“Rammohan stands in History as the living bridge, over which India marches from her unmeasured past to her incalculable future” (S. D. Collet: ‘Life and Letters or Raja Rammohan, p 168) রামমোহন সম্পর্কে শ্রীমতী সোফিয়া ডবসন কোলেটের এই স্মরণ সুন্দর শ্রদ্ধার্ঘ্য যথার্থ।

রামমোহন রায়ের জন্ম ও কর্মজীবন :

রামমোহনের জীবন ও কর্মক্ষেত্র ছিল বহু বিস্তৃত। হুগলী জেলার খানাকুল-কৃষ্ণনগরে রাধানগর গ্রামে তাঁর জন্ম হয়। তবে জন্মসন ও তারিখ নিয়ে দ্বিমত আছে। একটি মতে, ১০ই মে ১৭৭৪ খ্রীস্টাব্দে জন্ম (দ্রষ্টব্য : ‘সংসদ বাংলা সাহিত্যসঙ্গী’, শিশির দাস, প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০০৩, পৃষ্ঠা ১৯৪), মৃত্যু ইংলন্ডের ব্রিস্টলে ২৭শে সেপ্টেম্বর ১৮৩৩ খ্রীস্টাব্দ। পারিবারিক সূত্র বলে কথিত অন্য মতটি হল ১৭৭২ খ্রীস্টাব্দ, এবং জন্ম সম্ভবত ২২শে মে (দ্রষ্টব্যঃ ‘বঙ্গ অভিধান’, প্রথম বইমেলা ১৯৯৯, যোগনাথ মুখোপাধ্যায়, সংস্করণ পৃষ্ঠা ৪৬৬)। এঁদের কৌলিক পদবি ছিল ‘বন্দ্যোপাধ্যায়’ তবে কয়েক পুরুষ আগে ‘রায়’ উপাধি গ্রহণ করেন। রামমোহনের পিতা রামকান্ত রায়, মা তারিণী দেবী। তিনি ছিলেন রামকান্তের তিন পত্নীর মধ্যে দ্বিতীয়া। তিনি জগমোহন ও রামমোহন নামে দুই পুত্র ও এক কন্যার জন্ম দেন। সেই যুগের কৌলীন্য প্রথা অনুযায়ী রামমোহনেরও নয় বছরের মধ্যেই বিবাহ সম্পন্ন হয়। তাঁর মৃত্যু হয় ১৮০৩ সালের ২৭শে সেপ্টেম্বর।

রামমোহনের প্রপিতামহ কৃষ্ণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় মুঘল সম্রাট ঔরংজেবের আমলে মুর্শিদাবাদের নবাবের অধীনে কাজ করতেন। তাঁর কর্মদক্ষতায় সন্তুষ্ট হয়ে নবাব তাঁকে ‘রায়-রামন’ উপাধিতে ভূষিত করেন। তখন থেকে ঐ বংশের ‘রায়’ উপাধি প্রচলিত হয়।

শৈশব থেকেই রামমোহন ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। সেইজন্য পিতা রামকাস্ত রায় এই পুত্রকে উপযুক্ত শিক্ষালাভের জন্য মাত্র নয় বছর বয়সে পাটনায় পাঠিয়ে ছিলেন। সেখানে পৌঁছে রামমোহন আরবী, ফার্সি ভাষা শিক্ষা করেন। সমস্ত রকম শাস্ত্র পাঠ করেন। তারপর পাটনা থেকে তিনি ভারতের সনাতন ধর্ম ও সংস্কৃত চর্চার পীঠস্থান বারাণসী বা কাশীতে আসেন। এখানেও তিনি সংস্কৃত ভাষার সঙ্গে হিন্দুধর্মের নানা গ্রন্থ ও শাস্ত্র পাঠ করে প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য লাভ করেন।

রামমোহনের মনীষা ও পাণ্ডিত্য সম্পর্কে নানাবিধ মতামত প্রচলিত আছে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ গ্রন্থে বলেছেন, রামমোহন সংস্কৃত, আরবী, ফার্সী, উর্দু, হিব্রু, গ্রীস, ল্যাটিন, ইংরেজি, পারসি এই নয় ভাষায় ব্যুৎপন্ন ও বিলক্ষণ বুদ্ধিশক্তি সম্পন্ন ছিলেন। তিনি জ্ঞানচর্চার জন্য ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেছেন। প্রায় কিশোর বয়সেই কাশীতে সংস্কৃত অধ্যয়ন করেছেন। ষোল বছর বয়সে আরবি ভূমিকা সহ ফার্সী ভাষায় গ্রন্থ রচনা করেছেন। শোনা যায়, সুদূর তিব্বতে পর্যন্ত তিনি জ্ঞানানুসন্ধানের জন্য গিয়েছিলেন। পক্ষাস্তরে ড. কালিদাস নাগ ‘The Cultural Her itage of India’ গ্রন্থের ‘The Brahma Samaj’ নিবন্ধে এ সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন”….his wonderings in different parts of Eastern India, and even as far as Tibet may or may not be true.”

রামমোহন ছিলেন রীতিমত বিষয়ী এবং কর্মোদ্যোগী পুরুষ। ১৮০৫ খ্রীস্টাব্দে ঢাকায় জন ডিগবীর অধীনে তার কর্মজীবনের প্রথম পর্যায় শুরু হয়। সেখানে একসময় জেলার কালেক্টর স্যার ফ্রেডারিক হ্যামিলটন নামক জনৈক আমলার দুর্ব্যবহারে রামমোহনের জীবন অশাস্তিময় হয়ে ওঠে। তিনি পাল্কি করে যাওয়ার সময় রাস্তার বা পাশে দাঁড়িয়ে থাকা হ্যামিলটনকে দেখতে না পাওয়ার জন্য সে যুগের প্রথা অনুযায়ী সেলাম করেন নি। সেই অপরাধে তিনি আপত্তিকর ভাষায় রামমোহনকে গালিগালাজ করেন। এর প্রতিবাদে রামমোহন তদানীস্তন গভর্নর জেনারেল লর্ড মিন্টোকে চিঠি লেখেন। এই চিঠিতে তাঁর আত্মমর্যাদাবোধ ও প্রতিবাদী মানসিকতা ব্যক্ত হয় : “If natives, therefore, of caste and rank were to be subjected to treatment which must infallibly dishonour and degrade them, not only within the pale of their own re ligion and society, but also within the circle of English societies of high respectability into which they have the honour of being liberally and affably admitted, they would be virtually condemned to close confine ments within their house from the dread of being assaulted in the streets with every species of ignominy and degradation.”

