বাংলা গদ্যের বিকাশে রামমোহন রায়ের কৃতিত্ব সম্পর্কে আলোচনা কর।
বাংলা গদ্যসাহিত্যের বিকাশে রামমোহন রায়ের অবদান সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা কর।
ভূমিকা: রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩] বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী, ইংরেজ কালেক্টরের দেওয়ান, কোম্পানির শেয়ারের ব্যবসায়ী, ভুটানে প্রেরিত ইংরেজ দূত, ধর্মশিক্ষা প্রচারক ও সমাজসংস্কারক প্রভৃতি কাজে নিযুক্ত ছিলেন। ১৮১৭ সালে তিনি স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য কলকাতায় আসেন এবং ঐশ্বর্যশালী গণ্যমান্য ব্যক্তি হিসেবে মর্যাদা লাভ করেন। তাঁর গৃহে সে আমলের সকল সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গের সমাগম ঘটত, অনেক বিদেশি পরিব্রাজক তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য আসতেন। ১৮৩০ সালে তৎকালীন দিল্লির সম্রাট দ্বিতীয় আকবর তাঁকে ‘রাজা’ উপাধিতে ভূষিত করে ইংল্যান্ডের রাজার কাছে দূত হিসেবে প্রেরণ করেন। সমাজসংস্কার ও সাহিত্যে অপরিসীম অবদানের জন্য অনেকে রাজা রামমোহন রায়কে ‘প্রভাত-সূর্য’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
বাংলা গদ্যের ইতিহাসে রামমোহন রায়ের [১৭৭২-১৮৩৩] রচনাবলির মূল্য নিরূপণের আগে আলোচনার সুবিধার জন্য তাঁর প্রধান রচনাগুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া প্রয়োজন। ১৮১৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় ‘বেদান্তগ্রন্থ’ এবং ‘বেদান্ত সার’। প্রথম গ্রন্থটি বেদান্তের বঙ্গানুবাদ এবং দ্বিতীয়টি বেদান্তের সার সংকলন। ১৮১৬-১৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম শাস্ত্রীয় বিচারমূলক রচনা ‘উৎসবানন্দ বিদ্যাবাগীশের সহিত বিচার’ প্রকাশিত হয়। এই জাতীয় বিচার বিতর্কমূলক অনান্য পুস্তিকার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ‘ভট্টাচার্যের সহিত বিচার’ [১৮১৭] এবং ‘গোস্বামীর সহিত বিচার’ [১৮১৮]। ‘ভট্টাচার্যের সহিত বিচার’ মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের ‘বেদান্তচন্দ্রিকা’র উপরে লিখিত হয়েছিল। সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত রচনা ‘সহমরণ বিষয় প্রবর্তক ও নিবর্তকের সম্বাদ’ (১৮১৮] রামমোহনের রচনাবলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া তিনি পাঁচখানি উপনিষদ অনুবাদ করেন এবং ‘গৌড়ীয় ব্যাকরণ’ নামে একটি বাংলাভাষার ব্যাকরণ সংকলন করেন। রামমোহন রচিত বাংলা গ্রন্থের সংখ্যা ছোটো বড়ো সব মিলিয়ে তিরিশ।
