রাজনীতিক সামাজিকীকরণ আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়:

যে-কোন দেশের বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার সপক্ষে দেশবাসীর মধ্যে সমর্থনসূচক মনোভাব, মূল্যবোধ, বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি করা দরকার। তা না হলে রাজনীতিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা বিপন্ন হওয়ার আশংকা থাকে। অর্থাৎ যে-কোন রাজনীতিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা ও সাফল্যের স্বার্থে নাগরিকদের মধ্যে সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থার অনুকূলে বিশ্বাস ও চিন্তাধারা গড়ে তোলা আবশ্যক। এর পরিবর্তে নাগরিকদের মধ্যে যদি প্রতিরোধের মনোভাব বা সক্রিয় বিরোধিতার মানসিকতা থাকে, তা হলে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কোন রাজনীতিক ব্যবস্থার দীর্ঘস্থায়ী বা সফল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। এ প্রসঙ্গে সিজেল (Robert Sigel) তাঁর Assumptions About the Learning of Political Values শীর্ষক রচনায় বলেছেন: “… without a body-politics so in harmony with the ongoing political values and the political system would have trouble functioning smoothly and perpetuating itself safely.” সেইজন্য বলা হয় যে রাজনীতিক সামাজিকীকরণের উপর বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার স্থায়িত্ব ও সাফল্য বহুলাংশে নির্ভরশীল। এবং এই কারণের জন্যই আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় রাজনীতিক সামাজিকীকরণের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে রাজনীতিক সামাজিকীকরণের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কিত আলোচনার পটভূমি হিসাবে বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা, ক্রমবিকাশ ও পরিবর্তনের কথা বলা হয়।

রাজনীতিক সামাজিকীকরণ সম্পর্কিত আলোচনার ঐতিহাসিক পটভূমি:

এতদসত্ত্বেও রাজনীতিক সামাজিকীকরণ একেবারেই কোন আধুনিক বিষয় নয়। প্রাচীনকালের রাষ্ট্রনৈতিক আলোচনায়ও রাজনীতিক সামাজিকীকরণ সম্পর্কিত বিষয়াদির অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। তবে প্রত্যক্ষভাবে নয়, পরোক্ষভাবেই এই সমস্ত বিষয় প্রাচীন রাজনীতিক দর্শনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রাচীন গ্রীক পণ্ডিত প্লেটো-অ্যারিস্টটলের রাষ্ট্রচিন্তায় রাজনীতিক সামাজিকীকরণের বিষয়ে উল্লেখ আছে। প্লেটো নাগরিকদের মধ্যে বিশেষ ধরনের সামাজিক ও রাজনীতিক মূল্যবোধ গড়ে তোলার কথা বলেছেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি উপায় হিসাবে অনুকূল পারিবারিক জীবনধারা এবং রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত সহায়ক শিক্ষাব্যবস্থার উপর জোর দিয়েছেন। পরবর্তীকালে অ্যারিস্টটল সংবিধান-ব্যবস্থা সংরক্ষণের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি সংবিধানের উদ্দেশ্য ও বক্তব্য সম্পর্কে নাগরিকদের শিক্ষিত করে তোলার কথা বলেছেন। নাগরিকদের মধ্যে সমর্থনসূচক রাজনীতিক মূল্যবোধ সঞ্চারিত করার কথা মধ্যযুগের রাষ্ট্রদর্শনে দেখা যায়। পরবর্তীকালের রাষ্ট্রচিন্তায়ও এই ধারা অব্যাহত আছে। ঐতিহ্যবাদী গণতন্ত্রী, সাম্যবাদী, নাৎসিবাদী, ফ্যাসিবাদী নির্বিশেষে সকলেই নাগরিকদের মধ্যে নিজেদের রাজনীতিক মতাদর্শের পক্ষে অনুকূল রাজনীতিক মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার উপর জোর দেন। অর্থাৎ আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তায়ও রাজনীতিক সামাজিকীকরণ সম্পর্কিত আলোচনার অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকের আগে ‘রাজনীতিক সামাজিকীকরণ’ কথাটির ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়নি। এই সময় থেকেই এ বিষয়ে প্রত্যক্ষ আলোচনা বিশেষ গুরুত্ব লাভ করেছে। এই সময় চার্লস মেরিয়াম বিষয়টির আলোচনার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। এবং এর পর থেকেই আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় রাজনীতিক সামাজিকীকরণ একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসাবে প্রতীয়মান হয়।


