দলব্যবস্থা আধুনিক রাষ্ট্রের একটি অপরিহার্য অঙ্গ। সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর ইউরােপে বিভিন্ন ধরনের গােষ্ঠী, ক্লাব, গিল্ডের আবির্ভাব ঘটে। বিশেষজ্ঞদের মতে এগুলি রাজনৈতিক দলের প্রাথমিক উৎস। মরিস দ্যুভারজার তাঁর The Origin of Parties রচনায় বলেন যে, ১৮৫০ সালের আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোথাও রাজনৈতিক দলের ধারণা গড়ে ওঠেনি।
ভারতের সংবিধানে রাজনৈতিক দলব্যবস্থার কোনাে উল্লেখ করা হয়নি। ১৯৮৫ সালে ৫২তম সংবিধান সংশােধনের মাধ্যমে ভারতের দলব্যবস্থা সর্বপ্রথম সাংবিধানিক স্বীকৃতি লাভ করে।
ভারতীয় সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রাণকেন্দ্র হল দলব্যবস্থা। এই দলব্যবস্থায় জাতীয় দল, আঞ্চলিক দল এবং স্বীকৃতিবিহীন নথিভুক্ত দলের অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়। লােকসভা নির্বাচনে কমপক্ষে ৪টি রাজ্যে মােট ভােটের ৬ শতাংশ পেলে তাকে জাতীয় দল হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। অন্যদিকে, লােকসভা নির্বাচনে কোনাে রাজ্যে মােট ভােটের ৬ শতাংশ পেলে সংশ্লিষ্ট দলকে আঞ্চলিক দল হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া যেতে পারে। ভারতের উল্লেখযোগ্য জাতীয় দল হল, কংগ্রেস, বিজেপি, সিপিআই (এম), সিপিআই, বহুজন সমাজবাদী পার্টি প্রভৃতি। অন্যদিকে, উল্লেখযােগ্য আঞ্চলিক দলগুলির মধ্যে রয়েছে ডিএমকে, এআইএডিএমকে, রাষ্ট্রীয় জনতা দল, বিজু জনতা দল, তেলুগু দেশম, তৃণমূল কংগ্রেস, শিরােমণি আকালি দল, ন্যাশনাল কনফারেন্স, এনসিপি, প্রভৃতি।
ভারতীয় দলব্যবস্থা ব্রিটেন বা আমেরিকার মতাে সুস্পষ্টভাবে দ্বিদলীয় ব্যবস্থায় বিভক্ত হয়নি। আবার ফ্রান্সের মতাে বহুদলীয় ব্যবস্থা এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তবে ১৯৮৯ সালের পরে কর্তৃত্বযুক্ত দলীয় ব্যবস্থার অবসান ঘটায় এবং ভারতের আঞ্চলিক দলগুলি প্রথম সারিতে উঠে আসায়, ভারতীয় দলব্যবস্থায় এক নতুন মাত্রা সূচিত হয়েছে।
সংজ্ঞা: বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে তারা রাজনৈতিক দল সম্পর্কে সংজ্ঞা নির্দেশ করেছেন। ব্রিটিশ চিন্তাবিদ এডমন্ড বার্কের মতে, যখন কোনাে জনসমষ্টি নির্দিষ্ট নীতির ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে জাতীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য উদ্যোগী হয়, তখন তাকে রাজনৈতিক দল বলে। অধ্যাপক ম্যাকাইভারের মতে, কোনাে সংঘবদ্ধ জনগােষ্ঠী যখন নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে বৈধ উপায়ে শাসনক্ষমতা দখলের চেষ্টা করে, তখন তাকে রাজনৈতিক দল বলা যেতে পারে।
আধুনিক ধ্যানধারণা: রাজনৈতিক দল সম্পর্কে আধুনিক ধ্যানধারণার পরিচয় পাওয়া যায় ১৯৫০ সালের পরে দ্যুভারজার, নিউম্যান, আপটার ব্লন্ডেল, অ্যালমন্ড, জোসেফ পালােম্বারা প্রমুখের রচনায়। দ্যুভারজারের মতে, রাজনৈতিক দল হল এমন এক গােষ্ঠী সমবায় যা সমগ্র দেশে ছড়িয়ে থাকা কয়েকটি ছােটো ছােটো গােষ্ঠী এবং সহযােগী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করে। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী গেটেল রাজনৈতিক দলকে একটি সংগঠিত নাগরিক সম্প্রদায় বলে অভিহিত করেছেন।
