যে-কোন দেশের রাজনীতিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠার পিছনে বহু ও বিভিন্ন উপাদানের ভূমিকা অনস্বীকার্য। অর্থাৎ কোন একটি নয়, একাধিক উপাদানের ভিত্তিতে রাজনীতিক সংস্কৃতির সৃষ্টি হয়। রাজনীতিক সংস্কৃতি সমজাতীয় হোক বা মিশ্র প্রকৃতির হোক, বিভিন্ন উপাদানের উপর ভিত্তি করেই তা গড়ে উঠে। অ্যালান বল তাঁর Modern Politics and Government শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “A political culture, whether diverse or homogeneous is a product of many interrelated factors.” অর্থাৎ রাজনীতিক সংস্কৃতির ভিত্তিগত উপাদানগুলি কেবল সংখ্যায় বহু তা নয়, এই উপাদানগুলিকে রাজনীতিক সংস্কৃতির নির্ধারক (determinans) হিসাবেও নির্দেশ করা যায়। এই সমস্ত ভিত্তিগত বা নির্ধারক উপাদান হিসাবে যে সমস্ত উপাদান উল্লেখযোগ্য সেগুলি হল: ঐতিহাসিক বিকাশ, ঔপনিবেশিক শাসন, ভৌগোলিক অবস্থা বা অবস্থান, জাতিগত বিভিন্নতা, ধর্ম, আর্থ-সামাজিক কাঠামো, রাজনীতিক মতাদর্শ, শ্রেণী-কাঠামোর প্রভাব প্রভৃতি।
(১) ঐতিহাসিক বিকাশের ধারা -গ্রেট ব্রিটেনের ঐতিহাসিক রাজনীতিক বিকাশ:
যে-কোন রাজনীতিক ব্যবস্থায় রাজনীতিক সংস্কৃতির উপর দেশের ঐতিহাসিক বিকাশের ধারার গভীর প্রভাবকে অস্বীকার করা যায় না। ঐতিহাসিক বিকাশের ধারা পর্যালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে একটি দেশের রাজনীতিক ব্যবস্থার নিরবচ্ছিন্নতা বা বিচ্ছিন্নতা প্রতিপন্ন করার পক্ষে পর্যাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়। এবং এর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট রাজনীতিক সংস্কৃতির ভিত্তি সম্পর্কে জানা যায়। এ প্রসঙ্গে জোহারী বলেছেন: “A study of history offers ample authentic evidence to prove the continuity or discontinuity of a political system behind which the foundation of a political culture can well be found out.” বল বিষয়টি ব্যাখ্যা করার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন মহাদেশের বিভিন্ন দেশের ঐতিহাসিক বিকাশের ধারা পর্যালোচনা করেছেন। তিনি প্রথমে গ্রেট ব্রিটেনের কথা বলেছেন। ব্রিটেনের রাজনীতিক ব্যবস্থায় এক নিরবচ্ছিন্ন ধারার অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। বল বলেছেন: “We have noted the importance of political continuity in Britain, in which the older values have been allowed to merge with modern attitudes, undisturbed by violent internal strife or domination by a foreign power.” বস্তুত ব্রিটেনের রাজনীতিক সংস্কৃতিতে ঐতিহ্যগত ধারার সঙ্গে আধুনিকতার এক অভিনব সমন্বয় সাধিত হয়েছে। রক্ষণশীল ইংরেজ জাতির পরম্পরাগত মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যের সঙ্গে এখনকার বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও শিল্পোন্নত সমাজ-সম্ভৃত অত্যাধুনিক মূল্যবোধের সংমিশ্রণ ঘটেছে। গ্রেট ব্রিটেনের সাবেকী কাঠামো হল অভিজাতকেন্দ্রিক। ঐতিহাসিক বিকাশ বা অবস্থার চাপে এই কাঠামো নিজেকে আধুনিক শিল্পভিত্তিক সামাজিক কাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বা উপযোগী করে নিয়েছে। সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার প্রতীক স্বরূপ রাজতন্ত্র ও লর্ডসভা এখনও ব্রিটেনের রাজনীতিক ব্যবস্থায় বর্তমান। কিন্তু বর্তমানে ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের গণতন্ত্রীকরণ ঘটেছে এবং লর্ডসভার ক্ষমতা ও ভূমিকা বিশেষভাবে হ্রাস পেয়েছে। এ প্রসঙ্গে বল বলেছেন: “An interesting example was the acceptance of the first labour government by the leader of the other political parties in 1924. …the Labour leaders themselves were anxious to prove the moderation of their programme…. Thus there was no challenge to the political system.
