বিজ্ঞানসাধনা-দার্শনিকতা ও সাহিত্যভাবনার একত্র মিলনে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যে এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। সুরেশচন্দ্র সমাজপতি তাঁর মধ্যে “দর্শনের গঙ্গা বিজ্ঞানের সরস্বতী ও সাহিত্যের যমুনার” ত্রিবেণীসঙ্গম লক্ষ্য করেছিলেন।
তাঁর প্রবন্ধ পাঠ করে অতুল গুপ্ত ভেবেছিলেন : “বিজ্ঞানের মাটিতে শিকড় গেড়ে দর্শনের আকাশে পাখা মেলেছে, এবং সাহিত্যের অমৃতরস এদের অক্ষয় নবীনতা দান করেছে” (নলিনীরঞ্জন পণ্ডিত সম্পাদিত, ‘আচার্য রামেন্দ্রসুন্দর’ গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত)। তাঁকে দেখে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মনে হয়েছে “বিদ্যার একটা বড় জাহাজ।” আর বর্ষীয়ান বিশ্বকবি তার এই স্নেহানুজকে পঞ্চাশ বৎসর পূর্তি উপলক্ষে ‘অভিবাদন’ করেছেন এই বলে: “তোমার হৃদয় সুন্দর, তোমার বাক্য সুন্দর, তোমার হাস্য সুন্দর, হে রামেন্দ্রসুন্দর, আমি তোমাকে সাদরে অভিবাদন করিতেছি।”
রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর জন্ম ও কর্মজীবন:
মুর্শিদাবাদ জেলার শক্তিপুরের কাছে টেয়া-বৈদ্যপুর গ্রাম রামেন্দ্রসুন্দরের পৈত্রিক নিবাস। তার পূর্বপুরুষ বলভদ্র ত্রিবেদী জেমোকান্দিতে বসবাস করেন। ১৮৬৪ খ্রীস্টাব্দের ২০শে আগস্ট রামেন্দ্রসুন্দরের জন্ম। পিতা গোবিন্দসুন্দর ত্রিবেদী, মা চন্দ্ৰকামিনী দেবী। গোবিন্দসুন্দর বিজ্ঞান ও সাহিত্যে সুপণ্ডিত ছিলেন। তিনি ‘বঙ্গবালা’ নামে একটি উপন্যাস লেখেন। ত্রিবেদী পরিবারে সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চার ঐতিহ্য ছিল। রামেন্দ্রসুন্দর ছাত্রজীবন থেকেই সাহিত্য রচনায় পারদর্শী ছিলেন। শৈশব থেকেই রামেন্দ্রসুন্দরের ছাত্রজীবন কৃতিত্বে উজ্জ্বল। পাঠশালার বার্ষিক পরীক্ষা থেকে স্নাতকোত্তর শ্রেণী পর্যন্ত সর্বত্রই তিনি প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন। ১৮৮১ খ্রীস্টাব্দে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় প্রথম ও রসায়ন শাস্ত্রে প্রথম হন। ১৮৮২-তে পি. আর. এস. বৃত্তি পান। তারপরে সুদীর্ঘকাল (১৬ বছর) রিপন কলেজের অধ্যাপক এবং (১৯০৩-১৯১৯ খ্রীঃ) অধ্যক্ষরূপে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময় থেকে মৃত্যুকাল পর্যন্ত এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