মার্কসীয় চিন্তাধারা: মার্কসীয় চিন্তাবিদরা সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে রাজনৈতিক দলের বিষয়টিকে দেখতে চেয়েছেন। তাদের মতে, শ্রেণিবিভক্ত সমাজে অর্থনৈতিক স্বার্থরক্ষার জন্য প্রতিটি শ্রেণি রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করে, তা থেকেই রাজনৈতিক দলগুলি গড়ে ওঠে।
গ্রহণযােগ্য সংজ্ঞা: রাজনৈতিক দলের একটি গ্রহণযােগ্য সংজ্ঞা দিতে গিয়ে অধ্যাপক অ্যালান বলের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করে বলা যায়, যখন কোনাে জনসংগঠন এককভাবে বা অন্যদের সঙ্গে একযােগে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করতে অথবা তা বজায় রাখতে চেষ্টা করে তখন তাকে রাজনৈতিক দল বলা যেতে পারে।
সংজ্ঞা: সাধারণভাবে জাতীয় রাজনৈতিক দল বলতে সেই দলকে বােঝায় যাদের সাংগঠনিক প্রভাব-প্রতিপত্তি সারা দেশে ছড়িয়ে রয়েছে| জাতীয় দল জাতীয় রাজনীতির অপরিহার্য অঙ্গ। জাতীয় দলের দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রেও জাতীয় রাজনীতি এবং জাতীয় বিষয়গুলি প্রাধান্য পায়। জাতীয় দলের লক্ষ্য হল সারা দেশের আর্থসামাজিক তথা রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের এবং উন্নয়নের জন্য কাজ করা।
নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নির্দেশিত সংজ্ঞা: ভারতের নির্বাচন কমিশনের বিজ্ঞপ্তি অনুসারে জাতীয় দল বলতে সেই দলকে বােঝায়, যে দল লােকসভা নির্বাচনে কমপক্ষে ৪টি রাজ্যে মােট ভােটের ৬ শতাংশ লাভ করেছে। তা ছাড়া কোনাে রাজনৈতিক দল ৪টি বা তার বেশি রাজ্যে স্বীকৃত রাজনৈতিক দল’-এর মর্যাদা লাভ করলে তাকেও জাতীয় দল বলা যায়।
নির্বাচন কমিশনের নতুন ঘােষণা: জাতীয় দলের স্বীকৃতি প্রদানের ক্ষেত্রে ২০০০ সালের ২ ডিসেম্বর তারিখে নির্বাচন কমিশন নতুন এক ঘােষণায় নিয়মকানুন আরও শিথিল করে জানায় যে, যদি কোনাে দল লােকসভায় যেকোনাে রাজ্য থেকে চারটি আসন পায় এবং লােকসভা নির্বাচনে মােট ভােটের ২ শতাংশ ভােট পায়, তাহলে সেই দলকে জাতীয় দলের স্বীকৃতি দেওয়া যেতে পারে।
বর্তমানে ভারতের জাতীয় দল: বর্তমানে নির্বাচন কমিশনের এক ঘােষণা অনুসারে (২০১৫) ৬টি রাজনৈতিক দলকে জাতীয় রাজনৈতিক দলের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এই ৬টি জাতীয় রাজনৈতিক দল হল—
-
(i) ভারতের জাতীয় কংগ্রেস,
-
(ii) বিজেপি,
-
(iii) সিপিআই (এম),
-
(iv) সিপিআই,
-
(v) বহুজন সমাজবাদী পার্টি,
-
(vi) জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস (এনসিপি)।
সংজ্ঞা: আঞ্চলিক দল বলতে সেইসব রাজনৈতিক দলকে বােঝায় যে দলগুলি একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের স্বার্থসমূহের প্রতিনিধিত্ব করে এবং সংশ্লিষ্ট স্বার্থসমূহের সমর্থনে কাজকর্ম করে। আঞ্চলিক দলের সাংগঠনিক শক্তি ও প্রভাব-প্রতিপত্তি একটি অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নির্দেশিত সংজ্ঞা: ভারতের নির্বাচন কমিশনের বিজ্ঞপ্তি অনুসারে আঞ্চলিক দল বলতে সেই দলকে বােঝায় যে দল রাজ্যের লােকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনে মােট বৈধ ভােটের ৬ শতাংশ পেয়ে থাকে। কোনাে দল এই পরিমাণ ভােট পেলে নির্বাচন কমিশন তাকে আঞ্চলিক দল হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারে।
