বাংলাদেশে লোক প্রশাসনের অবস্থা নাজুক কেন?


প্রশ্নঃ লোক প্রশাসনে ‘রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা’ কীরূপ? বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা আলোচনা কর।  বাংলাদেশে লোক প্রশাসনের অবস্থা নাজুক কেন? 

ভূমিকাঃ আধুনিক লোক প্রশাসনে ‘রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা’ একটি সাম্প্রতিক ধারণা বলে মনে হলেও এর চর্চা বা অধ্যয়ন কোন নতুন বিষয় নয়। বিশেষত বিশ্ব ব্যাপী গণতন্ত্রায়নের পাশাপাশি ধারণাটি জোরদারভাবে প্রশাসনে স্থান করে নিয়েছে। গণতন্ত্রের চর্চার সাথে সাথে রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা প্রসঙ্গটিও অনিবার্যভাবে এর প্রশাসনের সাথে সমান্তরালভাবে এসে যায়। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে সাধারণত দু’ধারার প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা বা কাঠামোগত বিন্যাস পরিদৃষ্ট হয়। যথাঃ রাজনৈতিক শাসক শ্রেণী এবং রাষ্ট্রের স্থায়ী প্রশাসক শ্রেণী বা আমলা শ্রেণী। অতি সাধারণভাবে যেটা গণতন্ত্রে স্বীকৃত সেটা হলো রাষ্ট্রের স্থায়ী প্রশাসক বা আমলাগণ কোন বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রতি ঝুঁকে পড়বেন না বা তাদের সাথে সর্বপ্রকার রাজনৈতিক সংশ্রব এড়িয়ে নির্দলীয় নিরপেক্ষ চিন্তা চেতনা দ্বারা পরিচালিত হবেন। তারা অবশ্যই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের উন্নয়ন পরিকল্পনা বা রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের সকল পর্যায়ে তাদের সাথে পরিপূর্ণ সহযোগিতা করে যাবেন, কিন্তু তা অবশ্যই হতে হবে নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে। এমনকি যদি স্থায়ী প্রশাসকদের কারো ব্যক্তিগত সমর্থনের রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন হয় সে ক্ষেত্রেও ব্যক্তিগত আবেগ অনুভূতিকে অবদমন করে নিরপেক্ষভাবে (Neutrally) রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক দায়িত্ব পরিচালনা করে যেতে হবে। কারণ গণতন্ত্রে কোন রাজনৈতিক দলই স্থায়ীভাবে সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকে না। কিন্তু স্থায়ী প্রশাসক বা আমলাগণ রাষ্ট্রের স্থায়ী প্রশাসক। ফলে স্থায়ী ও অস্থায়ী প্রশাসকদের মধ্যে ব্যবধান অনেক। ব্যক্তি বা সমাজের একজন পূর্ণাঙ্গ ও সচেতন সদস্য হিসেবে প্রতিটি মানুষের ন্যায় আমলাগণ অবশ্যই কোন একটি রাজনৈতিক দলের সমর্থন করার অধিকার ভোগ করেন। কিন্তু সেটা তার রাষ্ট্রীয় কর্তব্য বা কর্মক্ষেত্রে প্রকাশিতব্য নয়। কিন্তু বাস্তবে এ নীতির প্রয়োগ কতখানি সম্ভব বা অসম্ভব সেটা একটি বড় প্রশ্ন বটে। উন্নয়নশীল দেশসমূহে এ রাজনৈতিক নিরপেক্ষতার প্রসঙ্গ কতটা বাস্তবানুগ তাও খতিয়ে দেখতে হবে। তবে লোক প্রশাসনের সাম্প্রতিক গবেষণা সে সব বিষয়ে সমাধান খুঁজবে।

রাজনৈতিক নিরপেক্ষতার সংজ্ঞাঃ রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা সম্পর্কিত ধারণাটি একটি জটিল বিষয়। তাই এর সংজ্ঞা নির্ধারণ বা অল্প কথায় একে প্রকাশ বা ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। বিভিন্ন রাজনীতি বিশারদ, প্রশাসন বিজ্ঞানী এ নিয়ে গবেষণায় ব্রতী হয়েছেন। তারা বিষয়টির অত্যন্ত গভীরে প্রবেশ করে এর অর্থ, ব্যাখ্যা ও পর্যালোচনা করেছেন।

(ক) সাধারণ অর্থঃ শাব্দিক অর্থগত দিক দিয়ে রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা বলতে রাজনীতিতে নিরপেক্ষ থাকার রীতিকে বুঝায়। কিন্তু রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা শব্দের অর্থ আরো ব্যাপক। 

