ভারতপথিক রামমােহন রায় উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাংলা দেশে নবজাগরণের প্রথম পর্যায়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য শিক্ষায় অগাধ পাণ্ডিত্যসম্পন্ন আধুনিক মানুষ। তিনি পাশ্চাত্য ধ্যানধারণা, রীতিনীতির সঙ্গে প্রাচ্য ধ্যানধারণা ও রীতিনীতির সমন্বয় ঘটাতে চেয়েছিলেন। তাই শিক্ষাক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন তিনি। তাঁর শিক্ষাচিন্তা নীচে উল্লেখ করা হল一

শিক্ষার লক্ষ্য: রামমােহন পাশ্চাত্যের উৎকৃষ্ট অবদানপুলিকে প্রাচ্য শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে গ্রহণ করার বিষয়ে উদ্যোগী ছিলেন। তাঁর শিক্ষাচিন্তার মূল লক্ষ্য ছিল

  • পাশ্চাত্যের জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রয়ােজনীয় দিকগুলিকে গ্রহণ করে প্রাচ্যশিক্ষার পুনরুজ্জীবন ঘটানাে।

  • ভারতীয় শিক্ষা ও সংস্কৃতির উৎকৃষ্ট দিকগুলিকে সংরক্ষণ করা।

  • ভারতীয় জনগণের নৈতিক মূল্যবােধের বিকাশসাধন করা।

শিক্ষার পাঠক্রম: রামমােহন শিক্ষার পাঠক্রমে গণিত, ভৌতবিজ্ঞান, শারীরতত্ত্ব প্রভৃতি বিজ্ঞানের বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে মত প্রকাশ করেন। তিনি দেশে উদারধর্মী এবং জ্ঞানদীপ্ত বিষয়গুলি পড়ানাের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠিত অ্যাংলাে-হিন্দু বিদ্যালয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞান, যন্ত্রবিদ্যা, ইউক্লিডের জ্যামিতি, কারিগরিবিদ্যা প্রভৃতি বিষয় পড়ানাের ব্যবস্থা করেন। তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠিত বেদান্ত কলেজে হিন্দু দর্শন ও সাহিত্যের সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজি ও বিজ্ঞান পড়শােনার ব্যবস্থাও করেন।

পুস্তক প্রণয়ন: রামমােহন শিক্ষার্থীদের সবরকম‌ বিকাশের জন্য বহু সংস্কৃত বই বাংলায় অনুবাদ করেন। তার অনুবাদ গ্রন্থগুলি হল—“বেদান্ত গ্রন্থ’, ‘বেদান্তসার’, বিভিন্ন উপনিষদের অনুবাদ ইত্যাদি।

জনশিক্ষা: জনশিক্ষা প্রসারে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা‌ পালন করেন। তিনি মনে করতেন, শিক্ষাই মানুষকে প্রকৃত পথের সন্ধান দিতে পারে। জনশিক্ষার জন্য তিনি বিভিন্ন সংবাদপত্র প্রকাশ করেন। যেমন-‘সম্বাদ কৌমুদী”, মিরাৎ-উল-আখবার”, ‘দ্য ব্রানিক্যাল ম্যাগাজিন ইত্যাদি। তাঁর সম্পাদিত পত্রিকাগুলিতে তৎকালীন সমাজ, ধর্ম, শিক্ষা, অর্থনীতি, রাজনীতি ইত্যাদি বিষয়ে প্রবন্ধ ও আলােচনা থাকত।

প্রাচ্যশিক্ষার সঙ্গে পাশ্চাত্য শিক্ষার সমন্বয়ের দ্বারাই যে ভারতীয় শিক্ষার পুনরুজ্জীবন এবং আধুনিকীকরণ সম্ভব, তা অনুভব করতে পেরেছিলেন রামমােহন। তাই তিনি শিক্ষাচিন্তার ক্ষেত্রে সবসময়ই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষার উৎকৃষ্ট দিকগুলির মধ্যে মিলন ঘটানাের চেষ্টা করেন।

রাজা রামমােহন রায় তাঁর সংস্কারমূলক পরিকল্পনার সপক্ষে আন্দোলন গড়ে তােলার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সংবাদপত্র ও পত্রপত্রিকা প্রকাশ এবং সম্পাদনা করেন। 1820 খ্রিস্টাব্দে কলকাতা থেকে রামমােহনের সম্পাদনায় ‘সম্বাদ কৌমুদী নামে একটি বাংলা সাপ্তাহিক প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া 1822 খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘মিরাৎ-উল-আখবার নামে ফারসি ভাষায় একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন| 1829 খ্রিস্টাব্দে তিনি বেঙ্গল হেরাল্ড’ নামক একটি ইংরেজি পত্রিকা প্রকাশ করেন। এই পত্রিকা প্রকাশ ছাড়াও তিনি নিজস্ব মতামত প্রকাশের জন্য ছােটো ছােটো বই এবং কয়েকটি আলােচনা পুস্তক প্রকাশ করেন। তাঁর প্রকাশিত আর-একটি গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা হল ব্রাহ্মণসেবধি’। এই সমস্ত পত্রিকার মধ্যে সম্বাদ কৌমুদী ছিল বেশ উচ্চমানের।