রাজনীতিক সামাজিকীকরণের ধারণা

সামাজিকীকরণের ধারণা: সামাজিকীকরণ হল একটি বিশেষ প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যক্তি সমাজের সঙ্গে একাত্ম হয়। নবজাতক সামাজিক জীব হয়েই জন্মগ্রহণ করে না। জন্মগ্রহণের পর জাতক কালক্রমে সামাজিক জীবনের যাবতীয় মূল্যবোধ, রীতিনীতি, আচরণবিধি, এক কথায় সামাজিক জীবনধারা আয়ত্ত করে। সামাজিক জীবনধারার সঙ্গে জাতক ধীরে ধীরে পরিচিত হয়। এই ভাবে জাতক সমাজবদ্ধ হয় বা সামাজিক জীবে পরিণত হয়। যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এটা সম্ভব হয় তাকে সামাজিকীকরণ বলে। যে-কোন সমাজই তার স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে চায়। এই উদ্দেশ্যে সমাজের মূল্যবোধ, রীতিনীতি, আচরণবিধি ও কার্যকলাপের সঙ্গে ব্যক্তিকে একাত্ম করতে বা সামাজিক জীবনধারায় ব্যক্তিকে দীক্ষিত করতে যে প্রক্রিয়া কার্যকর হয়, তাকেই সামাজিকীকরণ বলে। সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সমাজের চিন্তা-চেতনা, মূল্যবোধ, ভাবধারা, রীতিনীতি, আচরণবিধি প্রভৃতি ব্যক্তির মধ্যে সঞ্চারিত হয়। সামাজিকীকরণের প্রণালীতে সমাজের প্রচলিত প্রথা, রীতিনীতি, মূল্যবোধ, সংক্ষেপে সমগ্র সমাজের সঙ্গে সামঞ্জস্য সাধনের পন্থা সম্পর্কে ব্যক্তি মানুষ অভিজ্ঞতা অর্জন করে। এবং এইভাবে সমাজব্যবস্থার সঙ্গে ব্যক্তি সঙ্গতি সাধনে সক্ষম হয়। সামাজিকীকরণের পদ্ধতির মাধ্যমেই মানুষ ‘সামাজিক জীব’-এ পরিণত হয়। ডেভিসের অভিমত অনুসারে মানবশিশু যে পদ্ধতিতে ক্রমশ সামাজিক মানুষে পরিণত হয় তাকেই বলে সামাজিকীকরণ।

সামাজিকীকরণের সংজ্ঞা: প্রকৃত প্রস্তাবে মানুষের সামাজিক প্রকৃতির উন্মেষের উপায়কে সামাজিকীকরণ বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ সামাজিকীকরণ হল সামাজিক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে ব্যক্তি মানুষের সামাজিক প্রবৃত্তির বিকাশসাধন সম্ভব হয়। সামাজিকীকরণের মাধ্যমে নবজাতক প্রথমে মানব প্রকৃতি এবং কালক্রমে সামাজিক প্রকৃতির অধিকারী হয়। Hand book of Social Psychology শীর্ষক গ্রন্থে কিম্বাল ইয়ং বলেছেন: “Socialization will mean the process of inducting the individual into the social and cultural world; of making him a participant member in society and its various groups and inducing him to accept the norms and values to the society…. Socialization is definitely a matter of learning and not a biological inheritance.”

রাজনীতিক সামাজিকীকরণ: সুতরাং সামাজিকীকরণ হল শিক্ষা গ্রহণের একটি পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া। রাজনীতিক দিক থেকে এই প্রক্রিয়াকে রাজনীতিক দীক্ষিতকরণের প্রক্রিয়া হিসাবেও দেখা যায়। তখন রাজনীতিক সামাজিকীকরণের কথা এসে যায়। রাজনীতিক সামাজিকীকরণ হল বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার সহায়ক শিক্ষা গ্রহণের প্রক্রিয়া বা অনুকূল মূল্যবোধ সঞ্চারের পদ্ধতি। অর্থাৎ বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার অনুকূল মনোভাব, মূল্যবোধ ও মতাদর্শে নবজাতককে শিক্ষিত ও দীক্ষিত করার প্রক্রিয়াই হল রাজনীতিক সামাজিকীকরণ। রাজনীতিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা সংরক্ষণের স্বার্থে জনসাধারণের মনে বিদ্যমান ব্যবস্থার অনুকূল মূল্যবোধ ও চিন্তাধারা সঞ্চারিত করা একান্তভাবে অপরিহার্য। এবং এ ক্ষেত্রে রাজনীতিক সামাজিকীকরণই হল একমাত্র উপায়। এই উপায়ের মাধ্যমে নির্দিষ্ট কতকগুলি মূল্যবোধ ও রাজনীতিক দৃষ্টিভঙ্গি সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের মধ্যে সঞ্চারিত করা যায় বা সঞ্চারিত করা হয়। অ্যালান বল তাঁর Modern Politics and Government শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “Political socialisation is the establishment and development of attitudes to and beliefs about the political system.” অর্থাৎ বলের মতানুসারে বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার প্রতি মনোভাব এবং রাজনীতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা ও প্রসারিত করাই হল রাজনীতিক সামাজিকীকরণ। বলের অভিমত অনুসারে সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জাতির প্রতি আনুগত্য উজ্জীবিত হতে পারে এবং বিশেষ মূল্যবোধকে বিকশিত করতে পারে। এই প্রক্রিয়া রাজনীতিক ব্যবস্থার প্রতি সমর্থনকে বৃদ্ধি করতে পারে অথবা রাজনীতিক ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্নতাকে বাড়াতে পারে। অর্থাৎ রাজনীতিক সামাজিকীকরণের মাধ্যমে নাগরিকদের মধ্যে যে রাজনীতিক মূল্যবোধ ও বিশ্বাস সঞ্চারিত করা হয় তা বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার অনুকূল হতে পারে, আবার প্রতিকূলও হতে পারে। সুতরাং সঙ্গতভাবেই বলা যায় যে রাজনীতিক সামাজিকীকরণ হল রাজনীতিক সংস্কৃতিকে সঞ্চারিত করার, সংরক্ষণের বা পরিবর্তনের এক বিশেষ প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি। বল বলেছেন: “It is particularly important in the degree of participation in political life that is expected of groups and individuals.” রাজনীতিক সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার সাহায্যে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে রাজনীতিক মূল্যবোধকে সঞ্চারিত করা হয়।

অ্যালমন্ড ও পাওয়েল এবং সিজেল: অ্যালমন্ড ও পাওয়েল তাঁদের Comparative Politics শীর্ষক গ্রন্থে রাজনীতিক সামাজিকীকরণ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। এই দুই আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর অভিমত অনুসারে রাজনীতিক সামাজিকীকরণ হল একটি বিশেষ পদ্ধতি। এই পদ্ধতির মাধ্যমে রাজনীতিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও পরিবর্তন সাধন সম্ভব হয়। রাজনীতিক সামাজিকীকরণের সাহায্যে রাজনীতিক ব্যবস্থার সদস্যদের মধ্যে রাজনীতিক সংস্কৃতিকে সঞ্চারিত করা হয়। এই পদ্ধতির মাধ্যমে রাজনীতিক বিষয়ে তাদের বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা হয়। আবার রাজনীতিক সংস্কৃতির ধরন বা প্রকৃতির পরিবর্তনও করা হয় রাজনীতিক সামাজিকীকরণের মাধ্যমে। অ্যালমন্ড ও পাওয়েল বলেছেন: “Political Socialisation is the process by which political culture are maintained and changed…individuals are inducted into the political culture, their orientations towards political objects are formed.” এ প্রসঙ্গে জোহারীর অভিমতও প্রণিধানযোগ্য। তিনি যথার্থই বলেছেন: “…it refers to the learning process by which norms and behaviour acceptable to a well running political system are transmitted from one generation to another.” সিজেলও তাঁর Assumptions About the Learning of Political Values শীর্ষক রচনায় বলেছেন: “Political socialisation refers to the learning process by which the political norms and behaviour acceptable to an ongoing political system are transmitted from generation to generation.” সিজেলের অভিমত অনুসারে রাজনীতিক সামাজিকীকরণ হল বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থায় স্বীকৃতি ও অনুসৃত রীতি-নীতি, মনোভাব ও আচার-আচরণ ক্রমশ রপ্ত করার জন্য শিক্ষা গ্রহণের পদ্ধতি। সিজেল বলেছেন: “The goal of political socialisation is to so train or develop individuals that they become well functioning members of the political society.” রাজনীতিক সামাজিকীকরণের মাধ্যমে যে মনোবৃত্তি ও মূল্যবোধের সৃষ্টি হয় তা দেশের বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থাকে স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল গতিসম্পন্ন করে তোলে।

