ভূমিকা: যে-কোন রাষ্ট্রে বিভিন্ন ব্যক্তি বিদ্যমান রাজনীতিক কাঠামো ও কার্যাবলীর ব্যাপারে ভিন্ন ভিন্ন ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন। এ বিষয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির মনোভাব এবং মূল্যবোধও পৃথক প্রকৃতির হয়ে থাকে। বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার প্রতি কেউ নিঃশর্তে আনুগত্য জ্ঞাপন করেন, আবার কেউ কেউ তার আমূল পরিবর্তনের ব্যাপারে সক্রিয়ভাবে উদ্যোগী। সামগ্রিক বিচারে এই দু’ধরনের প্রবণতার অস্তিত্ব সত্ত্বেও রাজনীতিক তত্ত্বের আলোচনায় রাজনীতিক স্থিতিশীলতা সুসংরক্ষণের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এ কথা সাধারণভাবে সত্য। সাবেকী রাজনীতিক তত্ত্বেও সমকালীন রাজনীতিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রতি দেশবাসীর সমর্থন সৃষ্টির প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়। তবে এ ক্ষেত্রে প্রাচীনকালের রাজনীতিক চিন্তায় কোন সুনির্দিষ্ট ও পৃথক উদ্যোগ দেখা যায় না। কিন্তু বর্তমানে ‘রাজনীতিক সংস্কৃতি’-র ধারণার মাধ্যমে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা এক প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন।

বর্তমানে বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করা হয়ে থাকে। আধুনিককালের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের কাছে রাজনীতিক সংস্কৃতি সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি হল একটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি। বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার কোন বিশেষ ধরনের বৈশিষ্ট্য বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে এই দৃষ্টিভঙ্গির গুরুত্ব বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে। বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগের পর থেকেই রাজনীতিক সংস্কৃতির আলোচনা রাজনীতিক সমাজতত্ত্ব (Political Sociology) এবং আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বিশেষভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

বিভিন্ন রাজনীতিক ব্যবস্থার মধ্যে পারস্পরিক তুলনামূলক আলোচনার স্বার্থে ‘রাজনীতিক সংস্কৃতি’ কথাটির ব্যবহার শুরু হয়। এবং এ ব্যাপারে সর্বপ্রথম অ্যালমন্ডের নামই উল্লেখযোগ্য। The Civic Culture শীর্ষক গ্রন্থে অ্যালমন্ড ও ভাবা (G. A. Almond and S. Verba) রাজনীতিক সংস্কৃতি সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। এ প্রসঙ্গে অ্যালমন্ড ও পাওয়েল (G. A. Almond and G. B. Powell) -এর Comparative Politics গ্রন্থটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।


রাজনীতিক সংস্কৃতির ধারণা

রাজনীতিক সংস্কৃতি কাকে বলে? রাজনীতিক বিষয়ে মূল্যবোধ বা মাত্রাবোধের প্রতীক হিসাবে রাজনীতিক সংস্কৃতি প্রতিপন্ন হয়। বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার প্রতি সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থার সদস্যদের এক ধরনের মনোভাব, মূল্যবোধ, বিশ্বাস, দৃষ্টিভঙ্গি বা প্রবণতার অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে ব্যক্তিবর্গের এই সমস্ত আবেগ-অনুভূতির সমন্বয়ই রাজনীতিক সংস্কৃতি হিসাবে পরিচিত। প্রত্যেক দেশের রাজনীতিক ব্যবস্থায় দেশবাসীর মধ্যে বিদ্যমান ব্যবস্থা প্রসঙ্গে বিশেষ কিছু প্রবণতা, অনুভূতি এবং মনস্তাত্ত্বিক ও রাজনীতিক মাত্রাবোধ বর্তমান থাকে। রাজনীতিক ব্যবস্থার প্রতি ব্যক্তিমানুষের এই সমস্ত মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা অনুভূতি ও প্রবণতার এক সমন্বিত রূপকেই বলে রাজনীতিক সংস্কৃতি। কোন দেশের মূল রাজনীতিক মূল্যবোধের প্রতীক হল এই রাজনীতিক সংস্কৃতি। প্রকৃত প্রস্তাবে রাজনীতিক সংস্কৃতি হল কোন দেশের বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে দেশবাসীর একটি ভাবগত ধারণা, মানসিক অনুভূতি, একটি বিশেষ মনোবৃত্তি।

