রাজনীতিক সংস্কৃতি স্থিতিশীল নয়:
সমকালীন সমাজব্যবস্থার প্রকৃতির পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিক সংস্কৃতি নির্ধারিত হয়। সমাজব্যবস্থার চেহারা-চরিত্রের উপর বিবিধ উপাদানের প্রভাব-প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়। তবে আর্থনীতিক ব্যবস্থার দ্বারা সমাজব্যবস্থার প্রকৃতি বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়। যে সকল উপাদানের ভিত্তিতে রাজনীতিক সংস্কৃতি গঠিত হয় সেগুলি স্থিতিশীল নয়, গতিশীল। এই কারণে রাজনীতিক সংস্কৃতিও স্থিতিশীল নয়, গতিশীল। অ্যালান বল তাঁর Modern Politics and Government শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। তাঁর অভিমত অনুসারে কোন রাজনীতিক সংস্কৃতি নির্দিষ্ট কোন পর্যায়ে একেবারে স্থিতিশীল থাকে না। বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থা সঞ্জাত নতুন মতাদর্শের প্রভাবে বা বিদেশি নতুন মতাদর্শের প্রভাবে রাজনীতিক সংস্কৃতি প্রভাবিত ও পরিবর্তিত হয়। অর্থাৎ আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ও প্রবণতার প্রভাবকে রাজনীতিক সংস্কৃতি উপেক্ষা করতে পারে না। বল বলেছেন: “A political culture is not static but will respond to new ideas generated from within the political system or imported or imposed from outside.” এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে জাপানের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিগত শতবর্ষ ধরে আভ্যন্তরীণ ও বহির্বিশ্বের প্রভাবের ফলে জাপানে ব্যাপক ও বিস্ময়কর পরিবর্তন ঘটেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার ফলে জাপানে রাজনীতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।
রাজনীতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন সর্বত্র এক রকম নয়:
The Government of Japan শীর্ষক গ্রন্থে বার্কস (A, W. Burks) এবং A History of Modern Japan শীর্ষক গ্রন্থে স্টোরি (R. Storry)-র বক্তব্য অনুসরণ করে বল জাপানের উদাহরণটির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। এ প্রসঙ্গে একজন সমীক্ষকের মন্তব্য বল উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেছেন: “Modern Japan has inherited a remarkably integrated ethos which, despite rapid changes, has always provide a source of stability.” পূর্বতন রাজনীতিক সংস্কৃতির কিছু সাবেকী বৈশিষ্ট্য এবং পরিবর্তিত সংস্কৃতির কিছু আধুনিক বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়ে এক নতুন রাজনীতিক সংস্কৃতির সৃষ্টি সম্ভব। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে গ্রেট ব্রিটেনের রাজনীতিক সংস্কৃতির কথা বলা যায়। ব্রিটেনের বর্তমান রাজনীতিক সংস্কৃতিতে সাবেকী সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে একেবারে অধীকার না করে আধুনিক জীবনধারার উপাদানসমূহের সঙ্গে সামঞ্জস্য সাধনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আবার আভ্যন্তরীণ আর্থ-সামাজিক ও রাজনীতিক পরিকাঠামোর পুনর্বিন্যাস বা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে পূর্বতন রাজনীতিক সংস্কৃতির অবসান এবং নতুন এক রাজনীতিক সংস্কৃতির আবির্ভাব ঘটে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে সফল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের উত্তর-পর্বে রাশিয়া ও চীনের রাজনীতিক সংস্কৃতির কথা বলা যায়।
রাজনীতিক সংস্কৃতির পরিবর্তনের বিভিন্ন কারণ:
একটি দেশ বা জাতির রাজনীতিক জীবনের মনোভাব ও মূল্যবোধের পরিবর্তনের ক্ষেত্রে শিল্পায়নের প্রভাব-প্রতিক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ। শিল্পায়ন ছাড়া আরও কতকগুলি বিষয়ের কথা বলা হয় যেগুলি রাজনীতিক মূল্যবোধ ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রে পরিবর্তন সূচিত করে এবং বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থায় নানা রকম চাপ ও প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এই সমস্ত বিষয়ের মধ্যে বহির্দেশীয়দের বসবাসের জন্য ব্যাপক হারে আগমন, যুদ্ধ, বড় কোন যুদ্ধে পরাজয়, বিপ্লব প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই সমস্ত ঘটনা বা বিষয় রাজনীতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন সাধন করে। বল বলেছেন: “Industrialisation is an important factor in changing values and attitudes. Rapid influx of immigrants, war and especially defeat in a major war, revolution, all may provoke changes in political values and beliefs, with subsequent strains on the political system.” যুদ্ধোত্তর পর্বে বিজয়ী রাষ্ট্র বিজিত রাষ্ট্রের উপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তার মতাদর্শ, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গিকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বরাজনীতিতে তার প্রাধান্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার আর্থনীতিক সাম্রাজ্যবাদ কায়েম করেছে। এই সমস্ত মহাদেশের দরিদ্র ও অনগ্রসর দেশগুলিকে আর্থনীতিক সাহায্য-সহযোগিতা প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন রাজনীতিক মূল্যবোধ ও মতাদর্শ, দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্বাস চালান করার চেষ্টা করছে। তার ফলে সাহায্যপ্রাপ্ত দেশগুলির রাজনীতিক সংস্কৃতিতে মার্কিনী প্রভাব অল্পবিস্তর পরিবর্তন কায়েম করেছে। এ প্রসঙ্গে বল মন্তব্য করেছেন: “This sense of mission to extend American values to less fortunate nations was readily amenable to an anti communist crusade, espicially after 1945….”
রাজনীতিক ব্যবস্থার স্থায়িত্বের সঙ্গে সম্পর্ক:
বলের আরও অভিমত হল যে বর্তমান রাজনীতিক সংস্কৃতির সঙ্গে নতুন মনোভাব, মূল্যবোধ, বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গির সামঞ্জস্য সাধনের ক্ষেত্রে সাফল্য ও ব্যর্থতার উপর বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার স্থায়িত্ব বহুলাংশে নির্ভরশীল। বল বলেছেন: “The stability of a political system is underlined by the relative success or failure of the assimilation of new attitudes into the existing value structure….”
Leave a comment