রাজনীতি বলতে রাষ্ট্রনীতিক কার্যকলাপকেই বোঝায়। এবং সাধারণভাবে রাজনীতিক কার্যকলাপের অন্তর্ভুক্ত বিষয়াদির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল মতভেদ, মতভেদের মীমাংসা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, ক্ষমতা, কর্তৃত্ব প্রভৃতি। অধ্যাপক অ্যালান বলের অভিমত অনুসারে রাজনীতিক কাজকর্ম বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল রাজনীতিক ভাবধারা। Modern Politics and Government শীর্ষক গ্রন্থে অ্যালান বল বলেছেন: “Political ideas are another important element in the analysis of political activity.”

সমাজের মধ্যেই রাজনীতিক ভাবধারার উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে। এই কারণে সমাজব্যবস্থা থেকে ভাবধারাকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করা যায় না। তবে, অধ্যাপক বলের মতানুসারে, সমাজব্যবস্থার কাঠামোর উপর রাজনীতিক ভাবধারা পুরোপুরি নির্ভরশীল নয়। মতভেদ এবং মতভেদের মীমাংসা হল রাজনীতিক কার্যাবলীর অন্তর্ভুক্ত। এই মতভেদ বা বিরোধের সৃষ্টি এবং তার মীমাংসার ক্ষেত্রে রাজনীতিক ভাবধারার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বলের অভিমত অনুসারে রাজনীতিক পরিকাঠামোকে রাজনীতিক ভাবধারা বিধিসম্মত বা আইনানুগ করে তুলতে পারে। এবং তার ফলে রাজনীতিক স্থায়িত্ব বৃদ্ধি পায়। এ বিষয়ে দ্বিমতের অবকাশ নেই। বল বলেছেন: “Political ideas can legitimise the political structures, and consequently increase political stability.” বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বল বলেছেন যে, একটি নির্বাচিত সরকারের প্রতি সাধারণত আনুগত্য প্রদর্শন করা হয়। তার কারণ নির্বাচিত সরকারকে জনসাধারণের প্রতিনিধি হিসাবে মনে করা হয়। এবং মনে করা হয় যে জনগণই পরোক্ষভাবে নিজেদের শাসন করছে। এবং এও মনে করা হয় যে, রাজনীতিক নেতারা জনসাধারণের দাবি-দাওয়াকে মর্যাদা দেবে। আবার বিপরীতক্রমে কোন কোনো রাজনীতিক ভাবধারা রাজনীতিক অস্থিরতার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। বল বলেছেন: “… certain political ideas may result in politcal instability.” ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এ প্রসঙ্গে বল বলেছেন যে প্রচলিত রাজনীতিক ব্যবস্থা বা স্থিতাবস্থার বৈধতা প্রসঙ্গে যে সমস্ত ভাবধারা প্রশ্ন তোলে বা বিরোধিতা করে। সাধারণত ক্ষমতাসীন সকল সরকার সংশ্লিষ্ট ভাবধারাকে অল্পবিস্তর নিয়ন্ত্রণ বা সেন্সর করে। এবং সরকার যত বেশী স্বৈরতান্ত্রিক প্রকৃতির হবে এই রাজনীতিক নিয়ন্ত্রণও তত বেশী প্রকট হবে। এ প্রসঙ্গে বলের একটি দীর্ঘ ও গুরুত্বপূর্ণ অভিমত প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন: “It is not too important that political ideas provide a too idealised’ description of how the political system works, that the practice is divorced too widely from how it ought to work; political instability results from the realisation of that divorce amongst the vast majority of the people.”