(খ) মূল সংজ্ঞাঃ বিশেষত রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা বিষয়টি সরকারি প্রশাসনের নিরপেক্ষতাকেই বুঝায়। অর্থাৎ রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা হলো প্রশাসনিক রাজনীতিতে নিরপেক্ষতার প্রশ্ন। কোন একটি দেশের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের প্রতি আমলা বা রাষ্ট্রীয় স্থায়ী প্রশাসকবৃন্দের প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনে রাজনীতি মুক্ত বা নিরপেক্ষ আচরণই হচ্ছে এর মূল প্রতিপাদ্য। রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা বলতে এমন একটি পরিস্থিতিকে বুঝায়, যেখানে সরকারি প্রশাসন রাজনৈতিক বা অন্য কোন পৃষ্ঠপোষকতা বণ্টনের কেন্দ্রে পরিণত হয় না। অথবা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা এবং অনুগ্রহ লাভের জন্য রাজনৈতিক দিক থেকে পক্ষপাতপুষ্ট আচরণ করে না অথবা কোন রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় আসীন রাখা বা ক্ষমতাচ্যুত করার উদ্যোগের সাথে জড়িত রাখে না। অর্থাৎ সক্রিয় রাজনীতিমুক্ত প্রশাসনের ধারণা রাজনৈতিক নিরপেক্ষতার সাথে সংশ্লিষ্ট। রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা বলতে সাধারণভাবে সরকারি প্রশাসকদের মধ্যে রাজনৈতিক মূল্যবোধের অনস্তিত্ব বুঝায়। তারা রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ না করলেও তাদের মধ্যে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মূল্যবোধ থাকতে পারে। তবে, এ ক্ষেত্রে মূল্যবোধ প্রয়োগযোগ্য নয়। সুতরাং সরকারি প্রশাসকদের নিরপেক্ষতা বলতে সকল প্রকার রাজনৈতিক মূল্যবোধ ও অগ্রাধিকার হতে মুক্তিকে বুঝায়।

রাজনৈতিক নিরপেক্ষতার প্রকৃতিঃ পরিবর্তনশীলতার বৈশিষ্ট্য ধরে রাজনীতির ঊর্ধ্বে থেকে ক্ষমতাসীন দলের আদর্শ, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনুসারে দলীয় কার্যক্রমকে বাস্তবে রূপ দান করার জন্য রাষ্ট্রের স্থায়ী প্রশাসকগণকে সর্বাত্মকভাবে সচেষ্ট হতে হয় । রাষ্ট্র ক্ষমতায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের উত্থান পতনের সাথে জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মাদর্শ ও চিন্তা চেতনারও যে পরিবর্তন ঘটে তার সাথে আমলাদের মনমানসিকতারও পরিবর্তন ঘটাতে হয়। অর্থাৎ একদিকে তাদেরকে যেমন দল নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে হয়, তেমনি আবার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নানা প্রকার কার্যক্রমের সাথে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করতে হয়। যে সকল ক্ষেত্রে পূর্বাপর ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলোর মতাদর্শগত পার্থক্য বিরাজমান সে সকল ক্ষেত্রেও আমলাদেরকে সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে নিজেদের কর্মধারার পরিবর্তন সাধন করতে হয়। নতুন ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক আদর্শ বিগত ক্ষমতাসীন দলের চিন্তাধারা ও মতাদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত হলেও বর্তমানদের প্রতিই তাদের সহযোগিতার হস্ত প্রস্তুত করতে হয়। অর্থাৎ তাদেরকে যখন যে পাত্রে রাখা হয় সে পাত্রের রং ধারণ করতে হয়। কিন্তু বিশেষ নীতি বা তত্ত্বের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন তাদের নিকট আদৌ কাম্য নয়।

নিরপেক্ষতা আমলাতন্ত্রের এক সাধারণ ও গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। আমলাগণ রাষ্ট্রীয় সরকারের স্থায়ী প্রশাসনকর্তা হিসেবে তাদের পদ কোন রাজনৈতিক দলের সাথে বা দলীয় রাজনীতির সাথে সম্পর্কযুক্ত নয়। দেশের যে রাজনৈতিক দলই শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হোক না কেন ‘সে দলীয় সরকারের অধীনে আমলাদেরকে শাসনকার্য পরিচালনা করতে হয়। রাষ্ট্রীয় আদর্শ, নীতি ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক আচরণের সাধারণ প্রথানুযায়ী তাদেরকে রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা রক্ষা করে আপন প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতে হয়। রাজনৈতিক দলীয় সরকারের নীতি, পরিকল্পনা, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও সামগ্রিক কার্যাবলি যাই হোক না কেন সেগুলো আমলা বা সরকারি কর্মচারীদের দ্বারা বহুলাংশে প্রভাবিত হলেও তাদেরকে দল ও রাজনীতির ঊর্ধ্ব থেকে দেশ সেবায় আত্মনিয়োগ করতে হয়। উক্ত রাজনীতি বা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে তাদের কোন প্রকার সংশ্রব থাকা বৈধ নয়। তাই অধ্যাপক লাস্কি (Prof. Laski) বলেছেন যে, “The ethos of the civil service is detachment and neutrality.”