ফ্রান্সের রাজনীতিক বিকাশ: অপরদিকে ফ্রান্সে ঐতিহাসিক বিকাশের ধারা ভিন্নমুখী। ফরাসী বিপ্লব সংঘটিত হয় ১৭৮৯ সালে। এই বিপ্লবের মাধ্যমে ফ্রান্সের বিদ্যমান রাজনীতিক কাঠামো, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি অপসারিত হয় এবং তার জায়গায় নতুন রাজনীতিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে নূতন রাজনীতিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। ফরাসী বিপ্লব-সম্ভৃত মনোভাব, মূল্যবোধ ও বিশ্বাসই বহুলাংশে ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর রাজনীতিক সংঘাত-বিরোধকে প্রভাবিত করেছে। বল বলেছেন: “The revolution of 1789 violently overthrow the existing political structures, and the political conflicts and antagonisms of the nineteenth and twentieth centuries may be said to be largely determined by the attitudes, values and beliefs formed by the revolutionary upheaval.”
আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম: আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের সূত্রে কতকগুলি ক্ষেত্রে সামাজিক পরিবর্তনের সূত্রপাত ঘটে। তবে বস্তুতপক্ষে এই স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটেনের সঙ্গে রাজনীতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা। তা ছাড়া এর মাধ্যমে উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কতকগুলি পদ্ধতির ব্যাপারে সহমত প্রতিষ্ঠিত হয়। বল এ প্রসঙ্গে বলেছেন: “…the Revolution did establish a stable political system based on new egalitarian and competitive values which were not fundamentally changed by the later industrialisation and mass immigration.”
(২) ঔপনিবেশিক শাসন:
রাজনীতিক ব্যবস্থা ও রাজনীতিক সংস্কৃতির কাঠামো ও প্রকৃতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাব-প্রতিক্রিয়াকে অস্বীকার করা যায় না। আগেকার উপনিবেশগুলির রাজনীতিক ব্যবস্থা পর্যালোচনা করলে এ বিষয়ে সম্যকভাবে অবহিত হওয়া যায়। যে সমস্ত দেশ সুদীর্ঘকাল ধরে ঔপনিবেশিক শাসনাধীনে কাটিয়েছে তাদের প্রত্যেকের উপর প্রাক্তন ঔপনিবেশিক শাসকের রাজনীতিক সংস্কৃতির স্থায়ী ও কার্যকর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। ঔপনিবেশিক শাসনের অধীন দেশগুলিতে শাসকগোষ্ঠী নিজেদের প্রয়োজনের তাগিদে এক বিশেষ ধরনের রাজনীতিক কাঠামো গড়ে তোলে এবং নিজেদের প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতি চালু করে। এইভাবে সুদীর্ঘকাল ধরে ঔপনিবেশিক শাসকের দ্বারা শাসিত হওয়ার ফলে সংশ্লিষ্ট শাসনব্যবস্থার রাজনীতিক কাঠামো ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাদির ব্যাপারে দেশবাসী অভ্যস্ত ও অভিজ্ঞ হয়ে যায়। তাদের মধ্যে এ ব্যাপারে সহমতের সৃষ্টি হয়। এশিয়া ও আফ্রিকা এই দুটি মহাদেশের বিভিন্ন দেশ এই ধরনের ঔপনিবেশিক শাসনাধীনে দীর্ঘদিন কাটিয়েছে। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত এই সমস্ত দেশের রাজনীতিক সংস্কৃতির উপর ঔপনিবেশিক শাসনের গভীর প্রভাব বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে। এ প্রসঙ্গে বল বলেছেন: “The impact of European colonial domination on many new states in Africa and Asia is an important factor explaining some aspects of the political culture of these states.”
এ প্রসঙ্গে উদাহরণ হিসাবে ভারতের রাজনীতিক ব্যবস্থা ও সংস্কৃতির দৃষ্টান্ত বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ভারতের বর্তমান সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা, আমলাতান্ত্রিক কাঠামো, বিচার বিভাগীয় সংগঠন ও পদ্ধতি, ভোটাধিকারের নীতি প্রভৃতি ব্রিটিশ শাসকদের কাছ থেকেই পাওয়া। এ বিষয়ে জোহারী বলেছেন: “…the indians learnt from their British masters the values of parliamentary democracy and efficiency of the constitutional means…” প্রসঙ্গত বলের দীর্ঘ অভিমত প্রণিধানযোগ্য। তিনি মন্তব্য করেছেন: “India provides an illustrative example of colonial domination extended over a long period of time, and the gradual introduction of the Westminister model of government. There was indirect rule in the case of the princely states but the British system of conciliar local government was established in other areas.”.
