প্রথমেই একথা স্বীকার, যে এই চারটি কাব্যই মহাকাব্যের অন্তর্গত। আমরা আগে জেনেছি মহাকাব্যের দুটি শ্রেণি। (১) আদি মহাকাব্য বা বিশুদ্ধ মহাকাব্য বা অকৃত্রিম কিংবা স্বতঃস্ফূর্ত মহাকাব্যে যাকে ইংরেজিতে বলা হয় Autheniepic ও (২) সাহিত্যিক মহাকাব্য বা Literary epic.এখন আলোচনা করে দেখা যেতে পারে প্রশ্নোধৃত কাব্য চতুষ্টয় কোনো শ্রেণির মহাকাব্যের অন্তর্ভুক্ত।
প্রথমে ‘রামায়ণ’কে নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। রামায়ণ একটি ‘সার্থক’ আদি মহাকাব্যের নিদর্শন কারণ আদি মহাকাব্যের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য সারল্যের পরিচয় মেলে আখ্যানের প্রতিটি ছত্রে। পিতৃসত্য রক্ষার্থে অযোধ্যার রাজপুত্র রামচন্দ্রের চৌদ্দ বৎসরের বনবাস, অগ্রজের প্রতি অনুজ লক্ষ্মণের ভক্তি ও আনুগত্য, রাবণ কতৃক সীতার অপহরণ ও রামভক্ত হনুমান এবং রানর সেনাদের তৎপরতা ও সহযোগিতায় রাবণ নিধন ও সীতা উদ্ধার অযোধ্যা প্রত্যাবর্তন করে প্রজানুরজ্জনের স্বার্থে সীতার অগ্নিপরীক্ষা ইত্যাদি নিয়ে এক সরল ও আদর্শয়িত কাহিনি বিন্যাস। আদি মহাকাব্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল এ জাতীয় মহাকাব্যের বিষয় হবে ‘বীরপুরুষদের কথা’, রামায়ণ নিঃসন্দেহে তাই-ই। আশীবৰ্চন, নমস্ক্রিয়া ইত্যাদির মাধ্যমে মহাকাব্যের আদি-মধ্য-অন্ত্য সম্বলিত সমগ্র কাহিনি বৃত্তটিও এ মহাকাব্যে পূর্ণ ও সুগঠিত। বিশ্বনাথ কবিরাজ নির্দেশিত তিন রস অর্থাৎ শৃঙ্গার বীর ও শান্ত-রসের মধ্যে বীররসই যদিও রামায়ণের অসীম তবুও অন্যান্য রসের আভাসে সেই মূল রসের পুষ্টি। এবং শেষ লক্ষণ কাব্য বলা যেতে পারে রামায়ণ মহাকাব্যের ভাষা তার সম্পদ। এমন গুণগম্ভীর ভাষা, পৃথিবীর আদি ছন্দ অনুষ্টুপ ছন্দে এ কাব্য রচিত। বৈদিক ভাষার ছন্দের অসামান্য ঐশ্বর্য মাধুর্যে রাময়ণ আদি মহাকাব্য হিসাবে সার্থকতা লাভ করেছে।
রামায়ণের পরে আমরা হোমারের ইলিয়ডকে নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করতে পারি। ইলিয়ড ও রামায়ণের মতো আদি মহাকাব্যের পর্যায়ভুক্ত। খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতকে রচিত ইলিয়ড। এ কাব্যের মূল বিষয়বস্তু মোটামুটি এরকম, খ্রিস্টপূর্ব ত্রয়োদশ শতকের শেষপাদে গ্রিক সুন্দরী হেলেনকে কেন্দ্র করে ট্রয় রাজ্যের দীর্ঘ অবরুদ্ধ দশ। ও অস্তিমে গ্রিসের সামরিক শক্তির