রাষ্ট্র তা বাস্তবায়নে ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
(৭) ধর্মতত্ত্ব জ্ঞানের প্রতিষ্ঠাঃ একুইনাস ধর্মতত্ত্ব জ্ঞানের সার্থক রূপায়ন ঘটান। এরিস্টটলের মতে, দর্শনের জ্ঞান সর্বোচ্চ স্থানে অবস্থান করে। কিন্তু একুইনাস বলেন যে, দর্শনের উর্ধ্বেও একটি জ্ঞানের শাখা আছে এবং তা হলাে ধর্মতত্ত্ব। দৃশ্যমান এই প্রাকৃতিক জগতের উর্ধ্বে যে আরেক বৃহত্তর জগত আছে তা অনুধাবন করতে হলে ধর্মতত্ত্বের জ্ঞান থাকা প্রয়ােজন। প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ও দর্শন যার শুরু করে ধর্মতত্ত্ব তাকে স্বার্থকতার স্বর্ণদ্বারে পৌঁছিয়ে দেয়।
(৮) নীতি শাস্ত্র ও প্রাকৃতিক জগতঃ সেন্ট টমাস একুইনাস এরিস্টটলের প্রাকৃতিক জগৎ ও নীতিশাস্ত্র বিষয়ক বক্তব্য গ্রহণ করেন বিনা দ্বিধায়। তার মতে, মানুষ স্বাভাবিকভাবে সুখের ঘরের চাবিকাঠি পেতে পারে এবং স্বাভাবিক লক্ষ্য অর্জন করতে পারে। তিনি আরও বলেন, মানুষের পরম সুখ হলাে আত্মার মুক্তি ও পূত পবিত্র জীবন।
(৯) দাসতত্ত্বঃ এরিস্টটল ও অগাস্টিনের ন্যায় একুইনাসও দাসপ্রথাকে স্বাভাবিক বলে সমর্থন করেন। তিনি দাস প্রথাকে রাষ্ট্রীয় সংগঠনের অস্তিত্ব ও সমৃদ্ধির জন্য ন্যায়সংগত বলে মত প্রকাশ করেন। তবে তার মতে, সৈনিকেরা যখন সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করতে অক্ষমতা প্রকাশ করবে শুধু তখনই তাদেরকে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা উচিত। তিনি আরও বলেন, দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হওয়ার চেয়ে সৈনিকদের সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করে মৃত্যুবরণ করাই ভালাে।
(১০) আইন তত্ত্বঃ একুইনাসের মতে, আইন হচ্ছে বিবেক বুদ্ধির প্রত্যাদেশ; যার উদ্দেশ্য সাধারণ জনগণের কল্যাণ সাধন। তিনি আইন বলতে ন্যায় বােধের অনুশাসনকে বুঝিয়েছেন। তার মতে, শাসক এই অনুশাসন সকলের মঙ্গল ও কল্যাণার্থে বাস্তবে প্রয়ােগ করবেন। শাসক ইচ্ছা করলেই যেকোনাে আইন জারি করতে পারেন না। শাসক আইনের নৈতিক গণ্ডি লঙ্ঘন করলে তিনি আর শাসক থাকেন না, হয়ে ওঠেন স্বৈরাচারী।
(১১) মানব জ্ঞান রাজ্যের ঐক্যঃ এরিস্টটলের মানব জ্ঞান রাজ্যের ঐক্যের মতবাদকে একুইনাস গ্রহণ করেন। একে তিনি একটি পিরামিডের সাথে তুলনা করেন, যদিও তার পটভূমিতে রয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। এরিস্টটলের পিরামিডে সর্বোচ্চ স্থান দখল করেছে দর্শন। অন্যদিকে একুইনাস দর্শনকে জ্ঞানের সর্বোচ্চ স্থান না দিয়ে ধর্মতত্ত্বকে শীর্ষে স্থান দেন।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, রাষ্ট্র দর্শনে একুইনাসের অবদান বহুমুখী। বিশেষত তিনি আইনকে পৃথক-পৃথক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করে একে অনেকটা সহজ করেছেন। ধর্মতত্ত্ব ও আইনের সংঘাত প্রতিরোধে তিনি ছিলেন সফল রাষ্ট্রচিন্তাবিদ। একারণেই Prof. Sabine বলেছেন, Aquinas four kinds of law are four forms of reason, manifesting themselves at four levels of cosmic reality, but remainingone reason throughout.
Leave a comment