রামমােহনের রচনাবলী: বাঙলা গদ্যের ইতিহাসে রামমােহন রায়ের (১৭৭২-১৮৩৩) রচনাবলীর মূল্য নিরূপণের আগে আলােচনার সুবিধার জন্যে তার প্রধান রচনাগুলাের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া প্রয়ােজন। ১৮১৫ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় ‘বেদাস্তগ্রন্থ’ এবং ‘বেদান্তসার’। প্রথম গ্রন্থটি বেদান্তের বঙ্গানুবাদ এবং দ্বিতীয়টি বেদান্তের সার সংকলন। ১৮১৬-১৭ খ্রীষ্টাব্দে প্রথম শাস্ত্রীয় বিচার-মূলক রচনা ‘উৎসবানন্দ বিদ্যাবাগীশের সহিত বিচার’ প্রকাশিত হয়। এই জাতীয় বিচার-বিতর্কমূলক অনান্য পুস্তিকার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য ‘ভট্টাচার্যের সহিত বিচার’ (১৮১৭) এবং ‘গােস্বামীর সহিত বিচার’ (১৮১৮)। ‘ভট্টাচার্যের সহিত বিচার’ মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের ‘বেদান্তচন্দ্রিকা’র উপরে লিখিত হয়েছিল সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত রচনা ‘সহমরণ বিষয় প্রবর্তক ও নিবর্তকের সম্বাদ’ (১৮১৮) রামমােহনের রচনাবলীর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। এছাড়া তিনি পাঁচখানি উপনিষদ অনুবাদ করেন এবং ‘গৌড়ীয় ব্যাকরণ’ নামে একটি বাঙলা ভাষার ব্যাকরণ সংকলন করেন। রামমােহন রচিত বাঙলা গ্রন্থের সংখ্যা ছােট বড়াে মিলিয়ে তিরিশখানি।

এই গ্রন্থ-তালিকার প্রতি দৃষ্টিপাত করলে প্রথমেই রচনার বিষয়বস্তু নির্বাচনে রামমােহন রায়ের দুঃসাহসে বিস্মিত হতে হয়। তিনি কোনও বিশেষ শ্রেণীর মানুষের জন্য রচনায় প্রবৃত্ত হন নি, জনসাধারণই তাঁর রচনার লক্ষ্য ছিল। এইসব দুরূহ বিষয় আলােচনার উপযুক্ত ভাষা তখনও গড়ে ওঠেনি, সাধারণ মানুষের গদ্যবােধশক্তিও ছিল না। কিন্তু রামমােহন জনসাধারণের প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা নিয়ে উচ্চতম জ্ঞানের বিষয় তাদের সম্মুখে ধরেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠিকই বলেছেন, “কেবল পাণ্ডিত্য করা, জ্ঞানীদের নিকট খ্যাতি অর্জন করা রামমােহন রায়ের ন্যায় পরম বিদ্বান্ ব্যক্তির পক্ষে সুসাধ্য ছিল। কিন্তু তিনি পাণ্ডিত্যের নির্জন অত্যুচ্চশিখর ত্যাগ করিয়া সর্বসাধারণের ভূমিতলে অবতীর্ণ হইলেন এবং জ্ঞানের অন্ন ও ভাবের সুধা মানবসভার মধ্যে পরিবেশন করিতে উদ্যত হইলেন।”