কাছে ট্রয়ের নতি স্বীকার। অতিকায় এই মহাকাব্যটির ব্যাপ্তি, সমুন্নতি ও গম্ভীর্যে জাতীয় জীবনের অকৃত্রিম আলেখ্য রচনা করেছে। সুচনাংশের প্রার্থনা, যুদ্ধ বিগ্রহ দেব-দেবীর অংশগ্রহণ, মহাকাব্যিক উপমার সাহায্যে ভাষার অলঙ্করণে ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য সমুজ্জ্বল হয়ে আদি মহাকাব্যের শিক্ষা প্রাপ্তি ঘটেছে ‘ইলিয়ড’-র ক্ষেত্রে।
কালিদাসের অমর সৃষ্টি কুমার সম্ভব। এটি একটি সাহিত্যিক মহাকাব্যের উদাহরণ, অধিকাংশ সমালোচকই এ ব্যাপারে একমত যে কুমার সম্ভবই কালিদাস রচিত সর্বাপেক্ষা প্রাচীন মহাকাব্য হরপার্বতীর মিলন ও অশুভ শক্তির বিনাশার্থে কার্তিকের-র জন্মলাভই এ কাব্যের মূল বিষয়। মোট সতেরোটি সর্গে কবি এই কাহিনিটিকে বিস্তৃত বর্ণনা করেছেন। কুমারসম্ভব যেহেতু মহাকাব্য তাই-ই এই কাব্যে সানুপুঙ্খ বর্ণনার প্রচুর সুযোগ ছিল যা কবি সদ্ব্যাবহার করেছেন। হর পার্বতীর মিলন বর্ণনায় কবি যে সুযোগ কাজে লাগিয়েছেন। যার ফলে শরীরী মিলনের মূহূর্তগুলি অনেক দীর্ঘয়িত ও সানুপুঙ্খ হয়েছে। আর এ মহাকাব্য আদি মহাকাব্যের মর্যাদা থেকে বঞ্ছিত, কারণ, একাব্যে ছন্দোবৈচিত্র্য নেই, অজান্তে কবি নূতন ছন্দ ব্যবহার করেননি, এছাড়াও সাহিত্যেক মহাকাব্যের বৈশিষ্ট্য মেনে এ কাব্যের বিষয়বস্তু সংগৃহীত হয়েছে, পুরাণ থেকে, যদিও তা কবির ‘মনের মাধুরী’ মিশে অনন্য হয়ে উঠেছে। সুতরাং একাব্য সাহিত্যিক মহাকাব্য।
‘মেঘনাদ বধ কাব্য’ একটি সার্থ-সাহিত্যিক মহাকাব্যের উদাহরণ। এ কাব্য আদি মহাকাব্যের গৌরব সর্ব্বাংশ দাবী করতে পারে না। যদিও তিনি তার কাব্যকে অনধিক অষ্টম সর্গে বিভক্ত করেছেন ও সংস্কৃত অলংকার শাস্ত্রানুসারে তাতে বন, পাহাড়, নগর, সন্ধ্যা, প্রভাত, যুদ্ধ, মন্ত্রণা ইত্যাদির সমাবেশ ঘটিয়েছেন তবুও তার কাব্যে আদি মহাকাব্যের মর্যাদা পায়নি, কারণ, কবি অজান্তে নূতন ছন্দ ব্যবহার করেননি। যদিও তিনি বলেছেন—‘গাইব মা বীররসে ভসি মগগীত’—তবুও কাব্যে করুণ রসের স্রোেত সর্বত্র লক্ষিত হয়। এছাড়াও অলংকার শাস্ত্রানুসারে মহাকাব্য মিলনান্তক, কিন্তু মধুসূদনের মহাকাব্য বিষদাত্মক। সর্বোপরি মেঘনাদ বধের নায়ক রাবণ কিংবা ইন্দ্রজিৎ কেউই সুবংশজাত ও ধীরোদত্তে গুণ সমন্বিত নন, তার। অনার্য বংশ জাত। সুতরাং মেঘনাদ বধ কাব্যকে মহাকাব্যের মর্যাদা দিলেও তাকে আদি মহাকাব্যের মর্যাদা দেওয়া যায়।
Leave a comment