ভূমিকা: রাজ্য জনপালনকৃত্যক রাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা। এটি গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভরূপে পরিচিত। ভারতের অঙ্গরাজ্যগুলিতে প্রশাসনিক কাজ পরিচালনা করার জন্য রাজ্য জনপালনকৃত্যক রয়েছে। রাজ্যসরকারের উচ্চপদস্থ কর্মচারীগণ রাজ্য জনপালনকৃত্যকের অন্তর্ভুক্ত। প্রতিযােগিতামূলক পরীক্ষা (লিখিত ও মৌখিক) এবং পদোন্নতির মাধ্যমে রাজ্যপাল এদের নিয়ােগ করেন। বর্তমানে নানাবিধ কারণে জনপালনকৃত্যকের কাজকর্মের পরিধি বৃদ্ধি পাচ্ছে। নির্বাচিত মন্ত্রীদের সবসময় যে শাসনকার্যে অভিজ্ঞতা থাকবে এমন কোনাে নিশ্চয়তা নেই। শাসনকার্য পরিচালনায় একদল কর্মচারীদের উপর তাদেরকে নির্ভর করতে হয়, যারা রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। এককথায় রাজ্য জনপালনকৃত্যক রাজনৈতিক ব্যবস্থা সংশােধনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন।
প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের প্রশাসনিক কাজে নিযুক্ত স্থায়ী কর্মচারী হলেন রাজ্য জনপালনকৃত্যকের আধিকারিকগণ। বলাবাহুল্য, এই জনপালনকৃত্যকের উপরেই রাজ্যের শাসন পরিচালনার দায়িত্বভার ন্যস্ত রয়েছে। এমনকি জনপালনকৃত্যকের আধিকারিকগণ রাজ্যের সকল জনকল্যাণমূলক কাজের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রাখেন। জনপালনকৃত্যক আধিকারিকরা রাজ্যের শাসনতান্ত্রিক সিদ্ধান্তকে বাস্তবে কার্যকরী করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। রাজ্যের সামাজিক, অর্থনৈতিক সমস্যা নিরসনে রাজ্যকৃত্যকদের নানাবিধ কাজ করতে হয়। নিম্নে রাজ্য জনপালনকৃত্যকের কার্যাবলি সংক্ষেপে আলােচনা করা হলㅡ
(1) শাসনকার্যের স্থায়িত্ব ও নিরবচ্ছিন্নতা রক্ষা করা: আমলাবাহিনী দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্থায়িত্ব বজায় রেখে চলেন। প্রতিনিধিত্বমূলক শাসন ব্যবস্থায় আমলাদের এই ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তারা সদাসর্বদা প্রশাসনিক কাঠামােকে সচল রাখেন। সুশাসনের স্বার্থে শাসনকার্যের মধ্যে তারা নিরবচ্ছিন্নতা বজায় রাখেন।
(2) দৈনন্দিন কার্য পরিচালনা: জনপালনকৃত্যকের কর্মচারীবৃন্দ প্রশাসনের দৈনন্দিন শাসনকার্য পরিচালনা করেন। তাদের এই কাজকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। যথা – (a) শাসননীতি নির্ধারণ এবং (b) শাসননীতি প্রয়ােগ।
(3) বিশেষীকৃত অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান সরবরাহ: জনপালনকৃত্যকের অভিজ্ঞ ও বিচক্ষণ আমলারা তাদের দীর্ঘদিনের প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা লব্ধ জ্ঞান রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রীদের সরবরাহ করেন, আইনসভায় মন্ত্রীদের যেসকল প্রশ্নের জবাব দিতে হয় তার উত্তর বিচক্ষণ আমলারাই প্রস্তুত করে দেন।
(4) সংবাদ ও তথ্য সরবরাহ: আমলারা প্রশাসনিক সংবাদ ও তথ্য সরবরাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। সরকারি নীতি ও যাবতীয় তথ্যের উৎস হল আমলাতন্ত্র।
(5) আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত কাজ: আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রেও জনপালনকৃত্যকের আমলারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। আমলারা দু-ধরনের আইন প্রণয়ন করে থাকে, যেমন―
- (a) অর্পিত ক্ষমতাপ্রসূত আইন (delegated law),
- (b) প্রশাসনিক দপ্তর প্রণীত আইন (departmental law)।
(6) স্বার্থগােষ্ঠীর ব্যাপারে ভূমিকা: বর্তমান রাজনৈতিক শাসন ব্যবস্থায় জনপালনকৃত্যকের আধিকারিকগণ বিভিন্ন ধরনের চাপ সৃষ্টিকারী গােষ্ঠী এবং স্বার্থগােষ্ঠীর চাপে কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হন। যেমন—শ্রমিক সংঘ, কৃষক সংঘ, ব্যবসায়ী সংঘ, শিক্ষক সংগঠন ইত্যাদি এবং তারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য আমলাবাহিনীর সঙ্গে যােগাযােগ গড়ে তােলে তাই আমলাদের ভূমিকা এক্ষেত্রেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
