সাবেকী দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন:
একেবারে আধুনিক কালের রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ সরকার ও তার শ্রেণীবিন্যাস সম্পর্কিত আলোচনার পক্ষপাতী নন। তার পরিবর্তে তারা রাজনীতিক ব্যবস্থা ও তার বৈশিষ্ট্য, শ্রেণী বিভাজন প্রভৃতি বিষয়ের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। বর্তমান শতাব্দীর মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের গবেষণামূলক মৌল দৃষ্টিভঙ্গির জন্য আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় এ রকম এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। এই শ্রেণীর রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতানুসারে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাবেকী দৃষ্টিভঙ্গি নিতান্তই তত্ত্বসর্বস্ব ও সংকীর্ণ। তাঁরা গতানুগতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে নিছক আনুষ্ঠানিক, অবৈজ্ঞানিক ও অসম্পূর্ণ বলে আলোচনা করেছেন। তাঁরা রাজনীতিক বিষয়গুলিকে সমাজতত্ত্ব ও মনোবিজ্ঞানমূলক দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করেছেন। তাঁর ফলে রাষ্ট্রনৈতিক বিষয়ের আলোচনায় নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও পদ্ধতির সৃষ্টি হয়েছে।
রাজনীতিক ব্যবস্থা সম্পর্কিত আধুনিক ধারণা:
এই আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের অভিমত অনুসারে একটি দেশের রাজনীতিক অবস্থা ও কর্মধারার স্বরূপ বিচার-বিবেচনার ক্ষেত্রে রাজনীতিক ব্যবস্থার বিশ্লেষণ সাহায্য করে। প্রকৃত প্রস্তাবে রাজনীতিক ব্যবস্থা হল মানুষের আচার-ব্যবহারের ভিত্তিতে নির্ধারিত যাবতীয় রাজনীতিক পদ্ধতি ও কার্যাবলি; এ কেবল সংকীর্ণ আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠান মাত্র নয়। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাজনীতিক জীবনের সকল দিক সামগ্রিকভাবে বিচার-বিশ্লেষণের উপযোগী এক ধারণা গড়ে তোলার পক্ষপাতী। এবং এই ধারণাটিই হল ‘রাজনীতিক ব্যবস্থা’। এই শ্রেণীর রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে ডেভিড ইস্টন, অ্যালান বল, অ্যালমন্ড ও পাওয়েল, মরিস দ্যুভারজার, মর্টন ক্যাপলান, কোলম্যান প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর নাম উল্লেখযোগ্য। বল বলেছেন: “A more rewarding approach to the problems of classification would be to classify types of political systems rather than to concentrate on types of Governments.”
রাজনীতিক ব্যবস্থার আলোচনা সম্পর্কিত ডেভিড ইস্টনের অভিমত:
রাজনীতিক ব্যবস্থার আলোচনা আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এক নূতন দৃষ্টিভঙ্গির সংযোজন ঘটিয়েছে। সমাজের ভিতর সকল রকম রাজনীতিক কার্যকলাপ এবং রাজনীতিক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনসমূহের বৈশিষ্ট্য, প্রকৃতি, পারস্পরিক সম্পর্ক প্রভৃতি বিষয়কে রাজনীতিক ব্যবস্থা বলা হয়। ডেভিড ইস্টন তাঁর The Political System শীর্ষক রচনায় ‘রাজনীতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করেছেন। ইস্টনের মতানুসারে রাজনীতিক ব্যবস্থা হল