এই ঘটনার পর ১৯০৯ সালে রামমোহন রংপুরে চলে যান। সেখানে ডিগবীর দেওয়ান রূপে ১৮১৪ খ্রীস্টাব্দের জুলাই পর্যন্ত বৈষয়িক কাজে যুক্ত থাকেন। এর পরে ডিগবী স্বয়ং অবসর নিয়ে ইংলন্ডে চলে যান। রামোহনেরও চাকুরিজীবন শেষ হয়। ইতোমধ্যেই তিনি যথেষ্ট বিষয় সম্পত্তির অধিকারী হয়েছিলেন। ১৮১৪ সালে কলকাতায় মানিকতলা অঞ্চলে একটি বড় বাড়ি কিনে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। অতঃপর নানাবিধ জনহিতকর প্রগতিশীল ধর্মীয় ও সমাজসংস্কারের কাজে যুক্ত হন। এখানে ১৮৩০ সাল পর্যন্ত তাঁর কর্মজীবনের ১৬ বছর অতিবাহিত হয়। এখানেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘আত্মীয়সভা’।

তার কর্মপরিধি ছিল চারটি পথে সুবিন্যস্ত –

  • (ক) সভা স্থাপন,
  • (খ) বিদ্যালয় বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সূচনা,
  • (গ) বিভিন্ন জনের সঙ্গে আলাপ আলোচনা,
  • (ঘ) পুস্তক ও পত্রিকাদি প্রকাশ।

১৮১৫ খ্রীস্টাব্দে রামমোহন ‘আত্মীয়সভা’ স্থাপন করেন। এই সভা ১৮২৮ সালে পরিণত রূপ লাভ করে ‘ব্রাহ্মসমাজে’। এই সমাজ হয়ে ওঠে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলের মিলনক্ষেত্র। তার ফলে বেদ ব্যাখ্যাতা রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ, পাখোয়াজ বাদক গোলাম আব্বাস, মন্টগোমারি মার্টিনের মত নিবিষ্ট শ্রোতা সকলেরই সহাবস্থান ঘটেছিল। তিনি প্রথম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এ্যাংলো-হিন্দু স্কুল। ১৮১৫-১৬ সালে রামমোহন বিভিন্ন শাস্ত্রগ্রন্থ অনুবাদের কাজে হাত দেন। ১৮১৭-তে কলকাতায় হিন্দু কলেজ স্থাপনের উদ্যোগে সামিল হন। ১৮১৭ থেকে ১৮২৩ পর্যন্ত সাকারবাদের বিপক্ষে এবং নিরাকার ব্রহ্মজ্ঞানের সপক্ষে বাঙালি এবং অবাঙালি ও দক্ষিণী পণ্ডিতদের সঙ্গে বিতর্কে ব্যস্ত থাকেন। ১৮১৮ থেকে ১৮২৯ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়পর্বে (১৮১৮, ১৮১৯ এবং ১৮২৯) বর্বরোচিত সতীদাহ প্রথা বন্ধ করার জন্য সমাজ-সংস্কারকের ঐতিহাসিক ভূমিকায় দেখা দেন। এই কাজে তিনি সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। অথচ এরই পাশাপাশি অন্য কাজেও তাকে সক্রিয় হতে দেখা যায় যেমন— ১৮২০-তে যীশুর উপদেশ সংকলন করে প্রকাশ করেন ‘The Precepts of Jesus’ কিন্তু যীশুর ঈশ্বরতত্ত্ব ও অলৌকিক ক্ষমতার উল্লেখ না করার জন্য তিনি মার্শম্যানসহ শ্রীরামপুরের ক্যাথলিক পাদ্রীদের অশালীন আক্রমণের শিকার হন। ১৮২১ থেকে ১৮২৩-এর মধ্যে রামমোহন খ্রীস্টান জনগণের প্রতি তাঁর বিখ্যাত তিনটি আবেদন প্রকাশ করেন। ১৮২১-এ প্রকাশ করেন ইংরেজি ও বাংলা দ্বিভাষিক পত্রিকা ‘Brahmunical Magazine! | ১৮২১ খ্রীস্টাব্দে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে প্রকাশ করেন ‘সম্বাদ কৌমুদী’। পত্রিকাটি ছিল সাপ্তাহিক। রাজনীতিই ছিল এর প্রধান আলোচ্য। প্রায় তেরো বছর ধরে পত্রিকাটির প্রচার অব্যাহত ছিল। ১৮২২-এ প্রতিষ্ঠা করেন এ্যাংলো হিন্দু স্কুল। অন্যদিকে এই বছরেই ১২ই এপ্রিল প্রকাশ করেন প্রথম ফার্সী পত্রিকা ‘মীরাৎ-উল-আখবার্’। এই সময় কোন কারণে সরকারী নীতির সমালোচনা করেন ‘ক্যালকাটা জার্নালে’র সম্পাদক জেমস বাকিহাম। সেই অপরাধে তাঁকে ভারত থেকে বহিষ্কার করা হয়। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করার জন্য ১৮২৩ খ্রীস্টাব্দে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করে কুখ্যাত প্রেস অর্ডিনান্স জারি করা হয়। রামমোহন এই চণ্ডনীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। এই প্রেস শাসনের বিরুদ্ধে জনপ্রতিনিধিদের একত্র করে তাদের স্বাক্ষর নিয়ে সুপ্রীম কোর্টে প্রতিবাদপত্র পাঠান। রামমোহনের জীবনীকার এস. ডি. কোলেট এই ঘটনাকে ভারত ইতিহাসের অ্যারিওপ্যাজিটিকা’ বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসক এই আবেদন অগ্রাহ্য করে গভর্নর জেনারেলের আদেশকেই আইনে পরিণত করেন। রামমোহন পুনরায় আরও অনেকের স্বাক্ষর নিয়ে ইংল্যান্ডের রাজার কাছে আবেদন করেন এবং প্রতিবাদের নজির রূপে ১৮২৩-এ ‘মীরাং’-এর প্রকাশ বন্ধ করে দেন। এই পত্রিকার শেষ সংখ্যায় রামমোহন লিখেছিলেন—“যে সম্মান হৃদয়ের শত রক্তবিন্দুর বিনিময়ে ক্রীত কিন্তু কোন অনুগ্রহের আশায় সেই সম্মান দারোয়ান রূপী সরকারী আমলার কাছে বিক্রয় করা তার পক্ষে সম্ভব নয়।” (তথ্যসূত্র, ‘বিদ্যাসাগরিকা’ পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২০)। ১৮২৩ সালের ১১ই ডিসেম্বর এদেশে ইউরোপীয় শিক্ষা প্রবর্তনের জন্য অনুরোধ করে লর্ড আমহার্স্টকে এক গুরুত্বপূর্ণ পত্র লেখেন। এদেশে প্রাচীন সংস্কৃত শিক্ষার প্রতি তাঁর প্রথম দিকে আস্থা না থাকলেও ১৮২৬ খ্রীস্টাব্দে তিনি বেদান্ত কলেজ স্থাপন করেছিলেন ১৮২৮ খ্রীস্টাব্দে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক নতুন গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হলে নতুন জুরি বিলের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন রামমোহন। ১৮২৯ খ্রীস্টাব্দের ৪ঠা ডিসেম্বর সতীদাহ নিবারণ আইন প্রণয়ন করা হয়। তবু এদেশের রক্ষণশীল সমাজপতিরা বিলেতের প্রিভি কাউন্সিলের কাছে আবেদন করে তা পুনঃপ্রচলনের চেষ্টা করলে রামমোহন তা রোধ করবার জন্য ১৮৩০ খ্রীস্টাব্দের ১৯শে ডিসেম্বর ইংলন্ডে পাড়ি দেন। সেইসঙ্গে দিল্লীশ্বর বাদশাহের দৌত্যকর্মেও যুক্ত হন। সেখানে বিদেশীদের মনে ভারতীয়দের সম্পর্কে ভাবনা-চিন্তার সূত্রপাত করেন। তাঁর পাণ্ডিত্য ও ব্যক্তিত্ব সর্বত্র স্বীকৃতি লাভ করে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি কমিটির কাছে তিনি স্মারকলিপি পেশ করেন। ১৮৩৩-এর ইংলন্ডের চার্টার অ্যাক্টের মূলে তা বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে।