তার মতে, “আমলাদের রাজনীতি বিমুক্ত হওয়া উচিত। তারা ক্ষমতাসীন সকল রাজনৈতিক দলকে সর্বান্তকরণে এবং নৈপুণ্যের সাথে সমানভাবে সাহায্য করবে।” তাদের রাজনৈতিক নিরপেক্ষতার প্রসঙ্গে তিনি যে বিষয়গুলোর উপর অধিক জোর দিয়েছেন সেগুলো হলো আমলাদের যোগ্যতা, চাকরির স্থায়িত্ব, কার্য পরিচালনায় উৎসাহ দান এবং পদোন্নতির ব্যবস্থা। আমলাদের মধ্যে রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এগুলোর দিকে সর্বাত্মক গুরুত্ব প্রদান করা উচিত। তিনি আরো বলেন, আমলাদের নিরপেক্ষতায় জনসাধারণের আস্থা অর্জনের জন্য নীতি প্রণয়নকারী আমলাদের রাজনীতিমুক্ত থাকা উচিত। নিম্ন পর্যায়ের কর্মচারীদের জন্য তিনি রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা বজায় রাখার সুপারিশ করেন নি। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, বৈষম্য-পীড়িত করনিক এবং পিওনের জন্য সরকারি অফিসে নিযুক্ত হবার গৌরব কোন ফলপ্রসূ ক্ষতি পূরণ নয়। এ কারণেও আমলাদের নিরপেক্ষ থাকা প্রয়োজন যে, কোন মন্ত্রীর পক্ষে তার বিপরীত রাজনৈতিক মতাবলম্বী পদস্থ আমলার উপর আস্থা স্থাপন করা সম্ভব নয়। কোন আমরার পক্ষে নির্বাচনে পরাজিত হয়ে আবার রাষ্ট্রকৃত্যকে প্রত্যাবর্তন ও রাজনৈতিক কার্যাবলিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রশাসনকে দলীয় শাখায় পরিণত করে।

তবে মার্কসবাদীগণ ভিন্নমত পোষণ করেছেন। তারা মনে করেন, আমলাদের নিরপেক্ষতা একটি মুখোস ব্যতীত আর কিছু নয়। আমলাগণ কখনোই রাজনীতি নিরপেক্ষ হতে পারেন না। অভিজ্ঞতা থেকে তারা দেখিয়েছেন যে, সর্বপ্রকার শোষণ নির্ভর সমাজ ব্যবস্থায় আমলারা কায়েমী স্বার্থের রক্ষক হিসেবে প্রতিশ্রুত ভূমিকা (Commited role) পালন করে থাকেন। কেবলমাত্র সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সামগ্রিকভাবে জনসাধারণের প্রতি প্রশাসন ব্যবস্থা অঙ্গীকারবদ্ধ থাকে।

আমলাতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে আমলাগণ বা সরকারি কর্মকর্তাগণ স্ব স্ব পদে স্থায়ী। একটি নির্দিষ্ট বয়স সীমা পর্যন্ত তারা ঐ পদের অধিকারী। তাই সরকারের পরিবর্তন, মন্ত্রিসভার উত্থান পতন বা নির্দলীয় সরকারের আগমন তাদের সরকারি কর্মচারীদের স্থায়িত্বকে কোন ক্রমেই প্রভাবিত করতে পারে না। অর্থাৎ সরকার যায় সরকার আসে তাতে তাদের পদের স্থায়িত্বের পক্ষে কিছুই আসে যায় না। এটিই তাদের পেশা। তাই অধ্যাপক ফাইনার (Harold J. Finer) বলেছেন, “The civil service is a professional body of officials, permanent, paid and skilled.” এসব স্থায়ী কর্মচারীগণ সরকারি নীতি ও কর্মসূচিকে কার্যকরী করার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রীয় কাজে আত্মনিয়োগ করাকে নিজের পেশা হিসেবে গ্রহণ করে থাকেন। তাই রাজনৈতিক দলীয় সরকারের সাফল্য বা ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতে সুনাম বা দুর্নাম কোন কিছুই তাদের পেশাদারিত্বকে স্পর্শ করে না। এসব সুনাম বা দুর্নাম ভোগ করতে হয় ক্ষমতাসীন সরকারের মন্ত্রীদেরকে।