সমাজের সেই সমস্ত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ব্যবস্থা যার মাধ্যমে বাধ্যতামূলক নীতি নির্ধারণের সিদ্ধান্তসমূহ গৃহীত হয়। ইস্টন বলেছেন: “Political system is that system of interactions in any society through which binding or authoritative allocations are made.” অর্থাৎ পারস্পরিক প্রতিক্রিয়ার সম্পর্কে আবদ্ধ ব্যবস্থাই হল রাজনীতিক ব্যবস্থা। কর্তৃত্বসম্পন্ন বা বাধ্যতামূলক বরাদ্দের নীতি এই ব্যবস্থার মাধ্যমে কার্যকর হয়। তাঁর মতে সমাজের সর্ববিধ রাজনীতিক কার্যকলাপ ও রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের গঠন, প্রকৃতি ও ক্রিয়াকলাপ প্রভৃতিকে নিয়ে একটি রাজনীতিক ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়। যে কোন সমাজে ক্ষমতা, শাসন ও কর্তৃত্বের সঙ্গে মানবীয় কার্যকলাপের সমন্বয়ের ভিত্তিতে রাজনীতিক ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়। এই কারণে রাজনীতিক ব্যবস্থার বিভিন্ন অংশসমূহ পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ রাজনীতিক ব্যবস্থা বিভিন্ন অংশকে নিয়ে গঠিত হয়। এই অংশগুলি পরস্পরের উপর নির্ভরশীল এবং প্রতিক্রিয়াশীল। রাজনীতিক ব্যবস্থার কোন একটি বিশেষ অংশের পরিবর্তন ঘটলে তার প্রতিক্রিয়া সামগ্রিকভাবে সমগ্র রাজনীতিক ব্যবস্থার উপর পড়ে। ইস্টন রাজনীতিক ব্যবস্থাকে আত্মনিয়ন্ত্রিত এবং প্রতিবেদনশীল ব্যবস্থা হিসাবে ব্যাখ্যা করেছেন। বস্তু ও মূল্যের বরাদ্দ প্রসঙ্গে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাই হল রাজনীতিক ব্যবস্থার উদ্দেশ্য। এবং এই সিদ্ধান্ত হল বাধ্যতামূলক ও কর্তৃত্বসম্পন্ন। তার কারণ বলপ্রয়োগের বৈধ ক্ষমতা এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। সমাজে বৈধ দৈহিক বলপ্রয়োগের সঙ্গে রাজনীতিক ব্যবস্থা সম্পর্কযুক্ত। এই কারণেই অন্যান্য ব্যবস্থার সঙ্গে রাজনীতিক ব্যবস্থার মৌলিক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। রাজনীতিক ব্যবস্থার বিভিন্ন কাজকর্মের মধ্যে সংযোগ সাধনের সূত্র হিসাবে এই বৈধ বলপ্রয়োগের ক্ষমতা গুরুত্বপূর্ণ।
রাজনীতিক ব্যবস্থার আলোচনা সম্পর্কিত অ্যালমন্ড ও পাওয়েল-এর অভিমত:
অ্যালমন্ড ও পাওয়েল তাদের Comparative Politics : A Developmental Approach শীর্ষক গ্রন্থে রাজনীতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এই দুই আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর অভিমত অনুসারে বৈধ বলপ্রয়োগ হল রাজনীতিক ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান; কিন্তু একমাত্র উপাদান নয়। কেবলমাত্র বলপ্রয়োগ ও বাধ্যবাধকতার সঙ্গে রাজনীতিক ব্যবস্থা জড়িত এমন নয়। রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সকল কাঠামোই রাজনীতিক ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত। আইন আদালত, প্রশাসনিক সংস্থা প্রভৃতি শুধুমাত্র সরকারী সংস্থাকে নিয়েই রাজনীতিক ব্যবস্থা গঠিত হয় না। বিভিন্ন আনুষ্ঠানিক ও অ-আনুষ্ঠানিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান রাজনীতিক ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত থাকে। বিভিন্ন