রামমোহন রায়ের সাহিত্যজীবন প্রধানত ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশক জুড়ে বিস্তৃত হয়। তিনি লিখেছিলেন ফার্সীতে, বাংলায়, ইংরেজিতে এবং সংস্কৃতেও। তিনি পুস্তক-পুস্তিকা লিখেছেন, ‘বাঙ্গাল গেজেটি’, ‘ব্রাহ্মণসেবধি’, ‘সম্বাদ কৌমুদী’ প্রভৃতি সংবাদপত্রেও লিখেছেন। গদ্যকার রামমোহন বেদান্ত অনুবাদ থেকে শুরু করে দৈনন্দিন নানান সামাজিক সমস্যা প্রকাশে প্রধানভাবে বাংলা গদ্য অবলম্বন করেছিলেন। ফলে বাংলা গদ্যের বিষয়বস্তুতে নতুনতর বিস্তার ও গভীরতা এসেছিল। খুব সম্ভবত, ‘সম্বাদ কৌমুদী’ সম্পাদনা কালে তিনি এই গদ্যের লোকায়ত গুরুত্ব অনুভব করেন। এই পত্রিকা সম্পর্কে ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন : “Rammohun Roy was not only the principal Promoter but the de facto editor of this periodical [Samvad-Kaumudi], and articles from his pen often appeared in it.” (দ্রষ্টব্য : ‘Rammohun Roy as a Journalist’, ‘Modern Review, April, 1931, p. 409)। এমন কি, সম্বাদ কৌমুদীতে প্রকাশিত হয় রামমোহনের জ্ঞানগর্ভ অমিশ্র সাহিত্যরচনা’র নিদর্শন রূপে ‘বিবাদ ভঞ্জন’ সহ কয়েকটি নীতিকাহিনী (রাজনারায়ণ বসু ও আনন্দচন্দ্র বেদান্তবাগীশ সংগৃহীত ও পুনঃসম্পাদিত ‘রাজা রামমোহন রায় গ্রন্থাবলী’। কলকাতা, ১৭৯৫ শকাব্দ, পৃষ্ঠা ৭৯৭-৯৮, ৮১৬-১৭ দ্রষ্টব্য) ফলে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের বা ‘সমাচার দর্পণ’-কথিত “কোম্পানীর কলেজের’” (“‘সংবাদপত্রে সেকালের কথা’, প্রথম খণ্ড, চতুর্থ মুদ্রণ, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, কলকাতা ১৩৭৭ বঙ্গাব্দ, পৃষ্ঠা ৪০) পাঠ্যপুস্তকের সীমানা ছাড়িয়ে বাংলা গদ্যে এই প্রথম বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য এল। বৃহত্তর ও মননশীল পাঠকগোষ্ঠীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হল। রামমোহন রচিত গ্রন্থ বা পুস্তিকার সংখ্যা খুব কম নয়। গবেষক শ্রীপ্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্য ‘রামমোহন রায় এবং বাংলা গদ্য’ প্রবন্ধে (দ্রষ্টব্য : ‘অবভাস’, ১ম বর্ষ, ১ম সংখ্যা, ১৭ই বৈশাখ ১৪০৮, পৃষ্ঠা, ২০-২২) এ বিষয়ে একটি মূল্যবান গ্রন্থ তালিকা প্রকাশ করেছেন। বিষয় অনুযায়ী সেই গ্রন্থনামগুলিকে বিন্যস্ত করা যেতে পারে।