রাজনীতিক সংস্কৃতি জন্মসূত্রে লব্ধ নয়:

ব্যক্তি মানুষ জন্মলাভ করেই রাজনীতিক সংস্কৃতির অধিকারী হয় না। অর্থাৎ রাজনীতিক সংস্কৃতি জন্মসূত্রে লব্ধ বিষয় নয়। ব্যক্তির মধ্যে রাজনীতিক সংস্কৃতির সৃষ্টি হয় রাজনীতিক সামাজিকীকরণের মাধ্যমে। যে সমাজব্যবস্থায় ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করে এবং যে রাজনীতিক ব্যবস্থার মধ্যে ব্যক্তি বড় হয়, সেই সমাজ ও রাজনীতিক ব্যবস্থা ব্যক্তির মধ্যে সঞ্চারিত করে এক বিশেষ রাজনীতিক মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি। বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার অন্তর্গত রাজনীতিক দল, অন্যান্য রাজনীতিক সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান, চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী, রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও তার কার্যাবলী প্রভৃতির সঙ্গে ব্যক্তির সংযোগ সাধিত হয়। এইভাবে বিদ্যমান সমাজ ও রাজনীতিক ব্যবস্থার প্রতীক ও মূল্যবোধের সঙ্গে ব্যক্তি ক্রমশ সংযুক্ত ও একাত্ম হয়। ব্যক্তি-মানুষের জীবনজুড়ে এই প্রক্রিয়া নিরবচ্ছিন্নভাবে চলতে থাকে। এবং এইভাবে ব্যক্তির মধ্যে রাজনীতিক সংস্কৃতির উদ্ভব হয়। রাজনীতিক সংস্কৃতির মূল নিহিত থাকে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং মানুষের জীবনধারার বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে। বস্তুত রাজনীতিক সংস্কৃতি বলতে ব্যক্তিবর্গের এক অভিজ্ঞতাবাদী বিশ্বাসকে বোঝায়। এই অভিজ্ঞতাবাদী বিশ্বাসের সৃষ্টি হয় বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার প্রতি ব্যক্তিবর্গের রাজনীতিক মূল্যবোধ, মনোভাব, দৃষ্টিভঙ্গি, প্রতীক প্রভৃতির পরিপ্রেক্ষিতে। সুতরাং রাজনীতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠে রাজনীতিক ব্যবস্থা তথা জনজীবনের ইতিহাস এবং মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের ইতিহাসের ভিত্তিতে। রাজনীতিক সংস্কৃতি বলতে বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থা সম্পর্কিত যে মূল্যবোধ, মনোভাব, বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গিকে বোঝায় তা অব্যক্তভাবেও গোষ্ঠী ও ব্যক্তির মধ্যে বর্তমান থাকতে পারে। অর্থাৎ রাজনীতিক সংস্কৃতি সব সময় সুস্পষ্ট ও সচেতনভাবে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মধ্যে নাও পরিলক্ষিত হতে পারে।

বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থা সম্পর্কিত সকল মনোভাবের সমন্বয়:

বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে ব্যক্তিবর্গের মধ্যে বিভিন্ন মনোভাব ও মূল্যবোধের অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। রাজনীতিক কাঠামো ও কার্যাবলী প্রসঙ্গে জনসাধারণের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গি ও মনস্তাত্ত্বিক মাত্রাবোধগত পার্থক্য সকল রাজনীতিক ব্যবস্থাতেই বর্তমান। কেউ কেউ সমকালীন রাজনীতিক কাঠামো ও কার্যাবলীকে দ্বিধাহীনভাবে সমর্থন করেন। অনেকে আবার বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের পক্ষপাতী। এমন অনেক মানুষ আছেন যাঁরা রাজনীতির বিভিন্ন দিক সম্পর্কে সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত থাকেন। আবার এমন মানুষ আছেন যাঁরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে রাজনীতিক বিষয়াদিতে সক্রিয়ভাবে যোগ দেন। তেমনি আবার আর এক শ্রেণীর মানুষ দেখা যায়, যাদের মধ্যে রাজনীতিক বিষয়ে সচেতনতা আছে, কিন্তু সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের আগ্রহ নেই। তবে সামগ্রিক বিচারে বলা যায় যে, যে-কোন দেশের রাজনীতিক সংস্কৃতির মধ্যে সমকালীন রাজনীতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে একটি সহায়ক বা বিরোধী ধারা বহমান থাকে। তবে রাজনীতিক সংস্কৃতি বলতে বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থা সম্পর্কিত অনুকূল বা প্রতিকূল সকল মনোভাব, মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি, বিশ্বাস প্রভৃতির সমন্বিত প্রকাশকে বোঝায়।

রাজনীতিক ব্যবস্থা ও রাজনীতিক সংস্কৃতির মধ্যে সম্পর্ক:

বস্তুত রাজনীতিক ব্যবস্থা এবং রাজনীতিক সংস্কৃতির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ওতপ্রোত। বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থা এবং তার মৌলিক কাঠামো ও কার্যপ্রক্রিয়া প্রসঙ্গে ব্যক্তিবর্গের মধ্যে ব্যাপক ঐকমত্য থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট রাজনীতিক ব্যবস্থা শক্তিশালী ও স্থিতিশীল হয়ে থাকে। বিপরীতক্রমে বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার কাঠামো, কার্যাবলী প্রসঙ্গে জনগণের মধ্যে মতানৈক্য সংশ্লিষ্ট রাজনীতিক ব্যবস্থাকে প্রবল প্রতিকূলতার সম্মুখীন করে। তার ফলে সেই রাজনীতিক ব্যবস্থার ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। অ্যালান বল তাঁর Modern Politics and Government শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “Where this consensus is weak, there is greater likelihood of the political system being challenged by disorder or even revolution.” এ প্রসঙ্গে বল আরও বলেছেন: “The consensus may exit of the goals of society as well as the means of reaching those goals, such as working through the existing political structures instead attempting to violently overthrow them.”

রাজনীতিক সংস্কৃতি সম্পর্কে বলের সংজ্ঞা:

অ্যালান বল তাঁর Modern Politics and Government শীর্ষক গ্রন্থে রাজনীতিক সংস্কৃতি সম্পর্কে বিশদভাবে আলোচনা করেছেন। বলের মতানুসারে ‘রাজনীতিক সংস্কৃতি’ গঠিত হয় রাজনীতিক ব্যবস্থা এবং রাজনীতিক বিষয়াদির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বিভিন্ন মনোভাব, বিশ্বাস, আবেগ-অনুভূতি ও মূল্যবোধকে নিয়ে। তিনি বলেছেন: “A political culture is composed of the attitudes, beliefs, emotions and values of society that relate to the political system and political issues.” বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মধ্যে এই সমস্ত মনোভাব নিহিত থাকে। তবে ব্যক্তিবর্গ বা গোষ্ঠী সব সময় সচেতনভাবে এই সমস্ত মনোভাব পোষণ করে, তা নাও হতে পারে। আবার রাজনীতিক সংস্কৃতির এই সমস্ত উপাদানকে সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করাও সম্ভব নয়। কিন্তু রাজনীতিক সংস্কৃতির ভিত্তি সম্পর্কিত জ্ঞানের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত হওয়া যায়। অধ্যাপক বল বলেছেন: “…an awareness of the basis of the political culture will allow amore detailed picture of the political system to emerge.” কেবলমাত্র রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং রাজনীতিক সমস্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে এ বিষয়ে বিশদভাবে ধারণা লাভ করা সম্ভব নয়।

রাজনীতিক সংস্কৃতি সম্পর্কে অ্যালমণ্ড ও পাওয়েল:

