রাজনীতিক সংযোগসাধনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য:
নির্বাচনী আচরণ এবং রাজনীতিক সংযোগ সাধনের মধ্যে সম্পর্ক বর্তমান। রাজনীতিক বিষয়াদি সম্পর্কে সংযোগসাধনের সঙ্গে ভোটদাতাদের নির্বাচনী আচরণের যে সুস্পষ্ট সম্পর্ক থাকে এ বিষয়ে দ্বি-মতের অবকাশ নেই। অ্যালান বল তাঁর Modern Politics and Government শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “It is clear that there is a relationship between voting behaviour and the communication of political information.” অধ্যাপক বল-এর অভিমত অনুসারে নির্বাচকমণ্ডলীর অধিকাংশই রাজনীতিক বিষয়াদিতে খুব বেশী আগ্রহী থাকেন না। শুধু ভোট প্রদানটুকু ছাড়া সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটদাতা রাজনীতিক প্রক্রিয়ায় প্রত্যক্ষভাবে নিজেদের জড়িয়ে ফেলতে চান না। তা ছাড়া রাজনীতিক বিষয়ে তাঁদের জ্ঞানও সাধারণত কম থাকে। এই কারণে রাজনীতিক সংযোগসাধন সম্পর্কে বিশদভাবে অবহিত হওয়া আবশ্যক। বল বলেছেন: “It is, therefore, important to know as much as possible about how political information is conveyed to the electorate, and to be able to assess the effect of these messages on the receipients.” প্রকৃত প্রস্তাবে প্রাপ্ত সংবাদ ও তথ্যাদির মাধ্যমে নির্বাচকদের রাজনীতিক সিদ্ধান্ত ও নির্বাচনী আচরণ নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। অনুরূপভাবে রাজনীতিক নেতৃবৃন্দের কার্যধারা ও ভূমিকা বহুলাংশে সংগৃহীত সংবাদ ও তথ্যাদির উপর নির্ভরশীল। নির্বাচনী আচরণের কথা বাদ দিলেও, জনসাধারণের রাজনীতিক কার্যকলাপের ধরন-ধারণ বহুলাংশে রাজনীতিক সংযোগসাধনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়ে থাকে। অনেকের অভিমত অনুসারে রাজনীতিক কাজকর্ম মাত্রেই হল রাজনীতিক সংযোগসাধনের কার্য। রাজনীতিক সংযোগসাধন সম্পর্কে বিচার-বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি লাভ করা যায়। বর্তমানে সংযোগ-সাধনের ব্যবস্থা তার ব্যাপকতার পরিপ্রেক্ষিতে সভ্য জীবনের স্নায়ু হিসাবে প্রতীয়মান হয়। বেতার, দূরদর্শন, সংবাদপত্র প্রভৃতি গণমাধ্যমের সাহায্যে জনসাধারণ বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার সমস্যাদি সম্পর্কে অবহিত হওয়ার সুযোগ পায়। জনগণ দেশের রাজনীতিক নেতৃবৃন্দের কার্যধারা, নীতি ও সিদ্ধান্ত সম্পর্কে বিভিন্ন বিষয় জানতে পারে। বস্তুত বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে জ্ঞানলাভের জন্য রাজনীতিক সংযোগসাধন সম্পর্কে অবহিত হওয়া আবশ্যক।
রাজনীতিক সংযোগসাধনের প্রক্রিয়া:
রাজনীতিক সংযোগসাধন কাকে বলে তা জানা দরকার। রাজনীতিক সংযোগসাধন বলতে এক বিশেষ প্রক্রিয়া বা পদ্ধতিকে বোঝায়। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিশেষ কোন বিষয়ে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী অপর কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে তার মনোভাব বা দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে অবহিত করে। সাধারণত ভাষার মাধ্যমে লিখিত বা মৌখিকভাবে সংযোগসাধন সম্পাদিত হয়। রাজনীতি-সম্পর্কিত সংবাদ ও তথ্যাদি এবং দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিজ্ঞতার আদান-প্রদানকেই রাজনীতিক সংযোগসাধন বলা হয়। সাধারণত গণসংযোগের মাধ্যমগুলিই রাজনীতিক তথ্য ও সংবাদ সরবরাহ করে এবং রাজনীতিক সংযোগসাধনের প্রক্রিয়াকে অব্যাহত রাখে। রাজনীতিক সংযোগসাধনের সরকারী ব্যবস্থা হিসাবে সরকারের আইন-বিভাগ, শাসন-বিভাগ, জনসংযোগ-বিভাগ এবং সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত বেতার, দূরদর্শন প্রভৃতির কথা বলা হয়। আবার সরকারী নিয়ন্ত্রণের বাইরে বিভিন্ন রাজনীতিক দল, সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীসমূহ প্রভৃতির ভূমিকাও এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। অর্থাৎ রাজনীতিক সংযোগসাধন বলতে রাজনীতিক ক্ষেত্রে সংবাদ, তথ্য ও অভিজ্ঞতার আদান-প্রদানের যে ব্যবস্থাকে বোঝায় তা সরকারী ও বে-সরকারী সংস্থা বা কাঠামোর মাধ্যমে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। এবং বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার মাধ্যমেই তা সম্পাদিত হয়। রাজনীতিক সংযোগসাধনের কাঠামোগত দিক আলোচনার মাধ্যমে বিভিন্ন রাজনীতিক ব্যবস্থার মধ্যে তুলনামূলক মূল্যায়ন করা যায় এবং তারতম্য বিচার-বিশ্লেষণ করা যায়।
রাজনীতিক সংযোগসাধনকারী হিসাবে রাজনীতিক দল:
যে-কোন রাজনীতিক ব্যবস্থায় বিভিন্ন সংগঠন, প্রতিষ্ঠান বা গোষ্ঠী রাজনীতিক সংযোগসাধনের ভূমিকা পালন করে। এই সমস্ত সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানকে বলে রাজনীতিক সংযোগসাধনকারী প্রতিষ্ঠান। রাজনীতিক সংযোগকারী প্রতিষ্ঠান তার কাজকর্মের মাধ্যমে সরকারের নীতি নির্ধারণের ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে এবং সরকারী কার্যাবলীকে নিয়ন্ত্রণ করে। বর্তমানে সকল রাজনীতিক ব্যবস্থায় রাজনীতিক সংযোগসাধনকারী হিসাবে রাজনীতিক দল এবং চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীসমূহের ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বল বলেছেন: “Political parties have channels of communication to the electorate, and this ability to convey both information and opinions are not merely confined to election periods but is a continuing process.” এ প্রসঙ্গে বল লর্ড উইনডিলশ্যাম (Lord Windlesham) -এর Communication and Political Power শীর্ষক রচনা থেকে একটি উদাহরণ তুলে ধরেছেন। এই উদাহরণে বলা হয়েছে যে, গ্রেট ব্রিটেনে ১৯৫৭ ও ১৯৫৯ সালের মধ্যে রক্ষণশীল দল তার প্রতি বিরূপ নির্বাচকমণ্ডলীকে পরিবর্তিত করে দলের সমর্থক নির্বাচকমণ্ডলীতে পরিণত করতে পেরেছিল। এ ক্ষেত্রে রক্ষণশীল দল প্রথমেই প্রত্যক্ষভাবে গণ-মাধ্যমসমূহের সাহায্যে কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। তার পরিবর্তে এই দল স্থানীয় স্তরে দলের সক্রিয় কর্মীদের মাধ্যমে উদ্যোগ-আয়োজন গ্রহণ করেছিল এবং সফল হয়েছিল।
রাজনীতিক সংযোগসাধনকারী হিসাবে গণ-সংযোগের মাধ্যমসমূহ:
বর্তমানে সকল রাজনীতিক ব্যবস্থাতেই রাজনীতিক সংযোগসাধনকারী হিসাবে গণ-সংযোগের মাধ্যমসমূহের গুরুত্ব ও তাৎপর্য যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। সাম্প্রতিককালে সকল দেশেই নির্বাচকণ্ডলী আকারে প্রকারে যথেষ্ট বেড়েছে। সরকারী কাজকর্মের জটিলতা বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে, জনমত নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বহু ও বিভিন্ন কলাকৌশলের সৃষ্টি হয়েছে প্রভৃতি। এই সমস্ত কারণের জন্য গণ-সংযোগের মাধ্যমসমূহের গুরুত্ব বেড়েছে। এই সমস্ত মাধ্যমের সাহায্যে জনসাধারণের ইচ্ছা-অনচ্ছিা, চিন্তা-ভাবনা, অভাব-অভিযোগ অভিব্যক্তি লাভ করে। তারফলে রাজনীতিক নেতৃবৃন্দ ও সরকারের কর্তাব্যক্তিরা জনসাধারণের সমস্যাদি সম্পর্কে অবহিত হওয়ার সুযোগ পান। জনসংযোগসাধনকারী মাধ্যমসমূহের স্বাধীনতা, সাফল্য ও কার্যকারিতা এই সমস্ত মাধ্যমের উপর সরকারী নিয়ন্ত্রণ আরোপিত হওয়া বা না হওয়ার উপর নির্ভরশীল। বর্তমানে প্রায় সকল রাজনীতিক ব্যবস্থাতেই গণ-সংযোগ সম্পাদনকারী মাধ্যমসমূহের নিয়ন্ত্রণ ও তার ফলাফল গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়। বল বলেছেন: “the control and effect of the mass media are most important considerations in all political system. Socialist and autocratic regimes are particularly concerned with government control of the mass media….” পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের সংবাদ মাধ্যম সমূহ সরকারের দ্বারা সরাসরি নিয়ন্ত্রিত হত। সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থায় জনসংযোগের মাধ্যমসমূহের উপর সরকারী নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা সুবিদিত। উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় গণ-সংযোগের মাধ্যমসমূহের পরিপূর্ণ স্বাধীনতার কথা বলা হয়। কিন্তু বাস্তবে উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেও এই সমস্ত মাধ্যমের উপর সরকারের পরোক্ষ, প্রচ্ছন্ন ও নিপুণ নিয়ন্ত্রণ থাকতে পারে। তা ছাড়া এই ধরনের রাজনীতিক ব্যবস্থায় সরকার সাধারণত গণ সংযোগসাধনকারী মাধ্যমসমূহের প্রতি অতিমাত্রায় সংবেদনশীল হয়ে থাকে। তারফলে তথ্যাদি ও অভিজ্ঞতার আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে অসুবিধার সৃষ্টি হয়। এর ফলেও সুস্থ জনমত গঠনের পথে বাধার সৃষ্টি হয়। বল বলেছেন: “Restriction of mass media competition in liberal democratic systems and the degree of government control may be more subtle.” উদারনীতিক গণতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থায় সংবাদমাধ্যম সমূহের উপর সরকারের প্রকাশ্য নিয়ন্ত্রণ না থাকতে পারে। কিন্তু সংবাদপত্র, বেতার, দূরদর্শন প্রভৃতি জনসংযোগের মাধ্যমসমূহের মালিকানা মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের হাতে কেন্দ্রীভূত থাকতে পারে। মালিকানার এই কেন্দ্রীভবন সংবাদমাধ্যমগুলির স্বাধীনতাকে বিপন্ন করে। তার ফলে নির্ভীক, নিরপেক্ষ ও স্বাধীন সংবাদ পরিবেশন প্রহসনে পরিণত হয়। কারণ মালিক গোষ্ঠীর শ্রেণী-স্বার্থ ও দৃষ্টিভঙ্গির উপর সংবাদ পরিবেশনের বিষয়টি আকারে প্রকারে নিয়ন্ত্রিত হয়। বল বলেছেন: “The trivialisation of political news, the manner in which information is presented and what is omitted may be politically significant…” গণসংযোগের মাধ্যমসমূহের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে বল আরও বলেছেন: “It may be that readers and viewers are only willing to expose themselves to political views that they already agree with, and perhaps the relative apathy, not to be confused with ignorance, of the population may be an excellent means of defence against the onslaughts of the mass media.”
স্থানীয় ও ব্যক্তিগত পর্যায়ের সংযোগসাধন:
জনমত গঠনের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত পর্যায়ের সংযোগসাধন অনেক সময় অধিকতর কার্যকর প্রতিপন্ন হয়। জন-সংযোগসাধনকারী ও রক্ষাকারী বিভিন্ন মাধ্যমের থেকে এর কার্যকারিতা বেশী অর্থবহ। আবার এ ক্ষেত্রে জনমত গঠনকারী স্থানীয় স্তরের নেতাদের ইতিবাচক ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বল বলেছেন: “the most effective means of influencing public opinion is not through the mass media but at the level of personal contacts through local opinion leaders whose authority may stem from other than political roots.
রাজনীতিক সংযোগসাধনের অন্যান্য মাধ্যম:
যে-কোন রাজনীতিক ব্যবস্থায় রাজনীতিক সংযোগসাধনের ক্ষেত্রে কেবলমাত্র সংযোগকারী মাধ্যমগুলি যাবতীয় ভূমিকা পালন করে, তা নয়। সংবাদপত্র, বেতার, দূরদর্শন প্রভৃতি গণ-সংযোগের মাধ্যমগুলি ছাড়াও রাজনীতিক সংযোগসাধনের অন্যান্য মাধ্যম বা উপায়ও আছে। এ ক্ষেত্রে রাজনীতিক দল ও চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলির কথা আগেই বলা হয়েছে। তা ছাড়া প্রতিনিধিদল, রাজনীতিক নেতৃবৃন্দ প্রভৃতির ব্যক্তিগত ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য। বল বলেছেন: “The mass media should not be seen as the only means of political communi-cations in the political system. Other poliltical agencies, such as leaders, representatives, parties and pressure groups, contribute to this communication network at various levels.”
অ্যালান বলের অভিমত অনুসারে রাজনীতিক বিষয়ে সংযোগসাধন
অ্যালান বলের অভিমত অনুসারে রাজনীতিক সংযোগসাধনের প্রক্রিয়াটি কেবল একটি একমুখী ব্যবস্থা নয়। শুধুমাত্র উপর থেকেই যে রাজনীতিক সংযোগসাধন সম্পাদিত হয় তা নয়। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিক বিষয়ে জনগণও অনেক সময় তাদের মতামত ধারণা ও চাহিদা জ্ঞাপন করে। জন সাধারণের এই সমস্ত মতামত, ধারণা ও চাহিদা সরকারের নীতি নির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে থাকে। বল মন্তব্য করেছেন: “the movement is not only one way Ideas, demands, opinions are being communicated upwards from below as well.” বল এ প্রসঙ্গে জনমত সমীক্ষার বিষয়টির উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি বলেছেন: “Public opinion polls are another means of estimating opinion on various matters, including fore casting election result.”
Leave a comment