রাষ্ট্রকূট বংশ:
অষ্টম শতাব্দীর মধ্যভাগে দক্ষিণ ভারতে চালুক্যবংশের দুর্বলতার সুযোগে রাষ্ট্রকুটগণ প্রতিপত্তিশালী হয়ে উঠেছিল। রাষ্ট্রকূটগণের বংশপরিচয় বা তাদের প্রতিষ্ঠালাভের পথ সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ লক্ষ্য করা যায় না। এ বিষয়ে মূল যে সমস্ত মতবাদ প্রচলিত আছে, সেগুলি হল—(ক) রাষ্ট্রকুটদের আদি অনুশাসন লিপিতে তাঁরা নিজেদেরকে মহাভারতের যদুবংশীয় রাজা ‘সাত্যকীর বংশধর’ বলে বর্ণনা করেছেন। এমনকি রাষ্ট্রকুট-রাজাদের সভাকবিরা রাষ্ট্রকুটরাজ তৃতীয় গোবিন্দকে ‘ভগবান কৃষ্ণ’ বলে বর্ণনা করেছেন। (খ) অনেকের মতে, অশোক শিলালিপিতে বর্ণিত ‘রথিক’ বা রাষ্ট্রীকগণই হল রাষ্ট্রকূটগণ। (গ) বার্নেল-এর মতে, এঁরা ছিলেন অন্ধ্রপ্রদেশের ‘রাড্ডি’দের বংশধর। (ঘ) অনন্ত আলতেকরের মতে, রাষ্ট্রকুটগণ ছিলেন কর্ণাটকের অধিবাসী, এঁদের মাতৃভাষা ছিল কানাড়ি। (ঙ) এ বিষয়ে ড. আর. সি. মজুমদারের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তাঁর মতে, দক্ষিণ ভারতের ‘রাষ্ট্রকূট’ কথাটি সম্ভবত ‘রাষ্ট্রের বা প্রদেশের প্রধান’ অর্থে ব্যবহৃত। “The word Rastrakuta is used as the name of an official in early records of the Deccan, and probably indicates The heads of a rastra of Province’.” মনে করা যায়, রাষ্ট্রকূটবংশের প্রতিষ্ঠাতারা এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। পরবর্তীকালে একটি বৃহৎ সাম্রাজ্য গঠনের পরেও এই নামটি তাঁদের সঙ্গে থেকে যায়। পঞ্চম শতাব্দী থেকেই বহু রাষ্ট্রকুটবংশীয় প্রধান দাক্ষিণাত্যের বিভিন্ন অঞ্চলে শাসনকর্তা হিসেবে নিযুক্ত ছিল বলে জানা যায়। এঁরা ছিলেন চালুক্যরাজাদের অধীন সামন্ত রাজা। সপ্তম শতাব্দীর প্রথমার্ধে এদের মধ্যেই কোনো একজন একটি শক্তিশালী রাজ্যগঠনের সূচনা করেন। রাষ্ট্রকূটবংশের প্রথম উল্লেখযোগ্য শাসক ছিলেন ইন্দ্ৰ, যিনি এক চালুক্য রাজকন্যাকে বিবাহ করেছিলেন। ইন্দ্রের পরবর্তী সময়ে সিংহাসনে বসেন তাঁর পুত্র দস্তিদুর্গ (৭৫৩-‘৫৮ খ্রিঃ)। দস্তিদুর্গের সময় থেকেই রাষ্ট্রকূটদের প্রকৃত উত্থান শুরু হয়।
দস্তিদুর্গের রাজ্যশাসনের সূচনা তাঁর পূর্বপুরুষদের মতোই চালুক্য রাজাদের অধীনস্থ সামন্তরাজা হিসেবে। ড. আলতেকরের মতে, দস্তিদুর্গ তাঁর প্রভু দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্যকে পল্লবদের বিরুদ্ধে কাঞ্চি অভিযানে এবং আরবদের ভারত অভিযান প্রতিরোধে সক্রিয় সহায়তা করেছিলেন। তাঁর বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে চালুক্যরাজ দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্য দস্তিদুর্গকে ‘পৃথিবী বল্লভ’ উপাধিতে ভূষিত করেন। দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্যের মৃত্যুর পর দস্তিদুর্গ নিজ বাহুবলে