বর্তমানে ভারতের কয়েকটি আঞ্চলিক দল: ভারতের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল তামিলনাড়ুর ডিএমকে, এআইএডিএমকে, পাঞ্জাবের আকালি দল, জম্মু ও কাশ্মীরের ন্যাশনাল কনফারেন্স, অন্ধ্রের তেলুগু দেশম, পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস, ঝাড়খণ্ডের ঝাড়খণ্ড মুক্তিমােচা প্রভৃতি।
চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনায় ‘চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠী’ খুব একটা প্রাচীন ধারণা নয়। বিংশ শতাব্দীর গােড়ার দিকে এই সম্পর্কে আলোচনার সূত্রপাত ঘটে। চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠীর সংজ্ঞা ও নামকরণ নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতবিরােধ রয়েছে। অনেকে চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠী (Pressure Group) এবং স্বার্থগােষ্ঠীকে (Interest Group) অভিন্ন বলে মনে করেন অধ্যাপক অ্যালান বল তার Modern Politics and Government গ্রন্থে চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠী ও স্বার্থগােষ্ঠীর মধ্যে পার্থক্য চিহ্নিত করেছেন। তাঁর মতে চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠীর মধ্যে দুটি ভাগ রয়েছে-
-
[1] স্বার্থগােষ্ঠী (Interest Group),
-
[2] সমমনােভাবাপন্ন গােষ্ঠী (Common Attitude Group)।
যে ধরনের ব্যক্তিরা একই স্বার্থের জন্য গােষ্ঠীবদ্ধ হয়ে জনমত ও সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করে, তাকে স্বার্থগােষ্ঠী বলে। যেমন, কৃষকরা সবাই গােষ্ঠীবদ্ধ হয়ে কৃষক সমিতি গঠন করেন। অন্যদিকে, সমমনােভাবাপন্ন গােষ্ঠীর ক্ষেত্রে সবাই একই পেশার লােক নাও হতে পারেন, সেখানে ভিন্ন ভিন্ন পেশার লােক থাকলেও তাদের মনােভাব। কিন্তু এক। যেমন, পরিবেশ সুরক্ষা সমিতি বা গ্রিন পিস মুভমেন্ট ইত্যাদি।
সংজ্ঞা: অধ্যাপক অ্যালান বলের মতে, যখন স্বার্থগােষ্ঠী ও সমমনােভাবাপন্ন গােষ্ঠী চাপসৃষ্টির দ্বারা সরকারি সিদ্ধান্তকে নিজেদের গগাষ্ঠীস্বার্থের অনুকূলে আনতে সক্ষম হন, তখন তা চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠীতে রূপান্তরিত হয়। চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠী হল সমমনােভাবাপন্ন ও অভিন্ন স্বার্থের দ্বারা আবদ্ধ এমন এক গােষ্ঠী, যারা সরকার পরিচালনায় অংশ না নিয়েও সরকারি সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে নিজেদের পক্ষে আনতে সক্ষম হন।
প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্য: চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠীর বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল-
-
উদারনৈতিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার অঙ্গ: উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠী রাজনীতির একটি অপরিহার্য অঙ্গ।
-
প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামাের ওপর নির্ভরশীলতা: অধ্যাপক অ্যালান বলের মতে, চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠীর ভূমিকা অনেকটাই রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামাের ওপর নির্ভরশীল।
-
রাজনৈতিক সংস্কৃতির ওপর নির্ভরশীলতা: চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠীর কাজকর্মের সাফল্য ও ব্যর্থতা অনেকটাই রাজনৈতিক সংস্কৃতির ওপর নির্ভরশীল। যেমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক সংস্কৃতি চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠীর পক্ষে যতটা অনুকূল, ইউরােপের দেশগুলির ক্ষেত্রে ততটা নয়।
