ভূমিকা: সংবিধানের ১৯৪ নং ধারায় রাজ্য আইনসভা এবং তার সদস্যদের বিশেষাধিকার এবং অব্যাহতি সম্পর্কে আলােচনা করা হয়েছে। সংবিধানের ১০৫ নং ধারায় বর্ণিত রয়েছে যে, সংসদ এবং তার সদস্যদের বিশেষাধিকার অব্যাহতির অনুরূপ।

বলা যায়, রাজ্য আইনসভার প্রতিটি কক্ষ সমষ্টিগতভাবে এবং সদস্যরা ব্যক্তিগতভাবে যেসকল অধিকার ভােগ করেন তার সমষ্টিকে বলা হয় রাজ্য আইনসভার সদস্যদের বিশেষাধিকার। এইসকল অধিকার ছাড়া রাজ্য আইনসভা এবং তার সদস্যদের যথাযথভাবে কার্য সম্পাদন করা সম্ভব নয়। তাই সকল অঙ্গরাজ্যের আইনসভার সদস্যরা ব্যক্তিগতভাবে কতকগুলি বিশেষ সুযােগসুবিধা ভােগ করে থাকেন। এইগুলিকে সংক্ষেপে বিভাগীয় বিশেষাধিকার বলা হয়। সাধারণত শাসন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও জনসাধারণের বিরুদ্ধে আইন বিভাগ ও তার সদস্যরা এই সমস্ত অধিকার ভােগ করে থাকেন।

উৎস: সংবিধানে সদস্যদের বিশেষ অধিকার ও অব্যাহতিকে সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করা হয়, যথা—

  • (1) সদস্যদের ব্যক্তিগত অধিকার ও অব্যাহতি,
  • (2) পার্লামেন্টের সমষ্টিগত অধিকার ও অব্যাহতি।

[1] রাজ্য আইনসভার সদস্যদের ব্যক্তিগত অধিকার ও অব্যাহতি: রাজ্য আইনসভার প্রত্যেক কক্ষই ব্যক্তিগতভাবে যে অধিকার ও অব্যাহতি ভােগ করে থাকে সেগুলি নিম্নে আলােচনা করা হল一