রাজনৈতিক নিরপেক্ষতার প্রশ্নে প্রশাসকদের কোনভাবেই কোন প্রকার দলীয় ভূমিকা থাকা সমীচীন নয়। তারা দল মত নির্বিশেষে নিরপেক্ষভাবে রাষ্ট্রের সেবায় কাজ করে যাবেন। তাতে জনমতের প্রতি সংবেদনশীল হওয়া ঊর্ধ্বতন প্রশাসকের একটি প্রাথমিক দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণীয়। আর এ সবের মাধ্যমেই অর্থনৈতিক পরিকল্পনাসহ বিভিন্ন পরিকল্পনার বাস্তবায়ন, তাৎপর্য, গুরুত্ব প্রভৃতি অথবা সংগঠনের মধ্যে তার কোন দ্বন্দ্ব আছে কি না প্রশাসক সে সব জানতে পারেন। তাতে সংগঠনের দুর্বলতাগুলো সারিয়ে তোলা তার পক্ষে সম্ভব হয়। আবার কোন একটি বিষয়ে জনমত অধিকাংশ জনগণের মত কি না তাও প্রশাসককে জানতে হয় মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেই।

সরকারি কর্মচারীদের নিরপেক্ষতা ও পেশাদারিত্বঃ পাবলিক সার্ভেন্টদের নিরপেক্ষতা ও পেশাদারিত্ব কতিপয় পন্থায় সমঝোতা হতে পারে। সেগুলো হলো-

১। By appointing (নিয়োগ) people with well-known partisan ( কঠিন সমর্থক) Connections who will be clearly unacceptable to a future alternative government;

2। By appointing (নিয়োগ করে) people with well-known commitments to particular policy directions that may render them unacceptable to a future alternative government; and

৩। By replacing (নিয়োগ করে) incumbent (প্রার্থী) public servants, particularly on a change of government, when there is no good reason to question their competence (সামর্থ্য) and loyalty (বিশ্বস্ততা ) but simply in order to impose (জরিমানা) the government’s authority (Particularly if the incumbents are dismissed, rather than retained with similar status and remuneration.)

রাজনৈতিক প্রশাসনের নিরপেক্ষ দায়িত্ব কারঃ অধ্যাপক লাস্কি বলেন, “The public service of a state must live under the aegis of two definite rules.” অর্থাৎ কোন রাষ্ট্রের পাবলিক সার্ভিস ব্যবস্থার ক্ষেত্রে অবশ্যই দু’টি সুনির্দিষ্ট বিধান প্রতিপালিত হবে। এর প্রথম বিধানটি হলো সিভিল সার্ভেন্টগণকে নিয়োগ করার ক্ষমতা অবশ্যই রাজনৈতিক নির্বাহীকর্তার হস্তে থাকবে না। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে তাদেরকে নিয়োগ করার ক্ষেত্রে অবশ্যই স্বজনপ্রীতির সম্ভাবনাকে ন্যূনতম পর্যায়ে আনতে হবে। সবসময়ে সরকারি কর্মচারীগণ তাদের মন্ত্রীদের প্রতিও সতর্ক থাকবেন, এটিও তাদের দায়িত্ব এবং মন্ত্রীগণও কয়েকটি পন্থায় দায়ী থাকবেন। যেমনঃ

১। Ministers are accountable to the elected representatives of the people through the legislature;

২। Ministers have a duty to give the legislature and the public as full information as possible about their policies, decisions, and actions, and not to deceive or knowingly mislead them;

৩। Ministers have a duty not to use public resources for party political purposes, to uphold the ‘political impartiality of the public service, and not to ask civil servants to act in any way which would conflict with their public service code;

৪। Ministers have a duty to give fair consideration and due weight to informed and impartial advice from civil servants, as well as to other considerations and advice, in reaching decisions; and

৫। Ministers have a duty to comply with the law, including international law and treaty obligations, and to uphold the administration of justice (and are answerable to the courts where they exceed or misuse their powers.)

সরকারি কর্মচারীদের দায়বদ্ধতাঃ রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষতা অবলম্বনের স্বার্থে সিভিল সার্ভেন্টগণের যে বিষয়গুলো চিহ্নিত করে তাদের সংস্থা শাসন বা পরিচালনা করা উচিত সেগুলো হলো :

১। মন্ত্রীর প্রতি সরকারি কর্মকর্তার দায়িত্ব (the accountability of civil servants to the Minister);

২। সকল সরকারি অফিসারের যৌক্তিকতা ও আইন অনুযায়ী সকল প্রকার গণ অনুষ্ঠানাদি ও পরিত্যাগ করা;

৩। আইন মান্য বা নিশ্চিত করা, আন্তর্জাতিক আইনসহ চুক্তির বাধ্যবাধকতা, ন্যায়ানুগ প্রশাসনের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করার প্রতি দায়িত্ব (the duty to comply with the law, including international law and treaty obligations, and to uphold the administration of justice); এবং

৪। নৈতিক মানসম্পন্ন প্রশাসন বিশিষ্ট পেশা (ethical standards governing particular professions.)

