রাজনীতিক ক্ষমতা গুরুত্বপূর্ণ: সাম্প্রতিককালের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় ক্ষমতা (Power) হল একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাজনীতিক মতাদর্শের মত রাজনীতিক ক্ষমতার আলোচনাও বর্তমানে তাৎপর্যপূর্ণ। সর্বোপরি রাজনীতিক মতাদর্শ এবং রাজনীতিক ক্ষমতার পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়টি অধিকতর তাৎপর্যমণ্ডিত। রাজনীতিক মতাদর্শ সম্পর্কে ধারণা লাভের সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতিক ক্ষমতার সঠিক অর্থ সম্পর্কে অবহিত হওয়া আবশ্যক। কারণ বর্তমানে রাজনীতিক ক্ষেত্রে নীতি নির্ধারণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং রাজনীতিক আচার-আচরণ বহুলাংশে রাজনীতিক ক্ষমতার দ্বারা নির্ধারিত হয়ে থাকে। অ্যালান বলের অভিমত অনুসারে ক্ষমতা হল একটি অন্যতম মুখ্য ধারণা।

ক্ষমতার অর্থ: সাধারণভাবে বলা যেতে পারে যে ক্ষমতা বলতে আর্থ-সামাজিক বা রাজনীতিক ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সামর্থ্যকে বোঝায়। অর্থাৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা অন্যান্যদের উপর প্রভাব বিস্তার করার সামর্থ্যই হল ক্ষমতা। সুতরাং সামর্থ্যই ক্ষমতা হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকে। রাজনীতিক ক্ষমতা অন্যান্যদের কাজকর্মকে প্রভাবিত করার সামর্থ্যের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকে। এ দিক থেকে বিচার করলে রাজনীতিক ক্ষমতা হল এক ধরনের সম্পর্ক বিষয়ক অবস্থা বা ঘটনা। International Politics শীর্ষক গ্রন্থে ফ্রাঙ্কেল (J. Frankel) বলেছেন যে, অন্যান্যদের ক্রিয়াকলাপ ও মনের উপর রাজনীতিক ক্ষমতা প্রযুক্ত হয়ে থাকে। ল্যাসওয়েল ও ক্যাপলান (Lasswell & Kaplan) তাঁদের Power and Society গ্রন্থে এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অংশগ্রহণই হল ক্ষমতা (Power is participation in the making of decisions.”)। এই দুই আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতে এক বিশেষ ধরনের প্রভাবের প্রয়োগই হল ক্ষমতা। ডেভিড ইস্টন তাঁর The Political System শীর্ষক গ্রন্থে ক্ষমতাকে এক ধরনের সম্পর্ক হিসাবে অভিহিত করেছেন। এই সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে নিজেদের উদ্দেশ্য অনুসারে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী অপর কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাজকর্মকে নিয়ন্ত্রণ করে। Politics Among Nations শীর্ষক গ্রন্থে ব্যক্ত মরগেনথাউ (H. J. Morgenthau)-এর অভিমত অনুসারে সরকারী কর্তৃত্বযুক্ত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে পারস্পরিক নিয়ন্ত্রণমূলক সম্পর্ক এবং এদের সঙ্গে জনগণের পারস্পরিক নিয়ন্ত্রণমূলক সম্পর্কই হল রাজনীতিক ক্ষমতা। অর্থাৎ মরগেনথাউও রাজনীতিক ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণমূলক সম্পর্ক হিসাবে প্রতিপন্ন করেছেন। অ্যালান বলও তাঁর Modern Politics and Government শীর্ষক গ্রন্থে রাজনীতিক ক্ষমতাকে এক ধরনের সম্পর্ক হিসাবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন: “Political power is a relationship.” তাঁর আরও অভিমত হল যে রাজনীতিক ক্ষমতা বলতে অন্যান্যদের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করার সামর্থ্যকে বোঝায়। অপরের আচরণকে প্রভাবিত করার জন্য শাস্তির ভয় দেখান হয়। রাজনীতিক ক্ষমতা বোঝাতে বল বলেছেন: “the capacity to affect other’s behaviour by the threat of some form of sanctions.” সুতরাং রাজনীতিক ক্ষমতার পরিমাণ ও পরিধি ভীতি প্রদর্শনের কার্যকরিতা ও ব্যাপ্তির উপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল।