(৩) ভৌগোলিক অবস্থিতি:
যে-কোন দেশের ভৌগোলিক অবস্থান তার রাজনীতিক সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে থাকে। বল বলেছেন: “…geography is another important factor in fashioning a political culture.” গ্রেট ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভৌগোলিক অবস্থান বিশেষ ধরনের। বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিহত করার ক্ষেত্রে এই ভৌগোলিক অবস্থান স্বাভাবিকভাবেই এক অনুকূল অবস্থার সৃষ্টি করেছে। এই অবস্থায় এই দুটি দেশ স্বাধীনভাবে তাদের নিজেদের সত্তার প্রভাবে নিজস্ব রাজনীতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে। আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রাকৃতিক সম্পদে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ। এই সমৃদ্ধি মার্কিন রাজনীতিক ব্যবস্থাকে স্থায়িত্ব দিয়েছে। অনুরূপভাবে পশ্চিম জার্মাণীর ভৌগোলিক অবস্থান এবং সংকটের আশংকার কারণে দেশবাসীর বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থাকে বাধ্য হয়ে মেনে নিয়েছে। Politics in Germany শীর্ষক গ্রন্থে এডিংগার (L. J. Edingar)-এর বক্তব্যকে অনুসরণ করে অধ্যাপক বল বলেছেন: “West Germans are said to accept the existing political structures of the Federal Republic party because of their geographical position between the competing international alliances led by Russia and America, in that any instability in West German Politics would result in increased international tension.”
(৪) জাতিগত বিভিন্নতা:
দেশবাসীর মধ্যে জাতিগত বিচারে ব্যাপক বিভিন্নতা থাকলে রাজনীতিক সংস্কৃতির উপর প্রভাব পড়ে। জাতিগত প্রবণতা প্রবল হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের আনুগত্য জাতীয় সরকারের পরিবর্তে নিজ জাতির প্রতি প্রদর্শিত হয়। আবার এই জাতিগত ভিত্তিতে পররাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যের সৃষ্টি হলে দেশের রাজনীতিক ব্যবস্থায় অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। এ প্রসঙ্গে বল বলেছেন: “The instability in the political system caused by ethnic groups’ loyalties being directed to themselves and not to the national government is increased of allegiances are also directed outwards to another state.” তবে জাতিগত বিভিন্নতার প্রভাব-প্রতিক্রিয়া সকল রাজনীতিক সংস্কৃতির উপর একই রকম হয় না। এ ক্ষেত্রে দেশভেদে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। বল বলেছেন: “The impact of ethnic differences on a particular culture varies.” মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বহু ও বিভিন্ন জাতির মানুষ বসবাস করে। কিন্তু তারা মার্কিন জীবনধারার সঙ্গে পুরোপুরি সম্পৃক্ত হয়ে গেছে। মার্কিনী হিসাবেই তারা তাদের পরিচয় দেয়। এবং মার্কিন সরকারের প্রতি তাদের আনুগত্য বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে। সাম্প্রতিককালে জাতিগত তারতম্য ব্রিটেনে অল্পবিস্তর প্রতিকূল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। বল বলেছেন: “Ethnic differences have recently began to affect attitudes in Great Britain.” এ প্রসঙ্গে বল আরও বলেছেন: “However, European immigration into Canada and South Africa has not removed entirely the consciousness of being members of different ethnic groups, and the party system reflect this consciousness.” প্রকৃত প্রস্তাবে রাজনীতিক সংস্কৃতির উপর জাত পাতের তারতম্য এবং উপজাতীয় আনুগত্যের প্রভাব-প্রতিক্রিয়াকে অস্বীকার করা যায় না। বিশেষত সাবেকী এবং উত্তরণশীল সমাজব্যবস্থার ক্ষেত্রে এ কথা বিশেষভাবে প্রযোজ্য। মূলত এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে এ ধরনের অবস্থার অস্তিত্ব অনস্বীকার্য।
