পরিচয়: ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ভারত ছাড়াে আন্দোলনের সময়ও মুসলিম লিগের অনড় দাবি ছিল পৃথক পাকিস্তান রাষ্ট্রের গঠন। এই লক্ষ্যের বাস্তবায়নেই তাদের যাবতীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। এই অবস্থায় স্বাধীন ভারতকে দ্বিখণ্ডিত না করে, অথচ জিন্নার দাবির কিছু অংশ বাস্তবায়িত করে গান্ধি অনুগামী মাদ্রাজের চক্রবর্তী রাজাগােপালাচারী এক সমাধানসূত্র প্রকাশ করেন (মার্চ, ১৯৪৪ খ্রি.)। তার এই সমাধানসূত্র ‘রাজাজি সূত্র’ বা সি. আর. ফর্মুলা (C. R. Formula) নামে পরিচিত।

প্রস্তাবসমূহ:

  • [i] কংগ্রেসের স্বাধীনতার দাবিকে মুসলিম লিগ পূর্ণভাবে সমর্থন করবে এবং কংগ্রেসের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করবে। 

  • [ii] দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞলের অধিবাসীদের গণভােট গ্রহণ করে দেখা হবে যে তারা পৃথক রাষ্ট্র গঠনের পক্ষপাতী কিনা। 

  • [iii] গণভােট গ্রহণের আগে সব দলকে তাদের বক্তব্য প্রচারের সুযােগ দেওয়া হবে। 

  • [iv] মুসলিম-প্রধান অঞ্চলগুলি পৃথক রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে মত দিলে দুটি পৃথক রাষ্ট্র গঠিত হবে। দেশভাগ হলেও প্রতিরক্ষা, বাণিজ্য, যােগাযােগ ও অন্যান্য বিষয়ে উভয় অংশই সমানভাবে জড়িত, এইসব বিষয় যৌথভাবে পরিচালিত হয়। 

  • [v] ব্রিটিশ সরকার ভারতকে স্বাধীনতা দিলে তবেই এই প্রস্তাব কার্যকরী হবে।

প্রস্তাবের ব্যর্থতা: গান্ধিজি ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের ৬ মে জেল থেকে ছাড়া পান। এরপর তিনি রাজাজির প্রস্তাব অনুসারে ৯ সেপ্টেম্বর থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বােম্বাইয়ে জিন্নার বাসগৃহে ২১ বার বৈঠক করেন। কিন্তু জিন্না বিভিন্ন কারণে রাজাজি সূত্র প্রত্যাখ্যান করেন।

আইন পাস: ভারতীয় স্বাধীনতা আইনের বলে ভারত ও পাকিস্তান দুই আলাদা ডােমিনিয়নের হাতে আলাদা-আলাদাভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়। পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয় মাউন্টব্যাটেন প্রস্তাবের অন্তর্ভুক্ত প্রদেশগুলি। আর অবশিষ্ট অংশ নিয়ে গঠিত হয় ভারতবর্ষ।

আইনের ধারা: 

  • [i] ভারতবর্ষকে বিভক্ত করা হবে এবং ১৯৪৭খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট ভারত’ ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র আত্মপ্রকাশ করবে। 

  • [ii] দুটি রাষ্ট্রের ওপর থেকে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সমস্ত অধিকার লুপ্ত হবে। উভয় রাষ্ট্রই স্বাধীনভাবে তাদের অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রীয় ব্যাপার পরিচালনা করবে এবং সংবিধান রচনা করবে। 

  • [iii] দেশীয় রাজ্যগুলির রাজারা ভারত বা পাকিস্তান যে-কোনাে ডােমিনিয়নে যােগ দিতে পারবে। 

  • [iv] আসামের শ্রীহট্ট জেলায় গণভােটে স্থির হবে তা ভারত বা পাকিস্তান কোন ডােমিনিয়নে থাকবে। 

  • [v] দেশীয় রাজ্যগুলির ওপর ব্রিটেনের সার্বভৌম অধিকার লুপ্ত হবে।

স্বাধীনতার স্বরূপ: পলাশির যুদ্ধে বিপর্যস্ত ভারতের যে স্বাধীনতার সূর্যাস্ত ঘটেছিল তারপর সূর্যোদয় ঘটে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট। ভারতবাসীর এই স্বাধীনতা বহু আকাঙ্ক্ষিত হলেও তার মধ্যে বিষাদের সুর ছিল। কারণ টুকরাে করা স্বাধীনতা ভারতবাসীকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেনে নিতে হয়েছিল। স্বাধীন ভারতের প্রথম গভর্নর-জেনারেল হিসেবে শপথ নেন মাউন্টব্যাটেন এবং প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বে ভারতীয় মন্ত্রীসভা শপথ গ্রহণ করে। এর আগে ১৪ আগস্ট ডােমিনিয়ন পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর-জেনারেল হিসেবে শপথ নেন মহম্মদ আলি জিন্না। ঐক্যবদ্ধ ও অখণ্ড ভারত দ্বিবিভক্ত হয়ে দুটি আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে—যা ভারতবাসীর কাছে কাঙ্ক্ষিত ছিল না।