বিভিন্ন রাজনীতিক ভাবধারার মধ্যে কিছু ভাবধারা আছে যেগুলি বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার স্থায়িত্বের অনুপন্থী। এই সমস্ত ভাবধারা সমকালীন রাজনীতিক ব্যবস্থার স্থায়িত্বের পক্ষে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। সমসাময়িক রাজনীতিক নেতারা সাধারণত এই সমস্ত রাজনীতিক ভাবধারাকে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করে থাকে। রাজনীতিক নেতাদের এই উদ্যোগের উদ্দেশ্য হল তাঁদের রাজনীতিক ক্ষমতার পরিধিকে প্রসারিত করা। সাধারণত তাঁরা জনসাধারণের সামনে এই বক্তব্য পেশ করেন যে বিভিন্ন শত্রু শক্তির দিক থেকে রাষ্ট্র সংকটের সম্মুখীন। সুতরাং সাফল্যের সঙ্গে এই সংকটের মোকাবিলা করার জন্য সরকারের হাতে বাড়তি ক্ষমতা থাকা দরকার। কিন্তু সকল দেশের সমাজব্যবস্থায় প্রচলিত মূল্যবোধের গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। এই মূল্যবোধের ব্যবস্থা বহুলাংশে রাজনীতিক নেতাদের নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। শাসক ও শাসিত উভয় পক্ষকেই এই মূল্যবোধের ব্যবস্থার অনুগামী হতে হয়। এইভাবে বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার মধ্যে কোন ভাবধারা ব্যাপকভাবে স্বীকৃত ও সমর্থিত হয় এবং তার ফলে ব্যাপক ঐকমত্যের সৃষ্টি হয়। এই প্রসঙ্গে বল বলেছেন: “When certain ideas are widely accepted and agreed upon in the politcal system, we speak of a consensus.” এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে গ্রেট ব্রিটেনের রাজনীতিক ব্যবস্থার কথা বলা যেতে পারে। ব্রিটেনের বিদ্যমান রাজনীতিক কাঠামো সম্পর্কে ব্যাপক সহমত বর্তমান। এই কারণে যে রাজনীতিক ভাবধারার উপর ভিত্তি করে ব্রিটিশ রাজনীতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে তা স্বীকার করে না নিলে এখানে রাজনীতিক ক্ষমতা দখলের ক্ষেত্রে সাফল্য পাওয়া সম্ভব নয়। এ প্রসঙ্গে বল আরও বলেছেন: “They may not, of course, be consciously held ideas, and some may conflict with others; traditional support for a hereditary monarch may lie alongside notions of political equality.”

অতঃপর বল রাজনীতিক মতাদর্শের (ideology) ধারণা ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর অভিমত অনুসারে প্রচলিত রাজনীতিক ভাবধারাগুলির মধ্যে সংযোগ সম্পর্ক বর্তমান থাকলে তাকে রাজনীতিক মতাদর্শ বলা হয়। তিনি বলেছেন: “An ideology can be said to be coherent pattern of values and assumptions that underpin political relationship.” বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থায় রাজনীতিক ক্ষমতার নির্দিষ্ট ধরনের যে বণ্টন-ব্যবস্থা পরিলক্ষিত হয়, তার ব্যাখ্যা ও সমর্থন পাওয়া যায় সমকালীন রাজনীতিক মতাদর্শের মধ্যে। আবার কোন কোন রাজনীতিক ব্যবস্থায় একটি প্রাধান্যকারী রাজনীতিক মতাদর্শ প্রতিষ্ঠিত দেখা যায়। সংশ্লিষ্ট রাজনীতিক ব্যবস্থায় উদ্ভূত যাবতীয় রাজনীতিক মতভেদ বা বিরোধের মীমাংসা হয় প্রাধান্যকারী রাজনীতিক মতাদর্শের স্বীকৃত মূল্যবোধের মাধ্যমে। কিন্তু কোন রাজনীতিক ব্যবস্থায় শক্তিশালী একাধিক রাজনীতিক মতাদর্শের মধ্যে যদি বিরোধ বা সংঘাতের সৃষ্টি হয়, তা হলে রাজনীতিক ক্ষেত্রে অস্থিরতার সৃষ্টি হয় এবং রাজনীতিক ব্যবস্থার স্থায়িত্ব বিপন্ন হয়। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ প্রসঙ্গে বল বলেছেন: “…the rivalry of socialism and facism in Germany on the eve of Hitler’s rise to destroyed the existing political structures.”

বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থায় রাজনীতিক ক্ষমতার বণ্টন-ব্যবস্থাকে যুক্তিসঙ্গতভাবে সমর্থন বা সমালোচনা করার জন্য রাজনীতিক মতাদর্শকে ব্যবহার করা হয়। তবে যুক্তিসঙ্গত উপাদানের উপর অস্বাভাবিক গুরুত্ব আরোপ করা উচিত নয়। রাজনীতিক বিরোধ-বিতর্কের ক্ষেত্রে উচ্ছ্বাস, আবেগ ও অশালীন কথাবার্তার ব্যাপক ব্যবহার এবং এর গুরুত্ব ও তাৎপর্যকে অস্বীকার করা যায় না। এই কারণে বল বলেছেন: “Political ideas are used to rationally justify or attack an existing distribution of political power, but the rational element should not be unduly emphasized.” বলের আরও অভিমত হল সাম্য, স্বাধীনতা প্রভৃতি ধারণাগুলির অর্থ অনুধাবন করতে হলে দেখতে হবে কী রকম রাজনীতিক প্রেক্ষাপটে এগুলিকে ব্যবহার করা হয়েছে। এই সমস্ত ধারণার মাধ্যমে রাজনীতিক পছন্দ-অপছন্দ জ্ঞাপন করা হয়, অনুরূপভাবে বাস্তব পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করা হয়। বল বলেছেন: “The notion of the free world’ in a struggle against communist states is a way of expressing distaste for communist ideology.”