রাজ্যবিস্তারে উদ্যোগী হন। চালুক্যরাজাদের সামন্ত পদে থাকা অবস্থাতেই তিনি মধ্যপ্রদেশের পূর্বাংশে নিজ কর্তৃত্ব স্থাপন করেছিলেন, কিন্তু তিনি নিজে থেকে তাঁর প্রভু চালুক্যরাজাদের সাথে বৈরিতা এড়িয়ে যান। এতদ্সত্ত্বেও তাঁর উত্তরোত্তর শক্তিবৃদ্ধিতে উদ্বিগ্ন চালুক্যরাজ দ্বিতীয় কীর্তিবর্মন তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এই যুদ্ধে দস্তিদুর্গ কীর্তিবর্মনকে পরাজিত করে বাতাপির চালুক্যবংশের অবসান ঘটান ও রাষ্ট্রকুটবংশের সূচনা করেন (৭৫৩ খ্রিঃ) বর্তমানে শোলাপুরের নিকটে ‘মালখেডে’ তিনি রাজধানী স্থাপন করেন ও ‘মহারাজাধিরাজ’ উপাধি গ্রহণ করেন।
দন্তিদুর্গের মৃত্যুর অব্যবহিত পরে তাঁর পুত্র (মতান্তরে খুন্নতাত) প্রথম কৃষ্ণ সিংহাসনে বসেন (৭৫৮-৭৭৩ খ্রিঃ)। এই সময় চালুক্যরাজ দ্বিতীয় কীর্তিবর্মন তাঁর হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধারের জন্য একবার শেষ চেষ্টায় রত হন। কিন্তু ৭৬০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম কৃষ্ণের হাতে সম্পূর্ণ পরাজিত হন এবং এরই সাথে আক্ষরিক অর্থেই চালুক্যরাজবংশের অবসান ঘটে। এরপর প্রথম কৃষ্ণ মহীশুরের গঙ্গরাজা এবং বেঙ্গীর চালুক্যবংশীয় রাজাকে পরাজিত করেন। এর ফলে চালুক্যদের প্রায় সমস্ত সাম্রাজ্যই অর্থাৎ মহারাষ্ট্র ও মধ্যপ্রদেশ রাষ্ট্রকূটদের হস্তগত হয়। প্রথম কৃষ্ণ ৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে মারা যান। মৃত্যুর আগে তিনি রাষ্ট্রকুট সাম্রাজ্যকে একটি সংহত রূপদান করতে পেরেছিলেন। তবে তার সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি ইলোরার ‘কৈলাসনাথের মন্দির নির্মাণ। পাহাড়ের গায়ে পাথর খোদাই করে নির্মিত এই মন্দির ভাস্কর্য ও শিল্পনৈপুণ্যে আজও বিশ্বজনের বিস্ময় উদ্রেক করে। প্রথম কৃষ্ণের মৃত্যুর পর তাঁর সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হন কৃষ্ণের জ্যেষ্ঠপুত্র দ্বিতীয় গোবিন্দ (৭৭৩-৭৮০ খ্রিঃ)। তিনি ছিলেন ব্যভিচারী। কনিষ্ঠ ভ্রাতা ধ্রুবর হাতে শাসনকার্যের ভার ন্যস্ত করে তিনি অধিকাংশ সময় আমোদ-প্রমোদে ব্যস্ত থাকতেন। ফলে ধ্রুব ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকেন। ভীত গোবিন্দ ধ্রুবকে শাসনক্ষমতা থেকে বিচ্যুত করলে ধ্রুব বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন ও ভ্রাতা গোবিন্দকে পরাজিত করে সিংহাসন দখল করেন। ধ্রুবর সিংহাসনে আরোহণের সাথে সাথে রাষ্ট্রকুটদের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয় (৭৮০-‘৯৩ খ্রিঃ)। তারা আর কেবলমাত্র দক্ষিণ ভারতে আবদ্ধ না থেকে উত্তরের দিকে অগ্রসর হয় এবং এইভাবে রাষ্ট্রকুটগণ সমগ্র ভারতের ইতিহাসে তাদের স্থায়ী স্বাক্ষর স্থাপনে সমর্থ হয়।