(7) বিচারবিভাগীয় কার্যসম্পাদন: শাসন বিভাগের স্থায়ী অংশ জনপালনকৃত্যকের আমলাবাহিনীকে বিভাগীয় ন্যায়বিচার বা প্রশাসনিক বিচারব্যবস্থার দায়িত্বও পালন করতে হয়।
(8) সরকারি নীতি ও কর্মসূচি রূপায়ণ: জনপালনকৃত্যকের আমলাবাহিনীকে সরকার কর্তৃক গৃহীত কর্মসূচি ও নীতি রূপায়ণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হয়।
(9) রাজনৈতিক ব্যবস্থা সংরক্ষণ: দেশের সংকটকালীন পরিস্থিতিতে জনপালনকৃত্যকের আমলাবাহিনী সরকারের স্থায়িত্ব বজায় রাখতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে থাকেন।
(10) রাজনৈতিক পৃষ্ঠপােষকতা: কোন কোন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় জনপালকৃত্যকের আধিকারিকগণ রাজনৈতিক সুযােগসুবিধা দানের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কার্যসম্পাদন করে থাকেন।
(11) নীতি প্রণয়ন: জনপালনকৃত্যকগণ সরকারি নীতি প্রণয়নের ব্যাপারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নীতি নির্ধারণের প্রতিটি স্তরের সঙ্গে আমলাবাহিনী বিশেষভাবে জড়িত রয়েছে।
(1) দুর্নীতির অভিযােগ: জনপালনকৃত্যকের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড়া অভিযােগ হল রাজ্য জনপালনকৃত্যকের একটি বড় অংশের লােকেদের মধ্যে স্বজনপােষণ ও তােষণ ইত্যাদি লােভ ও দুর্নীতি বাসা বেঁধেছে।
(2) দীর্ঘসূত্রিতা: জনপালনকৃত্যকের আধিকারিকদের দীর্ঘসূত্রিতাও একটা বড়াে সমস্যা। অনেকসময় জনগণের দিক থেকে লেখালেখি চিঠিপত্র দিয়েও কোনাে কাজ হয় না। তার ফলস্বরূপ জনগণের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়, অনেকক্ষেত্রে এই আমলাদের ভুলে সরকারি সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
(3) সমস্যা এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা: অনেকক্ষেত্রে নানা অজুহাত এবং নিয়মকানুনের দোহাই দিয়ে এরা আসল সমস্যাকে এড়িয়ে যান। এর ফলে কাজগুলি শ্লথগতিসম্পন্ন কচ্ছপের মতাে হয়ে পড়ে।
(4) জনসংযােগের অভাব: ভারতের জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রব্যবস্থায় আমলাগণ জনকল্যাণমূলক কাজের দায়িত্বে থাকেন। কিন্তু কিছু আমলা আছেন যারা জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা, অভাব-অভিযােগের প্রতি তেমন আগ্রহ প্রকাশ করেন না। সেক্ষেত্রে সেইসকল আমলাদের সঙ্গে জনসাধারণের সংযােগের ক্ষেত্রে দূরত্ব বা অভাব পরিলক্ষিত হয়।
(5) রক্ষণশীলতা: অনেক জন পালন কৃত্যক আধিকারিক গণ শিক্ষাগত দিক থেকে এবং শ্রেণিচেতনার দিক থেকে প্রশাসনিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তােলেন। সাধারণ মানুষের অভাব-অভিযােগকে তেমন গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেন না। সরকারি অফিস-আদালত, হাসপাতাল সর্বত্র আজ এই দৃশ্যই বর্তমান।
(6) তোষামোদকারী প্রকৃতি: কখনো-কখনো জনপালনকৃত্যক আধিকারিকগণ কর্মক্ষেত্রে নিজেদের প্রোমোশন বা ভালাে পরিবেশে পােস্টিং-এর জন্য উচ্চ স্তরের নেতা-মন্ত্রীদের তােষামােদ করে চলেন। এই তােষামােদকারী আমলারা বা জনপালনকৃত্যক আধিকারিকগণ সুস্থ গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে বিপদ ডেকে আনেন। বলাবাহুল্য, এই শ্রেণির আমলারা কখনােই নিরপেক্ষভাবে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। রাষ্ট্রের প্রতি আমলাদের এই ভূমিকা নিরপেক্ষ হলেই দেশের শ্রীবৃদ্ধি ঘটবে।
পরিশেষে বলা যায় যে, রাজ্য জনপালনকৃত্যক আধিকারিকদের বিরুদ্ধে নানাবিধ অভিযােগ থাকা সত্ত্বেও রাজ্যের প্রশাসন এবং জনকল্যাণমুখী কাজকর্মের ক্ষেত্রে তাদের গুরুত্বকে কোনােভাবেই অস্বীকার করা যায় না। প্রশাসনিক কাজকর্ম পরিচালনা করতে গেলে যে অভিজ্ঞ, সুদক্ষ এবং নিরপেক্ষ কর্মচারী প্রয়ােজন তা এই আমলা বা জনপালনকৃত্যক আধিকারিকদের মধ্যেই পরিলক্ষিত হয়। বলাবাহুল্য, রাজ্য প্রশাসনকে সচল রাখতে এই আমলারাই কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করে থাকেন। এ ছাড়া এদের মাধ্যমেই বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কাজের মধ্য দিয়ে জনসাধারণের সঙ্গে সংযোগ ঘটানাে সম্ভব হয়।
Leave a comment