বঙ্কিমযুগেই রামেন্দ্রসুন্দরের রচনার সূচনা। সেই কারণে বঙ্কিমের কাছ থেকে যুক্তিবাদের পাঠ নিয়ে তার সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন আপন হৃদয়ের অনুভূতি এবং পরিশীলিত প্রজ্ঞা। তার প্রবন্ধ রচনার মধ্যে আছে বিষয়ের ব্যাপ্তি ও বিস্তৃতি। বস্তুতঃ শিক্ষা-সাহিত্য-ভাষাবিজ্ঞান-বৈদিক যজ্ঞকাণ্ড বিজ্ঞান-দর্শন ধর্ম-স্বদেশ-সমাজ-সংস্কৃতি থেকে শুরু করে বাঙালীর ব্রতকথা পর্যন্ত সর্বত্রই তার ভাবনার বিস্তার। বলা বাহুল্য, এই ভাবনাসমূহ পুঁথিগত নয়, সমকালের চেতনায় উদ্দীপ্ত। তাঁর অবদান এককথায় নানামুখী। তবু প্রধান তিনটি দিক হল—(ক) ধর্ম-নির্ভর দার্শনিকতার বদলে বিজ্ঞান-নির্ভর দার্শনিকতার প্রকাশ। (খ) জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিষয় এবং দর্শন-সমৃদ্ধ সত্য-স্বরূপকে সরস ভঙ্গিমায় পরিবেশন। (গ) উচ্ছ্বাসহীন জাতীয়তাবোধের প্রকাশ।
রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর গ্রন্থসমূহ:
‘প্রকৃতি’ (১৮৯৬), ‘পুণ্ডরীক কুলকীৰ্ত্তি পঞ্জিকা’ (১৯০০–ফতেসিংহ জমিদারীর ইতিবৃত্ত), ‘জিজ্ঞাসা’ (১৯০৪), ‘বঙ্গলক্ষ্মীর ব্রতকথা’ (১৯০৬), ‘মায়াপুরী’ (১৯১১), ‘ঐতরেয় ব্রাহ্মণ’ (১৯১১), ‘চরিতকথা’ (১৯১৩), ‘কর্মকথা’ (১৯১৩), ‘বিচিত্র প্রসঙ্গ’ (১৯১৪), ‘শব্দকথা’ (১৯১৭), ‘যজ্ঞকথা’ (১৯২০), ‘বিচিত্র জগৎ’ (১৯২০), ‘নানা কথা’ (১৯২৪), ‘জগৎকথা’ (১৯২৬) প্রভৃতি। এছাড়া ‘নানাকথা’, ‘বিচিত্রজগৎ’ বা মাসিক পত্রে প্রকাশিত বেশ কিছু বিষয় সমৃদ্ধ প্রবন্ধ এক সময় আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।
সমকালের বিজ্ঞান-চিত্তাকে সাধারণ বাঙালীর ঘরে পৌঁছে দেওয়ার কাজে রামেন্দ্রসুন্দরের কৃতিত্ব অপরিসীম। ডারউইন, ক্লিফোর্ড হেলম্হোল্টস, প্রমুখ বৈজ্ঞানিকদের বিজ্ঞান-আলোচনার ধারা ব্যাখ্যা করে বিজ্ঞানের দার্শনিক প্রত্যয় রূপে তিনি উপস্থিত করেছেন। তার বিজ্ঞান আলোচনায় প্রসাদগুণান্বিত ভাষারীতির কিছু দৃষ্টান্ত লক্ষ্য করা যেতে পারে। রামেন্দ্রসুন্দর বৈজ্ঞানিকের মতো বিশ্লেষণ করেছেন, দার্শনিকের মতো চিন্তা করেছেন ও সাহিত্যিকের মতো সরসভাবে প্রকাশ করেছেন।
দৃষ্টান্তপ্রবণতা : তাঁর স্টাইলের একটি অন্যতম পরিচয় হল দৃষ্টান্তপ্রবণতা। বক্তব্যকে হৃদ্য ও গ্রাহ্য করা এবং সম্ভাব্যতা দান করার জন্য তিনি দৃষ্টান্তের দিকে ঝুঁকেছেন। এই দৃষ্টাক্ত প্রবণতাও আবার বহুমিশ্র ভাবনার ফলশ্রুতি। (ক) কখনো প্রাত্যহিক জীবনের থেকে আহরণ, (খ) কখনো নৃতত্ত্ব, ইতিহাস-বিষয়ক দৃষ্টান্ত অন্বেষণ, (গ) কখনো বা সাহিত্য থেকে উদাহরণদান।