আনুমানিক ৭৮০ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় গোবিন্দকে ক্ষমতাচ্যুত করে সিংহাসন দখল করার পরই প্রথম ধ্রুব (৭৮০-৭৯৩ খ্রিঃ) মহীশূরের গঙ্গবংশীয় রাজা, বেঙ্গীর চালুক্যরাজ এবং পল্লবরাজ দম্ভিবর্মনকে পরাজিত করে কাবেরী নদীর তীর পর্যন্ত সমগ্র দক্ষিণ ভারতকে রাষ্ট্রকুট সাম্রাজ্যের অধীনস্থ করেছিলেন। দক্ষিণ ভারত বিজয়ের পর তিনি উত্তর ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তারে মনোযোগী হন। উত্তর ভারতে যে সময় দুটি প্রবল রাজশক্তি ছিল পূর্ব ভারতের পাল বংশ এবং পশ্চিম ভারতের গুর্জর প্রতিহার বংশ। হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর কনৌজকে কেন্দ্র করে এই দুই রাজশক্তির মধ্যে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছিল। রাষ্ট্রকুটরাজ ধ্রুব তৃতীয় শক্তি হিসেবে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অংশ নিলে শতবর্ষব্যাপী পাল প্রতিহার-রাষ্ট্রকূট সংঘাত দেখা দেয়, যা ভারতের ইতিহাসে ‘ত্রিশক্তি দ্বন্দ্ব’ নামে খ্যাত। এই দ্বন্দ্বের প্রথম পর্যায়ে প্রতিহাররাজ বৎসরাজ কনৌজের সিংহাসনে আসীন পালরাজ ধর্মপালের আশ্রিত চক্রায়ুধকে পরাজিত করেন। কিন্তু রাষ্ট্রকুটরাজ ধ্রুব বৎসরাজকে যুদ্ধে পরাজিত করেন ও তাঁকে কনৌজ ছেড়ে রাজপুতানায় পলায়নে বাধ্য করেন। এরপর ধ্রুব পালরাজ ধর্মপালের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন এবং তাকেও পরাজিত করে গঙ্গা-যমুনা-দোয়াব অঞ্চলে নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। তবে ধ্রুব তাঁর উত্তর ভারত অভিযানে বিজয়ী হলেও উত্তর ভারতে রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ্যের ভিত্তিকে কখনোই সুপ্রতিষ্ঠিত করননি। ৭৯০ খ্রিস্টাব্দে তিনি তাঁর রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করেন। ধ্রুব ছিলেন রাষ্ট্রকুটবংশের প্রথম সার্বভৌম নরপতি। তিনি ‘শ্রীবল্লভ’, ‘ধ্রুব নিরুপম ‘ইত্যাদি উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর রাজত্বকালেই রাষ্ট্রকুট-শক্তি প্রবল পরাক্রান্ত হয়ে ওঠে। বস্তুত, আসমুদ্র হিমাচল বিস্তৃত ভারতে ধ্রুবের শক্তিকে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আহ্বান করার মতো কোনো রাজাই তখন ছিল না।
ধ্রুব তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র তৃতীয় গোবিন্দকে (৭৯৩-৮১৪ খ্রিঃ) তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যান। একই সাথে তিনি তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র ঔদ্ভকে গঙ্গাদেবীর শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। স্বভাবতই স্তম্ভ কনিষ্ঠের কর্তৃত্ব স্বীকার না করে বিদ্রোহী হন। স্তম্ভকে এই কাজে পল্লববংশীয় রাজারা এবং শিবরাম নামে এক গঙ্গবংশীয় যুবরাজ সহায়তা করেন। এতদ্সত্ত্বেও স্তম্ভের