-
দলীয় ব্যবস্থার প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীলতা: চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠীর কার্যকলাপ দলীয় ব্যবস্থার প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল।
চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর ভূমিকা ও কার্যাবলি
উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠীগুলির উল্লেখযােগ্য ভূমিকা রয়েছে। এগুলি হল –
-
[1] রাজনৈতিক ব্যবস্থা সংরক্ষণ,
-
[2] শাসন বিভাগের ওপর প্রভাব বিস্তার,
-
[3] আইনসভার ওপর প্রভাব বিস্তার,
-
[4] বিচার বিভাগের ওপর প্রভাব বিস্তার,
-
[5] জনসংযােগ রক্ষা ও জনমত গঠন,
-
[6] নতুন আইন ও নীতির উৎস।
এ ছাড়া সরকারি জুটিবিচ্যুতি দূরীকরণে, রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে, জনগণ ও সরকারের মধ্যে সংযােগরক্ষায়, রাজনৈতিক মূল্যবােধ রক্ষার মতাে নানান কাজে চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠীগুলির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
রাজনৈতিক দল
-
রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে একটি বৃহৎ ও সুশৃঙ্খল দলীয় সংগঠন থাকে।
-
উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক কাজকর্ম পরিচালনার উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ঘটে।
-
রাজনৈতিক দলের প্রধান উদ্দেশ্য হল রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন।
-
রাজনৈতিক দল সাধারণত জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতে গঠিত হয়।
-
রাজনৈতিক দল মতাদর্শের ওপর ভিত্তি, করে গড়ে ওঠে।
-
রাজনৈতিক দলগুলি প্রকাশ্যে কাজকর্ম পরিচালনা করে।
-
কোনাে বিষয়ে দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রশ্নটি রাজনৈতিক দলের কাছে সময়সাপেক্ষ একটি বিষয়।
-
সমমনােভাবাপন্ন অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জোট বা মাের্চা গঠনের মাধ্যমে সরকার গঠন করে থাকে.
-
আধুনিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার একটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হল দলব্যবস্থা।
-
রাজনৈতিক দলকে বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে তাদের নীতি ও কর্মসূচি নির্বাচনি ইস্তাহারে স্পষ্টভাবে ঘােষণা করতে হয়।
চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠী
-
চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠীগুলি সাংগঠনিক দিক থেকে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র হয়।
-
চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠীর উদ্ভব ঘটেছে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষিতে।
-
এই গােষ্ঠীগুলির উদ্দেশ্য হল বাইরে থেকে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে গােষ্ঠীগত স্বার্থ পূরণ করা।
-
চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠীগুলি সংকীর্ণ গােষ্ঠীস্বার্থে পরিচালিত হয়।
-
চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠীগুলির কোনাে মতাদর্শগত ভিত্তি নেই।
-
চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠীর কাজকর্ম যতটা সম্ভব গােপনে ও পরােক্ষভাবে পরিচালিত হয়।
-
চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠীগুলিকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রশ্নে এই ধরনের কোনাে জটিলতার মধ্যে যেতে হয় না।
-
চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠীর ক্ষেত্রে সমমনােভাবাপন্ন গােষ্ঠীগুলির সঙ্গে সম্মিলিতভাবে মাের্চা গঠনের প্রবণতা লক্ষ করা যায় না।
-
চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠীর কাজকর্ম শুধুমাত্র উদার নৈতিক গণতান্ত্রিক দেশগুলিতেই সীমিত রয়েছে।
-
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে নিজেদের নীতি ও কর্মসূচি ঘােষণা করতে হয় না।
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার একটি অপরিহার্য অঙ্গ হল দলব্যবস্থা। ভারতের সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলব্যবস্থার স্বতন্ত্র মৌলিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এই বৈশিষ্ট্যগুলি হল-
-
[1] সাংবিধানিক স্বীকৃতি,
-
[2] ব্যক্তিকেন্দ্রিক দলব্যবস্থা,
-
[3] আঞ্চলিক দলের গুরুত্ব,
-
[4] ধর্মভিত্তিক দলের অস্তিত্ব,
-
[5] ভাষাভিত্তিক দলের অস্তিত্ব,
-
[6] নীতি, আদর্শ ও কর্মসূচিগত পার্থক্য,
-
[7] মাের্চা বা জোট গঠনের প্রয়াস,
-
[8] নির্বাচন কমিশনের স্বীকৃতি,
-
[9] গণসংগঠনের গুরুত্ব,
-
[10] এককেন্দ্রিক প্রবণতা,
-
[11] আলিক দলগুলির প্রাধান্য।
আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের উদ্ভবের কারণ
আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের উদ্ভব সাম্প্রতিককালের ভারতীয় রাজনৈতিক দলব্যবস্থার এক লক্ষণীয় দিক। ভারতের নির্বাচন কমিশন প্রদত্ত বিজ্ঞপ্তি অনুসারে কোনাে দল রাজ্যের লােকসভা এবং বিধানসভা নির্বাচনে মােট বৈধ ভােটের অন্তত ৬ শতাংশ পেলেই সেই দলকে আঞ্চলিক দল হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া যেতে পারে। ভারতের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় আঞ্চলিক দলগুলির উদ্ভবের নেপথ্যে নিম্নলিখিত কারণগুলি সক্রিয় রয়েছে-
-
[1] জাতপাত ও সাম্প্রদায়িক প্রভাব,
-
[2] ভাষাগত দাবি দাওয়া,
-
[3] আঞ্চলিক সমস্যা ও বঞ্চনা,
-
[4] অন্তর্কলহ ও ভাঙন,
-
[5] সংখ্যালঘু স্বার্থরক্ষা।
ভারতের রাজনীতিতে আঞ্চলিক দলের গুরুত্ব
ভারতের সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ১৯৮৯ সালে লােকসভার নবম সাধারণ নির্বাচনের পর থেকে ভারতে প্রাধান্যমূলক একদলীয় ব্যবস্থা (Dominant Party System)র অবসান ঘটে, সূত্রপাত হয়। জোটরাজনীতির সাম্প্রতিককালে, ভারতের সাধারণ নির্বাচনগুলিতে কোনাে দল একক নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় আঞ্চলিক দলগুলির গুরুত্ব অনিবার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভারতের রাজনীতিতে আঞ্চলিক দলগুলির গুরুত্ব নানান দিক থেকে স্বীকৃতি লাভ করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি দিক হল-
-
[1] যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামাের সমৃদ্ধিতে সহায়ক,
-
[2] ভাষা ও সংস্কৃতিগত উত্তরাধিকারকে সুরক্ষা প্রদানকারী,
-
[3] জাতীয় স্তরে আঞ্চলিক সমস্যার উত্থাপক,
-
[4] প্রাধান্যমূলক একদলীয় ব্যবস্থার অবসানে উদ্যোগী।
ভারতীয় দলব্যবস্থার সাম্প্রতিক প্রবণতা
ভারতের দলব্যবস্থা সাম্প্রতিককালে এক মৌলিক রূপান্তরের মধ্যে দিয়ে চলেছে। ভারতীয় দলব্যবস্থার সাম্প্রতিক প্রবণতা পর্যালােচনা করলে নিম্নলিখিত দিকগুলি উঠে আসে-
- [1] জোটরাজনীতির উদ্ভব,
- [2] কর্তৃত্বযুক্ত দলব্যবস্থার অবসান,
- [3] আঞ্চলিক দলগুলির প্রাধান্য বৃদ্ধি,
- [4] সাম্প্রদায়িকীকরণ।
ভারতীয় গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলের গুরুত্ব
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় দলব্যবস্থা এক অপরিহার্য অঙ্গ। ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় দলীয় ব্যবস্থা ভিন্নতর হয়। দলীয় ব্যবস্থার মধ্যে দিয়েই দেশের আর্থসামাজিক তথা রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চিত্রের প্রতিফলন ঘটে। ভারতের মূল সংবিধানে রাজনৈতিক দলীয় ব্যবস্থার কোনাে উল্লেখ না থাকলেও ১৯৮৫ সালে ৫২তম সংবিধান সংশােধনের মাধ্যমে ভারতের দলব্যবস্থা সর্বপ্রথম সাংবিধানিক স্বীকৃতি লাভ করে। সংসদের জনপ্রতিনিধিত্ব আইনেও ভারতের রাজনৈতিক দলব্যবস্থার কথা উল্লেখ করা হয়।
ভারতীয় গণতন্ত্রে বিভিন্ন দিক থেকে রাজনৈতিক দলগুলির গুরুত্ব লক্ষ করা যায়। এগুলি হল-
- [1] রাজনৈতিক কাঠামাের স্থায়িত্ব রক্ষা,
- [2] সরকার ও জনগণের মধ্যে সংযােগসাধন,
- [3] গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রাখা,
- [4] জাতীয় ঐক্য ও সংহতি রক্ষা,
- [5] রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ।
জোটরাজনীতি
বর্তমান ভারতের রাজনৈতিক দলব্যবস্থার এক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল জোটরাজনীতির প্রবণতা। ভারতে একক প্রভুত্বকারী দল হিসেবে জাতীয় কংগ্রেসের অবনমন এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক দলের দ্রুত উত্থানের ফলে কোনাে একটি দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ বর্তমানে আর সম্ভব নয়। ফলে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের স্বার্থে সমমনােভাবাপন্ন দলগুলি জোটবদ্ধ হয়ে জোটরাজনীতির সূচনা করেছে।
দলীয় জোটব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য
ভারতীয় রাজনীতিতে সাম্প্রতিক প্রবণতার একটি প্রধান দিক হল দলীয় জোটব্যবস্থা। সাধারণ নির্বাচনে লোকসভায় কোনাে দলের পক্ষে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন সম্ভব না হওয়ায় কেন্দ্রে জোটরাজনীতির চল শুরু হয়। আবার, রাজ্যগুলিতে বিধানসভার নির্বাচনেও এই প্রবণতার সূত্রপাত ঘটে। ভারতের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে দলীয় জোটব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে ১৯৭৭ সালে ষষ্ঠ লােকসভা নির্বাচনে। এর আগেই রাজ্যগুলিতে ১৯৬৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে কোয়ালিশন বা জোটা রাজনীতির সূচনা হয়। ১৯৬৭ সালে কেরল, বিহার, ওড়িশা, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, হরিয়ানা, পাঞ্জাব এবং পশ্চিমবঙ্গ এই ৮টি রাজ্যে অকংগ্রেসি জোট সরকার গড়ে ওঠে।
ভারতের রাজনীতিতে দলীয় জোটব্যবস্থার কয়েকটি উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে। সেগুলি হল-
-
[1] বন্ধুদলীয় প্রাধান্য,
-
[2] আঞ্চলিক দলগুলির প্রাধান্য,
-
[3] একক বৃহত্তম দলের নেতৃত্ব,
-
[4] অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচি,
-
[5] আপসমূলক দৃষ্টিভঙ্গি।
Leave a comment