রাজনৈতিক নিরপেক্ষতার বাস্তবতাঃ রাজনৈতিক নিরপেক্ষতার ধারণা বস্তুত রাষ্ট্রীয় আদর্শগত এবং তা নৈতিক মূল্যবোধ, দেশপ্রেম, নিস্বার্থ চিন্তা এমন অনেক ইতিবাচক দিকের উপর নির্ভরশীল। আর সেগুলো অনুন্নত বিশ্বের কোন দেশ তা নয়ই বরং উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও প্রায় সম্পূর্ণভাবেই অবান্তর প্রসঙ্গ মাত্র। কিন্তু বাস্তবে রাজনৈতিক নিরপেক্ষতার প্রশ্ন বা ধারণা প্রযোজ্য নয়। বস্তুত কোন দেশেই এর যথাযথ প্রয়োগ দেখা যায় না। কারণ আমলাগণও ব্যক্তিগত একটা জীবন পরিচালনা করে থাকেন। তাই তাদের ব্যক্তিগত দর্শন, সামাজিক দর্শন, প্রশাসনে নিয়োগ ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা তাদের মধ্যে এমন একটি মূল্যবোধের সৃষ্টি করে যা একমাত্রা বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এ কারণেই মূলত তাদের পক্ষেও রাজনৈতিক দিক দিয়ে নিরপেক্ষ হওয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া সাবেক দিনের আমলাতন্ত্র প্রায় সকল দেশেই এমন একটি ধারণা ও অনৈতিক আদর্শের দ্বারা পরিচালিত হয়ে এসেছে যে সেখানে স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা, স্বার্থবোধহীনতা, উদারতা প্রভৃতি প্রহসনের স্বীকার হয়েছে। নতুনভাবে প্রশাসনে যে সকল তরুণ অংশগ্রহণ করেছেন তারাও সেই প্রবীণদের কাছেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং তাদের পথ ধরেই প্রশাসনিক দায়িত্বে আত্মনিয়োগ করেছেন। ফলে তাদের মধ্যেও ব্যক্তিগত লোভ লালসা এবং সাবেক বা প্রচলিত পন্থাসমূহের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলার প্রবণতা সৃষ্টি হয়ে যায়। প্রশাসকগণ তাদের পদোন্নতি, সুযোগ সুবিধা বজায় রাখার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর পৃষ্ঠপোষকতা অর্জনের জন্য মরে হয়ে থাকে। আর যে দেশগুলো দুর্নীতির আখড়া সেখানে তো কোন কথাই থাকতে পারে না। সরকারের স্থায়ী প্রশাসকগণ অনেক সময় এমনভাবে কার্য পরিচালনা করেন যে তাদের প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক ভূমিকার মধ্যে পার্থক্য নির্ধারণ করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। তারা রাজনৈতিক নিরপেক্ষতার তথাকথিত ধারণাকে উপেক্ষা করে রাজনৈতিক পদাধিকারীদের মতই আচরণ করে থাকেন বা অভিমত ব্যক্ত করে থাকেন। তারা সরকারি প্রশাসনের উচ্চ ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নৈতিকভাবে এবং উদারতাপূর্ণ দেশপ্রেমের সাথে পালন করার পরিবর্তে সরকারি উচ্চ পদে নিয়োগ, সুবিধাজনক দফতরে বদলি লাভ, অবসর গ্রহণের পর লাভজনক দফতর বা উচ্চ পদ অর্জনের প্রভৃতি প্রলোভনে পক্ষপাত দোষে দুষ্ট হয়ে যান। তারা নিজেদেরকে সরকারি চাকরিরত অবস্থাতেই বিশেষ রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি, দল ও প্রক্রিয়ার সাথে নিজেরদেরকে একাত্ম করে ফেলেন।