বিদ্রোহ সফল হয়নি। তৃতীয় গোবিন্দ স্তম্ভকে পরাজিত করেন এবং শিবরামকে হত্যা করেন। স্তম্ভকে কিন্তু গোবিন্দ মুক্তি দেন এবং পুনরায় তাকে গঙ্গাবেদীর শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন, এবং আশ্চর্যের বিষয় স্তম্ভও পরবর্তী জীবনে তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতার অনুগত কর্মচারীরূপেই শাসনকার্য পরিচালনা করেছিলেন। এইভাবে নিজরাজ্যের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন করার পর তৃতীয় গোবিন্দ রাজ্যবিস্তারে মনোযোগী হন। দাক্ষিণাত্যের পল্লবরাজ দত্তিবর্মন, বেঙ্গীরাজ চতুর্থ বিষ্ণুবর্মন শীঘ্রই তাঁর প্রভুত্ব স্বীকার করে নেন। এর ফলে প্রায় সমগ্র দক্ষিণ ভারত তাঁর করায়ত্ত হয়। দক্ষিণ ভারত বিজয়ের পর গোবিন্দ ও তাঁর পিতার ন্যায় উত্তর ভারতের দিকে অগ্রসর হন। তিনি এক বিশাল বাহিনী নিয়ে ভূপাল ও ঝাসীর মধ্য দিয়ে কনৌজের দিকে অগ্রসর হন। উত্তর ভারতে তখনও পাল ও প্রতিহার রাজারা সক্রিয় ছিলেন, ফলে তৃতীয় গোবিন্দের উত্তর ভারত অভিযানের সাথে সাথে ত্রিশক্তি দ্বন্দ্বের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয়। প্রতিহাররাজ নাগভট্ট গোবিন্দকে বাধা দেন, কিন্তু তিনি যুদ্ধে পরাজিত হয়ে রাজপুতানায় পলায়ন করতে বাধ্য হন। কনৌজের রাজা পালবংশীয় ধর্মপালের আশ্রিত চক্রায়ুধ বিনাযুদ্ধে তৃতীয় গোবিন্দের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। পালবংশীয় ধর্মপালও তাঁর প্রবল শত্রু নাগভট্টকে পরাজিত করায়, কৃতজ্ঞতাস্বরূপ গোবিন্দের কাছে বিনাযুদ্ধেই বশ্যতা স্বীকার করেন। অতঃপর গোবিন্দের বিজয়বাহিনী সম্ভবত হিমালয়ের পাদদেশে প্রয়াগ, গয়া ও বেনারস অবধি অগ্রসর হয়েছিল। কিন্তু গোবিন্দও তাঁর পিতার মতো উত্তর ভারতে রাষ্ট্রকুট-শাসনকে দৃঢ়প্রতিষ্ঠ করার সুযোগ পাননি। তাঁর অনুপস্থিতির সুযোগে দাক্ষিণাত্যের গঙ্গ, পল্লব, পাণ্ড্য এবং কেরলবংশীয় রাজারা একত্রিত হয়ে রাষ্ট্রকুটদের বিরোধী এক শক্তিজোট গঠন করেন। এই একত্রিত শক্তিজোটকে দমন করতে তৃতীয় গোবিন্দকে দাক্ষিণাত্যে প্রত্যাবর্তন করতে হয়। দাক্ষিণাত্যে ফেরার পথে তিনি মালব, কোশল, বেঙ্গী প্রভৃতি রাজ্যগুলিকে নিজ বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করেন। দাক্ষিণাত্যে ফিরেই গোবিন্দকে গঙ্গা, পল্লব, পাণ্ড্য ও কেরলদের মিলিত শক্তিজোটের সাথে প্রবল সংগ্রামে লিপ্ত হতে হয়, কিন্তু তিনি একে একে সব দক্ষিণ ভারতীয় নৃপতিকেই যুদ্ধে পরাজিত করেন এবং পল্লবদের রাজধানী কাঞ্চি দখল করে নেন। এইভাবে সমগ্র দক্ষিণ ভারতে রাষ্ট্রকূটবংশের কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। কথিত আছে, তৃতীয় গোবিন্দের পরাক্রমে ভীত হয়ে সিংহলের রাজাও রাষ্ট্রকুটরাজের বশ্যতা স্বীকার করেন। সামরিক শক্তি ও রাজ্যসীমার বিচারে তৃতীয় গোবিন্দই ছিলেন শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রকূট নরপতি।
