রাধাকৃষ্মণ কমিশনের প্রতিবেদনকে ভারতীয় শিক্ষার ইতিহাসে একটি মূল্যবান দলিল বলা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানাের প্রয়ােজনীয়তা অনুভূত হয়। তাই স্বাধীনতার পরপরই ভারত সরকার ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্মণের সভাপতিত্বে বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন গঠন করে। উচ্চশিক্ষার মানােন্নয়নের জন্য এই কমিশন গঠন করা হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শিক্ষার উন্নয়ন প্রসঙ্গও তুলে ধরেছে। কমিশন স্বীকার করেছে যে, উচ্চশিক্ষার মানােন্নয়ন ঘটাতে গেলে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শিক্ষার আগে উন্নতি ঘটাতে হবে। শুধুমাত্র সুপারিশ করার মধ্য দিয়েই কমিশন তার দায়িত্ব শেষ করেনি, ভবিষ্যৎ ভারতের শিক্ষার রূপরেখা কেমন হওয়া উচিত সে বিষয়েও আলােচনা করেছে।

(১) শিক্ষা পরিকল্পনা : ভারতের স্বাধীনতা শুধুমাত্র ব্রিটিশ শাসনের হাত থেকে মুক্তি পাওয়াই নয়, নিজের দেশকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে গেলে ভালাে শিক্ষা পরিকল্পনা দরকার। তাই এই স্বাধীনতার অর্থ ব্যাপক।

(২) ব্যক্তির গুণাবলির বিকাশ: বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের সুপারিশগুলি পর্যালােচনা করলে এর গুরুত্ব বােঝা যায়। এই কমিশনে শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে—নতুন ভারত গঠনের জন্য নেতৃত্বদানের শিক্ষা, গণতান্ত্রিক মনােভাবের বিকাশ, সৌভ্রাতৃত্ববােধ, সহনশীলতা, শিক্ষায় সমান অধিকার, স্বাধীনতা প্রভৃতি গুণাবলি প্রয়ােজন। ব্যক্তির মধ্যে এই গুণগুলি বিকশিত হলে সামাজিক উন্নতিবিধান সম্ভব।

(৩) শিক্ষার্থী ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সুবিধা প্রদান: শিক্ষার্থীদের জন্য গ্রন্থাগার স্থাপন, গবেষণার উৎকর্ষতসাধন, শিক্ষক-শিক্ষিকা ও শিক্ষাকর্মীদের বেতন কাঠামাের উন্নয়ন সিনিয়র ও জুনিয়র শিক্ষার্থীদের জন্য ফেলােশিপের ব্যবস্থা প্রদান, সরকারি কলেজগুলির উন্নতিসাধন প্রভৃতি সুবিধাপ্রদান।

(৪) শিক্ষাসংক্রান্ত সংশােধনী: প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন ভুল-ত্রুটিসমূহকে সংশােধন করার জন্য কমিশন কতগুলি সুপারিশ করে। এইসকল ত্রুটিগুলির কয়েকটি যথাক্রমে গ্রামীণ শিক্ষার অবহেলা, প্রশাসনিক ব্যর্থতা, শিক্ষার নিম্নমুখী মান ইত্যাদি।

(৫) বৃত্তি ও পেশাগত শিক্ষার গুরুত্ব: পাঠক্রমে সাধারণধর্মী শিক্ষার পাশাপাশি বৃত্তি ও পেশাগত শিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। এতে বােঝা যায়, কমিশন একদিকে যেমন মেধাকে গুরুত্ব দিয়েছে, অপরদিকে সাধারণ মানের শিক্ষার্থীরা যাতে স্বনির্ভর হতে পারে, সেই ব্যবস্থাও পাঠক্রমে রেখেছে।