এটা তো গেল স্থায়ী প্রশাসকদের ব্যক্তিগত অনৈতিকতা বা রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা বিবর্জিত অবস্থানের প্রতি আসক্ততার কথা। অন্যদিকে আবার রাজনৈতিক প্রশাসক বা দলগুলোর অনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি এবং প্রচলিত প্রকাশ্য ‘রাজনৈতিক নিরপেক্ষতাকে উপেক্ষা প্রদর্শন এবং তাদের ব্যক্তি বা দলের স্বার্থে স্থায়ী প্রশাসকদের বিভিন্ন লোভনীয় প্রস্তাবসমূহের মাধ্যমে নিজেদের পক্ষ আনয়নের প্রচেষ্টার কথাও সমানভাবে প্রযোজ্য। রাজনৈতিক প্রশাসকগণ তাদের নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের আমলাদের ব্যবহার করে থাকেন। আবার শাসন বিভাগের প্রধান অনেক সময়ই রাজনৈতিক কর্মকর্তা তথা মন্ত্রীদের চেয়ে আমলাদের পরামর্শ ও প্রয়াসকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। আর যারা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের প্রতি অনুগত নন বা তাদের রাজনৈতিক আদর্শের সাথে একমত নন, তাদের প্রতি উক্ত দলের স্টিম রোলার চলতে থাকে। নিরন্তর স্থানান্তর, চাপসৃষ্টির মাধ্যমে অবসর গ্রহণের ভীতি প্রদর্শন, উচ্চপদ লাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করার নীতি তাদেরকে অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের সাথে সম্পৃক্ত করে ফেলে। অর্থাৎ আমলাদের দু’একজন ব্যক্তিগত আদর্শ দ্বারা পরিচালিত হয়ে দুর্নীতিমুক্ত থাকার আপ্রাণ প্রয়াসকেও এভাবে গলা টিপে হত্যা করে তাকে অসৎ বা রাজনৈতিক পক্ষপাত গ্রহণে বাধ্য করা হয়।

প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীন চিন্তা-চেতনা, আবেগ-অনুভূতি এবং সমর্থিত রাজনৈতিক আদর্শ পোষণ করার অধিকার রয়েছে যা নাগরিক অধিকারও বটে। সে মূল্যবোধকে বর্জন করার আদেশ কেউ দিতে পারেন না। অথবা দিলেও তাকে অন্তরে গ্রহণ করতে সবাই বাধ্য নয়। আমলাগণও সেই মূল্যবোধকে অন্তরে লালন করবেন এটাই স্বাভাবিক। ফলে সেই মূল্যবোধ বর্জন করে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়। তাদের রাজনৈতিক মূল্যবোধ, রাজনৈতিক আনুগত্য লাভের প্রয়াস এবং রাজনৈতিক নেতাদের নীতি সর্বত্রই আমলাতন্ত্রের রাজনীতিকীকরণের পথকে প্রশস্ত করে দিয়েছে।

রাজনৈতিক ব্যবস্থার সামগ্রিক চরিত্রের উপরই নির্ভরশীল আমলাতন্ত্রের পক্ষে রাজনীতি নিরপেক্ষ হয়ে ক্ষমতা পরিচালনা করা সম্ভব কি না সেটা। আমলাতন্ত্র প্রত্যেকটি দেশেই অঙ্গীকারবদ্ধ। শাসক শ্রেণী নিজেদের রাজনৈতিক, রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের কর্মসূচির সাথে সঙ্গতি রেখে আমলাতন্ত্রকে নিজেদের প্রয়োজন মোতাবেক বিন্যস্ত করে থাকেন। প্রশাসনিক কর্মকর্তা- কর্মচারীদের মধ্যে এভাবে তারা রাজনৈতিক মনোভাব গড়ে তোলার জন্য সচেষ্ট হয়।

আরো জরুরি কথা হলো শাসক শ্রেণীর শাসনের অংশ হিসেবে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নিকট আমলাতন্ত্র অঙ্গীকারবদ্ধ থাকে। স্থায়ী প্রশাসকদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, পটভূমি, নিয়োগের ব্যবস্থা শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রায়ই তাদেরকে কায়েমী স্বার্থের রক্ষকে পরিণত করে। আর শোষণনির্ভর শাসন ব্যবস্থায় তারা শাসকশ্রেণীর শোষণ প্রয়াসের হাতিয়ারে পরিণত হয়ে যান। তারা আপাত নিরপেক্ষতার অন্তরালে শোষক শ্রেণীর রক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। এমনকি মন্ত্রী বা রাজনৈতিক প্রশাসকদের সর্বপ্রকার দুর্নীতি, অপরাধ, শোষণ, আত্মস্যাৎকরণের মত জঘন্য কার্যাবলিসমূহের কারণে পরবর্তীকালের কোন প্রকার অবৈধতার প্রশ্ন পূর্বাহ্নেই তথা ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ের মধ্যেই বিভিন্ন কৌশল বৈধকরণের সমস্ত আয়োজনও সম্পন্ন করে দেন আমলারাই। কারণ এসব বিষয়ে আমলাগণই অধিক অভিজ্ঞ ও পারদর্শী। ফলে ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়লেও অনেক সময়ই তাদেরকে আইনের বেড়াজালে আটকানো সম্ভব হয় না। অবশ্য এতে স্থায়ী প্রশাসকবৃন্দ এবং রাজনৈতিক প্রশাসনের অসাধু সকলের স্বার্থই চরিতার্থ হয়। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রশাসন থাকে সম্পূর্ণরূপে অঙ্গীকারবদ্ধ। আর সে অঙ্গীকার সমাজের সর্বাধিক সংখ্যক মানুষ ও মানুনের স্বার্থের প্রতি, শোষণহীন সমাজের প্রতি, কোন অসাধু বা শোষকের প্রতি নয়। তাই বলা চলে রাজনৈতিক নিরপেক্ষতার বাস্তব প্রয়োগের প্রসঙ্গ যদি থাকে তবে তা সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে অনেকাংশেই খুঁজে পাওয়া যাবে। গণতন্ত্রের নামে পক্ষপাত নির্ভর সমাজে তার অস্তিত্ব অনুসন্ধান বিফল প্রয়াসেরই নামান্তর।

রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা মূলত গণতান্ত্রিক বিশ্বে আজ প্রহসনের স্বীকার। অর্থাৎ তত্ত্ব আছে কার্যকারিতা নেই বরং তাকে ব্যবহার করে কয়েকটি শ্রেণী তাদের স্বার্থ করে চলেছেন নির্বিবাদে। রাজনীতির সাথে আমলাদের ঘনিষ্ঠ সূত্রে জড়িয়ে পড়ার যথেষ্ট নজির বিদ্যমান। বস্তুত অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আমলাতন্ত্র ও রাজনীতির মধ্যেকার সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এবং অনেক ক্ষেত্রেই তা এক অপরের পরিপূরক।

স্থায়ী প্রশাসকদের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিগণ যে শুধুমাত্র তাদের নিকটবর্তী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সংস্পর্শেই আসেন তাই নয়। তারা বরং স্বার্থে মোহে অপরাপর রাজনৈতিক নেতা (ক্ষমতাসীন বা বিরোধী দলের) ও প্রভাবশালী সদস্যদের সাথেও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন। আবার সেখানে বৈধতার ভিত্তিও তাদের রয়েছে এবং এটা তাদের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পসহ সিংহভাগ প্রকল্পে অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতা ছাড়াও তাদেরকে বিশেষত ঊর্ধ্বতন প্রশাসককে প্রকল্প সম্পর্কে জনপ্রতিক্রিয়া জানতে হয়। সেটা জানা যদিও সনাতন নিয়মে রাজনীতিবিদদের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে, তথাপি আজ তা আমলাদেরও দায়িত্বের অংশ হয়ে গেছে। রাজনৈতিক দল যদি দুর্বল হয়ে পড়ে অথবা দলীয় নেতা প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও জরুরি বিষয়ে অভিজ্ঞতায় অক্ষম হন সে ক্ষেত্রে উক্ত ঊর্ধ্বতন আমলা বা স্থায়ী প্রশাসকগণই সে দায়িত্ব পালন করে থাকেন৷

রাজনৈতিক প্রশাসকগণকে প্রশাসনিক বিষয়ে উপদেশ প্রদানের সময় জন প্রতিক্রিয়ার দিকে লক্ষ্য রাখতে হয় এবং সে সম্পর্কেও তাদেরকে ধারণা প্রদান করতে হয়। এ জ্ঞান প্রশাসকগণ রাজনৈতিক মহলের সাথে বিচক্ষণতা দিয়ে যোগাযোগ রক্ষা করেও অর্জন করতে পারেন। কিন্তু এ মন্তব্যের বিরুদ্ধে প্রায়শই অভিমত ব্যক্ত করা হয় যৈ, কোন নীতি বা সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে বা হবে না।

সে বিষয়ে রাজনৈতিক নেতাদের উপদেশ দেয়ার এখতিয়ার প্রশাসকদের নেই। কিন্তু বাস্তব সত্য হলো কোন প্রশাসক নৈতিকতা বলে বলীয়ান হয়ে যতক্ষণ পর্যন্ত সততা ও আন্তরিকতার সাথে রাষ্ট্রীয় স্বার্থে কোন রূপ ভয়ভীতি ব্যতিরেকেই উপদেশ দিতে পারেন। তাছাড়া কোন রাজনৈতিক দলের সাথে অতিশয় ঘনিষ্ঠতাহেতু তাদের দলেরই একজন হিসেবে গোপনে উপদেশ দিলেও তাতে প্ৰমাণ না পাওয়া গেলে কিছুই বলার থাকে না। যা হোক, বৈধভাবে উপদেশ দিতে হলে অবশ্যই তার সাংবিধানিক ভিত্তিও থাকতে হবে।