রামমােহন রায় সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামের পথে অবতীর্ণ হন। 1823 খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন সরকার সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সংকোচন করলে রামমােহন সরকারি অর্ডিন্যান্সের বিরুদ্ধে প্রথমে সুপ্রিমকোর্ট এবং পরে প্রিভি কাউন্সিলে আবেদন জানান। শুধু তাই নয়, ওই অর্ডিন্যান্সের প্রতিবাদস্বরূপ তিনি তাঁর ‘মিরাৎ-উল-আখ্বার’ নামক পত্রিকাটির প্রকাশ বন্ধ করে দেন। অনেকের মতে, রামমােহনের এই প্রতিবাদ হল আইনসম্মত বিক্ষোভ বা আন্দোলনের প্রথম দৃষ্টান্ত। অনেকে এটিকে ভারতীয়দের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে শিক্ষিত ভারতীয়দের প্রথম প্রতিবাদ হিসেবে গণ্য করেন।

রামমােহন কলকাতায় থাকাকালীন সংবাদপত্র প্রকাশনার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল ভারতীয় ভাষায় পত্রিকা প্রকাশের ব্যবস্থা। এদেশের সংবাদপত্র চালু হওয়ার পর প্রায় প্রথম চার দশক ধরে ইংরেজি সংবাদপত্র প্রকাশিত হত এবং মূলত এদেশে আসা ব্রিটিশরাই তা পাঠ করত। তবে 1818 খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে ‘দিগদর্শন’ নামে একটি বাংলা মাসিক পত্রিকা প্রকাশনা শুরু হয়। এ ছাড়া 1818 খ্রিস্টাব্দের 15 মে প্রকাশিত হয় বাংলা ভাষায় প্রথম সংবাদপত্র ‘বঙ্গাল গেজেটি’। এই পত্রিকাটিতে রাজা রামমােহন রায়ের সহমরণ বিষয়ক প্রবর্তক ও নিবর্তকের সম্বাদ’ নামের প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়।

উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাংলা দেশে নবজাগরণের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রাজা রামমােহন রায়। শিক্ষার ক্ষেত্রে তিনি পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। তিনি লক্ষ করেছিলেন, সেই সময়ে টোলের পণ্ডিতেরা শিক্ষার্থীদের জীবনের বেশ কিছুটা মূল্যবান সময় অপচয় করতেন প্রয়ােজনহীন জ্ঞানচর্চার দ্বারা। তাই টোলের শিক্ষার পরিবর্তে তিনি আরও উদারধর্মী এবং জ্ঞানদীপ্ত বিষয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। তিনি পাঠক্রমে অঙ্ক, প্রকৃতিবিজ্ঞান, রসায়ন, শারীরতত্ত্ব ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞান বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষপাতী ছিলেন।

পাশ্চাত্য শিক্ষা রামমােহন রায়ের শিক্ষাচিন্তাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, প্রাচ্য সংস্কৃতির মধ্যে গভীর সত্য ও মহত্ব নিহিত থাকলেও, আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা থেকে দূরে থাকার ফলে ভারতবাসীদের মধ্যে কুসংস্কারের প্রাধান্য দেখা দিয়েছে। তাই প্রাচ্য সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবন ঘটানাের জন্য পাশ্চাত্য সাহিত্য এবং বিজ্ঞানচর্চা বিশেষভাবে প্রয়ােজন।

রামমােহন পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে বিশেষভাবে উদ্যোগী হয়েছিলেন। এই কারণে তিনি 1823 খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড আমহাস্টকে চিঠি লিখে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের জন্য সরকারি অর্থ সাহায্যের অনুরােধ জানান। শুধু তাই নয়, পাশ্চাত্য ইংরেজি শিক্ষা প্রসারের জন্য আলেকজান্ডার ডাকে তিনি জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইনস্টিটিউশন প্রতিষ্ঠায় সহযােগিতা করেছিলেন।

এ ছাড়া 1822 খ্রিস্টাব্দে ইউনিটেরিয়ান অ্যাসােসিয়েশনের পরিচালনায় তিনি ইঙ্গ-বৈদিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এই বিদ্যালয়টির কার্যকরী সমিতিতে তিনি ডেভিড হেয়ার এবং রেভারেন্ড অ্যাডামকে যুক্ত করেন। তিনি মনে করতেন, ভারতীয় শিক্ষার্থীদের অঙ্ক, বিজ্ঞান, দর্শন প্রভৃতি বিষয়ে শিক্ষাদানের জন্য ইউরােপীয় শিক্ষক নিয়ােগ করা প্রয়ােজন। রামমােহনের প্রতিষ্ঠিত বেদান্ত কলেজেও পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞান শিক্ষা ও ইংরেজি চর্চার ব্যবস্থা করা হয়। এককথায় বলা যায়, রামমােহনের মতাে ব্যক্তির ইংরেজি ভাষা প্রবর্তনের সপক্ষে আন্দোলন করার ফলেই তৎকালীন যুগে হিন্দুদের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রতি আস্থা জন্মায়।