বলের বক্তব্য: অ্যালান বলের অভিমত অনুসারে রাজনীতিক ক্ষমতার বণ্টন ব্যবস্থার সঙ্গে রাজনীতিক মতাদর্শ জড়িত থাকে। তা ছাড়া রাজনীতিক মতাদর্শের মাধ্যমে রাজনীতিক ক্ষমতার বণ্টনের প্রকৃতি পর্যালোচনা করা হয় এবং এই বণ্টন ব্যবস্থার ন্যায্যতা প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করা হয়। রাজনীতিক মতাদর্শ প্রচলিত সমাজব্যবস্থার প্রতি সমর্থন জানায় এবং সংশ্লিষ্ট সমাজব্যবস্থার স্থিতিশীলতার স্বার্থে যাবতীয় ব্যবস্থাদি গ্রহণ করে। আবার বিদ্যমান সমাজব্যবস্থা বিপজ্জনক প্রতিপন্ন হলে রাজনীতিক মতাদর্শ তার সংস্কার বা পরিবর্তন সাধনের ব্যাপারে উদ্যোগী হয়। বল বলেছেন: “All ideologies are concerned with nature of distribution of power.” তিনি আরও বলেছেন: “Perhaps the most important function of an ideology in a political system is to legitimise the political structures and the distribution of political power.”

সকল রাজনীতিক মতাদর্শেরই উদ্দেশ্য হল ক্ষমতা দখল করা। রাজনীতিক মতাদর্শের কার্যক্রমকে কার্যকর করার জন্য এই ক্ষমতার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। ক্ষমতা অধিকার করা সকল মতাদর্শের লক্ষ্য হলেও, এই লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার উপায়-পদ্ধতির ব্যাপারে বিভিন্ন রাজনীতিক মতাদর্শের মধ্যে পার্থক্য বর্তমান। এ ক্ষেত্রে কোন কোন মতবাদ আইনানুগ অর্থাৎ শাসনতান্ত্রিক বা সংস্কারমূলক পদ্ধতি অবলম্বনের পক্ষপাতী। উদাহরণ হিসাবে উদারনীতিক গণতান্ত্রিক মতবাদসমূহের কথা বলা যায়। আবার কোন কোন মতবাদ ক্ষমতা দখলের জন্য বৈপ্লবিক পদ্ধতি অবলম্বনের পক্ষপাতী। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে মার্কসবাদ লেনিনবাদের কথা বলা যায়।

ক্ষমতা দখল রাজনীতিক মতাদর্শের লক্ষ্য: রাজনীতিক মতাদর্শ এবং রাজনীতিক ক্ষমতার বিষয়টি দু’টি দিক থেকে বিচার-বিবেচনা করা দরকার। এ প্রসঙ্গে শ্রেষ্ঠতাবাদ (Elitism) এবং মার্কসবাদ (Marxism) -এর সংক্ষিপ্ত উল্লেখ আবশ্যক।