রাজনৈতিক নিরপেক্ষতাঃ প্রেক্ষিত বাংলাদেশ- 

ভারতীয় উপমহাদেশের একটি ক্ষুদ্র অংশ বাংলাদেশ যা ভারতবর্ষের সাথে সাথে দীর্ঘ প্রায় দু’শ বছর ব্রিটিশ উপনিবেশ হিসেবে সীমাহীন শোষণ বঞ্চনার স্বীকার। আর ভারতবর্ষে শোষণ কৌশল, উৎকোচ বা ঘুষ, ধামাধরা প্রবণতা প্রভৃতির শিক্ষক তারাই তথা ব্রিটিশরাই। উপরন্তু আরো তিন দশক পাকিস্তানি শাসকদের সীমাহীন শোষণের যাঁতাকলে পিষ্ট বাংলাদেশ। তাদের প্রশাসনের ধারাবাহিকতা থেকেই এ দেশের প্রশাসনও বিনির্মিত হয়েছে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর। প্রথমে একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত পঙ্গু অর্থনীতির দেশ হিসেবেই তাকে সামনের দিকে পা বাড়াতে হয়েছিল। কিন্তু দফায় দফায় সামরিক শাসনের করাল গ্রাসে পতিত হয়ে দেশটি তার কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নের মুখ দেখতে পারে নি আজো। যা হোক, এখানে প্রশাসন যে ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছিল তাদের মধ্যে সাবেক পাকিস্তানি আমলের আমলাগণ ছিলেন বৃহত্তর অংশে৷

বাংলাদেশের লোক প্রশাসনের অবস্থা এমনই নাজুক যে, এখানে প্রশাসনের প্রতিটি পর্যায়ে অনিরপেক্ষতা বা বিশেষ কোন রাজনৈতিক দলের প্রতি আমলাদের সংশ্লিষ্টতা একটি প্রকাশ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। তারা অনেক সময় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের মুখপাত্র হিসেবে ভূমিকা পালন করেন। আবার রাজনৈতিক প্রশাসনের পক্ষ থেকেও তাদের শক্তি, সাহস, সমর্থন যোগান হয় প্রকাশ্যে। ফলে এ দেশে দুর্নীতি পৃথিবীর রেকর্ডকে পরাজিত করে চলেছে। এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল পর পর তিনবারের জন্য বাংলাদেশকে বিশ্বের সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কাজেই এটা অত্যন্ত সহজেই অনুমেয় যে, এ দেশে রাজনৈতিক প্রশাসন ও স্থায়ী সরকারি প্রশাসনের যোগসাজসে ‘রাজনৈতিক নিরপেক্ষতার’ প্রসঙ্গটি কতদূরে অবস্থান করছে। অতএব বাংলাদেশে প্রসঙ্গটি নিতান্তই অধ্যয়নের একটি নতুন বিষয় হিসেবে বিবেচিত হবে মাত্র। এখানে এ তত্ত্বের বাস্তব প্রয়োগ সুদূর পরাহত।

সমাপনীঃ পরিশেষে বলা যায়, রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা লোক প্রশাসন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাম্প্রতিক ধারণা মনে হলেও বস্তুত চর্চা বিশ্বে গণতন্ত্র চর্চার সাথে সমান্তরালভাবে সামনের দিকে অগ্রসরমান। সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত বা কার্যকর হওয়ার ক্ষেত্রে এ তত্ত্ব বা ধারণার ক্ষেত্র তেমন মজবুত না হলেও ধারণাটি বহু চর্বিত ও প্রকাশ্য। তবে রাজনৈতিক নিরপেক্ষতার বিষয়টি শুধুমাত্র জাতীয়ভাবেই নয় বরং তা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এবং যা মান্য করে চলার উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। ফলে রাজনৈতিক নিরপেক্ষতার আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যাখ্যা করতে হবে। বিশ্ব রাজনীতিতে এমন নিরপেক্ষতার কতটুকু মূল্যায়ন করা হয়, তার আশ্রয়ই বা কোথায়, জাতিসংঘেরই বা কি বক্তব্য ইত্যাদি। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বিভিন্ন দেশের মধ্যে, আবার কোন কোন জাতির মধ্যে এর চর্চা কতখানি তাও এ প্রসঙ্গে আলোচনার অপেক্ষা রাখে। এ প্রসঙ্গে বিশেষ কথা হলো অন্তত প্রতিটি দেশের জনসাধারণের মঙ্গল নিশ্চিত করতে গেলে রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা তত্ত্বটির বাস্তব প্রয়োগ হওয়া একান্ত আবশ্যক।