প্রাত্যহিক জীবনের উল্লেখ আছে অতি প্রাকৃত প্রথম প্রস্তাবে’—
প্রাত্যহিক দৃষ্টান্ত : জলের মাছের উল্লেখ—
-
(১) “লোকালয়ের বাহিরে ও দূরে বৃহৎ জলাশয়ে নানা জাতীয় ছোট বড় মাছ, কাছিম, কাঁকড়া ও শামুক-গুগলির সহিত পুরুষাপরম্পরা ক্রমে ঘরকন্না করে” (‘অতি প্রাকৃত প্রথম প্রস্তাব’)।
-
(২) “প্রহারের দর্শন শ্রবণ বা কল্পনা ভয়ানক; কিন্তু প্রহার খাইতে তেমন কষ্ট নাই। সকলে পরীক্ষা করিতে সম্মত হইবেন কি না সন্দেহ” (সুখ না দুঃখ’)।
-
(৩) “হার্বার্ট স্পেন্সার একালের অভিব্যক্তিবাদের একজন প্রধান পাণ্ডা” (পূর্বোক্ত)।
-
(৪) “ফিজি দ্বীপের লোক বুড়া বাপকে রাঁধিয়া খায়” (পূর্বোক্ত)।
হাস্যরস : ১। যদি কোন প্রকাশ্য বৈজ্ঞানিক আসিয়া হঠাৎ প্রতিপন্ন করিয়া দেন যে, ভূত আছে ও তাহার পা বাঁকা, তাহা হইলে মন যেন হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচে (অতিপ্রাকৃত প্রথম প্রস্তাব’)।
নৃতত্ত্বের উল্লেখ : ২। “কত অতিকায় হস্তী, কত ভীমাকায় কুম্ভীর, কত বিশাল বিহঙ্গম এক কালে ধরাপৃষ্ঠে নাচিয়া বেড়াইয়াছিল। এখন তাহারা কোথায়? এখন তাহারা লোপ পাইয়াছে, তাহাদের শিলীভূত কঙ্কাল তাহাদের অস্তিত্বের একমাত্র সাক্ষী হইয়া বর্তমান” (“অমঙ্গলের উৎপত্তি)।
ইতিহাসের দৃষ্টান্ত : ৩। “ইহুদী জাতির বাইবেল নামক প্রামাণিক ইতিবৃত্তের” বিবরণ। (‘অমঙ্গলের উৎপত্তি’) “তৈমুরলঙ্গ ও চেঙ্গিস খাঁর অবলম্বিত নীতির” ব্যাখ্যা (ঐ); “পাঁচশ বছর পূর্বের ঋষিদের তপোবনের মত ‘শান্তরসাস্পদ’ জগৎটাকে ‘নাদির শাহে’র অনুগৃহীত দিল্লীর” (সুখ না দুঃখ’) সঙ্গে তুলনা দান ইত্যাদি।
রামায়ণের উল্লেখ : ৪। “রামায়ণ মানবজীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ দুঃখ-সঙ্গীত। তবে বৈরাগ্য-অবলম্বন ইহার উপদেশ নহে” (সুখ না দুঃখ’)। “অমঙ্গলের জয়বার্তা গীত হইয়াছে। রামায়ণের আদি কবি সেই গীতি গাহিয়াছেন। ভারতের ইতিহাস সেই গীতের প্রতিধ্বনি” (‘অমঙ্গলের উৎপত্তি’)।
নৈয়ায়িক ভঙ্গী : ৫। “এক বল, ঈশ্বর সর্ব্বশক্তিমান; তাহা হইলে তিনি দয়াময় নহেন। অথবা বল, তিনি দয়াময়; তাহা হইলে তিনি পূর্ণশক্তি নহেন” (ঐ)।