শ্রেষ্ঠতাবাদ: শ্রেষ্ঠতাবাদের প্রবক্তাদের মধ্যে মস্কা [Mosca (1858-1941)] এবং প্যারেটো [Pareto (1848-1923)]-র নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শ্রেষ্ঠতাবাদ অনুসারে শাসক শ্রেণীকে বলা হয় এলিট শ্ৰেণী। গুণগত যোগ্যতার বিচারে যারা উন্নত সমাজে তারাই শাসক শ্রেণীর ক্ষমতা ও মর্যাদা লাভ করে। সমাজের অন্যান্যরা শাসিত হয়ে থাকে। শ্রেষ্ঠতাবাদ অনুসারে সমাজে ক্ষমতার উৎস হল এলিটরা। তারাই হল ক্ষমতার প্রয়োগকর্তা। এবং এই এলিট শ্রেণীই হল সমাজের প্রকৃত প্রভু। আর্থনীতিক দিক থেকে প্রভাবশালী শ্রেণীর শাসনই হল শ্রেষ্ঠতাবাদ। শ্রেষ্ঠতাবাদ অনুসারে সমাজের একটি সংখ্যালঘিষ্ঠ শ্রেণীর হাতেই সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকে। এই মতাদর্শ সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ক্ষমতা বিস্তারের বিরুদ্ধে। এলিট শ্রেণী সমাজের সাধারণ মানুষকে সব সময় নানা অছিলায় ক্ষমতার আঙ্গিনা থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। শ্রেষ্ঠতাবাদের অন্যতম অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য হল এই বৈষম্য। এই মতাদর্শ অনুসারে গণতন্ত্রকে তত্ত্বগতভাবে স্বীকার করা হয়। কিন্তু এই তাত্ত্বিক স্বীকৃতি অর্থহীন। কারণ বাস্তবে গণতন্ত্রের মৌল আদর্শগুলি শ্রেষ্ঠতাবাদে অস্বীকৃত। রাষ্ট্রের আরক্ষা এবং সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা এলিট শ্রেণীর নিয়ন্ত্রণাধীনে থাকে। এবং শাসনকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে এই শ্রেণী পীড়নমূলক শক্তির সাহায্য নেয়। এলিট শ্রেণী সব সময় সাংবিধানিক নিয়মকানুন মেনে শাসনকার্য পরিচালনা করে না। ক্ষেত্রবিশেষে এলিট শ্রেণী স্বৈরী ক্ষমতার সাহায্য নেয়।

মতাদর্শগত বিচারে মার্কসবাদ হল শ্রেষ্ঠতাবাদের বিরুদ্ধে। মার্কসবাদে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করার কথা বলা হয়। মার্কসবাদ অনুসারে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ সর্বহারা শ্রেণী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করবে এবং এই শ্রেণীই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী হবে। অর্থাৎ জনসাধারণের হাতেই রাজনীতিক ক্ষমতা ন্যস্ত থাকবে। জনসাধারণই হবে প্রকৃত ক্ষমতার উৎস। মার্কসীয় মতাদর্শ অনুসারে সমাজে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়।

পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় রাজনীতিক ক্ষমতার অসম বণ্টন এবং শ্রেষ্ঠতাবাদ: পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় বুর্জোয়া তাত্ত্বিকরা রাজনীতিক ক্ষমতা বণ্টনের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠতাবাদকে সমর্থন করে থাকেন। তাঁরা বাছাই করা ব্যক্তিবর্গের হাতে রাজনীতিক ক্ষমতা ন্যস্ত করার পক্ষপাতী। তত্ত্বগতভাবে বুর্জোয়া চিন্তাবিদগণ মানবাধিকার, গণসার্বভৌমত্ব, ন্যায়বিচার প্রভৃতির কথা বলেন। কিন্তু এই সমস্ত তত্ত্বের আড়ালে রাজনীতিক ক্ষমতার অসম বণ্টন প্রচ্ছন্ন থাকে। গুণগত যোগ্যতার অভাবের অছিলায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণকে বিচ্ছিন্ন রাখা হয়। বস্তুত আর্থনীতিক ক্ষেত্রে সমবণ্টন ব্যতিরেকে রাজনীতিক ক্ষমতার সুষম বণ্টন অসম্ভব। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় আর্থনীতিক ক্ষমতার সুষম বণ্টন হয় না, হওয়া সম্ভব নয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় উৎপাদনের উপাদানসমূহের মালিকানা কেন্দ্রীভূত থাকে মুষ্টিমেয় পুঁজিপতিদের হাতে। এই সমাজে পুঁজিপতি শ্রেণী প্রাধান্যকারী শ্রেণী হিসাবে কর্তৃত্ব করে। এই মুষ্টিমেয় ব্যক্তিবর্গের স্বার্থের অনুকূলে ক্ষমতা বণ্টিত থাকে। সংখ্যালঘু পুঁজিপতিরা সংখ্যাগুরু সাধারণ মানুষের উপর শাসন-শোষণ কায়েম করে। এই ধরনের রাজনীতিক ব্যবস্থায় আর্থনীতিক ক্ষমতা অসমভাবে বণ্টিত থাকে। এবং এই কারণের জন্য রাজনীতিক ক্ষমতাও অসমভাবে বণ্টিত থাকে। উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রবক্তারা রাজনীতিক ক্ষমতার অসম বণ্টনকে তত্ত্বগতভাবে সমর্থন করেন না। এ কথা ঠিক। কিন্তু তাঁরা বাছাই করা ব্যক্তিবর্গের প্রতিভা এবং সাধারণ মানুষের গুণগত যোগ্যতার অভাব, অর্থাৎ শ্রেষ্ঠতাবাদকে সমর্থন করেন। রাজনীতিক ক্ষমতার অসম বণ্টনের জন্য তাঁরা মানুষের যোগ্যতাগত পার্থক্যের কথা বলেন। তাঁরা আর্থনীতিক বৈষম্য ও রাজনীতিক সাম্যকে একসঙ্গে সমর্থন করেন। অথচ আর্থনীতিক ক্ষেত্রে সাম্য ব্যতিরেকে রাজনীতিক ক্ষেত্রে সাম্য কল্পনাবিলাস মাত্র। প্রকৃত প্রস্তাবে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় রাজনীতিক ক্ষমতার অসম বণ্টনকে বুর্জোয়া তাত্ত্বিকরা শ্রেষ্ঠতাবাদের সাহায্যে সমর্থন করে থাকেন।

মার্কসীয় ধারণা অনুসারে রাজনীতিক ক্ষমতার বণ্টন: সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় রাজনীতিক ক্ষমতা বণ্টনের ব্যাপারে রাজনীতিক মতাদর্শ প্রকৃত সাম্যের নীতি প্রয়োগ করে থাকে। রাজনীতিক ক্ষমতার অধিকার ও প্রয়োগের ব্যাপারে সমাজের সকলের অংশগ্রহণকে সুনিশ্চিত করা হয়। জনসাধারণের রাজনীতিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এই উদ্দেশ্যে আর্থনীতিক ক্ষেত্রে বৈষম্য ও শ্রেণী-দ্বন্দ্বের অবসান ঘটান হয়। মার্কসীয় মতাদর্শ অনুসারে রাজনীতিক ক্ষমতার বণ্টন এবং তার ভিত্তি ও প্রকৃতি সমাজের আর্থনীতিক ক্ষমতার বণ্টন এবং তার ভিত্তি ও প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ নিছক রাজনীতিক উপাদানসমূহের দ্বারা রাজনীতিক ক্ষমতার বণ্টন নিয়ন্ত্রিত হয় না। ধনবৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থায় আর্থনীতিক ক্ষেত্রে অসম ক্ষমতার অস্তিত্বের কারণে রাজনীতিক ক্ষমতার সমবণ্টন অসম্ভব হয়ে পড়ে। আর্থনীতিক ক্ষমতা বণ্টনের সঙ্গে রাজনীতিক ক্ষমতাবণ্টন সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে থাকে। রাজনীতিক ক্ষমতা কখনই আর্থনীতিক ক্ষমতার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে না। যদি তা হয় তাহলে সংশ্লিষ্ট রাজনীতিক ক্ষমতাকে ক্ষুণ্ন করা হয়। মার্কসবাদীরা রাজনীতিক ক্ষমতা বণ্টনের ভিত্তি হিসাবে আর্থ-সামাজিক বিন্যাসের প্রকৃতির উপর জোর দেন। রাজনীতিক ক্ষমতা বণ্টনের প্রকৃতি আর্থনীতিক ক্ষমতা বণ্টনের প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল।