“শার্ট পরা কুমুদ হইল রাজপুত্র প্রবীর।”—উক্তিটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।

মতির চোখে অফুরন্ত স্বপ্ন। এই স্বপ্ন তার অনাগত জীবনকে পূর্ণ করে রাখে। তার স্বপ্নের সংসার জীবনে শশীর একটা ধূসর ছায়া পড়ে তার মগ্নচৈতন্যের আকর্ষণকে গভীরতর করেছিল। কিন্তু কুমুদকে দেখার পর মতির মনে আর এক আলোড়ন শুরু হয়। কুমুদ বিনোদিনী-অপেরার হয়ে এই গাঁয়ে যাত্রা করতে এসেছে। যাত্রাপালায় সে সেজেছে প্রবীর। কিন্তু শার্ট পরা কুমুদ যখন তালবনে সাপের কামড়ে অসহায় বালকের মতো কুসুমের কাছে শশীর সাহায্য প্রার্থনা করেছে, তখন তাকে দেখে মাটির পৃথিবীর মানুষ বলেই মতির মনে হয়েছে। কুমুদের ভয়ার্ত আহ্বান শুনে মতি প্রথম তালবনের ধারে ছুটে আসে। পরে আসে কুসুম। সাপ দেখে মতি বলে ওঠে, এ তো ঢোঁড়া সাপ, নির্বিষ সাপ। দুপুরের এই ঘটনার পর রাত্রের পালা অন্য। এদিকে গ্রাম বাংলায় যাত্রাপালা দেখার আকুলতা বড় তীব্র। সকলেই আগেভাগে তৈরি হয়ে সাতগাঁর কাছারি বাড়ি গিয়ে হাজির হয়েছে। সেই জমকালো আলোর রোশনাইয়ে দর্শকমণ্ডলীতে হৈ-চৈ, ঠেলাঠেলি, জায়গা পাবার জন্য ঠেলাঠেলি। কুসুম সংসারের কাজ শেষ করে যাত্রার আসরে মতিকে সঙ্গে নিয়ে চলে যায়। কনসার্ট-ঐকতান বেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই চারিদিকে উত্তেজনা। মতি অবাক হয়ে দেখে সে পুরুষমানুষ সখী সেজে নাচছে। জনাকে দেখেও মতির অনুরূপ সন্দেহ হয়। দ্বিতীয় দৃশ্যে প্রবীরের প্রবেশ। প্রবীরের রূপসৌন্দর্য ও জমকালো রাজকীয় সাজ দেখে দর্শক মুগ্ধ হয়ে যায়। সে প্রকৃতপক্ষে রাজপুত্র। রাজোদ্যানে প্রবীর তার প্রেয়সী মদনমঞ্জুরীর সঙ্গে প্রেমালাপে ব্যস্ত। তাকে দেখে মতি-কুসুম বিস্মিত। কুসুম অবাক বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করে যে এ দুপুরের সেই ঢোঁড়াসাপের দংশনে কাতর ছেলেটি কিনা মতি মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকে দেখে। শার্টপরা যে ছেলেটাকে সে তালবনে দেখেছে, সেই কি এই রাজপুত্র প্রবীর? প্রবীরের ভূমিকায় তার অভিনয় দেখে সে উচ্ছ্বসিত। “মতির বুকের ভিতর সিরসির করে।” মঞ্চে যে রাজপুত্র, সকলের মুগ্ধ করতালি তার দিকে উদ্যত কিন্তু দুপুরে তালপুকুরে তার সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয় মতির। মতি সেখানে হারানো মাকড়ি কুড়োতে এসেছে। কুমুদকে দেখে সে বিস্ময়াবিষ্ট হয়। সহস্র হৃদয়জয়ী যুবরাজ, প্রবীর রূপকথার রাজপুত্র, মহাপ্রেমিক প্রবীর মাটির পৃথিবীর কেউ নয়। অথচ তালবনে তাকে পাশে পেয়েছে, কাছে পেয়েছে মতি, এ কথা তার বিশ্বাস হচ্ছে না। শশী এতদিন ছিল তার নায়ক, কিন্তু শশী তার চিরচেনা। কুমুদও তার হৃদয়ের রাজা। সে তার কোনো খবরই রাখে না। সে তার অচেনা। তাই অজানা দেশের রাজপুত্রকে দেখে মতির প্রাণে বিস্ময়ের শেষ নেই।