Comparative Politics শীর্ষক গ্রন্থে অ্যালমন্ড ও পাওয়েল রাজনীতিক সংস্কৃতি সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। এই দুই আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর অভিমত অনুসারে রাজনীতিক সংস্কৃতির সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় জড়িত থাকে। এই সমস্ত বিষয়কে বিচ্ছিন্ন করে বাছাই করা যায়। এবং কতকাংশে এদের পরিমাপও করা যেতে পারে। এই কারণে রাজনীতিক সংস্কৃতিকে বলা হয় ব্যাখ্যামূলক বিষয়ের অবশিষ্টাংশ। অ্যালমন্ড ও পাওয়েলের অভিমত অনুসারে বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার সদস্যদের মধ্যে রাজনীতির প্রতি ব্যক্তিগত মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গিই হল রাজনীতিক সংস্কৃতি। তাঁরা বলেছেন: “Political culture is the pattern of individual attitudes and orientations toward politics among the members of a political system.”

রাজনীতিক সংস্কৃতি সম্পর্কে লুসিয়ান পাই:

Aspects of Political Development শীর্ষক গ্রন্থে লুসিয়ান পাই রাজনীতিক সংস্কৃতি সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। তাঁর অভিমত অনুসারে সামাজিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে সাধারণ সংস্কৃতির এবং রাজনীতিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে রাজনীতিক সংস্কৃতির গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে। যে-কোন দেশের রাজনীতিক সংস্কৃতির উৎস সেই দেশের রাজনীতিক ঘটনাসমূহ এবং দেশবাসীর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মধ্যে বর্তমান থাকে। রাজনীতিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠে বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার ইতিহাস এবং সংশ্লিষ্ট রাজনীতিক ব্যবস্থার সদস্যবর্গের ব্যক্তিগত জীবনের যৌথ ইতিহাসের সমন্বয়ের ভিত্তিতে। লুসিয়ান পাই-এর মতানুসারে রাজনীতিক সংস্কৃতি বলতে কতকগুলি মনোভাব, বিশ্বাস ও মানসিক অনুভূতির সমষ্টিকে বোঝায় (“A political culture is the set of attitudes, beliefs, senti ments….”)। রাজনীতিক প্রক্রিয়া পদ্ধতি এর মাধ্যমে সুশৃঙ্খল ও অর্থপূর্ণ হয়ে উঠে। আবার যে সমস্ত অনুমান ও বিধি-নিয়মের দ্বারা রাজনীতিক ব্যবস্থায় আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রিত হয় তাও এর থেকেই উৎসারিত হয়। রাজনীতিক আদর্শ এবং রাষ্ট্রীয় কার্য পরিচালনা সম্পর্কিত নিয়ম-নীতি রাজনীতিক সংস্কৃতির অঙ্গীভূত থাকে। পাই বলেছেন: “It encompasses both the political ideals and the operating norms of a polity.” তাঁর মতে রাজনীতির মনস্তাত্ত্বিক ও ব্যক্তিগত মাত্রাবোধের এক সমন্বিত অভিব্যক্তি হল রাজনীতিক সংস্কৃতি। তিনি বলেছেন: “Political culture is thus the manifestation in aggregate form of the psychological and subjective dimensions of politics.”

রাজনীতিক সংস্কৃতির উপাদানসমূহ:

যে-কোন দেশ বা জাতির রাজনীতিক ব্যবস্থা গঠনের ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্ব নির্ধারক হল সংশ্লিষ্ট দেশ বা জাতির রাজনীতিক সংস্কৃতি। আবার যে-কোন জাতির রাজনীতিক সংস্কৃতির মধ্যে অল্পবিস্তর অসঙ্গতির অস্তিত্ব দেখা যায়। কিন্তু প্রত্যেক জাতির রাজনীতিক সংস্কৃতি মোটামুটি তিনটি মূল উপাদানের সমন্বয়ে সৃষ্টি হয়। রাজনীতিক সংস্কৃতির তিনটি মৌলিক উপাদান নিম্নরূপ-

(১) অভিজ্ঞতাবাদী বিশ্বাসসমূহ: অভিজ্ঞতাবাদী বিশ্বাস বলতে বিভিন্ন রাজনীতিক বিষয় ও সমস্যা সম্পর্কে জনসাধারণের ধারণার ভিত্তিতে গড়ে উঠা বিশ্বাসকে বোঝায়। এই বিশ্বাসের দ্বারা শাসক-শাসিতের সম্পর্ক প্রভাবিত হয়ে থাকে। বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে নাগরিকদের রাজনীতিক বিশ্বাস প্রসঙ্গে জোহারী বলেছেন: “It includes certain norms such as the adult population of a country has the right to take part in the political discussions.”