(৫) ধর্ম:
রাজনীতিক সংস্কৃতির উপর ধর্মের প্রভাবও গুরুত্বপূর্ণ। কোন কোন দেশের রাজনীতিক ব্যবস্থায় রাজনীতিক মনোভাব, মূল্যবোধ, বিশ্বাস প্রভৃতির উৎস হিসাবে ধর্মের গুরুত্ব বিশেষভাবে প্রতীয়মান হয়। এ কথা ঠিক যে আধুনিক বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও শিল্প-সভ্যতার বিকাশ ও বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ স্বীকৃতি ও প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। আধুনিককালে অধিকাংশ দেশের রাজনীতিক ব্যবস্থায় ধর্মনিরপেক্ষতার প্রক্রিয়া বিশেষভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এতদসত্ত্বেও এর বিপরীত অবস্থার অস্তিত্বও অনস্বীকার্য। এমন সমাজ ও রাজনীতিক ব্যবস্থার পরিচয় পাওয়া যায় যেখানে রাজনীতিক সংস্কৃতি ও ধর্মের পারস্পরিক সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। বিশেষত সাবেকী ও উত্তরণশীল সমাজে এই অবস্থা পরিলক্ষিত হয়। এই সমস্ত দেশে বা রাজনীতিক ব্যবস্থায় ধর্মের অনুপ্রবেশ ঘটেছে এবং ধর্মের রাজনীতিকরণ সম্পাদিত হয়েছে। বল বলেছেন: “Religion, in fact not language was used by the Irish to emphasise their separateness from the British in long struggle for independence before 1922.”
(৬) আর্থ-সামাজিক কাঠামো:
রাজনীতিক সংস্কৃতির অন্যতম নির্ধারক হিসাবে আর্থ-সামাজিক কাঠামোর কথা বলা হয়। বল বলেছেন: “The socio-economic structure is another determinant of the political culture.” বলের অভিমত সাধারণত শহরকেন্দ্রিক ও শিল্পভিত্তিক সমাজব্যবস্থা জটিল প্রকৃতির হয়ে থাকে। এ ধরনের সমাজে শিক্ষা ও রাজনীতিক যোগাযোগ অধিক মাত্রায় বর্তমান থাকে। এই রকম সমাজের অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিবর্গ অধিকতর রাজনীতি সচেতন হন এবং প্রগতিশীল ও উদার মনোভাবাপন্ন হন। তাঁরা রক্ষণশীলতার বিরোধী এবং পরিবর্তনের পক্ষপাতী। আবার সরকারী নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে এঁদের অংশগ্রহণের হারও অধিক হয়ে থাকে। বিপরীতক্রমে গ্রামাঞ্চলে শিক্ষা ও রাজনীতিক যোগাযোগের হার ও মাত্রা কম। এই কারণে পল্লীসমাজে পরিবর্তন-বিরোধী প্রবণতা ও রক্ষণশীল মনোভাবের অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। এবং এ সবের ফলস্বরূপ গ্রামীণ রাজনীতিক ব্যবস্থার অংশগ্রহণের হার সাধারণত কম হয়ে থাকে। বল বলেছেন: “Rural societies are not geared to change and innovation, and states with a predominantly peasant population tend to be more conservative.” বলা হয় যে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মাত্রা বা হার দেশের রাজনীতিক সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে। যে সমাজব্যবস্থায় আর্থনীতিক কাঠামো মূলত শিল্প-ভিত্তিক, সেখানে অধিক হারে জাতীয় সরকারের প্রতি আনুগত্য পরিলক্ষিত হয়। কৃষি-ভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় এই হার কম হয়ে থাকে। বল বলেছেন: “Loyalty to the national us opposed to the regional group, is more a characteristic of an industrialised society, but the examples of such states as Belgium warn us that this is not a rigid correlation.” এ প্রসঙ্গে বলের আরও অভিমত হল যে আর্থ-সামাজিক অগ্রগমনের হার এবং রাজনীতিক জীবনে অংশগ্রহণের হারের মধ্যে কোন প্রত্যক্ষ ও আনুপাতিক সম্পর্ক নেই। এ কথা ঠিক। কিন্তু এতদসত্ত্বেও ব্যক্তিবর্গের রাজনীতিক মনোভাব ও মূল্যবোধের উপর আর্থ-সামাজিক অগ্রগমনের প্রভাব-প্রতিক্রিয়াকে অস্বীকার করা যায় না। তিনি বলেছেন: “There is not always a direct link between the level of socio-economic development and participatory liberal democracies, but nonetheless there are repercussions on certain political attitudes and values.”