রামমোহন রায়ের রচনাসমূহ

(ক) বেদ-উপনিষদের অনুবাদ : (১) ‘বেদান্ত গ্রন্থ’ (১৮১৫), বাংলা গদ্যে বেদান্ত সূত্র ব্যাখ্যা। রাজনারায়ণ বসু বলেছিলেন, রামমোহনের হাতে এই ব্রহ্মসূত্র ব্রহ্মাস্ত্রের মত অমোঘ হয়ে উঠেছিল। (২) ‘বেদাত্তসার’ (১৮১৫)—এটি পূর্ব গ্রন্থের সারসংক্ষেপ। উপনিষদের অনুবাদ। (৩) তলবকার উপনিষৎ’ (১৮১৬) –শঙ্কর ভাষ্য অনুসরণে কেনোপনিষদের অনুবাদ। (৪) ‘ঈশোপনিষৎ’ (১৮১৬) শঙ্কর ভাষ্য অনুসরণে তর্জমা। (৫) ‘কঠোপনিষৎ’ (১৮১৭)। (৬) মাণ্ডুক্যোপনিষৎ’ (১৮১৭)। (৭) ‘গায়ত্রীর অর্থ’ (১৮১৮)। (৮) ‘মুণ্ডকোপনিষৎ’ (১৮১৯)। (৯) ‘আত্মনাত্মবিবেক’ (আনু. ১৮১৯)। (১০) ‘ব্রহ্মনিষ্ঠ গৃহস্থের লক্ষণ’ (১৮২৬)। (১১) ‘বজ্রসূচী’ (১৮২৭),–এটি মৃত্যুঞ্জয়ের লেখা বজ্রসূচী নামে মহাযান বৌদ্ধশাস্ত্রের প্রথম নির্ণয়ের অনুবাদ। এর প্রতিপাদ্য, তিনিই ব্রাহ্মণ যিনি ব্রহ্মবাদী। (১২) ‘গায়ত্র্যা ব্রহ্মোপাসনাবিধানং’ (১৮২৭) অর্থাৎ কেবল গায়ত্রী জপ দ্বারাই ব্রহ্মোপাসনা হয়। (১৩) ‘ব্রহ্মোপাসনা’ (১৮২৮)। (১৪) ‘অনুষ্ঠান’ (১৮২৯)–এখানে আছে ‘উপনিষদে কথিত…. সনাতন উপাসনাকে প্রশ্নোত্তর প্রণালী তে সংক্ষেপে বর্ণনা।

(খ) বিতর্কমূলক গ্রন্থ-পুস্তিকা : রামমোহনের প্রথম বিতর্কমূলক পুস্তিকাটি সংস্কৃতে লেখা হয়—(১) ‘উৎসবানন্দ বিদ্যাবাগীশের সহিত বিচার’ (১৮১৬-১৭), (২) ‘ভট্টাচার্য্যের সহিত বিচার’ (১৮১৭); ইংরেজি অনুবাদের নাম- A Second Defence of the Monotheistical System of the Vedas’, (৩) ‘সহমরণ বিষয় প্রবর্ত্তক ও নিবর্ত্তকের সম্বাদ’ (১৮১৮)–সতীদাহের বিপক্ষে লেখা প্রথম পুস্তিকা, (৪) ‘গোস্বামীর সহিত বিচার’ (১৮১৮), (৫) ‘সহমরণের বিষয় প্রবর্ত্তক ও নিবর্ত্তকের দ্বিতীয় সম্বাদ’ (১৮১৯)— কাশীনাথ তর্কবাগীশের বিধায়ক নিষেধকের সম্বাদ গ্রন্থের প্রত্যুত্তরে লেখা, (৬) কবিতাকারের সহিত বিচার’ (১৮২০) কোন কোন স্থলে বইটি ‘প্রত্যুত্তর’ নামে পরিচিত (দ্রষ্টব্য : বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ প্রথম সংস্করণের ভূমিকা অংশ), (৭) সুব্রহ্মণ্য শাস্ত্রীর সহিত বিচার’ (১৮২০)–বইটি দেবনাগরী অক্ষরে সংস্কৃত ও হিন্দী ভাষায় এবং বঙ্গাক্ষরে সংস্কৃত ও বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হয়; এর ইংরেজি নাম – Apology for the Pursuit of Final Beatitude, independently of Brahmunical Observances, (৮) ব্রাহ্মণ সেবধি : ব্রাহ্মণ ও মিশনরি সম্বাদ’ (প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয় সংখ্যা ১৮২১) – হিন্দুশাস্ত্রের বিরুদ্ধে মিশনারিদের আক্রমণের জবাব, (৯) চারি প্রশ্নের উত্তর’ (১৮২২)– গোঁড়া হিন্দুয়ানির ধ্বজাধারী এক ‘ধৰ্ম্মসংস্থাপনাকাঙক্ষীর ছদ্মনামে ব্যক্ত চারখানি প্রশ্নের উত্তরদান, (১০) ‘প্রার্থনাপত্র’ (১৮২৩)–ইংরেজি নাম: ‘Humble suggestions to his Countrymen who believe in One true God’, (১১) ‘পাদরি ও শিষ্য সম্বাদ’ (১৮২৩?) –‘এক খ্রীস্টিয়ান পাদরি ও তাহার তিন জন চীন দেশস্থ শিষ্য ইহারদের পরস্পর কথোপকথন’, ট্রিনিটিপন্থী ধর্মতত্ত্বের সরস আলোচনা, (১২) ‘গুরুপাদুকা’ (১৮২৩) লঙের Descriptive Catalogue’-এ এবং ‘ছোট গল্প’ পত্রিকায় (১লা পৌষ, ২য় বর্ষ, ২৪ সংখ্যা, ১৩৪০, পৃষ্ঠা ১১৭৯) এই গ্রন্থের ভূমিকা অংশটুকু শুধু পাওয়া গেছে, (১৩) ‘পথ্যপ্রদান’ (১৮২৩)– কাশীনাথ তর্কপঞ্চাননের (১৪) ‘পাষণ্ডপীড়ন’ পুস্তিকার জবাবে লেখা, (১৫) ‘ব্রহ্মানিষ্ঠ গৃহস্থের লক্ষণ’ (১৮২৬), (১৬) ‘কায়স্থের সহিত মদ্যপান বিষয়ক বিচার’ (১৮২৬), (১৭) ‘সহমরণ বিষয়’ (১৮২৯)–সতীদাহের বিরুদ্ধে রামমোহনের শেষ পুস্তিকা।

(গ) মৌলিক রচনা: (1) Bengali Grammar in the English Language (1826), (২) ‘ব্রহ্মসঙ্গীত’ (১৮২৮), (৩) ‘গৌড়ীয় ব্যাকরণ’ (১৮৩৩) রামমোহন বিলেত যাবার পূর্বে এই ব্যাকরণটি লিখেছিলেন। গ্রন্থটি প্রকাশ করেন স্কুল বুক সোসাইটি।

(ঘ) প্রচারিত রচনা : রামমোহনের নামে প্রচারিত কয়েকটি গ্রন্থ পাওয়া যায়; যেমন—(১) ‘ক্ষুদ্ৰপত্রী’ (প্রকাশকাল অজ্ঞাত), (২) ‘ভগবদগীতা’র পদ্যানুবাদ (প্রকাশকাল অজ্ঞাত), (৩) ব্রাহ্ম পৌত্তলিক সম্বাদ’ (১৮২০ ) ।

