পরমাণু সম্পর্কে বিভিন্ন বিজ্ঞানী, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম মতবাদ প্রকাশ করেন। কিন্তু পরমাণু সম্পর্কে নিশ্চিত প্রমাণ লাভের জন্য সর্বপ্রথম রাদারফোর্ড 1911 খ্রিস্টাব্দে একটি পরীক্ষা করেন। যাকে আলফা কণা বিচ্ছুরণ পরীক্ষা বলা হয়। আলফা-কণা হচ্ছে হিলিয়াম পরমাণু থেকে দুটি ইলেকট্রন অপসারিত হলে যে দ্বি-ধনাত্মক হিলিয়াম ( ⁴₂He²+) আয়নের সৃষ্টি হয় তাই আলফা কণা। অবশ্য তেজস্ক্রিয় মৌল থেকে আলফা কণা নির্গত হয়।

রাদারফোর্ডের আলফা কণা বিচ্ছুরণ পরীক্ষাঃ

 রাদারফোর্ড পরমাণুর গঠন সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য আলফা কণা বিচ্ছুরণ পরীক্ষাটি করেন। এই পরীক্ষার জন্য তিনি একটি পাতলা 0.0004 cm পুরু সোনার পাত নেন এবং এই সোনার পাতের পেছনে একটি জিংক সালফাইডের (ZnS) পর্দা রাখেন। জিংক সালফাইডের পর্দার উপর আলফা-কণা পড়লে সেখানে আলোর প্রতিপ্রভা সৃষ্টি হয়। রাদারফোর্ড সোনার পাতের উপর আলফা-কণা নিক্ষেপ করে তা পর্যবেক্ষণ করেন। তার পর্যবেক্ষণ সমূহ হচ্ছে-

১. অধিকাংশ আলফা কণা স্বর্ণের পাত ভেদ করে জিংক সালফাইডের পর্দাকে আলোকিত করে।

২. কিছু আলফা রশ্মি যারা কেন্দ্রের নিকট দিয়ে যায়, তারা তাদের মূল পথ থেকে বেঁকে যায়।

৩. অল্পকিছু আলফা রশ্মি (২০,০০০ এর মধ্য ১টি বা ২টি) যারা সোজা কেন্দ্র বরাবর যায়, সেই আলফা রশ্মিগুলি আবার একই পথে ফিরে আসে। 

রাদারফোর্ড তার আলফা রশ্মির এই পরীক্ষার পর্যবেক্ষণ থেকে কিছু সিদ্ধান্ত উপনীত হন।



সিদ্ধান্ত সমূহঃ

 ১. যেহেতু অধিকাংশ আলফা রশ্মি স্বর্ণের পাত ভেদ করে অতিক্রম করে। কাজেই বলা যায় পরমাণুর অধিকাংশ স্থান ফাঁকা। এই ফাঁকা স্থানগুলিতে ইলেকট্রন অবস্থান করে। ইলেকট্রনের ভর আলফা কণার ভর থেকে অনেক কম হওয়ায় ইলেকট্রন আলফা কণার গতিপথের কোন পরিবর্তন ঘটাতে পারে না।

২. কিছু আলফা রশ্মি তাদের মূল পথ থেকে বেঁকে যাওয়ার কারণ হিসেবে বলা যায়, যেহেতু আলফা রশ্মি ধনাত্মক চার্জযুক্ত সেহেতু পরমাণুর কেন্দ্রে ধনাত্মক চার্জ বিদ্যমান। এই সমধর্মী চার্জের কারণে আলফা-কণাগুলি তাদের মূল পথ থেকে বেঁচে যায়। ধনাত্মক চার্জযুক্ত পরমাণুর কেন্দ্রকে রাদারফোর্ড নিউক্লিয়াস নামকরণ করেন।

৩. যেহেতু অল্পকিছু আলফা কণা যে পথে যায় সেই পথে ফিরে আসে। সেহেতু বলা যায়, পরমাণুর কেন্দ্রে কোন ভারী বস্তু বিদ্যামান। আলফা-কণাগুলি এই ভারী বস্তুর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, অথবা বিকর্ষণের কারনে আলফা-কণাগুলি যে পথে যায় ঠিক সেই পথেই আবার ফিরে আ। এ থেকে বলা যায় পরমাণুর সমস্ত ভর পরমাণুর কেন্দ্রে একত্রিত থাকে।

৪. পরমাণুর আকারের তুলনায় নিউক্লিয়াসের আকার অতি নগণ্য। অর্থাৎ পরমাণুর আকারের তুলনায় নিউক্লিয়াসের আকার 10 হাজার থেকে 1 লক্ষ গুণ ছোট। 

রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেলঃ

রাদারফোর্ড আলফা কণা বিচ্ছুরণ পরীক্ষার মাধ্যমে পরমাণুর গঠন সম্বন্ধে অবহিত হন। তিনি পরমাণুর গঠনকে সৌরজগতের সঙ্গে তুলনা করেন বলে, তার মডেলটিকে সোলার সিস্টেম এটম মডেল বলা হয়। এছাড়া রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেলে নিউক্লিয়াসের ধারনা পাওয়া যায় বলে, এ মডেলকে নিউক্লিয়ার পরমানু মডেলও বলে। রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেলের প্রস্তাবগুলো নিম্নরূপ-

১. পরমাণু গোলাকার। পরমাণুর দুটি অংশ থাকবে। একটি পরমাণুর কেন্দ্র অর্থাৎ নিউক্লিয়াস এবং অপরটি ইলেকট্রন সমৃদ্ধ নিউক্লিয়াসের বাহিরের অংশ।

২. পরমাণুর সমস্ত ভর এবং ধনাত্মক আধান নিউক্লিয়াসে পুঞ্জিভূত থাকবে। মূলত নিউক্লিয়াসের ভর, পরমাণুর ভর হবে।

৩. নিউক্লিয়াসের আয়তন পরমাণুর মোট আয়তনের তুলনায় অতি নগণ্য। 

৪. পরমাণুর নিউক্লিয়াসে অবস্থিত ধনাত্মক আধানের সমান সংখ্যক ঋনাত্বক আধান বিশিষ্ট ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসের বাহিরে অবস্থান করে। যেহেতু পরমাণুতে ধনাত্মক ও ঋনাত্বক আধানের সংখ্যা সমান, সেহেতু পরমাণু আধান নিরপেক্ষ হবে।

৫. নিউক্লিয়াসের চারপাশে ইলেকট্রনসমূহ সৌরজগতে সূর্যের চারিদিকে ঘুর্ণয়মান গ্রহমন্ডলীর মত ঘূর্ণায়মান থাকবে। ধনাত্মক আধান বিশিষ্ট নিউক্লিয়াস ও ইলেকট্রনের মধ্যকার স্থির বৈদ্যুতিক আকর্ষণজনিত কেন্দ্রমুখী বল ও ঘূর্ণায়মান ইলেকট্রনের কেন্দ্র বহির্মুখী বল পরস্পর সমান ও বিপরীতমুখী হবে।

রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেলের সীমাবদ্ধতাঃ

১. রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেলকে সৌরজগতের সঙ্গে তুলনা করা সঠিক হয়নি। কারণ, সৌরজগতে গ্রহসমূহ সামগ্রিকভাবে চার্জ নিরপেক্ষ। কিন্তু পরমাণুতে অবস্থিত নিউক্লিয়াস ও ইলেকট্রন ধনাত্মক ও ঋণাত্মক চার্জ বিশিষ্ট। 

২. ম্যাক্সওয়েলের তড়িৎ চুম্বকীয় তত্ত্ব অনুসারে পরমাণুতে ইলেকট্রন সমূহ নিউক্লিয়াসের চারদিকে ঘূর্ণনকালে অনবরত শক্তি বিকিরণ করতে থাকবে। এর ফলে ইলেকট্রনের কক্ষপথের ব্যাসার্ধ হ্রাসপেতে থাকবে এবং এটি সর্পিলাকারে একসময় নিউক্লিয়াসে পতিত হবে। ফলে এ মডেলের কোন অস্তিত্ব থাকবে না।

৩. রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেলটি বর্ণালী সম্বন্ধে কোন স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিতে পারে না।

৪. রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেল এক ইলেকট্রন বিশিষ্ট হাইড্রোজেন (₁H) বা এক ইলেকট্রন বিশিষ্ট আয়নের ( ₂He+ ; ₃Li²+ ; ₄Be³+….) ক্ষেত্রে ব্যাখ্যা করা গেলেও একাধিক ইলেকট্রন পরমাণুতে কিভাবে অবস্থান করবে তার ব্যাখ্যা এ মডেল দিতে পারেনা।

 ৫. এ মডেল পরমাণুতে ইলেকট্রনসমূহের কক্ষপথের আকার-আকৃতি সম্বন্ধে কোন ধারণা দিতে পারেনা।



৬. পরমাণুর বিভিন্ন কক্ষপথে ইলেকট্রনসমূহ কিভাবে সজ্জিত থাকবে তার কোনো সুস্পষ্ট ধারণা এ মডেল দিতে পারেনা।

তবে একথা অনস্বীকার্য যে, রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেল হতে নিউক্লিয়াস এবং কক্ষপথে পরিভ্রমণরত ইলেকট্রনের ধারণা পরমাণু জগতে সুদূরপ্রসারি প্রভাব বিস্তার করে।