রামমােহনের প্রথম বাংলা গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৮১৫ খ্রীষ্টাব্দে। তার পূর্বে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ থেকে অন্তত বারখানি পাঠ্যপুস্তক প্রকাশিত হয়েছিল। সুতরাং রামমােহন থেকেই বাঙলা গদ্যের সূচনা একথা কোনক্রমেই বলা চলে না। কিন্তু ফোর্ট উইলিয়ম-এর লেখকদের রচনা এবং রামমােহনের গদ্যচর্চার মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য আছে। ফোর্ট উইলিয়ম-এর লেখকরা যখন ইংরেজ ছাত্রদের ভাষা শিক্ষার উপযােগী গ্রন্থ রচনায় মগ্ন, তখন বাইরের বাস্তব সমাজ-পরিবেশ, ধর্ম ও প্রথাবদ্ধ জীবনাচরণ পদ্ধতি সম্পর্কে নানা বিচার-বিতর্কের আলােড়ন চলছিল। ১৮১৩ সালে রামমােহন স্থায়িভাবে কলকাতায় বাস করতে আসেন এবং ক্রমে তিনি কলকাতায় নবগঠিত সমাজের কেন্দ্রীয় পুরুষ হয়ে ওঠেন। তার জীবনব্যাপী কর্মধারা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, একমাত্র তিনিই সেই যুগসন্ধিকালের কাললক্ষণ সঠিকভাবে চিনেছিলেন। তিনি স্বদেশকে বিশ্বের পটভূমিতে দেখেছিলেন। যুগ-যুগান্তরের বিচ্ছিন্নতার অবসানে ভারতবর্ষের সঙ্গে বিশ্বের নতুন মিলনের সম্ভাবনাই ইংরেজ রাজত্বের প্রগতিশীল দিক। রামমােহনের বিশ্বাস ছিল প্রাচীন ভারতবর্ষের চিত্ত তার সমস্ত ঐশ্বর্য নিয়ে যে সীমাহীন জড়ত্বে অভিভূত হয়ে পড়েছে, ইংরেজ জাতির চিত্তের স্পর্শ সেই ভারতবর্ষকে জাগ্রত করে বিশ্বের সঙ্গে মিলিত হবার উপায় করে দেবে। তিনিই আমাদের মধ্যে প্রথম আধুনিক চেতনায় দীপ্ত মানুষ। আধুনিকতার আলােকে দীপ্ত রামমােহনের মন কোন অন্ধ সংস্কার বা কোন মােহকেই প্রশ্রয় দেয়নি। নবাগত শাসক জাতির ঐশ্বর্য ও শক্তি তাকে অভিভূত করেনি, তিনি ইংরেজ জাতিকে এক নতুন জীবনবাদের প্রতীকরূপেই দেখেছেন।

অন্যদিকে অভ্যন্ত আচার এবং আনুষ্ঠানিকতার জড়ত্বপাশ ছিন্ন করে তিনি প্রাচীন ভারতবর্ষের সত্যরূপ আবিষ্কার করতে চেয়েছেন। নির্মোহ যুক্তির পথে যিনি চলতে চান তার পথ কখনােই কুসুমাস্তীর্ণ হয় না। রামমােহনকেও পদে পদে সংগ্রাম করে অগ্রসর হতে হয়েছে। প্রধানতঃ তাঁকে সংগ্রাম করতে হয়েছে সংস্কারান্ধ প্রাচীনপন্থীদের সঙ্গে। খ্রীষ্টান মিশনারীগণও ছিল তার অপর এক প্রবল প্রতিপক্ষ। তার সর্বতােমুখী এবং সর্বত-প্রসারি হৃদয় এমন সত্যবস্তুর সন্ধান করেছিল যার ভিত্তিতে তার স্বদেশ আত্মসম্মান অক্ষুন্ন রেখে বিশ্বের সঙ্গে মিলিত হতে পারবে এই দ্রষ্টা পুরুষই আধুনিক ভারতবর্ষের বনিয়াদ রচনা করে গেছেন) রামমােহনের ব্যক্তিত্বের প্রভাব বাঙলাদেশ থেকে ক্রমে সমগ্র ভারতে প্রভাব বিস্তার করেছে। রামমােহনের রচনাবলীতে তার প্রখর ব্যক্তিত্বের শক্তিই প্রতিফলিত।

ফোর্ট উইলিয়মের লেখকদের লক্ষ্য ছিল কলেজের বিদেশীয় ছাত্রবৃন্দ ; বিষয়বস্তু নির্বাচন এবং রচনাশৈলীর ক্ষেত্রে পাঠ্যপুস্তক রচনার বিশেষ উদ্দেশ্যের দ্বারাই চালিত হয়েছেন। অন্যপক্ষে রামমােহনের সম্মুখে ছিল স্বদেশবাসীর চিত্তে নবজাগরণ সম্ভব করে তােলবার মহৎ প্রেরণা। তিনি “নব্যবঙ্গের প্রথম বাঙালী সর্বসাধারণকে রাজটীকা পরাইয়া দিলেন এবং এই রাজার বাসের জন্য সমস্ত বাঙলাদেশে বিস্তীর্ণ ভূমির মধ্যে সুগভীর ভিত্তির উপরে সাহিত্যকে সুদৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত করলেন। কালে কালে সেই ভিত্তির উপর নব নব তল নির্মিত হইয়া সাহিত্যহর্ম্য অভ্রভেদী হইয়া উঠিবে এবং অতীত ভবিষ্যতের সমস্ত বঙ্গহৃদয়কে স্থায়ী আশ্রয় দান করিতে থাকিবে” (রবীন্দ্রনাথ)।