(ঙ) পত্রিকা সম্পাদনা : (১) ‘সম্বাদ কৌমুদী’ (ডিসেম্বর ৪, ১৮২১), বাংলা এবং ইংরেজি নামে দ্বিভাষিক পত্রিকা– (২) ব্রাহ্মণসেবধি’ এবং ‘ব্রাহ্মণ ও মিশনরি সম্বাদ’ (সেপ্টেম্বর, ১৮২১) বা ‘Brahmunical Magazine’, ‘The Missionary and the Brahman’ –এটি রামমোহনের সহযোগী পণ্ডিত শিবপ্রসাদ শর্মার নামে প্রচারিত হয়। ফাসী পত্রিকা–(৩) ‘মীরাৎ উল আখবর’ (১৮২২)।

(চ) ফার্সী গ্রন্থ : ‘তুহফাৎ-উল-মুওয়াহিদ্দিন’ (১৮০৩-০৪)।

রামমোহন রায়ের গদ্যস্রষ্টা ও জনকত্ব বিচারী

রামমোহন ছিলেন মুখ্যত সমাজসংস্কারক এবং তার্কিক। তিনি সাহিত্যিক নন। তবে বাংলা গদ্য সৃষ্টির প্রথম পর্বে তিনি প্রায় ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনকারীর ভূমিকায় দেখা দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন—“রামমোহন বঙ্গসাহিত্যকে গ্রানিট-স্তরের উপর স্থাপন” (দ্রষ্টব্যঃ “বঙ্কিমচন্দ্র”, “আধুনিক সাহিত্য’, কলকাতা, বঙ্গাব্দ ১৩৬৩, পৃষ্ঠা ৭) রাজনারায়ণ বসু বলেছিলেন “রামমোহনকে বাঙ্গালা গদ্যের সৃষ্টিকর্তা বলিলে অন্যায় হয় না” (‘বাঙ্গালা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক বক্তৃতা, ১৮৭৮, পৃষ্ঠা ২২)। রমেশচন্দ্র দত্ত গ্রন্থে মস্তব্য করেছেন : “Rammohan formed the prose.” – Literature of Bengal (1877, p. 172) বিপরীতভাবে ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার “…সর্বপ্রথমে বাংলা গদ্যকে সাহিত্য-রূপ দেওয়ার প্রয়াস পাইয়াছিলেন। ……সুতরাং (গদ্যের) স্রষ্টা যদি কাহাকেও বলিতে হয়, তাহার দাবী সর্বাগ্রে”। (“রামমোহন ‘রায়’”, “সাহিত্য-সাধক চরিতমালা’-১৬, পঞ্চম সংস্করণ, ১৩৬৭ বঙ্গাব্দ, পৃষ্ঠা ৭৫) ঐতিহাসিক সুশীলকুমার দে-ও বলেছেন, বাংলা গদ্যের গোড়াপত্তনে রামমোহনের তুলনায় উইলিয়ম কেরী, মৃত্যুঞ্জয় বা ভবানীচরণের ভূমিকা অধিক গুরুত্বপূর্ণ (দ্রষ্টব্য : ‘Bengali Literature in the Nineteenth Century’, 2nd edition, Calcutta, 1962, pp. 140-43, 543-45)। সেক্ষেত্রে রামমোহনকে ‘বাংলা গদ্যের জনক’ বলা যায় না। আসলে, বাংলা গদ্য সাহিত্যের জনক নির্ণয়ের কৌতূহল জেগে উঠেছিল প্রধানতঃ ইংরেজি গদ্যের অনুসরণে। ইংরেজি গদ্যের ইতিহাসে যথাক্রমে কিং আলফ্রেড, সন্ন্যাসী উইক্লিফ, স্যার টমাস মোর, প্রমুখ লেখকদের নামগুলি একাধিক বার জনকত্বের দাবি উত্থাপনে সাহায্য করেছিল। কিন্তু বাংলা গদ্যের ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। কারণ এই গদ্য কারোর একক প্রয়াসে সৃষ্টি হয়নি। পোর্তুগীজ মিশনারী, শ্রীরামপুরের পাদরি, ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের লেখকগোষ্ঠী থেকে রামমোহন পর্যন্ত সকলের পরিচর্যায় বিকশিত হয়েছে।

রামমোহন এবং উইলিয়াম কেরীর মধ্যে তুলনা :

রামমোহন এবং উইলিয়াম কেরী দুই ভিন্ন আদর্শ-জাতি এবং ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তবু বাংলা গদ্য ভাষা সৃষ্টির প্রাথমিক পর্বে এঁদের ভূমিকা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। দুজনেই বাংলা ব্যাকরণ গ্রন্থ রচনা করেছেন। বাংলা গদ্যভাষা সম্পর্কে উভয়েরই কিছু নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিমত ছিল।

ভাষা সম্পর্কে অভিমত: কেরী এবং রামমোহন:

উইলিয়ম কেরী বাংলা ভাষাকে দুভাগে ভাগ করেছিলেন—(১) ব্রাহ্মণ এবং উচ্চবর্ণের হিন্দুদের ভাষা। (২) মুসলমান এবং নিম্নবর্ণের হিন্দুদের ব্যবহৃত হিন্দুস্থানী ভাষা—’Indeed there are two distinct languages spoken all over the country, viz, the Bengali, spoken by the Brahmans and the Higher Hindus; and the Hindustani, spoken by the Mussalmans and lower Hindus, which is a mixture of Bengali and Persian’. (‘Careys letter to Sutcliff’, p. 198).