৬। ভক্ত-প্রেমিক-দার্শনিকদের মঙ্গলের সপক্ষে নিজস্ব ধারণার শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করে সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতাকে ব্যঙ্গ করার বিরুদ্ধে উষ্মা ও প্রতিক্রিয়া—“তিনি আমার মত হতভাগ্যকে কৃপা করুণ; কিন্তু সংসার বিষে জর্জরিত আমার নিকট অমঙ্গলের অস্তিত্ব অপলাপ করিয়া আমাকে বিদ্রূপ করিলে তাহার সহৃদয়তায় আমি বিশ্বাস করিব না (অমঙ্গলের উৎপত্তি’)।
‘জিজ্ঞাসা’ গ্রন্থভুক্ত ‘অমঙ্গলের উৎপত্তি’ প্রবন্ধটি প্রায় আদ্যন্ত চড়া সুরে বাঁধা। প্রবন্ধের প্রথমেই ভূমিকম্পে মৃত্যু উপলক্ষ্যে মঙ্গলময় ঈশ্বরের বিধানের ব্যাখ্যাতাদের উপলক্ষে লেখক ব্যঙ্গযুক্ত বাক্যে তাদের মনোভাব বিশ্লেষণ করেছেন। যেমন কোনো নিরীহ ব্যক্তির “মাথা চেপ্টা করিয়া দিয়া তাহার অনাথা পত্নীর অন্নের সংস্থান বন্ধ করা হইল কেন” সংশয়বাদীর এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন তথাকথিত মঙ্গলপন্থী মানুষেরা এইভাবেঃ “সে ব্যক্তি না হয় নিৰ্দ্দোষ ও নিষ্কলঙ্ক ছিল, কিন্তু তাহার পত্নীর কথা কে জানে? অথবা তাহার দোষ না থাকুক, তার বাপের দোষ ছিল, অথবা পিতামহের দোষ ছিল; অথবা এ জন্মে দোষ না থাক, পূৰ্ব্বজন্মে দোষ ছিল না, তাহা কে বলিল?” তারপরই ব্যঙ্গ তুঙ্গে উঠেছে (পরের অংশেই) “ব্যাঘ্র মেষশাবককেও ঠিক এইরূপ বলিয়াছিল।”
কিম্বা মঙ্গলময় ঈশ্বরের মানুষের জন্য বিচিত্র দ্রব্য সৃষ্টির আয়োজনকে ব্যঙ্গ করে ঃ (মঙ্গলবাদীদের বক্তব্যকে) “তিনি কৃতজ্ঞতাভাজন, স্তুতিভাজন ও প্রীতিভাজন; কেন না, তাঁহার রচিত জগতের মধ্যে আমরা এত স্ফূর্তি সহকারে বেড়াইতেছি। অতএব গাও হে তাহার নাম” ইত্যাদি।
বিপরীতভাবে, তার ‘বঙ্গলক্ষ্মীর ব্রতকথা’ গ্রন্থটি প্রধানতঃ স্বাদেশিকতার ব্রত-দীক্ষায় সমৃদ্ধ; স্বদেশপ্রেমের সঙ্গে কবিত্বের ঘনিষ্ঠ সংযোগের ফলে ভাষা হয়ে উঠেছে ভক্তের নমনীত আবেগে পরিপূর্ণ : “মা লক্ষ্মী কৃপা কর। কাঞ্চন দিয়ে কাচ নেব না। শাঁখা থাকতে চুড়ি পরবো না। ঘরের থাকতে পরের নেব না।” রামেন্দ্রসুন্দরের ‘চরিতকথা’ গ্রন্থটি বাংলা সাহিত্যে মনীষীদের জীবন-চিত্রায়ণের এক অমূল্য সংযোজন। এখানে আছে আটজন মনীষীর জীবনী চিত্র : ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, হর্মান হেলম্হোল্যজ, আচার্য মক্ষমূলর, উমেশচন্দ্র বটব্যাল, রজনীকান্ত গুপ্ত এবং বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিষয়ের ভাব এখানে ভাষার লাবণ্যে কমনীয় হয়ে উঠেছে। এই গাম্ভীর্য ও কমনীয়তার গুণেই রামেন্দ্রসুন্দর রমণীয়।
Leave a comment