প্রশ্নঃ রাজনৈতিক উপন্যাস হিসেবে সেলিনা হোসেনের ‘কাঁটাতারে প্রজাপতি’র সার্থকতা বিচার কর। 

অথবা, তেভাগা আন্দোলনের প্রভাব সেলিনা হােসেনের ‘কাঁটাতারে প্রজাপতি’ উপন্যাসে কীভাবে প্রতিফলিত হয়েছে তা বর্ণনা কর।

উত্তরঃ বাংলাদেশের প্রধান কথাসাহিত্যিকদের অন্যতম সেলিনা হােসেন (জন্ম, ১৯৪৭)। তার সাহিত্যের বিষয় হিসেবে উঠে এসেছে বহমানকাল, রাষ্ট্র ও মানবজগৎ। তার উপন্যাসে রাজনৈতিক সময় বা আন্দোলন অধিকতর পরিপ্রেক্ষিত অর্জন করে। বাঙালির অহঙ্কার ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ তার লেখায় নতুন মাত্রা অর্জন করে। নারীর শাশ্বত দৃষ্টি, সনাতন আদর্শ বজায় থাকে তার লেখায়। এক্ষেত্রে তিনি স্বদেশ ও স্বজাতির ঐতিহ্যের প্রতি দৃঢ় এবং দায়িত্বশীল। এমন প্রত্যয়ে গৌরববাজ্জ্বল পর্বগুলাে উন্মােচিত হয় কাহিনিগাত্রে; জাতীয় চরিত্র প্রতীকায়িত হয় আদর্শের আশ্রয় থেকে। এভাবে তার রচনাসম্ভার হয়ে উঠেছে অনবদ্য এবং অভিনব।

‘কাঁটাতারে প্রজাপতি’ (১৯৮৯) উপন্যাসে প্রদত্ত প্রশ্নের উত্তরে প্রবেশের আগে তেভাগা আন্দোলনের উৎপত্তি এবং কীভাবে এতে দুই বাংলার মানুষেরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে যােগ দেয় তার সামান্য পরিচয় নেওয়া প্রয়ােজন। ১৯৩৬-১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বাংলায় ক্রমান্বয়ে কৃষক আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে, এতে অবশ্যই শিক্ষিত সমাজ ও কৃষক শ্রেণি থেকে আগত অসংখ্য কর্মী ও নেতার উল্লেখযােগ্য অবদান ছিল। এমনকি জমিদার ও জোতদারদের পরিবারের অনেক আত্মত্যাগী যুবকেরাও সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করে। তখন জাতীয়বাদী বিপ্লবীদের অনেকেই মার্কসবাদে দীক্ষা নিয়েছেন। তারা ব্রিটিশ কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বিভিন্ন জেলায় কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তুলে শ্রমিক, কৃষক, মহিলা ও ছাত্রফ্রন্ট সংগঠিত করে সমাজ জীবনের আমূল রূপান্তরের জন্য আন্দোলন পরিচালনা করেন। ভারতবর্ষে স্বাধীনতা আসার পরেই ঘটে গেল।

পঞ্চাশের মন্বন্তর, অনাহারে মরতে লাগল হাজার হাজার মানুষ আর মুনাফালােভী জোতদার আর চোরাকারবারির দল সেই সুযােগে সর্বস্বান্ত করতে চাইল খেটে খাওয়া মানুষদের। এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নাৎসীবাদের চূড়ান্ত পরাজয় ও দুনিয়াব্যাপী নতুন যুগের সম্ভাবনাময় পরিস্থিতিতেই তেভাগার সূচনা। নিপীড়িত, অত্যাচারিত কৃষক সমাজের উপর জোতদারদের জোরজুলুম বন্ধ করার দাবি নিয়ে এসেছিল তেভাগা। সারা বছরের হাড়ভাঙা খাটুনি শেষে ধান কাটা, জোতদারদের খােলানে কাটা ধান বহন করা, ঝাড়াই মাড়াই করা আর গােলাভর্তি করে বেগার খেটে যৎসামান্য ধান নিয়ে নিজের ভরণপােষণ করাই ছিল চাষিদের কাজ। কিন্তু এ ক্ষোভের মেঘ পুঞ্জিভূত হতে হতে বিশাল আন্দোলনের আকার নেয় এবং শ্লোগান ওঠে ধান কেটে ঘরে তােলে এবং দখল রেখে চাষ করাে। এমনি করে প্রচলিত অন্যায় ব্যবস্থাকে গুড়িয়ে দিয়ে এগিয়ে চলল মেহনতি মানুষের মিছিল। লেখকের ভাষায়-

“কমিশনের রিপোের্ট অনুসারে ফসলের দুই-তৃতীয়াংশ পাবার জন্য আন্দোলন শুরু করা হবে। ঐ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অল্পদিনের মধ্যেই বিভিন্ন জেলায় তেভাগা আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। জলপাইগুড়ি, রংপুর, দিনাজপুর, যশাের, খুলনা এবং আরাে অনেক জায়গায় তেভাগা আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠেছে। সেখানে আমাদের সংগ্রামী ভাইয়েরা মরণপণ লড়াই করছে।”

এ আন্দোলনের প্রত্যক্ষ প্রভাব থেকে তখনাে পূর্ব পাকিস্তানের কৃষক সমাজ দূরেই ছিল, কারণ দেশ-বিভাজনের বিষবাষ্প তখনাে নিঃশেষ হয়ে যায়নি। ক্রমে ক্রমে ফাটল ধরল, মুসলিম কৃষকদের মধ্যে থেকেও তেভাগার ডাক আসতে লাগল। মানুষ বুঝতে শিখল মুসলমান জোতদার আর হিন্দু জোতদারদের মধ্যে যেমন পার্থক্য নেই তেমনি মুসলমান আর হিন্দু কৃষকের মধ্যেও কোনাে পার্থক্য নেই। ধর্মের গণ্ডিকে মানুষ সহজেই পেরিয়ে এসে বলল- ‘দাড়ি টিকি ভাই ভাই, লড়াই এর ময়দানে জাতভেদ নাই। ‘কাটাতারে প্রজাপতি’ উপন্যাসটি লেখার মুখ্য উদ্দেশ্য কী ছিল তা সেলিনা হােসেন তার প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘নির্ভয় কর হে’ তে বর্ণনা করেছেন-

“নাচোলের তেভাগা আন্দোলনের পটভূমিতে ইলা মিত্রকে নিয়ে আমি যে উপন্যাসটি লিখি তার নাম কাঁটাতারে প্রজাপতি। আমি চেয়েছিলাম আমাদের ছেলে মেয়েরা গল্পের ভেতর দিয়ে জানুক নিকট অতীতকে। আবিষ্কার করুক সেইসব মানুষকে যারা জীবন দিয়ে ইতিহাসের সড়ক তৈরি করেন।”

‘কাঁটাতারে প্রজাপতি’ উপন্যাসে কাহিনির পরতে পরতে রয়েছে রাজনৈতিক ঘটনা ও পরিস্থিতির বুনােট। এ দিক থেকে এ উপন্যাসকে রাজনৈতিক উপন্যাসের সমগােত্র হিসেবে বিবেচনা করা চলে। কাহিনির অন্যতম প্রধান চরিত্র জমিদার রমেন মিত্র ও তার স্ত্রী ইলা মিত্র কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ও সংগঠক। কৃষ্ণ গােবিন্দপুরে হাট সভায় বক্তৃতার জন্য। ইলা মিত্র বক্তৃতার যে খসড়া তৈরি করে তাতে কৃষক আন্দোলনের রূপরেখা উঠে আসে। সেই সূত্রে উপন্যাসে বর্ণিত হয় ১৯২৯ সালের বিশ্বমন্দা, ভারতের কৃষি অর্থনীতিতে তার নেতিবাচক প্রভাব, জমিদারি প্রথার পতন মােকাবিলায় ভূমিসংস্কারের লক্ষ্যে ক্লাউড কমিশন গঠন, কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালিত প্রাদেশিক কৃষক সভা কর্তৃক জমিতে দখল স্বত্ব প্রতিষ্ঠা ও ফসলের দুই তৃতীয়াংশ ভাগ লাভের দাবি, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের প্রস্তাব, ১৯৪০ সালের কমিশন কর্তৃক কৃষকদের দাবির অনুকূলে রায় প্রদান, সে বছর জুনে যশােরে অনুষ্ঠিত কৃষক সভার চতুর্থ প্রাদেশিক সম্মেলনে তেভাগা আন্দোলনের সিদ্ধান্ত ইত্যাদি বাস্তব ঐতিহাসিক ঘটনা ও তথ্য।

তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতিও উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে। মার্চ মাসে সারা ভারতে নির্বাচন, বাংলাদেশে মুসলিম লীগের বিজয়, সােহরাওয়ার্দীর প্রধান মন্ত্রিত্ব লাভ, মুসলিম লীগ কর্তৃক ১৬ আগস্টকে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস ঘােষণা, কলকাতায় দাঙ্গার তাণ্ডবলীলা, নােয়াখালিতে দাঙ্গার বিস্তার, দাঙ্গার পক্ষে মুসলিম লীগের ডানপন্থি অংশের মদদ, বামপন্থি অংশের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরােধী অবস্থান, দেশ বিভাগের অনিবার্যতা, ১৯৪৮ সালের জুনের মধ্যে দেশ ছাড়ার জন্য ব্রিটিশ সরকারের ঘােষণা, ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট নতুন রাষ্ট্রের জন্ম, দেশ বিভাগের প্রতিক্রিয়া, কৃষক সভা ও কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে তেভাগা আন্দোলন, কমিউনিস্টদের ওপর মুসলিম লীগের দমন-পীড়ন, কলকাতায় অনুষ্ঠিত কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস, কংগ্রেসের রণদীভের সশস্ত্র সংগ্রামের নীতি অনুমােদন ইত্যাদি এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয়। লেখক এ উপন্যাসের দাঙ্গার যে বর্ণনা দিয়েছেন তাতে দাঙ্গার ভয়াবহতা সহজেই অনুমেয়।

“১২ আগস্ট কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করলে, মুসলিম লীগ তাতে যােগ দিল না। তার আগেই ১৬ আগস্ট প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস ঘােষণা করেছিল। এ দিন প্রচণ্ড দাঙ্গায় কলকাতার বায়ু দূষিত। রমেন চোখ বুজলে দেখতে পায় সেই দৃশ্য। দেখতে পায়, উপুড় হয়ে এক যুবক, মুখ থুবড়ে পড়ে এক মহিলা, দ্বিখণ্ডিত শিশু, ভাবতেই অস্ফুট আর্তনাদ বেরিয়ে আসে মুখ থেকে।”

অন্যদিকে দেশভাগের পরে জোতদারদের নির্দেশে পুলিশ দরিদ্র চাষিদের মারধাের করল, এদের কাছ থেকে যথাসর্বস্ব লুট করে নিয়ে গেল। এই ঘটনার জেরে দুটি বিশ্বাসঘাতক মানুষকে ধরা হলাে কিন্তু আশ্চর্যের কথা এরাও দরিদ্র চাষি, তবু কোনভাবেই এদেরকে বুঝানাে গেল না তেভাগার আন্দোলন মূলত তাদের কারণেই। আন্দোলনকারীরা টের পেল মুসলিম লীগ এ আন্দোলনকে সাম্প্রদায়িক মােড় দেওয়ার চেষ্টা করছে। হয়ত যখন তখন মুসলিম লীগ উচ্চারিত ভারতীয় দালাল তেভাগার নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করতে পারে পাকিস্তানি পুলিশ, সকলকেই তাই আত্মগােপন করতে হলাে। জোতদার, রাজনৈতিক নেতা এবং পুলিশ মিলে এ আন্দোলনের চিড় ধরাতে চাইলেও আজ কৃষকরা রানিমাকে ছেড়ে ভুল করতে রাজি নয়। উনিশশ পঞ্চাশের জানুয়ারি পাঁচ তারিখের ঝলমলে সকালে চকচকে কাস্তে হাতে হাজার কৃষক নেমে পড়ে মাঠে। তবে জোতদারবর্গ পুলিশকে জানিয়েছে, আজ তাদের ধান চোরেরা লুট করবে।

বিশাল জনতার মিছিল আর তেভাগার সমর্থনে শ্লোগানে হকচকিয়ে যায় পুলিশ বাহিনী। তবুও গুলি খেয়ে এক কৃষকের মৃত্যু হলেই জনতা পুলিশকে আক্রমণ করে এবং খুন করে কবর দেয় মাটিতে।

জোতদারেরা যারা তেভাগা মানেনি ইলা মিত্রের নির্দেশে তাদের খােলান থেকে ধান তুলে নিয়ে আসা হলাে। ঘটনাটির পর দ্রুত যেন সবকিছু ঘটতে থাকে। তিন পুলিশের খুনের পর সাধারণ চাষিদের উপর পাকিস্তানি পুলিশ শুরু করে নারকীয় অত্যাচার। যুবতী মেয়েদের ধর্ষণ করা থেকে শুরু করে বাড়ি ঘরের মধ্যে আগুন সংযােগ, নাবালক শিশু . থেকে দুধের গাই এমনকি বৃদ্ধ, বৃদ্ধারা জীবন্ত অবস্থায় পুড়ে মারা যায়। লেখকের ভাষায়-

“দাউদাউ পুড়ে যাচ্ছে গ্রাম। ঘাসুরা, চণ্ডিপুর, কেন্দুয়া, জগদল, ধরল, শ্যামপুর, নাপিতপাড়া সর্বত্র আগুনের লেলিহান শিখা- কালাে ধোঁয়া বিস্তৃত হচ্ছে এক গ্রামের সীমানা পেরিয়ে অন্য গ্রামে- নদীতীর এবং তার ওপার। গুলির মুখে লুটিয়ে পড়ছে মানুষ।”

কিন্তু পুলিশ ইলা মিত্রকে কোথাও খুঁজে পায় না। আত্মগােপনকারী রমেন মিত্রের সঙ্গে স্বজন বিয়ােগব্যথায় কাতর লােকেরা পথ হাঁটতে লাগল। এদিকে রমেন মিত্রের চিন্তা, ইলা মিত্র ধরা পড়েনি তাে? অন্যদিকে ইলা মিত্রকে ঘিরে যে চারশাে স্বেচ্ছাসেবক, তাদের মনেও একই চিন্তা। খুব শীঘ্রই রানিমাকে সীমান্ত পেরিয়ে পালাতে হবে, কারণ মুসলিম লীগ যে সাম্প্রদায়িক বিষ মানুষের মনে ঢােকাতে শুরু করেছে, তার শুরু দেখা গেলেও শেষ কোথায় তা একেবারেই অজানা, পরিষ্কার সাঁওতাল ভাষা বলতে পারা ইলা মিত্র সীমান্ত পেরিয়ে যাবার জন্য সাঁওতাল মেয়ের ছদ্মবেশই ধারণ করলেন অবশেষে। কিন্তু এত চেষ্টার পরও শুধু চন্দ্রালােকিত রাতে পথ ভুল করার ফলে পাকিস্তানি পুলিশের হাতেই পড়তে হয় তাদের। ছদ্মবেশী ইলার পরিচয় পুলিশের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল যে এ নারী সাঁওতাল মেয়ে নয়। রােহনপুর জেল হাজতে পুলিশ চুলের মুঠি ধরে ইলাকে নিয়ে যায়। দুইকান বধির হয়ে যায় ইলার এদের অশ্লীল রসিকতায় তবু চোয়াল শক্ত করে পথ চলা অব্যাহত রাখতেই হবে। এরপর ইলার উপর বুটের লাথি, ঘুষি, বেত্রাঘাত আর চাবুকের ঝড় বয়ে গেল। মুখ দিয়ে ফিকনি দিয়ে রক্ত উঠলেও ইলা মিত্র দেখেন সাঁওতাল ছেলে হরেকের মারের চোটে নাকে মুখে রক্ত গড়াচ্ছে তবু রমেন মিত্র বা ইলা মিত্রের কথা না বলে হরেক সেখানেই মারা যায়, আর বাকি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর ছেলেরা সকলেই প্রহারের ফলে জ্ঞান হারায় থানার মাটিতে।

এদের সবার থেকে আলাদা বিচার ইলা মিত্রের, ওরা বলে পাকিস্তানি অপারেশন এখাননা শেষ হয়নি। রমেন মিত্রকে পেলে এরা হয়ত গুলি করে মারত কিম ইলার দেহ বলে সে নারী, সুতরাং এ নারীকে জব্দ করতে হবে শরীরের দিক থেকে। পাকিস্তানি পুলিশের নারকীয় অত্যাচার শেষে ইলা মিত্রকে পার্টি থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল কোনাে সংস্কারের বশবর্তী হয়ে তিনি যেন কিছু গােপন না করেন। পার্টির নির্দেশে ইলা এক জবানবন্দি পেশ করেন, কারণ কোনাে পত্রিকা এটি প্রকাশ করতে চায়নি। অতএব কমিউনিস্ট পার্টি থেকে লিফলেট আকারে জবানবন্দি প্রকাশিত হয় ১৯৫০ সালের ১৬ জানুয়ারি। এদিন থেকে তার উপর পুলিশের নির্যাতন শুরু। সেলিনা হােসেনের প্রবন্ধ সংকলন ‘নির্ভয় করাে হে’ বইয়ে ‘সেই জবানবন্দিটি এবং আমাদের ঋণ’ নিবন্ধে বিস্তৃতভাবে যে জবানবন্দিটি তুলে ধরা আছে আমরা সম্পূর্ণ বিবৃতিটি না দিয়ে শুধু অংশ বিশেষ তুলে ধরবো-

“কেসটির ব্যাপারে আমরা কিছুই জানি না। বিগত ৭-১-৫০ তারিখে আমি রােহনপুরে গ্রেফতার হই এবং পরদিন আমাকে নাচোল নিয়ে যাওয়া হয় হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে জানতে। আমার যেহেতু বলার কিছু ছিল না, কাজেই তারা আমার সমস্ত কাপড়-চোপড় খুলে নেয় এবং সম্পূর্ণ উলঙ্গভাবে সেলের মধ্যে আমাকে বন্দি করে রাখে। …. সেদিন সন্ধ্যাবেলায় এস.আই.-এর উপস্থিতিতে সেপাইরা তাদের বন্দুকের বাট দিয়ে আমার মাথায় আঘাত করতে শুরু করে। সে সময় আমার নাক দিয়ে প্রচুর রক্ত পড়তে থাকে। যে কামরাটিতে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলাে সেখানে স্বীকারােক্তি আদায়ের জন্য তারা নানা ধরনের অমানুষিক পদ্ধতিতে চেষ্টা চালায়। দুটো লাঠির মধ্যে আমার পা দুটি ঢুকিয়ে চাপ দেওয়া হচ্ছিল এবং সে সময়ে চারিধারে যারা দাঁড়িয়ে ছিলাে, তারা বলছিলাে যে, আমাকে পাকিস্তানি ইনজেকশন দেওয়া হচ্ছে। ….. জোর করে আমাকে কিছু বলাতে না পেরে তারা আমার চুলও উপড়ে তুলে ফেলেছিল।

সেলের মধ্যে আবার এস. আই সেপাইদেরকে চারটে গরম সেদ্ধ ডিম আনার হুকুম দিল এবং বললাে, এবার সে কথা বলবে। তারপর চার পাচজন সেপাই আমাকে জোরপূর্বক ধরে চিত করে শুইয়ে রাখলাে এবং একজন আমার যৌন অঙ্গের মধ্যে একটি গরম সিদ্ধ ডিম ঢুকিয়ে দিল…. এরপর আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি।

৯-১-৫০ তারিখের সকালে যখন আমার জ্ঞান এলাে তখন উপযুক্ত এস. আই এবং কয়েকজন সেপাই আমার সেলে এসে তাদের বুট দিয়ে আমার পেটে লাথি মারতে শুরু করলাে। এরপর ডান পায়ের গােড়ালিতে একটা পেরেক ফুটিয়ে দেওয়া হলাে এস, আইকে বিড়বিড় করে বলতে শুনলামঃ আমরা আবার রাত্রিতে আসছি এবং তুমি যদি স্বীকার না করাে, তাহলে সেপাইরা একে একে ধর্ষণ করবে। গভীর রাত্রিতে… তিন চারজন আমাকে ধরে রাখলাে এবং একজন সেপাই সত্যি আমাকে ধর্ষণ করতে শুরু করলাে।

পরদিন ১০-১-৫০ তারিখে যখন জ্ঞান ফিরে এলাে তখন আমি দেখলাম যে, আমার দেহ থেকে দারুণভাবে রক্ত ঝরছে সেই অবস্থাতেই আমাকে নাচোল থেকে নবাবগঞ্জ নিয়ে যাওয়া হলাে।

১১-১-৫০ তারিখে সরকারি হাসপাতালে নার্স আমাকে পরীক্ষা করলেন। ….. আমার পরনে যে রক্তমাখা জামা কাপড় ছিল সেটা পরিবর্তন করে একটি পরিষ্কার কাপড় দেওয়া হলাে।

১৬-১-৫০ তারিখে সেপাইরা জোর করে একটি সাদা কাগজে সই আদায় করলাে। ২১-১-৫০ তারিখে নবাবগঞ্জ থেকে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে এসে সেখানে জেল হাসপাতালে ভর্তি করে দেওয়া হলাে।”

জবানবন্দিটি এখানেই শেষ, সেলিনা উপন্যাসে মূল জবানবন্দিটিকে হুবহু একইভাবে বর্ণনা করেছেন। সংস্কারের শৃঙ্খল ভেঙে এ জবানবন্দিটি একটি মাইলফলক। অন্যদিকে ধর্মভিত্তিক নতুন রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ভণ্ডামি এবং ব্যর্থতার সুস্পষ্ট চিত্র। রাষ্ট্র পরিচালনার শুরু থেকেই পাকিস্তান সরকার তথা সরকারি তাবেদার মুসলমান পুলিশেরা যে অনৈতিক এবং ধর্মবিরুদ্ধ বর্বরতা প্রদর্শন করেছে, তার মধ্যেই স্পষ্ট হয়েছে নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের নিয়তি। ইলা মিত্রের বিচার ও তার জবানবন্দি সেই সময়কার তরুণ সমাজকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। প্রতিবাদী হয়ে ওঠার, প্রেরণা দিয়েছিল মুসলিম লীগ। সরকারের ঘৃণ্য শাসনের বিরুদ্ধে।

উপন্যাসে কমিউনিস্ট ও কৃষক সভার রাজনৈতিক কর্মতৎপরতার প্রসঙ্গও এসেছে। গুরু মাডাং, নিতাই, শোয়েব সরকার শােষণের বিরুদ্ধে যে গান বাঁধে তার ভেতর দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক বক্তব্য প্রচারিত হয়। রমেন মিত্র, ইলা মিত্র, সাঁওতাল সর্দার, মাতলা মাঝি প্রমুখ কমিউনিস্ট পার্টির কাজে মেতে থাকে। মুসলিম লীগ সরকারের দমন পীড়নের মুখে তারা আত্মগােপনে থেকে কাজ চালিয়ে যায়, ক্যাম্প স্থাপন করে সশস্ত্র প্রতিরােধের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এভাবে উপন্যাসে নানা রাজনৈতিক ঘটনা সম্পর্কিত তথ্য বুনােট করায় উপন্যাসটি রাজনৈতিক উপন্যাসের চরিত্র পেয়েছে।