পক্ষান্তরে, রামমোহন এভাবে ভাষা বিভাজন করেননি। তবে ‘বেদান্তগ্রন্থে’র “অনুষ্ঠান” অংশে তিনি জানিয়েছেন, তার গদ্য “সামান্য আলাপের ভাষা” (দ্রষ্টব্য : ‘বেদান্তগ্রন্থ”, “অনুষ্ঠান”, কলকাতা, ১৮১৫, পৃষ্ঠা ১২) নয়। তিনি বলেছেন, “জাঁহাদের সংস্কৃতে ব্যুৎপত্তি কিঞ্চিতো থাকিবেক আর জাঁহারা ব্যুৎপন্ন লোকের সহিত সহবাস দ্বারা সাধু ভাষা কহেন আর সূনেন তাঁহাদের অল্প শ্রমেই ইহাতে অধিকার জন্মিবেক” (পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১২২)।

সাধারণত জাতির নবজীবনের দীপাবলী জ্বলে ওঠে কোন এক দীপ্তিমান ব্যক্তিত্বকে কেন্দ্র করে। আধুনিক যুগে রামমোহন ভারতীয় জীবনে সেই আলোকবর্তিকা। অনাগত কালের লক্ষণগুলি তাঁর মনন ও আচরণে এক একটি উজ্জ্বল শিখার মতো জ্বলে উঠেছিল।

রাজনীতি, বিদ্যাশিক্ষা, সমাজ, ভাষা, ধর্ম ইত্যাদি প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে তার অগ্রণী ভূমিকা স্মরণীয়। ভারতে তখন ‘বণিকের মানদণ্ড’ রাজদণ্ডে পরিণত। কুসংস্কারে, সঙ্কীর্ণতায়, অজ্ঞানতায় সারা দেশে তখন আত্মবিস্মৃতির অন্ধকার। অথচ ফরাসী বিপ্লবের সাম্য-মৈত্রী ও স্বাধীনতার রক্তচ্ছটায় ইউরোপের আকাশ তখন আলোকিত। শিল্পবিপ্লবের যন্ত্রধ্বনি, অর্থনৈতিক স্বাধীনতার দাবীতে টমাস পেনের যুক্তি ও বুদ্ধিমুক্তির বাণী, ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে রুশো, ভলটেয়ারের সাম্যের আদর্শ প্রচার, বেন্থাম, হিউম, রিকার্ডো, মিল প্রমুখ বুদ্ধিজীবীর মানববুদ্ধির জয়ঘোষণা, চ্যাথাম, বার্ক, ফক্স প্রমুখ রাজনীতিবিদদের অগ্নিময় বাণীতে প্রতীচ্যের আকাশ তখন বহ্নিময়। আর সেই মুহূর্তে ভারতকে শাস্ত্রের নামে লোকাচার ও সংস্কারের নাগপাশে বদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্ত করার জন্য সচেষ্ট হলেন রামমোহন। যুক্তি, মানবহিতবাদ ও মানবতাবোধে বিশ্বাসী এই সাধক জীবনব্যাপী শুধু ‘ভোর’ হওয়ার স্বপ্নেই বিভোর থাকেন নি, সর্ববিধ অজ্ঞতা ও জড়তার বিরুদ্ধে বজ্রবাণী নিক্ষেপেও ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

রামমোহনের মনোজগতের মানচিত্র অঙ্কন নিশ্চয়ই দুঃসাধ্য। তবু তার খানিকটা সীমান্ত মানসচিত্রে অদ্ভুত ধরা যায়বেকনের প্রতি তাঁর অপরিসীম অনুরাগ (A Letter on English Education, Calcutta, 1823)– গ্রন্থে লর্ড আমহার্স্টকে লেখা চিঠিতে, বেকনের Novum Organum-এর বঙ্গানুবাদের জন্য স্কুল বুক সোসাইটিকে অনুরোধ করার মধ্যে, ইসলামী মোতাজেলা সম্প্রদায় ও দার্শনিক লক-এর কাছ থেকে যুক্তিবাদের পাঠ গ্রহণে (‘The Precepts of Jesus’ Calcutta, 1820) ইসলামী মুওয়াহিদ্দিন ভাবনা, খ্রীস্টীয় ইউনিটারিয়ানিজম্ এবং বেদান্ত প্রতিপাদ্য ধর্মের একযোগে সহবস্থান, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলের জন্য ‘আত্মীয়সভা’ (১৮৫১) এবং ব্রাহ্মসমাজ (১৮২৮) প্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি কর্মোদ্যোগে।

বস্তুতপক্ষে, ১৮১৪ থেকে ১৮১৬ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে যে কোন একটি সময়ে তিনি যখন কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন, তারপর থেকেই তাঁর ধর্মীয় ও সামাজিক নব্য ভাবনাধারার সম্প্রচার শুরু হয়। এক কথায়, যে ধর্ম ছিল সর্বহিতকারী মানবতাবাদ। তাঁর ‘সমাজ’ ছিল সবার মিলনস্থল, সেখানে বেদ ব্যাখ্যা করতেন রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ, পাখোয়াজ বাজাতেন গোলাম আব্বাস। আবার মন্টিগোমারি মার্টিনের মতো শ্রোতারও উপস্থিতি ছিল। আসলে কোনও নান্দনিক প্রয়োজনে নয়, মূলত এই ধর্মাদর্শের সম্প্রচার সূত্রেই তাকে রচনা ও প্রকাশনে প্রবৃত্ত হতে হয়।

রামমোহন রায়ের মূল্যায়ন:

রামমোহন রায়ের সাহিত্যজীবন প্রধানত ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশক জুড়ে বিস্তৃত। তিনি লিখেছিলেন ফারসিতে, বাংলায় ও ইংরেজীতে, সামান্য সংস্কৃতে। তার একটি মাত্র ফারসি-পুস্তিকা ‘তুহফাৎ-উল-মুওয়াহিদ্দিন’ (১৮০৩-৪ খ্রীঃ) প্রথমজীবনে লেখা, ধর্মবিশ্বাস সংগঠনের প্রাথমিক ইতিহাসটি এখানে আছে। ১৮২২ খ্রীঃ ১২ই এপ্রিল কলকাতায় প্রকাশিত ফার্সীতে মুদ্রিত প্রথম সংবাদপত্রটিও তারই কৃতিত্বের নিদর্শন, নাম—’মীরাৎ-উল-আখবর’। ১৮২৩ খ্রীস্টাব্দে প্রচলিত সরকারী প্রেস অর্ডিন্যান্সের বিরুদ্ধে রামমোহন আরও পাঁচজন ব্যক্তির সঙ্গে লিখিতভাবে সুপ্রীম কোর্টে তীব্র প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেন এবং ব্যক্তিগতভাবেও দরবার করেন। রমেশচন্দ্র দত্তের মতে, রাজনৈতিক অধিকারের দাবিতে এদেশে এই প্রথম আন্দোলন।

রামমোহন রায়ের বিতর্কমূলক রচনা :