রামমোহনের ও ভারতের নবযুগ: এই গ্রন্থতালিকার দিকে দৃষ্টি দিলে প্রথমেই রচনার বিষয়বস্তু নির্বাচনে রামমোহন রায়ের দুঃসাহসে অবাক হতে হয়। তিনি কোনো বিশেষ শ্রেণির মানুষের জন্য রচনায় প্রবৃত্ত হননি, জনসাধারণই তাঁর রচনার লক্ষ ছিল। এ সব দুরূহ বিষয়, আলোচনার উপযুক্ত ভাষা তখনো গড়ে উঠেনি, সাধারণ মানুষের গদ্যবোধশক্তিও ছিল না। কিন্তু রামমোহন জনসাধারণের প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা নিয়ে উচ্চতম জ্ঞানের বিষয় তাদের সামনে তুলে ধরেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছেন-
“কেবল পাণ্ডিত্য করা, জ্ঞানীদের নিকট খ্যাতি অর্জন করা রামমোহন রায়ের ন্যায় পরম বিদ্বান ব্যক্তির পক্ষে সুসাধ্য ছিল। কিন্তু তিনি পাণ্ডিত্যের নির্জন অত্যুচ্চশিখর ত্যাগ করিয়া সর্বসাধারণের ভূমিতলে অবতীর্ণ হইলেন এবং জ্ঞানের অন্ন ও ভাবের সুধা মানবসভার মধ্যে পরিবেশন করিতে উদ্যত হইলেন।”
রামমোহনের প্রথম বাংলা গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৮১৫ খ্রিষ্টাব্দে। তার আগে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ থেকে অন্তত। বারোটি পাঠ্যপুস্তক প্রকাশিত হয়েছিল। সুতরাং রামমোহন থেকেই বাংলা গদ্যের সূচনা একথা কোনোক্রমেই বলা চলে না। কিন্তু ফোর্ট উইলিয়ামের লেখকদের রচনা এবং রামমোহনের গদ্যচর্চার মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য আছে। ফোর্ট উইলিয়ামের লেখকরা যখন ইংরেজ ছাত্রদের ভাষা শিক্ষার উপযোগী গ্রন্থ রচনায় মগ্ন, তখন বাইরের বাস্তব সমাজ পরিবেশ, ধর্ম ও প্রথাবদ্ধ জীবনাচরণ পদ্ধতি সম্পর্কে নানা বিচার বিতর্কের আলোড়ন চলছিল।
১৮১৩ খ্রিষ্টাব্দে রামমোহন স্থায়ীভাবে কোলকাতায় বাস করতে আসেন এবং ক্রমে তিনি কোলকাতায় নবগঠিত সমাজের কেন্দ্রীয় পুরুষ হয়ে উঠেন। । তাঁর জীবনব্যাপী কর্মধারা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, একমাত্র তিনিই সেই যুগসন্ধিকালের লক্ষণ সঠিকভাবে চিনেছিলেন। তিনি স্বদেশকে বিশ্বের পটভূমিতে দেখেছিলেন। যুগ যুগান্তরের বিচ্ছিন্নতার অবসানে ভারতবর্ষের সঙ্গে বিশ্বের নতুন মিলনের সম্ভাবনাই ইংরেজ রাজত্বের প্রগতিশীল দিক। রামমোহনের বিশ্বাস ছিল প্রাচীন ভারতবর্ষের চিত্ত তার সমস্ত ঐশ্বর্য নিয়ে যে সীমাহীন জড়ত্বে অভিভূত হয়ে পড়েছে, ইংরেজ জাতির চিত্তের স্পর্শ সেই ভারতবর্ষকে জাগ্রত করে বিশ্বের সঙ্গে মিলিত হওয়ার উপায় করে দেবে। তিনিই আমাদের মধ্যে প্রথম আধুনিক চেতনায় দীপ্ত মানুষ। আধুনিকতার আলোকে দীপ্ত রামমোহনের মন কোনো অন্ধ সংস্কার বা কোনো মোহকেই প্রশ্রয় দেয়নি।