“রাজপুত্র প্রবীর, দুপুরবেলা তালপুকুরের ধারে মাকড়িটি নিজের হাতে তাহার কানে পরাইয়া দিয়াছে শুনিলে বাড়িতে তাহাকে আর আস্ত রাখিবে না।”-কে কার কানে মাকড়িটি পরিয়ে দিয়েছিল? উক্তিটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।

রাজপুত্র প্রবীরবেশী কুমুদ মতির কানে মাকড়টি পরিয়ে দিয়েছিল।

যাত্রার অপূর্ব অভিনয় দেখার পর মতির হৃদয়রাজ্য জয় করেছে ‘জনার’ প্রবীর। প্রবীরবেশী কুমুদ ‘শার্ট-পরা কুমুদ’-কে পরের দিন দুপুরে দেখে মতি তখন বিস্ময়-বিমূঢ়। তার মনে ভ্রান্তি জাগে, এ কী গত রজনীর রাজপুত্র প্রবীর? শতসহস্র করতালি মুখরিত রাত্রে, কনসার্টের বিচিত্র পরিবেশে সে অপূর্ব স্বপ্ন আর মোহ। সেই রাজপুত্র তার পাশে এসেছে এক সঙ্কটের সময়। তালবনের মধ্যে মতি তখন তার কানের মাকড়ি খুঁজছে। মুখে-চোখে তার গভীর উদ্বেগ আর ব্যাকুলতা। এই ব্যাকুলতার মধ্যে সে পাশে সঙ্গী হিসেবে পেল রাজপুত্র প্রবীর তথা কুমুদকে। কুমুদ তার উদ্বেগে অংশ নিল। যে কুমুদকে তার মনে হয়েছিল মাটির পৃথিবীর কেউ নয়, সে তার সোনার মাকড়ি খোঁজার ব্যাকুলতায় সহযোগিতা করল। তারা দুজনে মাকড়ি খোঁজে। তালপুকুরের ভাঙাচোরা ঘাট থেকে তালবনের মাঝামাঝি পর্যন্ত পায়ে চলা পথের দুধারে তারা মাকড়ি খোঁজে। তখন কুমুদ তার অন্য মাকড়িটি চায়। সে বালিকাকে মাকড়ি হারানোর কথা বলতে বারণ করে এবং প্রতিশ্রুতি দেয় কাল সে আর একটা মাকড়ি এনে দেবে। সে অঞ্চলে পুরাতন হলেও নতুন। তাই গয়নার দোকানের হদিস জানে না। কুমুদ মাকড়িটি পকেটে পুরে চলে যায়। মতি ভাবে প্রবীরের মতো রাজপুত্রের পক্ষে তাকে মাকড়ি দেওয়ার ব্যাপারটা কিছু না। রাজপুত্র শেষ পর্যন্ত তাকে নিজে হাতে মাকড়ি পরিয়ে দিয়েছে। এ বড় বিস্ময়ের ব্যাপার। মতি সাধারণ গ্রাম্য বালিকা। সে বোঝে না যে পুরাতনের পাশে নতুন ঝকঝকে মাকড়ি দেখলে বাড়িতে কত সমস্যা হতে পারে। সে ত’ বলতে পারবে না যে গতরাত্রের রাজপুত্র তাকে স্বয়ং মাকড়ি পরিয়ে দিয়েছে। কুমুদ অবশ্য তার জন্য এই সমস্যাও সমাধান করে দিয়েছে, তেঁতুল দিয়ে দুটো মাকড়িই মাজার কথা সে যেন বাড়িতে বলে। রাজপুত্রের বুদ্ধি দেখে মতি অবাক। এই বিস্ময়ের মধ্যে দিয়ে দুই অসমবয়সী যুগলের সখ্য শুরু হয়।