যে-কোন দেশের রাজনীতিক ব্যবস্থায় রাজনীতিক সংস্কৃতির বিচার-বিশ্লেষণ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসাবে বিবেচিত হয়। রাজনীতিক সংস্কৃতির মাধ্যমে দেশবাসীর বা জাতির রাজনীতিক মূল্যবোধ, বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রতীয়মান হয়। মানুষের সামাজিক জীবনে সামাজিক সংস্কৃতি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। অনুরূপভাবে মানুষের রাজনীতিক সংস্কৃতির গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম।
রাজনীতিক সংস্কৃতির গুরুত্ব প্রসঙ্গে লুসিয়ান পাই-এর অভিমত:
রাজনীতিক সংস্কৃতির গুরুত্ব প্রসঙ্গে লুসিয়ান পাই -এর অভিমত আলোচনা করা আবশ্যক। ‘পাই’ তাঁর Aspects of Political Development শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। তাঁর মতানুসারে সামাজিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে সাধারণ সংস্কৃতির এবং রাজনীতিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে রাজনীতিক সংস্কৃতির গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে। রাজনীতিক প্রক্রিয়া পদ্ধতি রাজনীতিক সংস্কৃতির মাধ্যমে সুশৃংখল ও অর্থপূর্ণ হয়ে উঠে। দেশের রাজনীতিক পদ্ধতিকে সুশৃংখল ও অর্থবহ করে তোলার ক্ষেত্রে রাজনীতিক সংস্কৃতি সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তা ছাড়া যে সমস্ত বিধি-নিয়ম ও অনুমানের দ্বারা রাজনীতিক ব্যবস্থার আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রিত হয় তাও রাজনীতিক সংস্কৃতি থেকে উৎসারিত হয়। ব্যক্তি-ভিত্তিক ও সমষ্টি-ভিত্তিক বিচার-বিশ্লেষণের মধ্যে রাজনীতিক সংস্কৃতি সংযোগ সাধন করে। পাই বলেছেন: “Political culture provides a means of linking microanalysis and macro-analysis.” রাজনীতিক আদর্শ এবং রাষ্ট্রীয় কাজকর্ম পরিচালনা সংক্রান্ত বিধি-রীতি রাজনীতিক সংস্কৃতির অঙ্গীভূত থাকে। পাই বলেছেন: “It encompasses both the political ideals and the operating norms of a polity.” তাঁর অভিমত অনুসারে রাজনীতিক মনস্তাত্ত্বিক ও ব্যক্তিগত মাত্রাবোধের এক সমন্বিত অভিব্যক্তি হল রাজনীতিক সংস্কৃতি। এ প্রসঙ্গে তিনি মন্তব্য করেছেন: “Political culture is thus the manifestation in aggregate form of the psychological and subjective dimensions of politics.”
যে-কোন দেশের রাজনীতিক ব্যবস্থা ও রাজনীতিক সংস্কৃতির পারস্পরিক সম্পর্ক গভীর ও ঘনিষ্ঠ। রাজনীতিক সংস্কৃতির ধারণা থেকে বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত হওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে বল তাঁর Modern Politics and Government শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “…an awareness of the basis of the political culture will allow a more detailed picture of the political system to emerge.”
রাজনীতিক সংস্কৃতি ও রাজনীতিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা:
রাজনীতিক সংস্কৃতির প্রকৃতির পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা বা পরিবর্তনের সম্ভাবনা সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত হওয়া যায়। জনসাধারণের রাজনীতিক মূল্যবোধ ও মনোভাবের উপর রাজনীতিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা বহুলাংশে নির্ভরশীল। বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থা, তার মৌলিক কাঠামো ও কার্য প্রক্রিয়া সম্পর্কে জনসাধারণ ব্যাপক ঐকমত্য পোষণ করতে পারে। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট রাজনীতিক ব্যবস্থা বিশেষভাবে শক্তিশালী ও স্থিতিশীল হয়। আবার বিপরীতক্রমে বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার ব্যাপারে ব্যক্তিবর্গের মধ্যে মতামতের ব্যাপক অনৈক্য থাকতে পারে। তখন সেই রাজনীতিক ব্যবস্থা হীনবল হয়ে পড়ে এবং তার স্থিতিশীলতা বিপন্ন হয়। এ প্রসঙ্গে বল বলেছেন: “Where this consensus is weak, there is greater likelihood of the political system being challenged by disorder or even revolution.”
রাজনীতিক সংস্কৃতির মাধ্যমে রাজনীতিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা বা পরিবর্তনের সম্ভাবনা এবং তার প্রকৃতি, পরিধি ও প্রক্রিয়া অনুধাবন করা যায়। আবার বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার ব্যাপারে ব্যক্তি-মানুষ, বিভিন্ন গোষ্ঠী ও সংগঠন, রাজনীতিক দল প্রভৃতির মূল্যবোধ, মনোভাব, দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্বাস বিচার বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট রাজনীতিক সংস্কৃতির দৃষ্টিভঙ্গির সাহায্য গ্রহণ করতে হয়।
রাজনীতিক সংস্কৃতির দৃষ্টিকোণের গুরুত্ব:
ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর বিভিন্ন কার্যকলাপ ও আচার-আচরণের মধ্যে যুক্তিসঙ্গত ও অযৌক্তিক বিভিন্ন বিষয় বা উপাদান থাকে। এই সমস্ত বিষয় যথাযথভাবে অনুধাবন করার জন্য সংশ্লিষ্ট রাজনীতিক সংস্কৃতির পর্যালোচনা প্রয়োজন। রাজনীতিক সংস্কৃতির বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে রাজনীতিক ক্ষেত্রে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর ভূমিকা সম্যকভাবে অনুধাবন করা যায়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাজনীতিক সংস্কৃতির দৃষ্টিকোণ থেকে বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার সামাজিক উপাদানসমূহের উপর জোর দেন। মানব সমাজকে একটি গতিশীল যৌথ সত্তা হিসাবে ব্যাখ্যা করার জন্য রাজনীতিক সংস্কৃতির দৃষ্টিভঙ্গি অপরিহার্য বিবেচিত হয়।
সদ্য স্বাধীন ও অনগ্রসর দেশের ক্ষেত্রে রাজনীতিক সংস্কৃতির গুরুত্ব:
স্বাধীনতাপ্রাপ্ত উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে রাজনীতিক সংস্কৃতির বিচার-বিশ্লেষণ বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। এই সমস্ত অনগ্রসর দেশে বিদ্যমান রাজনীতির প্রতি দেশবাসীর মনোভাব, মূল্যবোধ ও বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিকূল হলে বিকাশজনিত সমস্যা দেখা দেয়। জাতি, ধর্ম, ভাষা, উপ-জাতি, ও গোষ্ঠীগত বিচার-বিবেচনার প্রাধান্য জাতিগত স্বার্থের বিকাশের বিষয়টিকে গুরুত্বহীন করে তোলে। দেশ ও জাতির প্রতি আনুগত্যের অভাব দেখা দেয়। দেশ ও দেশবাসীর সামগ্রিক উন্নতি বাধাপ্রাপ্ত হয়। জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও আঞ্চলিক সংকীর্ণ স্বার্থের সঙ্গে সমগ্র দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থের সংঘাত সৃষ্টি হয়। এই সমস্ত বহু ও বিভিন্ন সত্তার স্বাতন্ত্র্যের পরিপ্রেক্ষিতে অনগ্রসর দেশগুলিতে রাজনীতিক সংস্কৃতির আলোচনার প্রাসঙ্গিকতা বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে।
রাজনীতিক সংস্কৃতির মাধ্যমে রাজনীতিক ব্যবস্থার প্রকৃতি বোঝা যায়:
বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক বিন্যাসের ভিত্তিতে রাজনীতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠে। এই আর্থ-সামাজিক বিন্যাসে সংকট দেখা দিলে রাজনীতিক সংস্কৃতিতেই সংকটের সৃষ্টি হয়। তখন রাজনীতিক ক্ষেত্রে অবক্ষয় আটকানো যায় না। অর্থাৎ রাজনীতিক ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতার অভাব বা অবক্ষয়ের মূল কারণ বর্তমান থাকে রাজনীতিক সংস্কৃতির মধ্যে। রাজনীতিক বিকাশের প্রকৃতি রাজনীতিক সংস্কৃতির প্রকৃতির দ্বারা প্রভাবিত হয়। সুতরাং রাজনীতিক সংস্কৃতির বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমেই বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার বিকাশের চেহারা চরিত্র বোঝা যায়।
রাজনীতিক সচেতনতা রাজনীতির সংস্কৃতিতে প্রতিফলিত হয়:
বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থায় অংশগ্রহণের মাত্রার পরিপ্রেক্ষিতে দেশবাসীর রাজনীতিক বিষয়ে সচেতনতা ও সক্রিয়তার মান অনুধাবন করা যায়। কারণ রাজনীতিক বিষয়ে সচেতনতার প্রকাশ ঘটে রাজনীতিক ক্ষেত্রে অংশ গ্রহণের মাধ্যমে। বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে ব্যক্তিবর্গের মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে এর থেকেই অবহিত হওয়া যায়। এবং সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতিক জীবন সম্পর্কেও ব্যক্তিবর্গের আগ্রহ অনুধাবন করা যায়। প্রকৃত প্রস্তাবে ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও সমগ্র সমাজের রাজনীতিক সচেতনতার মাত্রা রাজনীতিক সংস্কৃতির মধ্যেই প্রতিফলিত হয়।
Leave a comment