বিতর্কমূলক রচনাগুলির মধ্য দিয়েই রামমোহনের আসল পরিচয় প্রকটিত। বুদ্ধি ও যুক্তির দীপ্তি; আবেগ ও সনাতনী মনোভাবের পিছুটান মুছে বিদ্রোহবুদ্ধির নবত্ব, কুসংস্কার ও প্রথার বহুলতম প্রচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি একাধিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন, যেমন স্বনামধন্য মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার গৃহীদের ব্রহ্মজ্ঞান অর্জন নিষিদ্ধ করে বলেছিলেন: “বিহিত কর্মানুষ্ঠান পরিত্যাগ করিয়া মোক্ষেচ্ছা রূপ মহাবৃক্ষারোহণ কদাচিৎ করিও না।” রামমোহন তার বিরুদ্ধে যুক্তি তুলে লেখেন— “ভট্টাচার্য্যের সহিত বিচার’ (১৮১৭) গ্রন্থ। তাঁর অন্যান্য বিচারগ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য যথাক্রমে উৎসবানন্দ বিদ্যাবাগীশের সহিত বিচার’ (১৮১৬-১৭), ‘গোস্বামীর সহিত বিচার’ (১৮১৮), ‘কবিতাকারের সহিত বিচার’ (১৮২০), ‘সুব্রহ্মণ্য শাস্ত্রীর সহিত বিচার’ (১৮২০)। ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রে জনৈক ধর্মসংস্থাপনকারীর ‘চারি প্রশ্নে’র জবাবে ‘চারি প্রশ্নের উত্তর’ (১৮২২), ‘সমাচার চন্দ্রিকা’তে জনৈক শ্রীগৌরাঙ্গদাসের পত্রের জবাবে ‘গুরুপাদুকা’ (১৮২৩) ইত্যাদি রচনাসমূহ। বৈষ্ণব পণ্ডিত ও ভক্ত উৎসবানন্দের আত্মীয়সভায় প্রেরিত প্রশ্নগুলির দ্বারা রামমোহন প্রথম বৈষ্ণব বিরোধিতার সম্মুখীন হন। প্রশ্নোত্তর দুয়েরই ভাষা ছিল সংস্কৃত। ‘গোস্বামীর সহিত বিচারে’ রামমোহন ভাগবতের শাস্ত্র হিসাবে প্রামাণ্য ধারণা খণ্ডন করেন। সদর দেওয়ানী আদালতের পণ্ডিত সুব্রহ্মণ্য শাস্ত্রীর উত্থাপিত প্রশ্নের উত্তরে রামমোহন জানিয়েছিলেন বর্ণাশ্রম ধর্মপালন না করে, কিম্বা বেদপাঠ না করলেও মানবের ব্রহ্মবিদ্যার অধিকার ক্ষুণ্ণ হয় না।

মিশনারীদের বিরুদ্ধে রচনা : ১৮২০-তে ‘The Precepts of Jesus’ লিখে রামমোহন প্রথম মিশনারীদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বিবাদের সম্মুখীন হয়ে পড়েন। গ্রন্থটি সংস্কৃত ও বাংলাতে অনুবাদও হয়। শ্রীরামপুর মিশনারীরা ‘ফ্রেন্ড অব ইন্ডিয়া’তে রামমোহনের বিরুদ্ধে খ্রীস্টধর্মের বিষয়ে অজ্ঞতা বা অল্পজ্ঞতার অভিযোগ তোলেন। তিনি লেখেন খ্রীস্টান জনসাধারণের প্রতি তাঁর বিখ্যাত তিনটি আবেদন (১৮২১, ১৮২২ ও ১৮২৩ খ্রীস্টাব্দে)। বস্তুতপক্ষে, মিশনারীদের কার্যকলাপ এবং ধর্মপ্রচারের পদ্ধতির মধ্যে এদেশীয় ধর্মের বিরুদ্ধে একটি অসঙ্গত আক্রমণের ভাব ছিল। অথচ সেই বিতর্কের রণক্ষেত্রে দেশীয় ধর্মরক্ষায় কোনও তথাকথিত ‘পণ্ডিত’ রথীর সেদিন দেখা পাওয়া যায়নি। সবাই ছিলেন উদাসীনতার অজ্ঞাতবাসে, দেখা দিয়েছিলেন শুধু এই বিচিত্রবীর্য তার্কিক রামমোহন রায়। মিশনারীদের ‘সমাচারদর্পণ কে দমাতে প্রকাশ করেন দ্বিভাষিক পত্রিকা ‘Brahmunical Magazine: The Missionary and the Brahman’ বা ‘ব্রাহ্মণসেবধি’ এবং ব্রাহ্মণ ও মিশনারী সম্বাদ’ (সেপ্টেম্বর ১৮২১) তাঁর সহযোগী পণ্ডিত শিবপ্রসাদ শর্মার নামে। ‘ব্রাহ্মণ সেবধি’-র ইংরেজী ভূমিকায় ছিল ? “Truth and true religion do not always belong to wealth and power, high names, or lofty places” “ব্রাহ্মণ সেবধি’র তিনটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়, ১৮২৩-এ চতুর্থ সংখ্যাটি প্রকাশিত হয় ইংরেজীতে। ইংরেজী সংস্করণ সহ ‘পাদরি ও শিষ্য সম্বাদ’ ‘এক খ্রীস্টিয়ান পাদরি ও তাহার তিনজন চীন দেশস্থ শিষ্য ইহারদের পরস্পর কথোপকথন’ নামে রচনাটিও এই উদ্দেশ্যেই লেখা হয়। এখানে কথোপকথনের আশ্রয়ে লেখকের শ্লেষাক্ত মনের পরিচয় উদ্ঘাটিত হয়েছে, যেমন

  • “পাদরি— ওহে ভাই এ এক নিগূঢ় বিষয়।
  • প্রথম শিষ্য— এ কি প্রকার নিগূঢ় বিষয় মহাশয়।
  • পাদরি— এ নিগূঢ় বিষয় হয় কিন্তু আমি জানি না কিরূপে তোমাকে বুঝাইব এবং আমি অনুমান করি এ গুপ্ত বিষয় কোনরূপে তোমার বোধগম্য হইতে পারে না।”

এহেন সরস রচনা (ট্রিনিটিপন্থী ধর্মতত্ত্বের আলোচনা) রামমোহন সাহিত্যে বিরলদৃষ্ট।

রামমোহন রায়ের সহমরণ-বিষয়ক রচনা :

