দু-শ্রেণীর মৌলিক উপাদান : অ্যালান বল তাঁর Modern Politics and Government শীর্ষক গ্রন্থে রাজনীতিক সংস্কৃতির উপাদান সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তিনি রাজনীতিক সংস্কৃতির মূলত দু’শ্রেণীর উপাদানের কথা বলেছেন। এই সমস্ত উপাদানের দুটি মৌলিক ভাগ হল: রাষ্ট্রের রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রতি মনোভাব এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের ও প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে নিজেরা কতদূর সক্ষম সে ব্যাপারে ব্যক্তিবর্গের ধারণা। বলের নিজের কথায়: “Two fundamental groups of components of a political culture are attitudes to the political institutions of the state and the degree to which citizens feel they can influence and participate in the decision-making process.” বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার স্থায়ীত্ব প্রসঙ্গে এই বক্তব্য গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রের রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রতি ব্যক্তিবর্গের সমর্থন ও আনুগত্য অধিক হলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের কথা সংশ্লিষ্ট রাজনীতিক ব্যবস্থায় অধিকতর শক্তিশালী হয় এবং তার বৈধতা বৃদ্ধি পায়। এই কারণে বলা হয় যে রাজনীতিক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠানসমূহ সম্পর্কে ব্যক্তিবর্গের মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়।
পশ্চিম জার্মানীর রাজনীতিক ব্যবস্থা: অ্যালমন্ড ও ভার্বা এবং ম্যাকইনটায়ার (A. C. Macintyre)-কে অনুসরণ করে বল বিষয়টি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। অ্যালমন্ড ও ভার্বা অভিজ্ঞতাবাদী সমীক্ষার সাহায্যে বিষয়টি পর্যালোচনা করেছেন। এই দুই আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতানুসারে মার্কিনীদের মধ্যে ৮৫ শতাংশ তাদের রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ সম্পর্কে গর্বিত। পশ্চিম জার্মানীর নাগরিকদের ক্ষেত্রে এই হিসাব হল মাত্র ৭ শতাংশ। জার্মানীরা তাদের আর্থনীতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে বিশেষভাবে গর্ববোধ করে। বিভিন্ন রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা করলে দেখা যাবে যে পশ্চিম জার্মানীর নাগরিকরা তাদের আমলাতন্ত্র ও বিচারব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু দেশের রাজনীতিবিদদের প্রতি দেশবাসীর এই শ্রদ্ধা নেই। পশ্চিম জার্মানীতে রাজনীতিক ব্যবস্থার স্থায়ীত্ব আর্থনীতিক ব্যবস্থার সন্তোষজনক সাফল্যের উপর অধিকতর নির্ভরশীল। এই স্থায়ীত্ব প্রতিনিধিত্বমূলক সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপর ততটা নির্ভরশীল নয়। তা ছাড়া পশ্চিম জার্মানীর রাজনীতিক ব্যবস্থার কর্তৃত্ববাদী উপাদানের উপরও এই স্থিতিশীলতা বহুলাংশে নির্ভরশীল।
রাজনীতিক কর্তৃত্বের উৎসের প্রতি মনোভাব: রাজনীতিক কর্তৃত্বের উৎসের প্রতি মনোভাব বা মূল্যবোধের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে সমর্থনসূচক মনোভাব রাজনীতিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতার বিষয়টিকে সুনিশ্চিত করে। রাজনীতিক কার্যাবলীর ধরন-ধারণের ক্ষেত্রেও এর গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এই কারণে রাজনীতিক কর্তৃত্বের প্রতি মনোভাবের বিষয়টিও রাজনীতিক সংস্কৃতির আলোচনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়। বল বলেছেন: “Attitudes to source of political authority are important, not only for the stability of the political system, but also for the style of political activity.” “গ্রেট ব্রিটেনের রাজনীতিক ব্যবস্থা প্রসঙ্গে একটি ধারণা বিশেষভাবে প্রচলিত আছে। ব্রিটেনের রাজনীতিক নেতাদের উপর দেশবাসীর গভীর ও ব্যাপক বিশ্বাস পরিলক্ষিত হয়। বিশ্বাস করা হয় যে রাজনীতিক নেতারা সর্বসাধারণের স্বার্থের জন্য কাজ করেন। তাঁরা কোন গোষ্ঠী স্বার্থের দ্বারা প্রভাবিত বা পরিচালিত হয় না। ব্রিটিশ রাজনীতিক ব্যবস্থায় রাজনীতিক নেতৃবৃন্দের প্রতি সপ্রশংস ও শ্রদ্ধাশীল মনোভাব পরিলক্ষিত হয়। The Civic Culture গ্রন্থে অ্যালমন্ড ও ভার্বা-এর অভিমতকে অনুসরণ করে বল এ প্রসঙ্গে বলেছেন: “Respect and admiration are features of persistent attitude, even of particular leader are not greatly liked.” এ ক্ষেত্রে মার্কিন রাজনীতিক ব্যবস্থার অবস্থা আলাদা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাজনীতিবিদদের প্রতি জনসাধারণের শ্রদ্ধা কম। তবে এই শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের অভাব মার্কিন রাজনীতিক ব্যবস্থার অস্থিরতা বা অস্থিতিশীলতার কারণ হয়ে দাঁড়ায় না।
স্থিতিশীল উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা: স্থিতিশীল উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার সীমানা সাধারণত সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্টভাবে টানা হয়। বল বলেছেন: “In stable liberal democracies the boundaries of the political system are fairly firmly drawn.” এ ধরনের রাজনীতিক ব্যবস্থায় সরকারী কার্যাবলীর সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে বিশ্বাস করা হয়। এই ব্যবস্থায় ব্যক্তি স্বাধীনতার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয় এবং জোর দেওয়া হয়। সঙ্গে সঙ্গে সরকারের কাজকর্মের মাধ্যমে ব্যক্তির কল্যাণ আশা করা হয়। এ প্রসঙ্গে বল বলেছেন: “This again stems from the basis of trust in political leadership, and a belief that the unwritten rules of the political game will be respected by all the participants.”
সামর্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা ও শিক্ষার বিকাশের হার: বলের অভিমত অনুসারে রাজনীতিক নেতৃবৃন্দের উপর আস্থা ও বিশ্বাসের বিষয়টি আর্থ-সামাজিক বিকাশের মাত্রা বা স্তরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। আরও বলা হয় যে নাগরিকদের মধ্যে তাদের সামর্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা শিক্ষার বিকাশের হারের উপর নির্ভরশীল। শিক্ষার মান যত উন্নত হবে নাগরিকদের নিজেদের সামর্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা তত বেশী হবে। বল বলেছেন: “This trust is linked to the level of socio-economic development in that higher the level of education, the greater will be the sense of competence on the part of the citizens.” শিক্ষার হার বেশী ও মান উন্নত হলে সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও নীতিনির্ধারণের প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে জনসাধারণের আগ্রহ আকর্ষণ বৃদ্ধি পায়। সরকারের যাবতীয় কাজকর্ম সম্পর্কে জনগণের সতর্কতা বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ রাজনীতিক সচেতনতা ও রাজনীতিক বিষয়ে অংশগ্রহণের হার বৃদ্ধি পায়। কারণ জনগণ সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও নীতি নির্ধারণের প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার ব্যাপারে সর্বতোভাবে উদ্যোগী হয়। জনগণের এই প্রভাবের পরিধি সম্পর্কে বিশ্বাসের সঙ্গে বাস্তবে প্রভাবের মাত্রা বা স্তর সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বল বলেছেন: “The actual level of influence is not necessarily related to the belief in the extent of that influence.” বলা হয় যে, সামর্থ্যের চেতনা অধিক হলে বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে সন্তুষ্টি এবং সংশ্লিষ্ট রাজনীতিক ব্যবস্থার প্রতি আনুগত্য অধিক হয়। এবং তারফলে রাজনীতিক ব্যবস্থার বৈধতা ও রাজনীতিক স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পায়। অ্যালমন্ডও ভার্বাকে অনুসরণ করে বল এ প্রসঙ্গে বলেছেন: “…the higher the sense of competence, the greater the satisfaction with, and loyalty to the political system. This in turn increases the legitimacy of the system and hence political stability.”
Leave a comment