তৃতীয় গোবিন্দের আমলে রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ্য শক্তি ও গৌরবের শিখরে আরোহণ করেছিল। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথেই এই সুবিশাল সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয়। তৃতীয় গোবিন্দের মৃত্যুর পর তাঁর নাবালক পুত্র প্রথম অমোঘবর্ষ সিংহাসনে আরোহণ করেন (৮১৪-‘৭৮ খ্রিঃ)। অবশ্য এ সময় তাঁর অভিভাবক হিসেবে রাজকার্য পরিচালনা করতেন তৃতীয় গোবিন্দের ভ্রাতুষ্পুত্র এবং গুজরাট ও মালবের শাসনকর্তা কর্ক/অমোঘবর্ষের সিংহাসনে বসার অনতিকাল পরেই রাষ্ট্রের মন্ত্রী ও রাজকর্মচারীরা ক্ষমতা আত্মসাৎ করতে থাকেন এবং রাজপরিবারের মধ্যেও অন্তর্দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এমতাবস্থায় রাজ্যের সর্বত্র বিদ্রোহ দেখা দেয়, বিদ্রোহ এত তীব্র হয়ে ওঠে যে, বালক অমোঘবর্ষ রাজধানী ত্যাগ করতে বাধ্য হন। তবে কিছুদিনের মধ্যেই কর্কের সহায়তায় তিনি আবার সিংহাসন লাভ করতে সমর্থ হন। রাষ্ট্রকুটবংশের বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তৃতীয় গোবিন্দ দ্বারা একদা পরাজিত বেঙ্গীর রাজা দ্বিতীয় বিজয়াদিত্য। অমোঘবর্ষ নিজ হস্তে শাসনভার গ্রহণ করে ৮৩০ খ্রিস্টাব্দে বিজয়াদিত্যকে পরাজিত করেন এবং বেঙ্গী দখল করেন। এরপর প্রায় দশ বছর বেঙ্গী তাঁর করায়ত্ব ছিল। এইভাবে রাজ্যের অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন করলেও অমোঘবর্ষের হাত থেকে গঙ্গাবেদী হস্তচ্যুত হয়। প্রায় কুড়ি বৎসর পরে মহীশূরের গঙ্গবংশীয় রাজাদের সাথে যুদ্ধ করলেও অমোঘবর্ষ পরাজিত হন ও গঙ্গদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য হন। কর্কের সাথে অমোঘবর্ষের সৌহার্দ্য কর্কের মৃত্যু অবধি স্থায়ী ছিল, কিন্তু কর্কের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র প্রথম ধ্রুব অমোঘবর্ষের বশ্যতা স্বীকারে অস্বীকার করেন। উভয়ের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। পঁচিশ বর্ষ ব্যাপী এই যুদ্ধের অবসান ঘটে প্রথম ধ্রুবের পৌত্র দ্বিতীয় ধ্রুবের মধ্যস্থতায় যখন প্রতিহাররাজ প্রথম ভোজ রাষ্ট্রকুটবংশের উত্তরাংশ আক্রমণে উদ্যোগী হন। উভয়ের মিলিত শক্তি প্রতিহারদের প্রতিহত করেছিল।
অমোঘবর্ষ ষাট বছরেরও বেশি সময় ধরে রাজত্ব করেছিলেন। তবে পূর্বপুরুষদের মতো সামরিক প্রতিভা তাঁর ছিল না। যুদ্ধজয়ের মাধ্যমে রাজ্যবিস্তার অপেক্ষা শান্তির পথকেই তিনি শ্রেয় হিসেবে বেছে নেন। তিনি নিজেও ছিলেন সুলেখক। তাঁর সভায় বহু হিন্দু ও জৈন ধর্মাবলম্বী লেখক সহাবস্থান করতেন। অমোঘবর্ষের রচিত ‘রত্নমালিকা’ ও ‘কবিরাজমার্গ’ গ্রন্থ দুটি সুধীজন সমাজে বহু প্রশংসিত এবং এগুলি কানাড়ি সাহিত্যের আদি নিদর্শনগুলির অন্যতম। এমনকি আরব পর্যটক সুলেমান বলেছেন যে, অমোঘবর্ষ ছিলেন ভারতের শ্রেষ্ঠ নরপতি এবং তিনি চিন সম্রাট, বাগদাদের খলিফা ও কনস্টানটিনোপোলের সম্রাটের সাথে তুলনীয়।