নবাগত শাসক জাতির ঐশ্বর্য ও শক্তি তাকে অভিভূত করেনি, তিনি ইংরেজ জাতিকে এক নতুন জীবনবাদের প্রতীক হিসেবেই দেখেছেন। অন্যদিকে অভ্যস্ত আচার এবং আনুষ্ঠানিকতার জড়ত্বপাশ ছিন্ন করে তিনি প্রাচীন ভারতবর্ষের সত্যরূপ আবিষ্কার করতে চেয়েছেন। নির্মোহ যুক্তির পথে যিনি চলতে চান তাঁর পথ কখনোই কুসুমাস্তীর্ণ হয় না। রামমোহনকেও পদে পদে সংগ্রাম করে অগ্রসর হতে হয়েছে। প্রধানত তাঁকে সংগ্রাম করতে হয়েছে সংস্কারাদ্ধ প্রাচীনপন্থিদের সঙ্গে। খ্রিষ্টান মিশনারিগণও ছিল তাঁর অপর এক প্রবল প্রতিপক্ষ। তাঁর সর্বতোমুখী বুদ্ধি এবং সর্বত্র প্রসারিত হৃদয় এমন সত্যবস্তুর সন্ধান করেছিল যার ভিত্তিতে তার স্বদেশ আত্মসম্মান অক্ষুণ্ণ রেখে বিশ্বের সঙ্গে মিলিত হতে পারবে। এই দ্রষ্টা পুরুষই আধুনিক ভারতবর্ষের বুনিয়াদ রচনা করে গেছেন। রামমোহনের ব্যক্তিত্বের প্রভাব বাংলাদেশ থেকে ক্রমে সমগ্র ভারতে প্রভাব বিস্তার করেছে। রামমোহনের রচনাবলিতে তাঁর প্রখর ব্যক্তিত্বের শক্তিই প্রতিফলিত।
ফোর্ট উইলিয়ামের লেখকদের লক্ষ্য ছিল কলেজের বিদেশীয় ছাত্রবৃন্দ। বিষয়বস্তু নির্বাচন এবং রচনাশৈলীর ক্ষেত্রে পাঠ্যপুস্তক রচনার বিশেষ উদ্দেশ্যের দ্বারাই চালিত হয়েছে। অন্যপক্ষে রামমোহনের সম্মুখে ছিল স্বদেশবাসীর চিত্তে নবজাগরণ সম্ভব করে তোলবার মহৎ প্রেরণা। রবীন্দ্রনাথ বলেন, “নব্যবঙ্গের প্রথম বাঙালি সর্বসাধারণকে রাজটিকা পরাইয়া দিলেন এবং এই রাজার বাসের জন্য সমস্ত বাংলাদেশে বিস্তীর্ণ ভূমির মধ্যে সুগভীর ভিত্তির উপরে সাহিত্যকে সুদৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত করলেন। কালে কালে সেই ভিত্তির উপর নব নব তল নির্মিত হইয়া সাহিত্যকর্ম অভ্রভেদী হইয়া উঠিবে এবং অতীত ভবিষ্যতের সমস্ত বঙ্গহৃদয়কে স্থায়ী আশ্রয় দান করিতে থাকিবে।”
রামমোহন বাংলা গদ্যের প্রথম লেখক নন, তাঁর রচনায় যে উৎকৃষ্ট গদ্যশৈলী গড়ে উঠেছিল এমনও নয়, কিন্তু তিনিই গদ্যভাষা অবলম্বন করে যথার্থ সাহিত্যের স্থায়ী প্রতিষ্ঠাভূমি প্রস্তুত করে গেছেন। বাঙালি প্রতিভা উত্তরকালে যা কিছু সৃষ্টি করেছে, বিশ্বের সম্মুখে যে সম্পদ নিয়ে বাঙালি জাতি সম্মানের আসন দাবি করার অধিকার অর্জন করেছে, রামমোহনই তার সূচনা করে গেছেন। এদিক থেকে বিচার করলে শুধু বাঙলা গদ্যভাষা বা আধুনিক সাহিত্যেরই নয়, তাঁকে সমগ্র ‘নব্যবঙ্গ সংস্কৃতির জনক’ বলে মানতে হয়। ছেদচিহ্নের স্বল্পতার জন্যই সে যুগের বাংলা গদ্যে আড়ষ্টতা দেখা দিয়েছিল-এই বিষয়ে রামমোহন তাঁর প্রথম বাংলা বই ‘বেদান্তগ্রন্থে’ পাঠকদের সতর্ক করে দিয়েছেন, “এ ভাষায় গদ্যকে অদ্যাপি কোন শাস্ত্র কিম্বা কাব্য বর্জনে আইসে না, ইহাতে এতদ্দেশীয় অনেক লোক অনভ্যাস প্রযুক্ত দুইতিন বাক্যের অন্বয় করিয়া গদ্য হইতে অর্থবোধ করিতে হঠাৎ পারেন না।” তিনি যে নবোদ্ভূত বাংলা গদ্যের সমস্যা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন, এই উক্তিই তার প্রমাণ।
