ভূমিকা: ভারতের অঙ্গরাজ্যের আইনসভারগুলিতেও কেন্দ্রের সংসদীয় শাসনব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে। আধুনিককালের রাজ্য আইনসভার একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করা। এই নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার একমাত্র অধিকারী হল রাজ্য আইনসভার জনপ্রিয় কক্ষ বলে পরিচিত বিধানসভা। কেন্দ্রীয় আইনসভার মতাে রাজ্য আইনসভাও রাজ্যের শাসন বিভাগ বা রাজ্য সরকারের উপর নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ভােগ করে।

(1) রাজ্য মন্ত্রীসভা গঠন: সংসদীয় রীতিনীতি অনুযায়ী রাজ্যে মন্ত্রীসভা গঠন সম্পূর্ণরূপে বিধানসভা বা রাজ্য আইনসভার উপর নির্ভরশীল। বিধান পরিষদ মন্ত্রীসভা গঠনে কোনাে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে না। বিধানসভায় যে দল বা জোট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সেই দল বা জোট সরকার গঠন করে থাকে। মন্ত্রীসভা গঠনের সময় মুখ্যমন্ত্রী বিধান পরিষদের সদস্যদের মধ্য থেকেও মন্ত্রীদেরকে নিয়ােগ করতে পারেন।

(2) মন্ত্রীপরিষদের কার্যকাল নিয়ন্ত্রণ: মন্ত্রী পরিষদের কার্যকাল নিয়ন্ত্রণ করা রাজ্য আইনসভার আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলে বিবেচিত হয়। বিধানসভার আস্থার উপরই মন্ত্রী পরিষদের ৫ বছরের কার্যকাল নির্ভরশীল। মন্ত্রীসভা যতদিন বা যতক্ষণ বিধানসভা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ভােগ করে থাকে ততদিন বা ততক্ষণ তার পক্ষে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকা সম্ভব হয়। বিধানসভা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারালে মন্ত্রীপরিষদকেও পদত্যাগ করতে হয়।

(3) রাজ্য মন্ত্রীসভার যৌথ দায়িত্বশীলতা: রাজ্য মন্ত্রীসভা ১৬৪ (২) নং ধারানুযায়ী বিধানসভার কাছে যৌথভাবে দায়িত্বশীল থাকে। এই যৌথ দায়িত্বশীলতার অর্থ হল মন্ত্রীসভা তার সকল প্রকার কাজের জন্য বিধানসভা বা রাজ্য আইনসভার নিকট জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবে। রাজ্য মন্ত্রিসভা কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ বিভাগীয় ন্ত্রীরা বিধানসভায় পেশ করে থাকেন। বিধানসভায় কোনাে মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পাস হওয়ার অর্থ হল সমগ্র মন্ত্রীসভার বিরুদ্ধে সেই প্রস্তাবটি পাস হওয়া। মন্ত্রীসভা যৌথভাবে যে-কোনাে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং মন্ত্রীসভার পক্ষ থেকে কোনাে একজন মন্ত্রী সেই প্রস্তাব বিধানসভায় পেশ করেন। এই কারণেই বিধানসভায় কোনাে মন্ত্রীর পরাজয় হওয়ার অর্থই হল সমগ্র মন্ত্রিসভার পরাজয় হওয়া।

(4) রাজ্য মন্ত্রীসভাকে নিয়ন্ত্রণ: কেন্দ্র সংসদীয় শাসনব্যবস্থার রীতি অনুযায়ী ভারতের অঙ্গরাজ্যগুলিতেও মন্ত্রীসভার নীতিসমূহকে আইনসম্মত রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে রাজ্য আইনসভার অনুমােদনের প্রয়ােজন হয়। রাজ্য আইনসভার জনপ্রিয় কক্ষ বলে পরিচিত বিধানসভা মন্ত্রীসভার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব, নিন্দাসূচক প্রস্তাব, মুলতুবি প্রস্তাব, দৃষ্টি-আকর্ষণ প্রস্তাব, রাজ্যপালের ভাষণ, বাজেট, বিতর্ক ইত্যাদির মাধ্যমেও রাজ্য সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

মন্ত্রীসভার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পাস হলেও মন্ত্রীসভাকে পদত্যাগ করতে হয়, তার কারণ হল বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণের সাহায্যে শাসকদল ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারে। তাই সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন হারালেই আইনগতভাবে আর সেই দল ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারে না। এইরকম পরিস্থিতির উদ্ভব হলে বিকল্প মন্ত্রীসভা গঠিত হতে পারে। বিধানসভা ভেঙে দেওয়ার জন্য মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যপালকে পরামর্শ দিতে পারেন।

(5) অর্থ সংক্রান্ত ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ: সংবিধানের ২৬৬ (৩) নং ধারা অনুসারে আইনসভার অনুমােদন ছাড়া সঞ্চিত তহবিল থেকে অর্থ ব্যয় হতে পারে না। বাৎসরিক বাজেট অনুমােদনের মাধ্যমে রাজ্য সরকারের অর্থব্যয়কে রাজ্য আইনসভা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। সর্বোপরি, বরাদ্দকৃত অর্থ নির্দিষ্ট খাতে ব্যয় করা হচ্ছে কি না, সরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রে অপচয় রোধ এবং দুর্নীতি রুখতে রাজ্য আইনসভার হাতে ব্যাপক ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে। সরকারি আয় ব্যয় নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও রাজ্য আইনসভা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ভোগ করে থাকে। রাজ্য আইনসভার অনুমােদন ছাড়া কোনাে অর্থ ব্যয় করা সম্ভব হয় না। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রাজ্যপালের অনুমােদন ছাড়া কোনাে ব্যয় মঞ্জুরির দাবি কিংবা রাজস্ব বিল আইনসভায় উত্থাপন করা যায় না। সরকারের কাজকর্ম সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করার জন্য কেন্দ্রের মতাে রাজ্যেও গঠন করা হয়েছে一

  • (a) আনুমানিক ব্যয় হিসাব কমিটি,
  • (b) সরকারি হিসাবপরীক্ষা কমিটি,
  • (c) নিয়ন্ত্রক ও মহাগণনা পরীক্ষক।

উপসংহার: শাসন বিভাগের উপর অর্থাৎ রাজ্য সরকারের উপর এই নিয়ন্ত্রণ যতটা তাত্ত্বিক, ততটা বাস্তবিক নয়। সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় বর্তমানে কেন্দ্রের মতাে রাজ্যগুলিতেও ক্যাবিনেটের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তা ছাড়া বিধানসভায় যতদিন কোন সরকারের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকে, সরকারের সদস্যরা দলীয় নির্দেশে পরিচালিত হন ততদিন বা ততক্ষণ বিধানসভার পক্ষে শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। শাসকদল বা জোটে ভাঙন দেখা দিলে তবেই শাসন বিভাগ তথা সরকারের উপর বিধানসভার নিয়ন্ত্রণ কার্যকর হতে পারে। বলা যায়, একমাত্র ত্রিশঙ্কু বিধানসভার ক্ষেত্রে রাজ্য আইনসভা কর্তৃক রাজ্য সরকারের উপর নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি বেশি গুরুত্বলাভ করেছে।