অমোঘবর্ষের পর তাঁর পুত্র দ্বিতীয় কৃষ্ণ সিংহাসনে বসেন (৮৭৮-৯১৪ খ্রিঃ)। তাঁর আমলে বেঙ্গীর চালুক্যরাজা তৃতীয় বিজয়াদিত্য কলচুরির রাজার সহায়তায় রাষ্ট্রকুট সাম্রাজ্য আক্রমণ করে। প্রাথমিক যুদ্ধে দ্বিতীয় কৃষ্ণ পরাজিত হলেও অবশেষে তিনি চালুক্যদের পরাজিত করেন এবং বিজয়াদিত্যের উত্তরাধিকারী ভীমকে বন্দি করেন ও তাঁকে নিজের সামন্তরাজায় পরিণত করেন। দ্বিতীয় কৃষ্ণের আমলের অপর উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল—প্রতিহাররাজ ভোজের সাথে দীর্ঘকালব্যাপী যুদ্ধ। এই যুদ্ধে কৃষ্ণ পরাজিত হন এবং প্রতিহাররা মালব এবং কাথিয়াওয়াড় উপদ্বীপ দখল করে নেয়। দ্বিতীয় কৃষ্ণ ৯১৪ খ্রিস্টাব্দে মারা যান এবং তাঁর পৌত্র তৃতীয় ইন্দ্ৰ (৯১৪-‘২২ খ্রিঃ) সিংহাসনে বসেন। সিংহাসনে বসার কিছুকাল পরেই তৃতীয় ইন্দ্র রাষ্ট্রকূটবংশের হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারের জন্য উত্তর ভারতে সামরিক অভিযান প্রেরণ করেন। এই অভিযানে তিনি প্রতিহাররাজ মহীপালকে পরাজিত করেন ও কনৌজ অধিকার করেন, কিন্তু তিনিও কনৌজে স্থায়ী আধিপত্য কায়েম করেননি। দক্ষিণ ভারতে ফিরে তৃতীয় ইন্দ্র বেঙ্গীর চালুক্যরাজ চতুর্থ বিজয়াদিত্যকে যুদ্ধে পরাজিত করেন ও হত্যা করেন। তৃতীয় ইন্দ্রের মৃত্যুর পর রাষ্ট্রকূটবংশের পতন ত্বরান্বিত হয়। তৃতীয় ইন্দ্রের পর সিংহাসনে বসেন তার পুত্র দ্বিতীয় অমোঘবর্ষ, কিন্তু অনতিকালের মধ্যেই চতুর্থ গোবিন্দ তাঁকে হত্যা করে সিংহাসন দখল করেন। চতুর্থ গোবিন্দের অত্যাচার প্রজাদের অতিষ্ঠ করে তোলে এবং শীঘ্রই (৯৩৬ খ্রিঃ) চতুর্থ গোবিন্দের খুল্লতাত তৃতীয় অমোঘবর্ষ গোবিন্দকে ক্ষমতাচ্যুত করে শাসনভার গ্রহণ করেন। তৃতীয় অমোঘবর্ষের তিন বছরের রাজত্বকালে মূল শাসনক্ষমতা ছিল তার পুত্র তৃতীয় কৃষ্ণের হাতে। তৃতীয় কৃষ্ণ (৯৪০-৬৮ খ্রিঃ) ছিলেন রাষ্ট্রকূটবংশের শেষ উল্লেখযোগ্য নরপতি। তিনি সিংহাসনে বসার পর রাষ্ট্রকুটবংশের হারানো মর্যাদা পুনরুদ্ধারে ব্রতী হন। তিনি উত্তর ভারতে প্রতিহাররাজ মহীপালকে পরাজিত করে ‘কালাঞ্জর’ ও ‘চিত্রকুট’ দুর্গ দুটি দখল করেন। গঙ্গাবেদীর শাসকের সহায়তায় কৃষ্ণ চোলরাজ রাজাদিত্যকে পরাজিত করেন এবং কাঞ্চি ও তাঞ্জোর দখল করেন। কৃষ্ণ তাঁর বিজয় অভিযান রামেশ্বর পর্যন্ত বিস্তৃত করেন এবং সেখানে এক বিজয়স্তম্ভও স্থাপনা করেন। চোল ছাড়া তিনি দক্ষিণ ভারতে পাণ্ড্য ও কেরলদেরও পরাজিত করেন। তৃতীয় কৃষ্ণ উত্তর ভারতে আরও একবার অভিযান চালিয়ে (৯৬৩ খ্রিঃ) মালব ও উজ্জয়িনী দখল করেন এবং বুন্দেলখও