ডেভিড ইস্টন: ইস্টন ও ডেনিস তাঁদের The Child’s Image of Government শীর্ষক রচনায় রাজনীতিক সামাজিকীকরণ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। উল্লিখিত রচনাটি প্রকাশিত হয়েছে ওয়েলস ও কুমার কর্তৃক সম্পাদিত Public Opinion Its Formation and Measurement and Impact শীর্ষক গ্রন্থে। এই দুই সাম্প্রতিককালের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর অভিমত অনুসারে রাজনীতিক সামাজিকীকরণ হল একটি বিশেষ পথ। এই পথে সমাজ তার রাজনীতিক জ্ঞান, মনোভাব, রীতিনীতি ও মূল্যবোধকে এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্মে প্রবাহিত করে। অর্থাৎ রাজনীতিক সামাজিকীকরণ হল একটি বিশেষ পদ্ধতি। এই পদ্ধতির মাধ্যমে শিশুর প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পথে বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার মূল্যবোধ ও মনোবৃত্তিকে জাগ্রত করা যায়। আবার এই পদ্ধতির মাধ্যমে প্রাপ্তবয়স্কদের বিভিন্ন রাজনীতিক ভূমিকার উপযোগী করে গড়ে তোলা সম্ভব। রাজনীতিক সামাজিকীকরণ হল এমন এক বিশেষ ব্যবস্থা যার মাধ্যমে রাজনীতিক মনোভাব, মূল্যবোধ, বিশ্বাস, আচার-আচরণ প্রভৃতি রাজনীতিক জীবনধারার উপাদানসমূহ এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্মে প্রবাহিত করা হয়।

এস. এল. ওয়াসবি: ওয়াসবি তাঁর Political Science: The Discipline and Its Dimensions শীর্ষক গ্রন্থে রাজনীতিক সামাজিকীকরণ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। ওয়াসবির অভিমত অনুসারে নাগরিকরা বিভিন্ন রাজনীতিক কাজকর্মে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের প্রাক্কালে বা তার আগে যে পদ্ধতিতে রাজনীতিক মূল্যবোধ অর্জন করে তাকে রাজনীতিক সামাজিকীকরণ বলে। ওয়াসবি বলেছেন: “The subject-matter of this area is the process by which people acquire political values, not simply during active political participation, but also in the period before they engage in any explicitly political activity…the process by which political values-not only political party preference but also such other items as political interests and opinions-were transferred from one generation to the next.” রাজনীতিক সামাজিকীকরণের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাজনীতিক মূল্যবোধ, রাজনীতিক স্বার্থ ও মতামত এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত হয়।

নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া: বল-এর অভিমত অনুসারে রাজনীতিক সামাজিকীকরণ হল একটি নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া বা অবিরাম পদ্ধতি। ব্যক্তির সারা জীবন জুড়ে এই প্রক্রিয়া প্রবাহিত থাকে। কেবলমাত্র শৈশবের কয়েকটি বছরের মধ্যেই রাজনীতিক সামাজিকীকরণের প্রক্রিয়া সীমাবদ্ধ থাকে না। প্রাপ্তবয়স্কদের জীবনব্যাপীও এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে। বল বলেছেন: “Political socialisation is not a process continued to the impressionable years of childhood, but one that continues throughout adult life.” রাজনীতিক সামাজিকীকরণ শিশু বয়স থেকে শুরু করে বার্ধক্য পর্যন্ত বিভিন্নভাবে চলতে থাকে। ব্যক্তিজীবনের কোন একটি নির্দিষ্ট অধ্যায়ে এই প্রক্রিয়া কেন্দ্রীভূত বা সীমাবদ্ধ থাকে না। ব্যক্তিজীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ভূমিকার মাধ্যমে রাজনীতিক সামাজিকীকরণের প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে। সামাজিক অভিজ্ঞতার আলোকে কখনো তা পরিবর্তিত হয়। আবার কখনও তা শক্তিশালী হয়। শৈশবে বা কৈশোরে রাজনীতিক মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠে। সমগ্র জীবনব্যাপী তা অব্যাহত বা অপরিবর্তিত থাকতে পারে, আবার পরিবর্তিতও হতে পারে। পরিবর্তিত অভিজ্ঞতা ও পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে ব্যক্তির আগেকার রাজনীতিক দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ, বিশ্বাস প্রভৃতির মৌলিক পরিবর্তন ঘটতে পারে। এই কারণে বলা হয় যে রাজনীতিক সামাজিকীকরণের প্রক্রিয়া হল এক নিত্য প্রবহমান প্রক্রিয়া। ভারমা বলেছেন: “Since the Individual is continually been influenced in the shaping of his political attitudes, orientations and values, the process of socialisation goes throughout his life.”


রাজনীতিক সামাজিকীকরণের প্রকারভেদ

সংকীর্ণ ও ব্যাপক অর্থে রাজনীতিক সামাজিকীকরণ:

রাজনীতিক সামাজিকীকরণ সর্বাবস্থায় অভিন্ন প্রকৃতির হয় না। অর্থাৎ রাজনীতিক সামাজিকীকরণের প্রক্রিয়া সকল ক্ষেত্রে এক রকমের নয়। আবার রাজনীতিক সামাজিকীকরণের প্রকারভেদ প্রসঙ্গেও মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। অনেকের অভিমত অনুসারে রাজনীতিক সামাজিকীকরণ সংকীর্ণ ও ব্যাপক। অর্থাৎ সংকীর্ণ অর্থে বা ব্যাপক অর্থে এই ধারণাটিকে ব্যবহার করা যায়। অনেক সময় সুপরিকল্পিত ও সচেতনভাবে বিশেষ কোন রাজনীতিক মূল্যবোধ, বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রাতিষ্ঠানিক উপায়ে ব্যক্তিবর্গের মধ্যে সঞ্চারিত করা হয়। এ রকম ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় রাজনীতিক তথ্যাদি ও কার্যধারা সম্পর্কে ব্যক্তি মানুষকে আনুষ্ঠানিকভাবে অবহিত করা হয়। এই প্রক্রিয়াকে সংকীর্ণ অর্থে রাজনীতিক সামাজিকীকরণ বলা হয়। তবে রাজনীতিক সামাজিকীকরণ কথাটি ব্যাপক অর্থেই ব্যবহার করা হয়। রাজনীতিক সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে সুপরিকল্পিত-অপরিকল্পিত, প্রাতিষ্ঠানিক অ-প্রাতিষ্ঠানিক, সরকারী-বেসরকারী প্রভৃতি যাবতীয় উদ্যোগ আয়োজন ব্যাপক অর্থে সামাজিকীকরণের অন্তর্ভুক্ত। মানুষ সমগ্র জীবনব্যাপী শিক্ষা গ্রহণ করে। এর মধ্যে রাজনীতিক আচরণ নিয়ন্ত্রণকারী অ-রাজনীতিক শিক্ষাও আছে। শিক্ষাও ব্যাপক অর্থে রাজনীতিক সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত। গ্রীনস্টেইন (Fred Greenstein) এইভাবে সংকীর্ণ ও ব্যাপক অর্থে রাজনীতিক সামাজিকীকরণ কথাটি ব্যবহার করার কথা বলেছেন।

সুস্পষ্ট ও প্রচ্ছন্ন রাজনীতিক সামাজিকীকরণ:

আবার প্রকৃতিগত বিচার-বিবেচনার পরিপ্রেক্ষিতে সুস্পষ্ট ও প্রচ্ছন্ন এই দু’ধরনের রাজনীতিক সামাজিকীকরণের কথা বলা হয়। রাজনীতিক বিষয়াদি সম্পর্কে বিশেষ মূল্যবোধ, মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রত্যক্ষভাবে সঞ্চারিত করার প্রক্রিয়া হল রাজনীতিক সামাজিকীকরণের সুস্পষ্ট ধরন (Manifest Political Socialisation)। বিভিন্ন রাজনীতিক দল ও তাদের শাখাসংগঠনসমূহ জনসাধারণের মধ্যে নির্দিষ্ট ধরনের রাজনীতিক দৃষ্টিভঙ্গি, মতাদর্শ ও অনুভূতি সঞ্চারিত করার চেষ্টা করে। আবার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতি বা পৌরনীতি সম্পর্কিত পাঠ্যক্রমের উপর পাঠ দেওয়া হয়। এভাবেও বিদ্যার্থীদের মধ্যে রাজনীতিক মতাদর্শ সরাসরি সরবরাহ করা হয়। এ হল সুস্পষ্ট রাজনীতিক সামাজিকী করণের উদাহরণ। রাজনীতিক সামাজিকীকরণ প্রচ্ছন্ন ধরনেরও (Latent Political Socialization) হতে পারে। অ-রাজনীতিক মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে ব্যক্তির মধ্যে রাজনীতিক বিষয়ে মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা যায়। অর্থাৎ অ-রাজনীতিক মনোভাব ও মূল্যবোধের সঞ্চার যখন বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলে তাকে প্রচ্ছন্ন রাজনীতিক সামাজিকীকরণ বলে। প্রচ্ছন্ন রাজনীতিক সামাজিকীকরণের প্রক্রিয়ায় পরোক্ষভাবে রাজনীতিক মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি সঞ্চারিত করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতিক বিশ্বাস ও মূল্যবোধ সঞ্চারিত করা হয় না। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে কোন রাজনীতিক বক্তব্য সরাসরি সংযুক্ত থাকে না। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যে মনোভাব ও অনুভূতি সঞ্চারিত হয় পরবর্তী কালে তা রাজনীতিক ব্যবস্থা সম্পর্কিত মূল্যবোধ, বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রভাবিত করে। সাধারণত সংস্কৃতির বিভিন্ন মৌলিক বৈশিষ্ট্য প্রচ্ছন্ন রাজনীতিক সামাজিকীকরণের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। এই সমস্ত বৈশিষ্ট্য রাজনীতিক সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করতে পারে। প্রচ্ছন্ন রাজনীতিক সামাজিকীকরণের উদাহরণ হিসাবে কর্তৃত্বের প্রতি শিশুর মনোভাব বা আনুগত্যের বিষয়টির কথা বলা যায়। শৈশবে পরিবারের কর্তাব্যক্তিদের শিশু স্বাভাবিকভাবে মান্যগণ্য করে চলে। শিশুর এই মনোভাব বয়ঃপ্রাপ্তির পর রাজনীতিক আনুগত্যের ভিত্তি রচনা করে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার যে সুস্পষ্ট রাজনীতিক সামাজিকীকরণ এবং প্রচ্ছন্ন রাজনীতিক সামাজিকীকরণের মধ্যে সমন্বয় ও সহাবস্থান পরিলক্ষিত হয়। এই দু’ধরনের সামাজিকীকরণের কোনটিই এককভাবে ব্যক্তির মধ্যে বিশেষ কোন রাজনীতিক মূল্যবোধ, মতাদর্শ বা দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রবিষ্ট করতে পারে না। বস্তুত বাস্তবে দেখা যায় যে কারও ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট রাজনীতিক সামাজিকীকরণ অধিকতর ফলপ্রসূ প্রতিপন্ন হয়। আবার বিপরীতক্রমে কারও ক্ষেত্রে প্রচ্ছন্ন রাজনীতিক সামাজিকীকরণ অধিকতর কার্যকর বলে প্রতীয়মান হয়। সুস্পষ্ট ও প্রচ্ছন্ন রাজনীতিক সামাজিকীকরণের এই দুটি ধরন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা অ্যালমন্ড ও পাওয়েল-এর Comparative Politics শীর্ষক গ্রন্থে পাওয়া যায়।