রামমোহনের গদ্যের বৈশিষ্ট্য: রামমোহনের গদ্যশৈলী সম্পর্কে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত লিখেছিলেন, “দেওয়ানজী জলের ন্যায় সহজ ভাষা লিখিতেন, তাহাতে কোন বিচার ও বিবাদ ঘটিত বিষয় লেখায় মনের অভিপ্রায় ও ভাবসকল অতি সহজে স্পষ্টরূপে প্রকাশ পাইত, এজন্য পাঠকেরা অনায়াসেই হৃদয়ঙ্গম করিতেন, কিন্তু সে লেখায় শব্দের বিশেষ পারিপাট্য ও তাদৃশ মিষ্টতা ছিল না।” রামমোহনের পূর্ববর্তী লেখকদের রচনার সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে কোথাও তাঁরা রামমোহনের চেয়ে উৎকৃষ্টতর, প্রসাদগুণসম্পন্ন গদ্য লিখেছেন। কিন্তু তাঁদের রচনার অংশবিশেষে যে উৎকর্ষতার পরিচয় আছে তাকে কোনোক্রমেই লেখকদের সচেতন শিল্পবোধের পরিচায়ক মনে করা যায় না।
শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “অন্তরের ভাব ও অনুভূতির সহিত নিঃসম্পর্ক, মৌলিকতাহীন রচনার শিথিল মাংস সমষ্টির মধ্যে সুস্পষ্ট উদ্দেশ্যের দৃঢ় অস্থিসংস্থান করিয়াছেন। সে জন্য তাঁহার ভাষা শ্রুতিমধুর না হইলেও, সময় সময় কর্কশ হইলেও ইহার শক্তি ও আকর্ষণীয়তা অনুভূত হয়। যুক্তিনিষ্ঠ মনের স্বভাবশৃঙ্খলা তাঁহার বাক্য গঠন ও শব্দ প্রয়োগকেও সুগ্রথিত করিয়াছে। বাঙলা সাহিত্যে তিনিই সর্বপ্রথম লেখক যিনি আধুনিক অনুশীলিত মন লইয়া গদ্যরচনায় আত্মনিয়োগ করিয়াছেন; তাঁহার গদ্য ললিতমধুর না হইলেও মননদীপ্ত ও ভাবের সমুন্নতিতে মর্যাদাময়।”
রাজা রামমোহন রায়ের আরো কিছু কীর্তির কথা উল্লেখযোগ্য। তিনি ১৮১৫ খ্রিষ্টাব্দে একেশ্বরবাদ প্রচারের জন্য যে ‘আত্মীয় সভা’ প্রতিষ্ঠা করেন, সেটিই ১৮২৮ খ্রিষ্টাব্দে ‘ব্রাহ্মসমাজে’ পরিণতি লাভ করে। রামমোহন ‘ব্রাহ্মণ সেবধি’ এবং ‘সম্বাদ কৌমুদী’ নামক দুটি বাংলা সাময়িক পত্র এবং ‘মিরাতুল আখবার’ নামে ফারসি সাময়িকপত্র প্রকাশ করেন। ডক্টর সুকুমার সেন রামমোহন সম্বন্ধে বলেন, “তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি ভারতবর্ষকে আগাইয়া যাইবার পথনির্দেশ করিয়াছিলেন। তিনিই আমাদের দেশের প্রথম লিঙ্গুয়িস্ট।… বাঙলা গদ্যের তিনি জনক-এই অর্থে যে তিনিই প্রথম বাঙলা গদ্যে স্বীয় স্বাধীন চিন্তা লিপিবদ্ধ করেন… তাঁহার বাঙলা ভাষার ব্যাকরণে… বাঙলা ভাষায় তাঁহার গভীর জ্ঞানের পরিচায়ক।”
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, প্রাচীন ও মধ্যযুগের মানুষের জীবনযাত্রা ছিল সহজ সরল ও গতানুগতিক। কিন্তু আধুনিক যুগে মানুষের জীবন বৈচিত্র্যময়, দ্বন্দ্ব ও সংঘাতময় হয়ে উঠে এবং জীবনযাত্রার জটিলতা ও সচলতা অনেক বৃদ্ধি পায়। আধুনিক যুগের এ সমস্যাসংকুল পরিবেশ বিচারবুদ্ধি প্রধান, যুক্তি প্রধান ও ভাব আদান-প্রদানের ভাষা তথা গদ্যের জন্ম হয়। এ গদ্য ভাষার বিকাশ সাধনে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলা সাহিত্যে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।
Leave a comment