অবধি অগ্রসর হন। কিন্তু তাঁর এই সাফল্য ছিল সম্পূর্ণ নিভে যাওয়ার আগে প্রদীপশিখার শেষবার উজ্জ্বল হয়ে ওঠার মতোই। তাঁর মৃত্যুর পর রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে সামন্তরাজারা বিদ্রোহ করতে থাকে। অবশেষে আনুমানিক ৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে রাষ্ট্রকুটদেরই সামন্তরাজা কল্যাণের চালুক্যবংশীয় তৈল বা তৈলপ শেষ রাষ্ট্রকুটরাজ দ্বিতীয় কর্ককে পরাজিত করে রাষ্ট্রকুট বংশের অবসান ঘটান।
রাষ্ট্রকুট শাসনব্যবস্থা :
রাষ্ট্রকুট শাসনব্যবস্থায় রাজা ছিলেন সর্বোচ্চ প্রশাসক। তিনি প্রতিদিন রাজদরবারে উপস্থিত থেকে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। তাঁরা ‘মহারাজাধিরাজ’, ‘পরমভট্টারক’ প্রভৃতি উপাধি ধারণ করতেন। রাজা কর্তৃক মনোনীত মন্ত্রীগণ শাসনকার্যে সহায়তা করতেন। যুবরাজ ও অন্যান্য কুমারগণ গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদে নিযুক্ত হতেন। মন্ত্রীদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও রাজস্বমন্ত্রী ছিলেন বিশেষ ক্ষমতাশালী।
রাষ্ট্রকুট শাসকদের প্রত্যক্ষ শাসিত অঞ্চলগুলি প্রদেশ, বিষয় ও ভুক্ত এই তিনভাগে বিভক্ত ছিল। শাসনব্যবস্থার সর্বনিম্ন একক ছিল ‘গ্রাম’। প্রদেশ বা রাজ্যের শাসনকর্তাকে বলা হত ‘রাষ্ট্রপতি’। নিজ এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা, সামরিক বাহিনীকে নিয়ন্ত্রিত করা প্রভৃতি কাজ রাষ্ট্রপতিকে করতে হত। বিষয়-এর প্রধান শাসককে বলা হত ‘বিষয়পতি’ । গ্রামগুলির শাসনের ভার ছিল গ্রাম-প্রধানের ওপর। শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য গ্রাম-প্রধানের অধীনে একটি সুশিক্ষিত লাঠিয়াল বাহিনী থাকত। গ্রাম মহাজন’ বা ‘গ্রাম-মহাত্তার’ নামক গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের পরামর্শক্রমে গ্রাম-প্রধান গ্রাম-শাসন করতেন। গ্রামের অভ্যন্তরীণ উন্নয়নমূলক কাজও গ্রাম-প্রধানকে করতে হত। রাষ্ট্রের আয়ের প্রধান উৎস ছিল ভূমিরাজস্ব। উৎপন্ন ফসলের এক-চতুর্থাংশ কর হিসেবে গৃহীত হত। এ ছাড়া জলকর, খনিজ দ্রব্যের ওপর কর প্রভৃতিও আদায় করা হত। ‘দেশগ্রামুক্ত’ নামে রাজস্ব কর্মচারীদের ওপর কর আদায়ের ভার ন্যস্ত থাকত। রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ্যে সামন্ত-শাসনেরও অস্তিত্ব ছিল। শাসনতান্ত্রিক ব্যাপারে সামন্তরাজাগণ ছিলেন স্বাধীন। তাঁরা রাষ্ট্রকুট রাজাদের নিয়মিত কর দিতেন এবং যুদ্ধের সময় সেনাবাহিনী দিয়ে সাহায্য করতেন। রাষ্ট্রকূটবংশের রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অনন্ত আলতেকার তাই বলেছেন : “The period of Rashtrakuta ascendancy in Deccan constitutes perhaps the most brilliant chapter in its history.”
Leave a comment