(৬) হাতেকলমে কাজের দক্ষতা: একদিকে গবেষণার মান উন্নত হবে, অন্যদিকে হাতেকলমে কাজের দক্ষতাও বৃদ্ধি পাবে। কমিশন পাঠক্রমে সমন্বয়ী দৃষ্টিভঙ্গি দেখিয়েছে।

(৭) ভারতীয় ভাষার মর্যাদা: শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে কমিশনের ত্ৰিভাষা নীতি অত্যন্ত উল্লেখযােগ্য বিষয়। মাতৃভাষার উপর কমিশন গুরুত্ব দিয়েছে। এ ছাড়া উচ্চশিক্ষার জন্য ভারতীয় ভাষা (আঞ্চলিক ভাষা) গ্রহণ করার কথা বলেছে। এইভাবে ভারতীয় ভাষাকে মর্যাদা দিতে চেয়েছে।

(৮) পরীক্ষা ব্যবস্থার সুপারিশ: পরীক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে কমিশনের সুপারিশগুলি অত্যন্ত প্রগতিশীলতার পরিচায়ক। সারা বছর পরীক্ষা ব্যবস্থা চালু করার কথা বলেছে, বর্তমানে যেটা প্রচলিত হয়েছে।

(৯) প্রশ্নের ধরন নির্ধারণ: এ ছাড়া অভীক্ষাপত্রে রচনাধর্মী ও নৈর্ব্যক্তিক দু-ধরনের প্রশ্ন রাখার উপর জোর দিয়েছে। এর ফলে রচনাধর্মী প্রশ্নের ত্রুটিগুলি দূর করা সম্ভব হবে বলে কমিশন মনে করে।

(১০) শিক্ষক নিয়ােগ: শিক্ষক নিয়ােগ সম্পর্কে কমিশন অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে বলেছে। শিক্ষক হবেন জ্ঞানপিপাসু এবং আদর্শ চরিত্রের অধিকারী। শিক্ষাগত যােগ্যতা ও মেধা অনুযায়ী শিক্ষক নিয়ােগ করতে বলেছে।

(১১) নারীশিক্ষা: নারীদের শিক্ষার জন্য পাঠক্রমে গার্হস্থ্য বিজ্ঞান ও গার্হস্থ্য অর্থনীতি অন্তর্ভুক্ত করেছে। সহশিক্ষার কলেজগুলিতে মেয়েদের স্বাচ্ছন্দ্যের উপর জোর দিয়েছে শুধু তাই নয়, শিক্ষার্থীদের নৈতিক চরিত্রের উন্নতিসাধনের জন্য ধর্মশিক্ষার প্রয়ােজনীয়তার কথা বলেছে, তবে ধর্মের গোঁড়ামিকে বাদ দিয়ে।

(১২) চিত্তসংযতকরণ  চিত্ত সংযত করার জন্য ধ্যান, প্রার্থনা, মনীষীদের জীবনীপাঠের ব্যবস্থা করার কথা বলেছে। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য কমিশন কমিটি তৈরি করতে বলেছে।

(১৩) গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন: বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ হল, গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনা। গ্রামের শিক্ষার্থীদের প্রয়ােজনীয়তার কথা ভেবে, গ্রামীণ অর্থনীতিকে সুদৃঢ় করতে গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সুপারিশ করেছে।

মূল্যায়ন: বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন প্রতিবেদন পেশ করার পর সুপারিশগুলি নিয়ে কেন্দ্রীয় শিক্ষা উপদেষ্টা পর্ষদে আলােচনা হয়। বেশিরভাগ সুপারিশ গ্রহণ করা হয়, যেগুলি বর্তমানে আজও গ্রহণযােগ্য। গ্রামে ও শহরে কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।

সবদিক থেকে বিচারবিবেচনা করলে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন আধুনিক ভারতের শিক্ষার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। সুপারিশগুলি এতটাই উন্নত চিন্তাধারার পরিচয় বহন করে যে, বর্তমানেও এগুলি সমানভাবে গ্রহণযােগ্য এবং প্রযােজ্য।