(২) সংবেদনশীল মনোভাব: নির্দিষ্ট রাজনীতিক লক্ষ্য প্রসঙ্গে ব্যক্তিবর্গের অনুকূল বা প্রতিকূল অনুভূতিকেই বলা হয় অনুভূতি সম্পর্কিত সংবেদনশীলতা বা সংবেদনশীল মনোভাব। ব্যক্তিবর্গের এই সংবেদনশীলতার উৎস হল বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থা এবং সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত মনোভাব।

(৩) মূল্যবোধের অগ্রাধিকারসমূহ: সরকারের অভিপ্রেত উদ্দেশ্য, জনসাধারণের ব্যক্তিগত ধারণা ও উৎকর্ষ প্রভৃতিকে নিয়ে এক ধরনের বিশ্বাসের সৃষ্টি হয়। এই সমস্ত বিশ্বাসের সমষ্টিকেই বলে মূল্যবোধের প্রাধিকার। জোহারী এ প্রসঙ্গে বলেছেন: “…the people have, in general, certain political values as elections should be held periodically and also in a free and fair manners, that the ministers should resign if they forfeit the confidence of the people….” তবে সকল জাতির রাজনীতিক সংস্কৃতিতে একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। এই বৈশিষ্ট্য হল যে, প্রত্যেক রাজনীতিক সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে অসঙ্গতির অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। যে সমস্ত উপাদানের সমন্বয়ে রাজনীতিক সংস্কৃতির সৃষ্টি হয়, সেই সমস্ত উপাদানের পরস্পরের মধ্যে সব সময় সঙ্গতি থাকে না।

রাজনীতিক উপ-সংস্কৃতি:

যে-কোন রাজনীতিক ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত সকল মানুষ সংশ্লিষ্ট রাজনীতিক ব্যবস্থা প্রসঙ্গে অভিন্ন অনুভূতি, বিশ্বাস বা মনোভাব পোষণ করেন না। প্রকৃত প্রস্তাবে প্রত্যেক রাজনীতিক ব্যবস্থার সদস্যবর্গের মধ্যে বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থা প্রসঙ্গে দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধগত পার্থক্য থাকে। সকল রাজনীতিক ব্যবস্থাতেই বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণী, জাতি, ধর্ম, ভাষাগত পার্থক্যের ভিত্তিতেই বিভিন্ন সম্প্রদায়, বিভিন্ন আঞ্চলিক গোষ্ঠী প্রভৃতির অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। এই সমস্ত বিভিন্নতার ভিত্তিতে ভিন্ন ভিন্ন প্রবণতা, মূল্যবোধ ও মনোভাবের সৃষ্টি হয়। আবার কোন দীর্ঘকালীন বঞ্চনা বা অবিচারজনিত কারণেও স্বতন্ত্র প্রবণতা বা স্বাধিকারের প্রেরণা দেখা দিতে পারে। এই প্রবণতা বা প্রেরণার অস্তিত্ব সাধারণ সংস্কৃতির মত রাজনীতিক সংস্কৃতির মধ্যেও পরিলক্ষিত হয়। আবার সমকালীন রাজনীতিক বিষয়াদি সম্পর্কে ব্যক্তিবর্গের মধ্যে নানা কারণে ব্যাপক মতপার্থক্যের সৃষ্টি হতে পারে। এই ধরনের মতপার্থক্যের পিছনে নানা কারণ বর্তমান থাকে। ভৌগোলিক অবস্থানগত পার্থক্য, শিক্ষাগত পার্থক্য, আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বিভিন্নতা, জাতি ধর্মের বিভিন্নতা, স্বাধিকারের ধারণা প্রভৃতি এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। এই সমস্ত বিভিন্নতা ও বৈচিত্র্যের পরিপ্রেক্ষিতে অভিন্ন রাজনীতিক ব্যবস্থার মধ্যে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের মধ্যে বিশেষ বিশেষ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ ও অনুভূতির সৃষ্টি হতে পারে। তার ফলে রাজনীতিক সংস্কৃতির ভিতরে বিশেষ ধরনের এক প্রবণতা সৃষ্টি হয়। এই বিশেষ ধরনের প্রবণতাই হল রাজনীতিক উপ-সংস্কৃতি (Political subculture)।

