উত্তর : ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যে সমাজ জীবনের লৌকিক স্ত রে রাধাকৃষ্ণের মানবিক প্রেমলীলারস তুলে ধরেছেন। রাধা ও কৃষ্ণ এখানে লৌকিক, মানবিক এবং আমাদের পরিচিত জগতের রক্ত-মাংসের সাধারণ মানব-মানবী হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। রাধা-কৃষ্ণের হৃদয়ানুভূতি আবেগ ও লৌকিক মানসিকতার সুষম মিথস্ক্রিয়ার আশ্চর্য শিল্পিত প্রকাশ ঘটেছে এই পৌরাণিক প্রেমগাথার মধ্যে। শুধু রাধার চিত্রণ কিংবা রাধা-সম্ভোগ চিত্রই নয়, সেই সাথে কৃষ্ণের অথবা রাধার কামনা বাসনার ক্ষেত্রেও কবি কোনোরূপ অলৌকিক, পরমার্থিক সুখানুভূতির অথবা কোনো অতীন্দ্রিয় আনন্দের ছবি আঁকেন নি। যতটুকু এঁকেছেন তা বাস্তব, লৌকিক এবং রক্ত মাংসের রাধা-কৃষ্ণের দেহকে কেন্দ্র করে। পরিচিত সমাজ-সংসার জীবনের মানব-মানবীর হৃদয়ের বাস্তবতা অঙ্কনে কবি বড়ু চণ্ডীদাস সচেতন ছিলেন।
রাধাবিরহ’ খণ্ডে আমরা নতুন এক রাধাকে দেখতে পাই। অপরিণত বয়সে রাধা কৃষ্ণের প্রেম ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে। দূতীকে অপমান করে। কৃষ্ণের প্রতি ঘৃণায়, বীতশ্রদ্ধায় বিগলিত হয়েছে। কিন্তু ‘রাধাবিরহ’ খণ্ডে এসে রাধার আর সেই বীতশ্রদ্ধা নেই। কৃষ্ণের প্রতি ঘৃণা বা অবজ্ঞার ভাব নেই। বরং এখানে সে কৃষ্ণপ্রেমে অন্ধ। কৃষ্ণপ্রেমে নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করেছে।
কৃষ্ণকে না পেলে যেন তার জীবন বিফলে যাবে। রাধার পরিণত বয়সের বিরহ সমগ্র কাব্যকে ট্রাজেডি কাব্যে পরিণত করেছে। এই খণ্ডে এসে তার সমাজ সংসারকে কোনো ভয় নেই- সাহসী ও দৃঢ়সংকল্পের অধিকারী এক রাধাকে এখানে দেখতে পাই। বিরহ’ খণ্ডে এসে কাব্যের মানবীয় প্রেমচেতনা এক অনন্ত অভিসারের পথে ধাবিত হয়েছে। এই অভিসার ইন্দ্রিয়াতীত নয়, নয় অলৌকিক কিংবা দেব-দেবীর স্বর্গের লীলাকীর্তন। কৃষ্ণপ্রেমে পুড়ে রাধার অন্তরের মলিনতা দূর হয়েছে। জগৎসংসারের কথা ভুলে গিয়ে এখন রাধা তার দেহমন সমর্পণ করেছে কৃষ্ণের কাছে। কৃষ্ণ তার দেহ-সম্ভোগ করে মথুরায় পালিয়ে যায়। এরপর শুরু হয় রাধার বিরহ। রাধা কৃষ্ণের ফিরে আসার প্রতীক্ষায় প্রহর গুনতে থাকে। শ্রমতী রাধিকা কৃষ্ণের সাথে মিলনের আকাঙ্ক্ষা কতটা বিরহকাতর হতে পারে তা নিম্নোক্ত উক্তিতে ফুটে উঠেছে:
” যে কাহ্নে লাগিআঁ গোঁ আন না চাহিলো বড়াই।
না মানিলা লঘু গুরুজনে॥
দেহমনে পরিহাসে আহ্মা উপেক্ষিতা রেখে
আন লয়ে বঞ্চে বৃন্দাবনে ॥”
একদিন শ্রীমতী রাধিকা যে কৃষ্ণের প্রেম প্রত্যাখ্যান করেছিল, আজ সেই নারী কৃষ্ণের জন্যই অপেক্ষা করে বৃন্দাবনেই সময় কাটায়। রাধা কৃষ্ণকে তার মন থেকে এক মুহূর্তের জন্যও সরাতে পারে না। এ রাধা সত্যিকার অর্থেই পদাবলীর রাধার মতই সমর্পিতা। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের ‘বিরহখণ্ডে’ কামনা বাসনা ও লালসার কোনো চিহ্ন নেই। সম্পূর্ণ মানবিক এক কাহিনি ‘এখানে বিধৃত। ‘বিরহখণ্ডের’ মানবরস পাঠককে আবেগতাড়িত করে, সিক্ত করে বিরহরসে।
Leave a comment