  • বাক স্বাধীনতা: রাজ্য আইনসভার সদস্যগণ আইনসভার চার দেয়ালের মধ্যেই বাকস্বাধীনতা ভােগ করে থাকেন। আইনসভায় বক্তৃতাদান বা ভােটদান সংক্রান্ত কোনাে বিষয়ে আদালতে কোনাে মামলা দাখিল করা যায় না। তবে আইনসভার সদস্যদের ব্যক্তিগতভাবে ‘Rules of Procedure’ মেনে চলতে হয়। সংবিধানের ১৯৪ নং ধারা অনুসারে, রাজ্য আইনসভার প্রত্যেক সদস্যই মতপ্রকাশের অধিকার পায়। তবে এই মতপ্রকাশের অধিকার সংবিধান এবং রাজ্য আইনসভার কার্যপরিচালনা সংক্রান্ত নিয়ম ও স্থায়ী নির্দেশের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে। ১৯৪ নং ধারায় আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাজ্য আইনসভা বা তার কোনাে কমিটিতে কোনাে বক্তব্য রাখার জন্য বা ভোটদানের জন্য কোনাে সদস্যকে আদালতে কখনােই অভিযুক্ত করা যায় না।
  • আদালত অভিযুক্ত না হওয়ার অধিকার: রাজ্য আইনসভার কোনাে সদস্যকে আইনসভার অভ্যন্তরে বা কমিটিতে বক্তৃতা বা ভোট প্রদানের সময় আদালতে অভিযুক্ত করা যায় না। তা ছাড়া কার্যবিবরণী, কাগজপত্র, আইনসভায় প্রকাশিত প্রতিবেদন প্রভৃতি কারণে কোনাে ব্যক্তিকে আদালতে অভিযুক্ত করা সম্ভব হয় না।
  • গ্রেফতার না হওয়ার স্বাধীনতা: রাজ্য আইনসভার অধিবেশন চলাকালীন কোনাে সদস্যকে দেওয়ানি মামলায় গ্রেফতার করা যায় না। বর্তমানে রাজ্য আইনসভার কোনাে সদস্যকে সভার অধিবেশন শুরু হওয়ার ৪০ দিন আগে থেকে এবং অধিবেশন শেষ হওয়ার ৪০ দিন পর্যন্ত দেওয়ানি অভিযােগের দায়ে গ্রেফতার করা সম্ভব হয় না অর্থাৎ রাজ্য আইনসভার সদস্যগণ অধিবেশন শুরু ও শেষ হওয়া (৪০ দিন আগে ও পরে) পর্যন্ত দেওয়ানি মামলায় গ্রেফতার না হওয়ার স্বাধীনতা ভােগ করে থাকে। তবে ফৌজদারি অভিযােগ ও নিবর্তনমূলক আটক আইনের মাধ্যমে গ্রেফতারের এই অধিকার ও অব্যাহতি পাওয়ার সুযােগ সদস্যদের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য হয় না (আনন্দ বনাম মাদ্রাজের মুখ্য সচিব, ১৯৫৬ খ্রি.)। এ ছাড়া রাজ্য আইনসভার কোনাে সদস্যকে বিধানসভার অধ্যক্ষ এবং বিধান পরিষদের সভাপতির অনুমতি ছাড়া দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলায় গ্রেফতার জারি করা যায় না। তবে যদি কোনো সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েও থাকে তাহলে সেই সংবাদটি বিধানসভার স্পিকার বা বিধান পরিষদের সভাপতিকে জানাতে হয়।
  • জুরি বা সাক্ষী হিসাব উপস্থিত না হওয়ার স্বাধীনতা: রাজ্য আইনসভার অধিবেশন চলাকালীন সময়ে রাজ্য আইনসভার কোনাে সদস্যকে জুরির সাহায্যে দায়িত্ব পালন করার জন্য বাধ্য করা যায় না। তা ছাড়া এইসময় আদালতের অনুমতি ব্যতিরেকে কোনাে সদস্যকেও সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য বাধ্য করা যায় না।

[2] রাজ্য আইনসভার সদস্যদের সমষ্টিগত অধিকার ও অব্যাহতি:

  • বহিরাগতাদের উপস্থিতি নিষিদ্ধ করার অধিকার: রাজ্য আইনসভার প্রত্যেক কক্ষে (যথা-বিধানসভা ও বিধান পরিষদ) বিতর্ক আলােচনার গোপনীয়তা রক্ষার জন্য কক্ষের সদস্য নন এমন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও আইনসভার অভ্যন্তরে প্রবেশ নিষিদ্ধ বলে ফরমান জারি করা হয়। মূলত রাজ্য আইনসভা সভার শান্তি-শৃঙ্খলার উদ্দেশ্যে বা যুদ্ধের ভয়াবহতা রক্ষা করার উদ্দেশ্যে এই অধিকার প্রয়ােগ করে থাকে।
  • অভ্যন্তরীণ কার্যপদ্ধতি নিয়ন্ত্রণের অধিকার: রাজ্য আইনসভার প্রত্যেক কক্ষ তার নিজ নিজ কাজকর্ম, অভ্যন্তরীণ কার্যপদ্ধতিকে স্বাধীনভাবে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করার অধিকার ভােগ করে থাকে। সভার অভ্যন্তরে কোনাে বক্তব্যের কারণে কাউকে আদালতে হস্তক্ষেপ করা যায় না। তবে ব্যতিক্রমী ঘটনা হিসেবে হত্যাকাণ্ড যদি ঘটে তাহলে তা আদালতের এক্তিয়ারের বিষয় হয়ে ওঠে।
  • অবমাননার জন্য শাস্তি দানের ব্যবস্থা: কোনাে ব্যক্তি বা সংবাদপত্র যদি রাজ্য আইনসভা বা তার কোনাে সদস্যকে অপমান করে কিংবা সদস্যদের বিশেষাধিকার ভঙ্গ করে তাহলে আদালত অবমাননাকারীদের শাস্তি প্রদান করতে পারে। এই শাস্তি প্রদানের ক্ষমতা একমাত্র বিধানসভার স্পিকার বা বিধান পরিষদের সভাপতিই প্রয়ােগ করে থাকেন। এই শাস্তি তিন প্রকারের হতে পারে— (a) অভিযুক্ত ব্যক্তিকে সভায় উপস্থিত হতে বলা হয় এবং তাকে তিরস্কার ও সতর্ক করা হয়, (b) কঠোর ভর্ৎসনা করা হয় এবং (c) অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জেলহাজতের অধীনে রাখা হয়।
  • বিতর্ক ও কার্যবিবরণী প্রকাশের অধিকার: রাজ্য আইনসভার অভ্যন্তরে যেসব বিতর্ক ও আলােচনা অনুষ্ঠিত হয়, রাজ্য আইনসভার প্রতিটি কক্ষই সেগুলি প্রকাশ করতে পারে। অবশ্য অনেকক্ষেত্রেই বিধান পরিষদের সভাপতি ও বিধানসভার স্পিকার কোনাে বিশেষ ধরনের বিষয়কে সংবাদপত্রে প্রকাশ করতে বাধা দিতে পারেন। এ ছাড়া আরও একটি বিষয় উল্লেখযােগ্য যে, যদি কোনাে ব্যক্তি আইনসভা সংক্রান্ত কোনাে সংবাদ বিকৃতভাবে প্রকাশ করেন তাহলে সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনসভায় অবমাননার অভিযােগ আনা যেতে পারে।
  • কার্যক্রমকে সঠিক রূপ প্রদানের অধিকার: রাজ্য আইনসভার (উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষ) উভয় কক্ষই খেয়াল রেখে চলে যেন রাজ্য আইনসভার কার্যাবলি সঠিকভাবে পরিচালিত হতে পারে। এরজন্য দুই কক্ষই তাদের নিজস্ব কর্মসূচি, অভ্যন্তরীণ কার্যপদ্ধতি প্রভৃতি সঠিকভাবে নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। বলাবাহুল্য, প্রতিটি কক্ষই স্বাধীনভাবে এই কার্যক্রম রচনা ও বাস্তবায়িত করতে সক্ষম।

উপসংহার: বস্তুত রাজ্য আইনসভা এবং তার সদস্যদের বিশেষাধিকার ও অব্যাহতি ভােগের ক্ষেত্রে অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতার অস্তিত্ব সমর্থন করা যায় না। জনগণের মৌলিক অধিকার অনেকক্ষেত্রে আইনসভার বিশেষাধিকারের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তা ছাড়া যেহেতু কেন্দ্রের এবং রাজ্যের শাসনব্যবস্থা সংসদীয়, তাই এই ধরনের মন্ত্রীসভা দলীয় আনুগত্যের মাধ্যমে আইনসভার নিজ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সচেষ্ট হয়। আইনসভার বিশেষাধিকার সমূহের অতি প্রয়ােগের ফলে আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে সংঘাতের সৃষ্টি হয়। এই সমস্ত সমস্যার একমাত্র উপায় হল আইনসভা কর্তৃক তাদের বিশেষাধিকারগুলি নির্দিষ্ট ও লিপিবদ্ধ করা, যার ফলে কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে আইনসভার বিশেষাধিকার লঙ্ঘিত হলেও সে বিষয়ে জনগণ সতর্ক থাকতে পারে। এই কারণেই বিশেষাধিকারের পরিধি সম্পর্কে কোনোরূপ অস্পষ্টতা থাকবে না এবং আদালতও মৌলিক অধিকার রক্ষায় যথেষ্ট সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে।