গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমসমূহ: রাজনীতিক ব্যবস্থা ও রাজনীতিক সামাজিকীকরণ পরস্পরের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ। সকল দেশেই বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার প্রতি দেশবাসীর বিশেষ ধরনের মনোভাব, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। এবং এ ক্ষেত্রে কতকগুলি মাধ্যম বা সংস্থার ভূমিকা বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। এ প্রসঙ্গে অ্যালান বল তাঁর Modern Politics and Government শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “The principal determinants of the development and establishment of various attitudes and about the political system may be listed as 

  • (1) the family; 

  • (2) the schools and other institutions of education; 

  • (3) voluntary groups, work and informal relationships; 

  • (4) the mass media; 

  • (5) government and party agencies.” 

বস্তুত প্রত্যেক রাজনীতিক ব্যবস্থায় রাজনীতিক সামাজিকীকরণের মাধ্যম বা বাহনগুলির ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। রাজনীতিক সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে মুখ্য মাধ্যম বা উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলি হল: 

  • (১) পরিবার (Family); 

  • (২) শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (Educational Institutions); 

  • (৩) পেশাগত সংগঠন (Professional Association); 

  • (8) গণ-মাধ্যম (Mass Media); 

  • (৫) রাজনীতিক দল (Political Party) ; 

  • (৬) অন্তরঙ্গ গোষ্ঠী (Peer Group); 

  • (৭) ধর্মীয় সংগঠন (Religious organisation) প্রভৃতি।

মাধ্যমগুলির ভূমিকার বিচ্ছিন্ন মূল্যায়ন অসম্ভব: রাজনীতিক সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে উপরি-উল্লিখিত সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সংযোগ বা প্রভাব-প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়। এই কারণে এই মাধ্যমগুলির ভূমিকা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নভাবে মূল্যায়ন করা যায় না। অধ্যাপক বল এ প্রসঙ্গে বলেছেন : “They cannot be examined in complete isolation.” রাজনীতিক সামাজিকীকরণের ব্যাপারে কোন ব্যক্তির উপর বিশেষ একটি মাধ্যমের একক ও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পড়তে পারে। আবার বিপরীতক্রমে একাধিক মাধ্যমের সাহায্যে কোন ব্যক্তির রাজনীতিক সামাজিকীকরণ সম্পাদিত হতে পারে। কোন সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কোন ব্যক্তির মধ্যে প্রাথমিকভাবে বিশেষ কিছু রাজনীতিক মূল্যবোধ, মতাদর্শ ও বিশ্বাস সঞ্চারিত হওয়ার পর কালক্রমে তার আমূল পরিবর্তন ঘটতে পারে। আবার এমনও হতে পারে, কোন একটি মাধ্যমের সাহায্যে কোন একজনের মধ্যে কিছু মূল্যবোধ, মতাদর্শ ও বিশ্বাস প্রাথমিকভাবে সঞ্চারিত হল এবং পরবর্তী কালে সেগুলি সুদৃঢ় হল অন্যান্য মাধ্যমের সাহায্যে। ব্যক্তি মানুষের মানসিকতা, প্রবণতা, রাজনীতিক বিষয়াদিতে আগ্রহ-অনাগ্রহ, শিক্ষা-দীক্ষা, আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ের দ্বারা স্থিরীকৃত হয় রাজনীতি, সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে কোন বিশেষ বা কোন কোন মাধ্যম অধিকতর কার্যকর হবে। এই কারণে বলা হয়। যে কোন বিশেষ মাধ্যম রাজনীতিক সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে সর্বাধিক কার্যকর হবে তা নির্ধারণ করা কঠিন। তা ছাড়া রাজনীতিক সামাজিকীকরণের মাধ্যমগুলি বিভিন্ন মাত্রায় বিভিন্ন উপাদানের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে বল সামাজিক সচলতা ও ভৌগোলিক সচলতার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন: “… all are affected, in varying degrees, by other factors, such as social and geographical mobility.” সামাজিক শ্রেণীর সিঁড়িতে ঊর্ধ্বমুখী উল্লম্বী সচলতার (upward vertical mobility) অন্যতম ফল হিসাবে ব্যক্তিবর্গের মধ্যে নতুন মূল্যবোধ ও মনোভাব গ্রহণ করার প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। বিপরীতক্রমে অধোমুখী উল্লম্ব সচলতা (downward vertical mobility)-র ক্ষেত্রে পূর্বতন রাজনীতিক মনোভাব আঁকড়ে থাকার প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। আবার কোন অঞ্চলে নবাগত ব্যক্তিরা সাধারণত রাজনীতিক বিষয়ক আলোচনায় যোগ দেয় না, রাজনীতিক বিষয়ক প্রশ্নের জবাব দেয় না এবং রাজনীতিক কাজকর্মে অংশগ্রহণ করে না। বল বলেছেন: “Geographical mobility has several consequences, such as the reluctance to discuss political questions or praticipate in political activities after moving into new district.”

যাইহোক রাজনীতিক সামাজিকীকরণ সম্পর্কিত মুখ্য মাধ্যমসমূহ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা‌ আবশ্যক।

(1) পরিবার

রাজনীতিক সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা প্রাথমিক ও তাৎপর্যপূর্ণ: রাজনীতিক সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে পরিবারের অনন্য ভূমিকা অনস্বীকার্য। অল্পবিস্তর সকল রাজনীতিক ব্যবস্থাতেই একথা অস্বীকার করা যায় না। শিশুর লালন-পালন পরিবারের মধ্যেই সম্পাদিত হয়। শিশুকে সামগ্রিকভাবেই পরিবারের উপর নির্ভরশীল থাকতে হয়। প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া অবধি এই ব্যবস্থাই বহাল থাকে। পারিবারিক জীবনের কোলে লালিত সুস্পষ্ট ও অস্পষ্ট যাবতীয় প্রভাব ব্যক্তির জীবনের উপর ব্যাপক ও গভীর নিয়ন্ত্রণের ছাপ রাখে। সমাজব্যবস্থার প্রতি পরিবারের সাধারণ মনোভাব শিশুর মনের উপর গভীরভাবে রেখাপাত করে। তাই বল বলেছেন: “The influence of family in the process of political socialisation seems obvious.” এ প্রসঙ্গে Comparative Politics শীর্ষক গ্রন্থে অ্যালমন্ড ও পাওয়েল মন্তব্য করেছেন: “The family unit is the first socialisation structure encountered by the individual.”

ব্যক্তির রাজনীতিক ব্যক্তিত্বের ভিত্তি পরিবারের ভিতরেই গড়ে উঠে: পরিবারের পরিমণ্ডলের মধ্যেই রাজনীতিক সামাজিকীকরণের সুস্পষ্ট ও প্রচ্ছন্ন প্রক্রিয়া ক্রিয়াশীল থাকে। প্রত্যেক ব্যক্তির ভবিষ্যতের অভিপ্রেত ভূমিকার বীজ পারিবারিক পরিবেশের মধ্যেই উপ্ত হয়। সুস্পষ্ট সামাজিকীকরণের প্রক্রিয়া পরিবারের সাহচর্যে কার্যকর করা হয় এবং এর প্রভাব সাধারণত সুদূরপ্রসারী হয়। ব্যক্তির বিভিন্ন মৌলিক দাবি পুরণের প্রধান উৎস হল পরিবার। পিতামাতার সঙ্গে শিশু নিজেকে একাত্ম করে। বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে শিশু পিতামাতার দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ গ্রহণ করে। এই কারণে ব্যক্তি-মানুষের রাজনীতিক ব্যক্তিত্ব গঠনের ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা হল কেন্দ্রীয়। পরিবারের মধ্যেই ব্যক্তি-মানুষের রাজনীতিক ব্যক্তিত্ব এবং রাজনীতিক কাজকর্ম ও চিন্তা-চেতনার প্রবণতার ভিত্তি রচিত হয়।

রাজনীতিক সামাজিকীকরণের প্রচ্ছন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যম হল পরিবার: রাজনীতিক সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে পরিবারের প্রচ্ছন্ন প্রক্রিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর উপর পরিবারের যৌথ কর্তৃত্ব বর্তমান থাকে। এই পারিবারিক কর্তৃত্ব প্রতিটি শিশুর কাছে বাহক হিসাবে প্রতীয়মান হয়। শিশু পরিবারের কর্তা ব্যক্তিদের প্রতি স্বভাবজাত আনুগত্য প্রদর্শন করে। এই আনুগত্যের মনোভাব পরবর্তীকালে রাজনীতিক কর্তৃত্বের প্রতি আনুগত্যের মনোভাব সৃষ্টিতে সাহায্য করে। অর্থাৎ পারিবারিক জীবনের অস্পষ্ট প্রভাবের মধ্যে কর্তৃত্বের প্রতি শিশুর মনোভাব গড়ে উঠে। আবার ছোটবেলা থেকেই শিশু পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অন্যতম অংশীদার হিসাবে প্রতিপন্ন হয়। এ ক্ষেত্রে শিশু কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন করে। এই অভিজ্ঞতা রাজনীতিক ব্যক্তিত্ব বিকাশে সাহায্য করে। পরিবারই প্রথম শিশুর সামনে বহির্বিশ্বের বাতায়ন উন্মুক্ত করে। কর্তৃত্বের সঙ্গে সম্পর্কের প্রকৃতি পরিবারের মধ্যেই শিশু প্রথম আঁচ করে। মাতা-পিতার নির্বাচনী আচরণের সঙ্গে সন্তান-সন্ততিদের নির্বাচনী আচরণের সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। এ প্রসঙ্গে বলের অভিমত বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন: “The family is the child’s first window on the world outside; it is the child’s first contact with authority; it is here that the first differences in the role expectation betw the sexes are implanted, and surveys have shown the strong link between the voting behaviour of parents and their children.” প্রকৃত প্রস্তাবে পরিবার বা পিতামাতার উপর নির্ভরশীলতার কারণে পিতামাতার রাজনীতিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করার প্রবণতা সন্তানদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। একই কারণে স্ত্রীও সাধারণত তার স্বামীর রাজনীতিক মনোভাব গ্রহণ করে।

পরিবারের ভূমিকার মধ্যে তারতম্য দেখা যায়: কিন্তু রাজনীতিক সামাজিকীকরণের ব্যাপারে পরিবারের ভূমিকা সকল ক্ষেত্রে সমান হয় না। ভৌগোলিক ও আর্থ-সাংস্কৃতিক অবস্থার পার্থক্যের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবারের ভূমিকার মধ্যে তারতম্য দেখা দেয়। পারিবারিক জীবনে অবহেলাজনিত অভাব-অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পিতা-মাতার রাজনীতিক অঙ্গীকারকে অস্বীকার করার প্রবণতা সন্তানদের মধ্যে সৃষ্টি হতে পারে। আবার রাজনীতিক বিষয়াদির প্রতি পরিবারের বিরূপ মনোভাব থাকলে সন্তানের মধ্যেও অনুরূপ অনুভূতির সৃষ্টি হতে পারে।

পরিবারের ভূমিকার সীমাবদ্ধতা: রাজনীতিক সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কেও অবহিত হওয়া আবশ্যক। (১) অনেক সময় দেখা যায় যে পরিবারের পুত্র-কন্যারা তাদের পিতা মাতার রাজনীতিক ভূমিকা বা দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে অনবহিত ও অনাগ্রহী। এ রকম ক্ষেত্রে রাজনীতিক সামাজিকীকরণের ব্যাপারে পরিবারের ভূমিকার গুরুত্ব হ্রাস পায়। (২) আবার কোন পরিবারের রাজনীতিক মনোভাব-মূল্যবোধ বা দৃষ্টিভঙ্গি সুস্পষ্ট বা সুনির্দিষ্ট নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে সন্তান-সন্ততিদের উপর পরিবারের রাজনীতিক প্রভাব না পড়ার সম্ভাবনাই বেশী। তা ছাড়া পুত্র-কন্যার উপর পিতা-মাতার রাজনীতিক মনোভাব বা অঙ্গীকারের প্রভাব সব সময় সমানভাবে পড়ে না। (৩) অপ্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় পারিবারিক সূত্রে প্রাপ্ত রাজনীতিক মনোভাব ও মূল্যবোধের সঙ্গে পরিণত বয়সে অর্জিত বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে অসঙ্গতি দেখা দিতে পারে। এ রকম ক্ষেত্রে বয়ঃপ্রাপ্তির পর ব্যক্তিবর্গের মধ্যে পূর্বতন রাজনীতিক মনোভাব ও মূল্যবোধের পরিবর্তন ঘটতে পারে। (৪) বিভিন্ন বাস্তব কারণের পরিপ্রেক্ষিতে কোন পরিবারের আর্থ সামাজিক অবস্থার মৌলিক পরিবর্তন ঘটতে পারে। পরিবারের পরিবর্তিত আর্থ-সামাজিক অবস্থার কারণে পরিবারের নতুন সদস্যদের মধ্যে পরিবারের সাবেকি রাজনীতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন নিতান্তই স্বাভাবিক। (৫) দীর্ঘকাল ধরে স্থিতিশীল রাজনীতিক ব্যবস্থায় রাজনীতিক সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা অধিকতর কার্যকর প্রতিপন্ন হয়। কিন্তু পরিবর্তনশীল রাজনীতিক ব্যবস্থায় রাজনীতিক সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে পরিবার-বহির্ভূত মাধ্যমসমূহের ভূমিকা বেশী কার্যকর প্রতীয়মান হয়। (৬) পরিণত বয়সে ব্যক্তি মানুষের রাজনীতিক জীবন বিভিন্ন বিষয়ের দ্বারা প্রভাবিত হয়। কারণ তখন মানুষ কেবলমাত্র পরিবারের উপর নির্ভরশীল থাকে না। অন্তরঙ্গ গোষ্ঠী, শিক্ষায়তন, গণ-সংযোগের মাধ্যম প্রভৃতি সংস্থা ও সংগঠনের দ্বারা ব্যক্তি মানুষের রাজনীতিক মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রভাবিত ও পরিবর্তিত হয়। এ প্রসঙ্গে বল বলেছেন: “… there are other agencies exerting influences on the child from an early age…..” (9) রাজনীতিক সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে পরিবারের প্রভাবের পরিধি ও কার্যকারিতা সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে অন্যান্য ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কের প্রকৃতির উপরও বহুলাংশে নির্ভরশীল। এ ক্ষেত্রে অন্যান্য সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের প্রভাব বা দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে পরিবারের রাজনীতিক মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির সংঘাত সৃষ্টি হতে পারে। তখন রাজনীতিক সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে পরিবারের প্রভাব ও ভূমিকার কার্যকারিতা হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। (৮) কোন পরিবারের রাজনীতিক মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি যথেষ্ট সুসংহত অবস্থায় নাও থাকতে পারে। তখন পরিবারের পুত্র-কন্যাদের রাজনীতিক মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি যে-কোন ধরনের, এমনকি পিতা-মাতার রাজনীতিক মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধীও হতে পারে। এ প্রসঙ্গে বল বলেছেন: “…it may be that the family is divided in its political attitudes, and the political values of the child may be formed in opposition to one of the parents.” (৯) আরও বলা হয় যে শিশুর বুদ্ধিমত্তা তীক্ষ্ণ হলে এবং শিক্ষাকাল দীর্ঘ হলে পারিবারিক প্রভাব অপেক্ষাকৃত হ্রাস পায়। এ প্রসঙ্গে বলের অভিমত বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি আরও বলেছেন: “…the longer the period of normal education and the higher the intelligence of the child, the smaller will be the extent parental influence.” রাজনীতিক সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা আলোচনার প্রসঙ্গে বল হাইম্যানের Political Socialisation শীর্ষক গ্রন্থের অভিমত অনুসরণ করে এক দীর্ঘ মন্তব্য করেছেন। মন্তব্যটি এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেছেন: “Political attitudes are not formed in terms of opposition to parents, however much they may differ, but parents are only one agency, and not always as influential as one would suspect, at least in terms of political values if not in terms of party allegiance.”

(২) শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

রাজনীতিক সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ: বর্তমানে রাজনীতিক জীবন থেকে শিক্ষা কোনক্রমে স্বতন্ত্র নয়। রাজনীতিকরণের প্রভাব থেকে শিক্ষা জীবন এখন আর বিচ্ছিন্ন নয়। আবার আধুনিককালের রাজনীতিক সামাজিকীকরণের প্রক্রিয়া শিক্ষা-ব্যবস্থার দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়। রাজনীতিক সামাজিকীকরণের প্রক্রিয়া অধিকতর কার্যকর হয় যদি শিক্ষা-ব্যবস্থা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্তরের ন্যায় উচ্চতম পর্যায় পর্যন্ত প্রসারিত হয়। বলের অভিমত অনুসারে বিভিন্ন স্তরের শিক্ষায়তনে প্রাপ্ত মূল্যবোধ ও প্রত্যয় সব সময় সরাসরি রাজনীতিক সামাজিকীকরণের প্রক্রিয়াকে প্রতিষ্ঠিত করে না। এতদ্‌সত্ত্বেও রাজনীতিক সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে শিক্ষা-ব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম। বল এ প্রসঙ্গে বলেছেন: “The educational system has important effect on the process of socialisation, the more so if it is extended to cover higher and university education. The values imparted by schools and universities may not be the result of direct political indoctrination, but are none theless important.” Comparative Politics শীর্ষক গ্রন্থে অ্যালমন্ড ও পাওয়েল ও অনুরূপ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তাঁদের মতানুসারে পারিবারিক ব্যবস্থার পরেই শিক্ষা ব্যবস্থা রাজনীতিক সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।

রাজনীতিক মূল্যবোধ ও মতাদর্শ গড়ে তোলা: বিদ্যালয়ে প্রবেশ করার পর শিশুর ভূমিকা বিস্তৃত হয়। শিশুর নিজস্ব যোগ্যতা ও ক্ষমতা এবং ইচ্ছা-অনিচ্ছার দ্বারা বৃহত্তর ক্ষেত্রে তার ভূমিকা নিয়ন্ত্রিত হয়। সুস্পষ্ট রাজনীতিক সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠ্যক্রম ও কাঠামো এবং প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্তের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক তাদের জীবন ও রাজনীতিক সামাজিকীকরণের উপর ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করে। সুনাগরিক গড়ে তোলার জন্য ভাল শিক্ষা-ব্যবস্থা দরকার। এই কারণে সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা ব্যবস্থাকে সরকারিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার সমর্থনসূচক মূল্যবোধ ও মনোভাব অনুকূল শিক্ষাব্যবস্থার দ্বারা শক্তিশালী হয়। শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাজনীতিক জীবনের অলিখিত রীতি-নীতি সঞ্চারিত করে। শিক্ষা-ব্যবস্থার পাঠ্যক্রমে পৌরবিদ্যা ও প্রশাসন সম্পর্কিত পাঠ্যসূচীও অন্তর্ভুক্ত থাকে। এ ধরনের পাঠ্যক্রম ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে নির্দিষ্ট ধরনের রাজনীতিক মূল্যবোধ ও মতাদর্শ গড়ে তোলে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিশেষ ধরনের রাজনীতিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের ভূমিকাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

পাঠ্যসূচীর মাধ্যমে রাজনীতিক মূল্যবোধ ও মতাদর্শ সঞ্চারিত হয়: রাজনীতিক মূল্যায়নের সামর্থ্য এবং রাজনীতিক বিষয়ে বিচক্ষণতা শিক্ষার মাধ্যমেই অর্জিত হয়। সুস্পষ্টভাবে বা প্রচ্ছন্নভাবে রাজনীতিক মূল্যবোধ ও মতাদর্শ শিক্ষার্থীদের মধ্যে সঞ্চারিত করার উদ্যোগ-আয়োজন সাধারণত সকল দেশের পাঠ্যক্রমের মধ্যে অল্পবিস্তর পরিলক্ষিত হয়। সুস্পষ্ট রাজনীতিক সামাজিকীকরণের উদ্দেশ্যে বিদ্যায়তনের মাধ্যমে কতকগুলি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়ে থাকে। স্বদেশের ইতিহাস ও জীবনধারার প্রতি শ্রদ্ধা সৃষ্টির জন্য পাঠ্যক্রমের মধ্যেই অনুকূল উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। তা ছাড়া বিভিন্ন সামাজিক বিজ্ঞানের সাহায্যে নির্দিষ্ট ধরনের রাজনীতিক মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার ব্যবস্থা করা হয়। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে সুস্পষ্ট রাজনীতিক সামাজিকীকরণের উপর জোর দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে শিক্ষাদানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী দর্শনকে সঞ্চারিত করার চেষ্টা করা হয়। উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়ও এর ব্যতিক্রম ঘটে না। এ ধরনের রাজনীতিক ব্যবস্থায় শিক্ষানীতি নির্ধারণ এবং পাঠ্যসূচী প্রণয়নের দায়িত্ব ও ক্ষমতা যাদের উপর ন্যস্ত থাকে তারা তাদের শ্রেণী-স্বার্থের অনুকূলে সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করে বা দায়িত্ব সম্পাদন করে। এ ক্ষেত্রে আলোচনা প্রসঙ্গে অধ্যাপক বল মার্কিন ও ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থার কথা দৃষ্টান্ত হিসাবে পর্যালোচনা করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাজনীতিক সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করা হয়। বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার অনুকূল রাজনীতিক মূল্যবোধ ও মনোভাব প্রসার ও প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাদি গ্রহণ করা হয়। মার্কিন শিক্ষা-ব্যবস্থা ও পাঠ্যসূচীর সঙ্গে উদারনীতিক গণতান্ত্রিক মতাদর্শ ও সংশ্লিষ্ট। মৌলিক মূল্যবোধসমূহ, প্রচলিত ন্যায়নীতির ধারণা, রাজনীতিক স্বাধীনতা ও সাম্যের আদর্শ প্রভৃতি শিক্ষার্থীদের সঞ্চারিত করার ব্যবস্থা করা হয়। আবার পূর্বতন সোভিয়েত রাশিয়ার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন যে সেখানে বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের পঠন-পাঠনের এক-পঞ্চমাংশ সময় রাজনীতিক বিষয় অধ্যয়নের জন্য ব্যয় করা হত। তা ছাড়া চূড়ান্ত পরীক্ষায় মার্কসবাদ-লেনিনবাদ সম্পর্কে ছাত্রছাত্রীদের জ্ঞান পরীক্ষা করা হত। এ প্রসঙ্গে জোহারী যথার্থই মন্তব্য করেছেন: “It is for this reason that the selection of courses comes to have an importance of its own and the politically conscious people fight for the revision of the syllabi as pertaining to their interests.”

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরোক্ষ প্রভাব: রাজনীতিক সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরোক্ষ প্রভাবের গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক ও অন্যান্য নানা বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংযোগ থাকে। এই সংযোগ ছাত্রছাত্রীদের রাজনীতিক বিচক্ষণতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। শিক্ষায়তনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া কর্তৃত্বমূলক। এই প্রক্রিয়া বিদ্যার্থীদের মধ্যে এক কর্তৃত্বসম্পন্ন মানসিকতার সৃষ্টি করে। শিক্ষার্থীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আনুষ্ঠানিক পাঠ্যসূচীর বাইরে বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশ গ্রহণ করে। তারফলে তাদের মধ্যে পরবর্তী জীবনে রাজনীতিক বিষয়ে অংশগ্রহণের এক প্রবণতার সৃষ্টি হয়। তাদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলী বিকশিত হয়। ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়মকানুন ও কর্তৃপক্ষের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে। এই অভ্যাস ও অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতে রাজনীতিক আনুগত্যের প্রবণতা সৃষ্টিতে সাহায্য করে। শিক্ষায়তনে রাজনীতিক বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা পরিচালনা ও মূল্যায়নের যোগ্যতা পরিণত বয়সে ব্যক্তিকে রাজনীতিক ক্ষেত্রে বিচক্ষণ করে তোলে। বিদ্যায়তনের মাধ্যমে রাজনীতিক সামাজিকীকরণের ফলে অনেক সময় বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থা ও মূল্যবোধের বিরোধী মানসিকতার সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন দেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এমন অনেক উদাহরণ পাওয়া যাবে। এ প্রসঙ্গে বল বলেছেন: “The effect of education on political values can be partly illustrated by the upsurgence of student radicalism in the late 1960s, especially in more industrialised countries, even through it may represent only a minority.”

বিকেন্দ্রীভূত শিক্ষাব্যবস্থার প্রভাব: বলের অভিমত অনুসারে শিক্ষা ক্ষেত্রে সরকারের হস্তক্ষেপ প্রতিরোধের ব্যাপারে বিকেন্দ্রীভূত শিক্ষাব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ। আবার বিকেন্দ্রীভূত শিক্ষা ব্যবস্থার কারণে রাজনীতিক ক্ষেত্রে উপ-সংস্কৃতির উদ্ভবের সম্ভাবনা থাকে। বল এ প্রসঙ্গে বলেছেন: “A decentralised education system may prevent government interference and may encourage and support subcultures.” মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিকেন্দ্রীভূত শিক্ষা ব্যবস্থা বর্তমান। এই কারণে শিক্ষার মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আঞ্চলিক আনুগত্যের উদ্ভব হয়েছে। বল বলেছেন: “… the states control of schools in the United States always the existence of regional loyalties, witness attitudes to racial segregation in the southern states, attitudes in which family attitudes are reinforced by the schools.”

পর্যালোচনা: পরিশেষে বলা প্রয়োজন যে, রাজনীতিক সামাজিকীকরণের মাধ্যম হিসাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রভাবের পরিধি বা প্রকৃতি যথাযথভাবে পরিমাপযোগ্য নয়। তা ছাড়া দেশ-কাল নির্বিশেষে এ বিষয়ে শিক্ষায়তনের ভূমিকা অভিন্ন প্রতিপন্ন হয় না। দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা সরকারের শিক্ষানীতি, শিক্ষায়তনের পাঠ্যসূচীর বিষয়বস্তু, শিক্ষকদের ভূমিকা প্রভৃতি বিষয়ও এক্ষেত্রে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া প্রথাবহির্ভূত শিক্ষার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংযোগ-সম্পর্কের বিষয়টিও এ ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ। এতদ্‌সত্ত্বেও এ বিষয়ে দ্বিমতের অবকাশ নেই যে রাজনীতিক সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক বলের অভিমত প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন: “However, the impact of University on political values is complex, and it may be that a University environment merely heightens political awareness without affecting basic political attitudes.” রাজনীতিক সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে পরিবার এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্যান্য মাধ্যম বাহন বর্তমান। কিন্তু এ ক্ষেত্রে অন্যান্য মাধ্যমসমূহের ভূমিকাকে অপেক্ষাকৃত অপ্রত্যক্ষ বলে মনে করা হয়। তাছাড়া আরও বলা হয় যে রাজনীতিক সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে অন্যান্য সংস্থাসমূহ পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রভাবের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। বল এ প্রসঙ্গে বলেছেন: “The other agencies of political socialisation are regarded as less direct (or measurable) and are closely interrelated to the influence of family and school.”

(৩) পেশাগত সংগঠন

পেশাগত সংগঠনের রাজনীতিক পরিচিতি ও ভূমিকা: বর্তমানে সকল দেশেই বিভিন্ন বৃত্তি বা পেশাগত ভিত্তিতে বিভিন্ন সংঘ-সংগঠনের সৃষ্টি হয়। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে শ্রমিক সংঘ, কৃষক সংগঠন, বণিক সংঘ প্রভৃতির কথা বলা যায়। এই সমস্ত পেশাগত সংগঠনগুলি সাধারণত পেশাগত স্বার্থের রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারেই বিশেষভাবে আত্মনিয়োগ করে। আধুনিককালের রাজনীতিক ব্যবস্থায় এই সমস্ত সংঘ-সংগঠনের একটা করে রাজনীতিক পরিচয়ও থাকে। সাধারণত কোন-না-কোন রাজনীতিক দলের গণ-সংগঠন হিসাবে এদের পরিচিতি প্রতীয়মান হয়। কারণ যে-কোন একটি রাজনীতিক দলের সঙ্গে পেশাগত সংঘ সংযোগ বজায় রাখে এবং সংশ্লিষ্ট তিক দলের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। তার ফলে পেশাগত সংগঠনের সদস্য সমর্থকদের মধ্যে সংশ্লিষ্ট পৃষ্ঠপোষক রাজনীতিক দলের মতাদর্শ, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি সঞ্চারিত হয়। নির্বাচনের প্রাক্কালে এই সমস্ত সংগঠন পৃষ্ঠপোষক রাজনীতিক দলের পক্ষে নির্বাচনী রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে। রাজনীতিক দলের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারকার্যে যোগ দেয়, দলীয় তহবিলে অর্থ সংগ্রহের ব্যাপারে উদ্যোগ আয়োজন গ্রহণ করে প্রভৃতি। তা ছাড়া পেশাগত সংঘ-সংগঠনগুলি পেশাগত স্বার্থ সংরক্ষণ ও প্রসারের জন্য রাজনীতিক দলের মতই ব্যাপকভাবে প্রচারকার্য পরিচালনা করে; বিক্ষোভ-আন্দোলন ও ধর্মঘটের সামিল হয় এবং সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে। পেশাগত সংঘ-সংগঠনগুলির কর্মসূচী ও কার্যপ্রক্রিয়া সদস্য-সমর্থকদের মধ্যে বিশেষ ধরনের রাজনীতিক চিন্তা-চেতনা, মূল্যবোধ ও বিশ্বাস সঞ্চারিত করে। জোহারী এ প্রসঙ্গে বলেছেন: “The job as well as the formal and informal organisation built around it, like unions and clubs may constitute the channels for the explicit communication of political information and beliefs…collective bargaining or the involvement with a strike can be a socialising experience for workers and employees alike.”

(8) গণ-মাধ্যম

প্রচ্ছন্ন ও সুস্পষ্ট রাজনীতিক সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে গণ-মাধ্যমসমূহের ভূমিকা: গণ-সংযোগের মাধ্যমগুলি আধুনিককালে রাজনীতিক সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসাবে বিবেচিত হয়। রাজনীতিক সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে এই মাধ্যমগুলি সুস্পষ্ট ও প্রচ্ছন্ন প্রক্রিয়া গ্রহণ করে থাকে। সংবাদপত্র, বেতার, চলচ্চিত্র, দূরদর্শন প্রভৃতি গণ-সংযোগের মাধ্যমসমূহ এখানকার রাজনীতিক ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। রাজনীতিক বিষয়-সম্পর্কিত বিভিন্ন ঘটনা এবং আনুষঙ্গিক ভাষ্য এই সমস্ত গণ মাধ্যমের সাহায্যে জনসাধারণের কাছে পৌঁছে যায়। তার ফলে রাজনীতিক জীবনের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। রাজনীতিক বিষয়ে তাদের চিন্তা-ভাবনার পরিধি প্রসারিত হয়। এবং এই সবের ফলশ্রুতি হিসাবে রাজনীতিক বিষয়ে জনসাধারণের আগ্রহ বৃদ্ধি পায় এবং রাজনীতিক কাজকর্মে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের প্রবণতা গড়ে উঠে। জোহারী এ প্রসঙ্গে বলেছেন: “By reading newspaper reports listening to radio-talks and seeing television-films people develop taste as well as distaste for certain norms and values.” সুস্পষ্ট রাজনীতিক সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রেও গণ মাধ্যমগুলির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কোন কোন রাজনীতিক ব্যবস্থায় গণ-সংযোগের মাধ্যমগুলি সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়। এ সমস্ত ক্ষেত্রে গণ-মাধ্যমগুলি রাজনীতিক বিষয়ে সরাসরি সরকারের মতামত, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গিকে জনসাধারণের মধ্যে প্রচার করে। আবার কোন কোন রাজনীতিক ব্যবস্থায় গণ-মাধ্যমগুলি বে সরকারি মালিকানাধীনে থাকে এবং বে-সরকারি উদ্যোগে এগুলি পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। তখন মালিক ও নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর রাজনীতিক মনোভাব-মূল্যবোধ এবং ধ্যান-ধারণা গণ-মাধ্যমের সাহায্যে জনসাধারণের কাছে পৌঁছে যায়। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা দরকার যে বিশেষ কোন স্বার্থ-গোষ্ঠীর (Interest Group) বা শ্রেণীর প্রভাবাধীন অথবা পুরোপুরি রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকলে গণ-মাধ্যমগুলি জনসাধারণের রাজনীতিক সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে সঠিক ও স্বাধীন ভূমিকা পালন করতে পারে না। যাইহোক্ এ প্রসঙ্গে বলের অভিমত প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন: “The mass media, whether directly controlled by the government or not, tend to reinforce existing political values and this aspect also highlights a negative weapon of the government, that of political censorship.”

(৫) রাজনীতিক দল

রাজনীতিক জীবনের সঙ্গে সংযুক্ত করে: বর্তমানে রাজনীতিক ব্যবস্থার একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল রাজনীতিক দল। রাজনীতিক সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে এই রাজনীতিক দলের ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বহুসংখ্যক মানুষকে রাজনীতিক দল রাজনীতিক জীবনের বহুমুখী কার্যাবলীর সঙ্গে যুক্ত করে। রাজনীতিক জীবনের সঙ্গে সংযুক্ত করার অর্থ হল রাজনীতিক সংযোগসাধন ও বিভিন্ন রাজনীতিক কাজকর্মে অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করা। রাজনীতিক দলের এই ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এর ফলে জনসাধারণের রাজনীতিক সচেতনতা সম্প্রসারিত হয়, রাজনীতিক মূল্যবোধ ও মনোভাব সুদৃঢ় হয় এবং নতুন রাজনীতিক বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গির সৃষ্টি হয়। রাজনীতিক সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে রাজনীতিক দলের ভূমিকা প্রচলিত রাজনীতিক সংস্কৃতির কাঠামোকে অব্যাহত রাখার অনুপন্থী হতে পারে। আবার রাজনীতিক দল সমকালীন রাজনীতিক সংস্কৃতির ধারায় আমূল পরিবর্তনের ব্যাপারে উদ্যোগী হতে পারে। রাজনীতিক সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে রাজনীতিক দলের ভূমিকা বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার স্থিতাবস্থার সহায়ক হবে, নাকি পরিবর্তনকামী হবে তা বহুলাংশে নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট রাজনীতিক দলের আর্থ-সামাজিক, রাজনীতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও কার্যক্রম এবং বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার সঙ্গে সংযোগ ও সম্পর্কের উপর। বহু-দলীয় রাজনীতিক ব্যবস্থায় বহুমুখী রাজনীতিক সংস্কৃতির সৃষ্টি ও সংরক্ষণের প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। কোন দেশের রাজনীতিক দলগুলি যদি বিভিন্ন মতাদর্শ ও মূল্যবোধের দ্বারা পরিচালিত হয়, তাহলে বহুমুখী রাজনীতিক সংস্কৃতি সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

রাজনীতিক সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে দলের বহুমুখী ভূমিকা: প্রত্যেক রাজনীতিক দলের সুনির্দিষ্ট রাজনীতিক মতাদর্শ, লক্ষ্য ও কর্মসূচী থাকে। রাজনীতিক কাজকর্মে বৈধতার মাপকাঠি, নাগরিকদের রাজনীতিক আচার-আচরণের মানদণ্ড প্রভৃতি বিষয়ে প্রত্যেক রাজনীতিক দলের নিজস্ব মূল্যবোধ ও মতাদর্শ থাকে। তদনুসারে সংশ্লিষ্ট রাজনীতিক দল বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থা ও রাজনীতিক সংস্কৃতির প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি নির্ধারণ করে। রাজনীতিক দল দৈনন্দিন জীবনে জনসাধারণকে রাজনীতিক বিষয়াদি, ধ্যান-ধারণা, সমস্যা ও অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিচিত করে। তারফলে রাজনীতিক বিষয়ে জনগণের জ্ঞান বৃদ্ধি পায়, সচেতনতা সম্প্রসারিত হয় এবং বৌদ্ধিক বিকাশ ঘটে। বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার সমস্যাদি মূল্যায়নের ক্ষেত্রে রাজনীতিক দল জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতার সৃষ্টি করে। আবার রাজনীতিক দল জনগণের মধ্যে রাজনীতিক কাজকর্মে অংশগ্রহণের ব্যাপারে আগ্রহের সৃষ্টি করে। এবং এই অংশগ্রহণ সূত্রে, জনগণের মধ্যে আনুগত্যের সৃষ্টি হয়। রাজনীতিক দল অনেক সময় অসামান্য ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এবং বিশেষভাবে প্রভাবশালী কোন নেতার মাধ্যমে দেশবাসীর উপর মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব কায়েম করার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়। রাজনীতিক দল এই পথে জনসাধারণের মধ্যে দলীন মতাদর্শ, মূল্যবোধ, বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গিকে সঞ্চারিত করতে সচেষ্ট হয়। রাজনীতিক সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে রাজনীতিক দলের ভূমিকা প্রসঙ্গে বলের অভিমত বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন: “Political parties are more diffuse because of their need to win wider support.”

(৬) অন্তরঙ্গ গোষ্ঠী

ব্যক্তির রাজনীতিক জীবনকে প্রভাবিত করে: আধুনিককালে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় বিকাশ ঘটেছে। সঙ্গে সঙ্গে শিল্পায়ন, নগরায়ন ও আধুনিকীকরণের ফলে সাবেকি সমাজব্যবস্থা ও জীবনধারার পরিবর্তন ঘটেছে। বর্তমানে ব্যক্তি জীবনের প্রয়োজন বিবিধ ও বিচিত্র এবং সমস্যাও বহু ও বিভিন্ন। এই কারণে এখন ব্যক্তিকে তার প্রয়োজন পূরণ ও সমস্যাদির সমাধানের জন্য অন্তরঙ্গ গোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত হতে হয় এবং তার সাহায্য গ্রহণ করতে হয়। সমপর্যায়ভুক্ত ব্যক্তিবর্গের গোষ্ঠীকেই অন্তরঙ্গ গোষ্ঠী বলা হয়। আধুনিক সমাজে এ রকম অন্তরঙ্গ গোষ্ঠী আনুষ্ঠানিকভাবে বা অ-আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হতে দেখা যায়। এই গোষ্ঠীগুলি ব্যক্তি মানুষের রাজনীতিক জীবনকে প্রভাবিত করে এবং রাজনীতিক সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অন্তরঙ্গ বন্ধু-বান্ধবের রাজনীতি বিষয়ক মনোভাব ও মতামত সমবয়স্কদের রাজনীতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রভাবিত করে। গোষ্ঠীগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সদস্য ব্যক্তিরা অংশীদার হয়। তারফলে তাদের মধ্যে যে রাজনীতিক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়, তা রাজনীতিক দক্ষতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। ব্যক্তি-মানুষের রাজনীতিক চিন্তা-চেতনা, মূল্যবোধ ও মতাদর্শকে বিকশিত করার ক্ষেত্রে অন্তরঙ্গ গোষ্ঠীর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। জোহারীর অভিমত অনুসারে, “Martin Levy has found a tendency for individuals to adopt the majority group within the peer groups.” অন্তরঙ্গ গোষ্ঠীসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের মধ্যে বিরোধিতার মনোভাব সৃষ্টি করতে পারে, আবার তার পরিবর্তনের প্রবণতাও সৃষ্টি করতে পারে। সমবয়স্কদের সম্পর্ক হল সমতার সম্পর্ক। এই সম্পর্ক হল আদান-প্রদানের সম্পর্ক। অন্তরঙ্গ গোষ্ঠীর সম্পর্কের মাধ্যমে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানুষ অনেক কিছু আয়ত্ত করতে পারে। এই কারণে রাজনীতিক সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে অন্তরঙ্গ গোষ্ঠীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তবে সাধারণত শিল্পোন্নত সমাজেই এই সমস্ত গোষ্ঠীর রাজনীতিক ক্ষেত্রে ভূমিকা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ।

(৭) ধর্মীয় সংগঠন

ধর্মীয় চেতনা রাজনীতিক সামাজিকীকরণকে প্রভাবিত করে: রাজনীতিক সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে ধর্মের ভূমিকাকেও একেবারে অস্বীকার করা যায় না। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলি এ ক্ষেত্রে অল্পবিস্তর অর্থবহ ভূমিকা গ্রহণ করে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানসমূহ ব্যক্তি মানুষের জীবনধারাকে প্রভাবিত করে। বস্তুত মানবসমাজে ধর্মের ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তিমানুষের বিভিন্ন ধারণা, বিশ্বাস, মূল্যবোধ প্রভৃতির উপর ধর্মের প্রভাবকে অস্বীকার করা যায় না। রাজনীতিক ক্ষেত্রে বিশ্বাস, মূল্যবোধ, মনোভাব প্রভৃতি ধর্মীয় বিচার-বিবেচনার দ্বারা প্রভাবিত হয়। তবে আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ ধ্যান-ধারণার বিকাশের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিক সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে ধর্মের ভূমিকা হ্রাস পেয়েছে। তবে এখনও কোন কোন দেশে মহিলাদের রাজনীতিক আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ধর্মের ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায় না। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্র ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে রোমান ক্যাথলিক ধ্যান-ধারণার বিরোধের অস্তিত্ব অনস্বীকার্য। এ প্রসঙ্গে বলের অভিমত বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন: “Perhaps the most important socialising agency in this voluntary category is the church. Its effect of political attitudes is less apparent when it reinforces other socialising agencies, but the role of Roman Catholicism in many European countries, liberal democratic and socialist, offers illustrations of its conflict with both state and education, and is possibly a vital factor in the political behaviour of women in some countries.”

মূল্যায়ন: রাজনীতিক সামাজিকীকরণ সম্পর্কিত আলোচনার মূল্যায়ন প্রসঙ্গে কতকগুলি বিষয় সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত হওয়া আবশ্যক। এ ক্ষেত্রে বিষয়গুলি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। 

(১) উপরিউক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্টত প্রতিপন্ন হয় যে রাজনীতিক সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে বহু ও বিভিন্ন উপায় বা মাধ্যম বর্তমান। এই মাধ্যমগুলি পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। এদের মধ্যে পারস্পরিক সংযোগ এবং পারস্পরিক প্রভাব-প্রতিক্রিয়া বর্তমান। বল বলেছেন: “We have seen that manifest sociali sation may be the result of several socialising agencies, and that inter-relationships are important.” এই কারণে রাজনীতিক সামাজিকীকরণের উপাদানগুলিকে বিচ্ছিন্নভাবে আলোচনা করা অসম্ভব।

(২) রাজনীতিক সামাজিকীকরণের মাধ্যমসমূহের কার্যকারিতা ভৌগোলিক ও সামাজিক সচলতার উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। ভৌগোলিক সচলতার পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিক বিষয়ের আলাপ-আলোচনায় যোগদানের বা রাজনীতিক কাজকর্মে অংশগ্রহণের প্রবণতার হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটায়। আবার ঊর্ধ্বমুখী বা অধোমুখী উন্নস্বী সামাজিক সচলতার ( upward or downward vertical social mobility) জন্যও ব্যক্তি-মানুষের রাজনীতিক মূল্যবোধ, মতাদর্শ ও মনোভাবের পরিবর্তন ঘটতে পারে এবং ঘটে।

(৩) রাজনীতিক সামাজিকীকরণ হল একটি নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া স্থিতিশীল নয়, গতিশীল। বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা বহুলাংশে রাজনীতিক সামাজিকীকরণের প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। বল বলেছেন: “Political socialisation is a continuous process and as such is not completely static. The test for a stable Political system is whether the socialising agencies are sufficiently flexible and interdependent to allow change without violent disruption.” অনেক সময় রাজনীতিক সামাজিকীকরণের পন্থা-পদ্ধতিসমূহের মধ্যে গভীর ও ধারাবাহিক যোগসূত্র থাকে না। তখন রাজনীতিক ব্যবস্থায় বিরোধ ও অসন্তোষ দেখা দেয়। রাজনীতিক ক্ষেত্রে স্থিতাবস্থার কারণে স্থিতিশীলতা বিপন্ন হয় এবং পরিবর্তনের পরিস্থিতি প্রতীয়মান হয়। বিপরীতক্রমে রাজনীতিক সামাজিকীকরণের উপায়-মাধ্যমগুলি যদি নমনীয় হয় এবং পারস্পরিক যোগসূত্রের ধারাবাহিকতা বজায় থাকে, তাহলে বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা নিরাপদ ও নিশ্চিত হয়। কারণ, তখন পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রয়োজনে শান্তিপূর্ণ পথে প্রয়োজনীয় এবং সামঞ্জস্যমূলক পরিবর্তন সাধন সম্ভব হয়। মানবসমাজ হিংসাত্মক ঘটনাবলীর আশংকা থেকে মুক্ত হয়।

(৪) রাজনীতিক সামাজিকীকরণ কোন একটি বিশেষ বা একক প্রণালী নয়। এ হল একাধিক প্রণালীর এক সমন্বিত কার্যক্রম। রাজনীতিক সামাজিকীকরণের প্রণালীগুলি একত্রে কার্যকর হয়। তবে ক্ষেত্রবিশেষে তাদের মধ্যে অসামঞ্জস্য বা অসঙ্গতি দেখা দিতে পারে। তখন তাদের মধ্যে পারস্পরিক বিরোধ দেখা দিতে পারে এবং এ রকম ক্ষেত্রে ব্যক্তিবর্গ যে যার নিজেদের মত করে রাজনীতিক সামাজিকীকরণের পন্থা পদ্ধতির মধ্যে বিরোধ দূরীকরণের ব্যাপারে উদ্যোগী হয়; অর্থাৎ তাদের মধ্যে পারস্পরিক অসঙ্গতির অবসান ঘটিয়ে সামঞ্জস্য সাধনের চেষ্টা করে। তবে সামগ্রিক বিচারে রাজনীতিক সামাজিকীকরণের উপায়-পদ্ধতিগুলি সাধারণত পরস্পরের পরিপূরক হিসাবেই ভূমিকা পালন করে থাকে। পরিশেষে বলের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন: “Some processes of socialisation are more homogeneous, and the various agencies will complement each other rather than conflict; yet this does not preclude change, nor does it stifle variety.”