(৭) রাজনীতিক মতাদর্শ:
আধুনিককালের রাজনীতিক ব্যবস্থায় প্রচলিত রাজনীতিক মতাদর্শও সমকালীন রাজনীতিক সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে। যে-কোন দেশের অধিবাসীদের রাজনীতিক বিষয়ক মনোভাব, মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্বাস প্রাধান্যকারী রাজনীতিক মতাদর্শের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়ে থাকে। রাজনীতিক মতাদর্শের প্রচার ও প্রসারের মাধ্যম হিসাবে রাজনীতিক দলের ভূমিকাও এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার যে কোন দেশে বিভিন্ন রাজনীতিক মতাদর্শ এবং এই সমাজে মতাদর্শের মধ্যে বিরোধ বর্তমান থাকলে সংশ্লিষ্ট দেশে রাজনীতিক সংস্কৃতির উপর তার প্রভাব-প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট রাজনীতিক সংস্কৃতিতেও পার্থক্যমূলক বৈশিষ্ট্যের সৃষ্টি হয়।
(৮) শ্রেণী-কাঠামোর প্রভাব:
কোন দেশের রাজনীতিক সংস্কৃতির উপর সংশ্লিষ্ট দেশের শ্রেণী-কাঠামোর প্রভাবকেও অস্বীকার করা যায় না। রাজনীতিক ক্ষেত্রে ব্যক্তির মনোভাব, মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্বাস শ্রেণী-কাঠামোর দ্বারাও বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়। ব্যক্তিবর্গের রাজনীতিক চেতনার প্রকৃতি ও পরিধি তাদের শ্রেণীগত সামাজিক অবস্থানের উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। বিভিন্ন দেশের শ্রেণী-কাঠামোতে পার্থক্য থাকে। এই কারণে বিভিন্ন দেশের রাজনীতিক সংস্কৃতিতেও পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। অধ্যাপক বলের অভিমত অনুসারে শিল্পভিত্তিক সমাজে শ্রেণী-কাঠামো জটিল প্রকৃতির হয়। তিনি বলেছেন: “An industrialised society will have a complex class-structure but the distinctness of class a sub-group will vary.” বল বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে শ্রেণী-সচেতনতার অনুপস্থিতির কথা বলেছেন। ইউরোপীয় শ্রমিক শ্রেণী সম্পর্কিত সচেতনতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে দেখা যায়। বলা হয় যে তাঁরা বুর্জোয়া জীবনযাপন পদ্ধতিতে অভ্যস্ত। বল বলেছেন: “In the United states it is claimed that the working class have been Membourgeoisfied and lack the consciousness of European working classes.” গ্রেট ব্রিটেনের শ্রমিক শ্রেণীর শ্রেণী-সচেতনতা সম্পর্কেও অধ্যাপক বল তাঁর বক্তব্য ব্যক্ত করেছেন। Political Change in Britain শীর্ষক গ্রন্থে বাটলার ও স্টোক্স-এর অভিমত অনুসরণ করে তিনি বলেছেন: “…in Britain…. consciousness of class membership does not mean that the working class see their values and interests as being in conflict with those of other social classes.” এ প্রসঙ্গে বল পরিশেষে যে মন্তব্য করেছেন তা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন: “A greater conflict between class sub-culture may be seen in certain European liberal democracies, such as France and Italy, where hostile attitudes to the values of the dominant political elites can be illustrated by the electoral support for the communist parties in those countries.”
উপসংহার: প্রকৃত প্রস্তাবে কোন দেশ বা জাতির রাজনীতিক সংস্কৃতি কোন বিশেষ একটি উপাদানের ভিত্তিতে গড়ে উঠে না। রাজনীতিক সংস্কৃতির সৃষ্টি হয় বহু ও বিভিন্ন উপাদানের সমন্বয়ে। এই সমস্ত উপাদান পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এই কারণে বল যথার্থই বলেছেন: “A political culture…is a product of many interrelated factors.” তবে রাজনীতিক সংস্কৃতির সকল উপাদান সব সময় সমানভাবে ক্রিয়াশীল থাকে না। এক-এক সময় এবং ভিন্ন ভিন্ন দেশ বা জাতির ক্ষেত্রে এক একটি উপাদানের প্রাধান্যমূলক ভূমিকা পরিলক্ষিত হয়।
Leave a comment