রামমােহন বাঙলা গদ্যের প্রথম লেখক নন, তাঁর রচনায় যে উৎকৃষ্ট গদ্য-শৈলী গড়ে উঠেছিল এমনও নয়, কিন্তু তার গদ্যভাষা অবলম্বন করে যথার্থ গদ্য-শৈলী গড়ে উঠেছিল এমনও নয়, কিন্তু তিনিই গদ্যভাষা অবলম্বন করে যথার্থ সাহিত্যের স্থায়ী প্রতিষ্ঠাভূমি প্রস্তুত করে গেছেন। বাঙালী প্রতিভা উত্তরকালে যা কিছু সৃষ্টি করেছে, বিশ্বের সম্মুখে যে সম্পদ নিয়ে বাঙালী জাতি সম্মানের আসন দাবি করবার অধিকার অর্জন করেছে, রামমােহনই তার সূচনা করে গেছে এইদিক থেকে বিচার করলে শুধু বাঙলা গদ্যভাষা বা আধুনিক সাহিত্যেরই নয়, তাকে সমগ্র নব্যবঙ্গ সংস্কৃতির জনক’ বলে মানতে হয়। ছেদচিহ্নের স্বল্পতার জন্যই সে যুগের বাঙলা গদ্যে আড়ষ্টতা দেখা দিয়েছিল ও এই বিষয়ে রামমােহন তাঁর প্রথম বাঙলা বই বেদান্তগ্রন্থে পাঠকদের সতর্ক করে দিয়েছেন, “এ ভাষায় গদ্যতে অদ্যাপি কোন শাস্ত্র কিম্বা কাব্য বর্জনে আইসে না, ইহাতে এতদ্দেশীয় অনেক লােক অনভ্যাস প্রযুক্ত দুইতিন বাক্যের অন্বয় করিয়া গদ্য হইতে অর্থবােধ করিতে হঠাৎ পারেন না।” তিনি যে নবােদ্ভূত বাঙলা গদ্যের সমস্যা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন, এই উক্তিই তার প্রমাণ।

রামমােহনের গদ্য-শৈলী সম্পর্কে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত লিখেছিলেন, “দেওয়ানজী জলের ন্যায় সহজ ভাষা লিখিতেন, তাহাতে কোন বিচার ও বিবাদ-ঘটিত বিষয় লেখায় মনের অভিপ্রায় ও ভাবসকল অতি সহজে স্পষ্টরূপে প্রকাশ পাইত, এজন্য পাঠকেরা অনায়াসেই হৃদয়ঙ্গম করিতেন, কিন্তু সে লেখায় শব্দের বিশেষ পারিপাট্য ও তাদৃশ মিষ্টতা ছিল না।” রামমােহনের পূর্ববর্তী লেখকদের রচনার সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে কোথাও তারা রামমোহনের চেয়ে উৎকৃষ্টতর, প্রসাদগুণসম্পন্ন গদ্য লিখেছেন। কিন্তু তাদের রচনার অংশবিশেষে যে উৎকর্যতার পরিচয় আছে তাকে কোনক্রমেই লেখকদের সচেতন শিল্পবােধের পরিচায়ক মনে করা যায় না। নিতান্তই আকস্মিকভাবে কোথাও কোথাও তারা নিপুণতার পরিচয় দিয়েছেন। সেইসব রচনার লেখকদের স্বকীয় মানসবৈশিষ্ট্যের কোন পরিচয় পাওয়া যায় না রামমােহন সেই “অন্তরের ভাব ও অনুভূতির সহিত নিঃসম্পর্ক, মৌলিকতাহীন রচনার শিথিল মাংস সমষ্টির মধ্যে সুস্পষ্ট উদ্দেশ্যের দৃঢ় অস্থিসংস্থান সংযােজনা করিয়াছেন। সেইজন্য তাহার ভাষা শ্রুতিমধুর না হইলেও সময় সময় কর্কশ হইলেও ইহার শক্তি ও আকর্ষণীয়তা অনুভূত হয়। যুক্তিনিষ্ঠ মনের স্বভাব-শৃঙ্খলা তাহার বাক্য গঠন ও শব্দ প্রয়ােগকেও সুগ্রথিত করিয়াছে। বাঙলা সাহিত্যে তিনিই সর্বপ্রথম লেখক যিনি আধুনিক অনুশীলিত মন লইয়া গদ্যরচনায় আত্মনিয়ােগ করিয়াছেন ; তাহার গদ্য ললিতমধুর না হইলেও মননদীপ্ত ও ভাবের সমুন্নতিতে মর্যাদাময়” (শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়)।