বিবিধ সামাজিক সমস্যা সত্ত্বেও সতীদাহ নিবারণ বিষয়ে রামমোহনের সক্রিয়তা বিশেষভাবে চোখে পড়ে। তার কারণ সম্ভবত এর মানবিক গুরুত্ব। একটি পত্রিকার সমীক্ষা থেকে জানা যায়, ১৮১৫ সালে বাংলাদেশে সহমরণের সংখ্যা ছিল ৩৭৮, ১৮১৬-য় ৪৪২, ১৮১৭-য় ৭০৭ এবং ১৮১৮-য় এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৩৯। রামমোহন ১৮১৮ ও ১৮১৯ সালে শাস্ত্রীয় যুক্তি দ্বারা সহমরণ অশাস্ত্রীয় বলে প্রমাণ করে লেখেন দুখানি পুস্তিকা: ‘সহমরণ বিষয়ক প্রবর্ত্তক ও নিবর্ত্তকের সম্বাদ’ এবং ঐ নামেই ‘দ্বিতীয় সম্বাদ’। ১৮২৯ সালে ‘সহমরণ বিষয়’ নামে ঐ বিষয়ে তার তৃতীয় পুস্তিকাটি প্রকাশিত হয়। তিনি এই বিকৃত হিন্দু আচারের পাশবিক চিত্র তুলে ধরেন “তোমরা অগ্রে ঐ বিধবাকে পতিদেহের সহিত দৃঢ়বন্ধ কর পরে তাহার উপরে এত কান্ঠ দেও যাহাতে ঐ বিধবা উঠিতে না পারে তাহার পর অগ্নি দেওন কালে দুই বৃহৎ বাঁশ দিয়া ছুপিয়া রাখ।” ভাষা এখানে মানবিকতা ও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার স্পর্শে সজীব। এই সূত্রে ‘সমাচার-চন্দ্রিকা সম্পাদক ও রক্ষণশীল গোষ্ঠী হয়ে দাঁড়ান তার শত্রুপক্ষ, কাশীনাথ তর্কপঞ্চানন লেখেন “বিধায়ক নিষেধের সম্বাদ’ (১৮১৯) এবং পরে ‘পাষণ্ড‌ পীড়ন’ (১৮২৩)। রামমোহন জবাবে লেখেন ‘পথ্যপ্রদান’ (১৮২৩) এবং ‘কায়স্থের সহিত মদ্যপান বিষয়ক বিচার’ (১৮২৬)।

রামমোহন রায়ের গদ্যরীতির বৈশিষ্ট্য :

রামমোহন প্রধানত প্রাবন্ধিক। তথ্য-নির্ভর প্রবন্ধে তিনি যুক্তি-নির্ভর ও তীক্ষ্ণ বাক্য সন্নিবেশে তৎপর, যেমন “ধর্মকে অধর্ম করিয়া ও অধর্মকে ধর্মরূপে যাঁহাদের জ্ঞান তাঁহারা পরমেশ্বরের উপদেশকে ধর্মনাশের কারণ করিয়া যে কহিবেন তাহাতে আশ্চর্য কি আছে” (“কবিতাকারের সহিত বিচার’)। তাঁর গদ্য ঋজু, তীক্ষ্ণ ও বলিষ্ঠ। ঈশ্বর গুপ্তের ভাষায়, “দেওয়ানজী জলের ন্যায় সহজ ভাষায় লিখিতেন, তাহাতে কোন বিচার ও বিবাদঘটিত বিষয় লেখায় মনের অভিপ্রায় ও ভাবসকল অতি সহজে স্পষ্টরূপে প্রকাশ পাইত, এজন্য পাঠকেরা অনায়াসেই হৃদয়ঙ্গম করিতেন, কিন্তু সে লেখায় শব্দের বিশেষ পারিপাট্য ও তাদৃশ মিষ্টতা ছিল না।” এ কথা ঠিক, রামমোহন প্রকৃত অর্থে ‘সাহিত্যিক ছিলেন না। বাংলার নবজাগরণের এই ঋত্বিক প্রধানত সমাজসংস্কারক ও প্রাবন্ধিকরূপেই প্রসিদ্ধ। সেদিক থেকে বাংলা গদ্যসাহিত্যের তার অবদান—

(ক) পাঠ্যপুস্তক রচনার বাইরে বাংলা গদ্যকে বেদান্ত অনুবাদ ও শাস্ত্রব্যাখ্যা এবং বিতর্কের মতো দুরূহ কাজে নিয়োগ করা,

(খ) মৌলিক চিন্তাধারাকে গদ্যে প্রকাশ করা এবং তার রীতির (Style) মধ্যে ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে তোলা,

(গ) বাংলাভাষা যে অন্যভাষা থেকে স্বতন্ত্র তা বুঝে তার প্রকৃতি অনুযায়ী ব্যাকরণ রচনা করা। ভাষাচার্য সুনীতিকুমার উল্লেখ করেছেন“বাংলা যে একটা স্বতন্ত্র ভাষা, আর এই ভাষার যে নিজস্ব প্রকৃতি আছে, আর তাই এর নিজস্ব ব্যাকরণও আছে—এই সহজ সত্যটি রামমোহন রায়ই প্রথম উপলব্ধি করেছিলেন” (উদ্ধৃত, বাংলা সাহিত্যের রেখালেখ্য’, পৃষ্ঠা, ১৮৪)।

(ঘ) পণ্ডিতী বাংলার সরীসৃপ দেহভঙ্গিমায় ঋজু-কঠিন মেরুদণ্ড স্থাপন করে তাকে বিষয়ের ভার ও উপস্থাপনার ধারে শাণিত করে তোলা। তুলনামূলকভাবে তাঁর গদ্যে কিছু ত্রুটিও আছে, যেমন—

  • (১) গতিশীলতার অভাব।
  • (২) বিদেশী বাক্যের অনুসরণে বাক্যের শেষে ক্রিয়াপদ সৃষ্টি, যেমন “জগন্নাথ যাঁহাকে ঈশ্বর করিয়া কহেন।”
  • (৩) যতিস্থাপন বিষয়েও তিনি ছিলেন উদাসীন। উপরন্তু,
  • (৪) তাঁর গদ্যে প্রসাদগুণ নেই।

আসলে রামমোহনের ভাষা শিল্পীর নয়, দক্ষ তার্কিকের ভাষা। এ ভাষায় নান্দনিক অনুভূতি বা রস নেই, কিন্তু প্রজ্ঞা ও রুচিবোধ আছে। তাই তাঁর সম্পর্কে কিশোরীচাদ মিত্রের মন্তব্যে সমকালের মূল্যায়ন ধরা পড়েছে সার্থকভাবে? “He was one of those nature who lead, not one of those who follow, one of those who are in advance of, not of those who are behind their age.”