উপ-সংস্কৃতি প্রসঙ্গে অ্যালান বল:

বলের অভিমত অনুসারে রাজনীতিক সংস্কৃতি এমনকি স্থিতিশীল সমাজ ব্যবস্থাতেও সমজাতীয় হয় না। একটি গোষ্ঠীর সঙ্গে আর একটি গোষ্ঠীর পার্থক্য সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হলে রাজনীতিক উপ-সংস্কৃতির অস্তিত্ব প্রতিপন্ন হয়। বল বলেছেন: “This is not to say that even in stable societies the political culture is homogeneous, and where differences between one group and others are marked, there is said to exist a political subculture.” বলের মতানুসারে রাজনীতিক উপ-সংস্কৃতি বলতে সুনির্দিষ্ট ধরনের মনোভাব, বিশ্বাস ও মূল্যবোধের সমন্বিত রূপকে বোঝায় না। তবে অন্যান্য উপ-সংস্কৃতির সঙ্গে ঐ সমস্ত নির্দিষ্ট ধরনের মনোভাব, বিশ্বাস ও মূল্যবোধের কিছু কিছু অংশ সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে থাকে। বল বলেছেন: “This (subculture) is not a distinct set of attitudes, beliefs and values, but a set of attitudes some of which are in common with other subcultures.” তাঁর মতানুসারে বাস্তবে অধিকাংশ রাজনীতিক সংস্কৃতি সমজাতীয় নয় (“Most political cultures are in fact heterogeneous.”)। উপ-সংস্কৃতির উদাহরণ হিসাবে বল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণকায়দের কথা বলেছেন। তাঁর মতানুসারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণকায় ব্যক্তিবর্গ একটি রাজনীতিক উপ সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে (“The blacks in the United States constitute a political subculture.”)।

রাজনীতিক উপ-সংস্কৃতি সম্পর্কে অ্যালমন্ড ও পাওয়েল:

Comparative Politics শীর্ষক গ্রন্থে অ্যালমন্ড ও পাওয়েল রাজনীতিক উপ-সংস্কৃতি সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। এই দুই আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর অভিমত অনুসারে বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার মধ্যে নির্দিষ্ট এক ধরনের রাজনীতিক দৃষ্টিভঙ্গি (a particular set of political orientation) পৃথকভাবে প্রতিপন্ন হলে তাকে রাজনীতিক উপ-সংস্কৃতি বলে। এঁদের মতানুসারে অভিজ্ঞতাবাদী অনুসন্ধানে (empirical investigation) যে-কোন রাজনীতিক সংস্কৃতির মধ্যে সমজাতীয় মাত্রা যাচাই করা দরকার।

ভারতীয় উদাহরণ: ভারতের বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থায় যে রাজনীতিক সংস্কৃতি বর্তমান তার মধ্যে সমজাতীয়তার অভাব অনস্বীকার্য। ভারতীয় রাজনীতিক সংস্কৃতিতে উপ-সংস্কৃতিগত তারতম্য বিরোধ বিতর্কের ঊর্ধ্বে। শিখ জঙ্গীদের পৃথক খালিস্তানের জন্য উগ্রপন্থী কার্যকলাপ এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আঞ্চলিক বা গোষ্ঠীগত অন্যান্য বিচ্ছিন্নতাবাদী কাজকর্ম ভারতের রাজনীতিক ব্যবস্থায় উপ-সংস্কৃতি হিসাবে বিবেচিত হয়। জাতি, ধর্ম, ভাষা, অঞ্চল, সম্প্রদায় প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিভিন্নতা ও বৈচিত্র্য ভারতের রাজনীতিক সংস্কৃতিতে সমজাতীয়তার মাত্রার হ্রাস ঘটায়।