রামমােহনের ‘বেদান্তগ্রন্থে’র বিশেষ পরীক্ষা করলেই বােঝা যায়, শব্দনির্বাচনে ও কাব্যবিন্যাসে তার রচনাভঙ্গি সে যুগের অন্যান্য বাঙলা গদ্য-লেখকদের তুলনায় কতটা সরল ও সুষম ছিল, ছেদচিহ্নের যথাযথ ব্যবহারের অভাবেই তার গদ্যকে দুরূহ ও আড়ষ্ট মনে হয় ; তখনও পর্যন্ত বাঙলা গদ্য লেখকেরা ছেদচিহ্নের ব্যবহার-কৌশলকে আয়ত্ত করে উঠতে পারেননি। য়েমন, “কেহাে কেহাে এ শাস্ত্রে প্রবৃত্তি হইবার উৎসাহের ভঙ্গ নিমিত্ত কহেন যে বেদের বিবরণ ভাষায় করাতে এবং শােনারতে পাপ আছে এবং শূদ্রের এ ভাষা শুনিলে পাতক হয়। তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা কর্তব্য যে যখন তাহারা শ্রুতি স্মৃতি জৈমিনিসূত্র গীতা পুরাণ ইত্যাদি শাস্ত্র ছাত্রকে পাঠ করান তখন ভাষাতে তাহার বিবরণ করিয়া থাকেন কিনা আর ছাত্রেরা সেই বিবরণ শুনেন কিনা আর মহাভারত যাহাকে পঞ্চম বেদ আর বেদার্থ কহা যায় তাহার শ্লোক সকল শূদ্রের নিকট পাঠ করেন কিনা এবং তাহার অর্থ শূদ্রকে বুঝান.কিনা শূদ্রেরাও সেই বেদার্থের অর্থ এবং ইতিহাস আলাপেতে কহিয়া থাকেন কিনা আর শ্রাদ্ধাদিতে শূদ্র-নিকটে ঐ সকল উচ্চারণ করেন কিনা।”

এই প্রসঙ্গে রাজা রামমােহন রায়ের আরও কিছু কীর্তির কথা উল্লেখযােগ্য। তিনি ১৮১৮ খ্রীঃ একেশ্বরবাদ প্রচারের জন্য যে ‘আত্মীয় সভা’ প্রতিষ্ঠা করেন, সেটিই ১৮২৮ খ্রীঃ ‘ব্রাহ্মাসমাজে’ পরিণতি লাভ করে। রামমােহন ‘ব্রাহ্মণ সেবধি’ এবং ‘সম্বাদ কৌমুদী’ নামক দু’টি বাঙলা সাময়িক পত্র এবং ‘মিরাতুল আখবার’ নামে ফারসী সাময়িক পত্র প্রকাশ করেন। আচার্য সুকুমার সেন রামমােহন সম্বন্ধে বলেন, “তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি ভারতবর্ষকে আগাইয়া যাইবার পথনির্দেশ করিয়াছিলেন। তিনিই আমাদের দেশের প্রথম লিঙ্গুয়িস্ট। … বাংলা গদ্যের তিনি জনক—এই অর্থে যে তিনিই প্রথম বাঙলা গদ্যে স্বীয় স্বাধীন চিন্তা লিপিবদ্ধ করেন … তাহার বাঙলা ভাষার ব্যাকরণে..বাঙলা ভাষায় তাঁহার গভীর জ্ঞানের পরিচায়ক।”