অ-আনুষ্ঠানিক গোষ্ঠী, তাদের রাজনীতিক মনোভাব ও মানসিকতা, ব্যক্তিবর্গের মধ্যে বহু ও বিভিন্ন পারস্পরিক সম্পর্ক প্রভৃতির ভিত্তিতে বিভিন্ন সরকারী প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা বহুলাংশে নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। জাতপাতের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা গোষ্ঠী, স্বার্থ-গোষ্ঠী, রাজনীতিক দল, সংযোগসাধনমূলক সংস্থাসমূহের বিক্ষোভ-আন্দোলন প্রভৃতি রাজনীতিক ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হয়। বস্তুত ব্যাপকতর বিচার-বিশ্লেষণ ব্যতিরেকে বিভিন্ন ধরনের সমাজের রাজনীতিক ঘটনাবলীর সার্থক ও অর্থবহ আলোচনা অসম্ভব। এবং এই কারণেই রাজনীতিক ব্যবস্থার ধারণা গ্রহণ করা হয়েছে।
রাজনীতিক ব্যবস্থার আকৃতি-প্রকৃতি:
রাজনীতিক ব্যবস্থা হল আসলে এক ধরনের ব্যবস্থা। পরস্পর নির্ভরশীল বিভিন্ন অংশের একত্রে অবস্থানের ভিত্তিতে এক-একটি ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। প্রত্যেক ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন অংশগুলি পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। এই কারণে কোন ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত একটি অংশে যদি পরিবর্তন দেখা দেয়, তা হলে তা অন্যান্য অংশকেও প্রভাবিত করে। এবং অন্যান্য অংশগুলির পরিবর্তন সমগ্র ব্যবস্থার উপর প্রতিফলিত হয়। রাজনীতিক ব্যবস্থাও হল একটি ব্যবস্থা। এবং রাজনীতিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে সাধারণত গণ-সংযোগের মাধ্যমে সমগ্র ব্যবস্থায় পরিবর্তন সূচিত হয়। সকল ব্যবস্থার ক্ষেত্রেই সীমানার ধারণা সম্পর্কযুক্ত হয়। কিন্তু রাজনীতিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে এ সীমানার বিষয়টি সমস্যাবহুল। কারণ রাজনীতিক ব্যবস্থার সীমানা নির্ধারণ অত্যন্ত কঠিন। তার কারণ হল রাজনীতিক ব্যবস্থায় ব্যক্তিবর্গ অ রাজনীতিক ভূমিকা পালন থেকে রাজনীতিক ভূমিকা পালনের সামিল হতে পারে। কারখানার শ্রমিক যখন নির্বাচনী প্রচারকার্যে অংশগ্রহণ করে বা ভোট দেয়, তখন সে আর্থনীতিক ভূমিকার পরিবর্তে রাজনীতিক ভূমিকা পালন করে এবং আর্থনীতিক ভূমিকার সীমানা অতিক্রম করে রাজনীতিক ভূমিকার সীমানায় অবতীর্ণ হয়। রাজনীতিক সংযোগসাধনের মাধ্যমে ব্যক্তি যদি প্রভাবিত হয়, চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী গঠন করে বা সরকারী দায়-দায়িত্ব পালনের সামিল হয়, তখন ব্যক্তি রাজনীতিক ভূমিকায় উপনীত হয়। রাজনীতিক ব্যবস্থায় জনসাধারণ ও ভোটদাতারা কার্যকারণ সূত্রে আমলা, আইনসভার সদস্য ও বিচারপতিদের সঙ্গে পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সম্পর্কে আবদ্ধ হন। আবার রাজনীতিক ব্যবস্থার মধ্যে যাঁরা রাজনীতিক সীমানার অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন ভূমিকা পালন করেন, তাঁরাই আবার সামাজিক ব্যবস্থার মধ্যে আর্থনীতিক, সাংস্কৃতিক, পারিবারিক, ধর্মীয় প্রভৃতি ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। অ্যালমন্ড ও পাওয়েলের আরও অভিমত হল যে রাজনীতিক ব্যবস্থার সীমানা মোটেই স্থিতিশীল নয়, বিশেষভাবে পরিবর্তনশীল। শান্তিকালীন পরিস্থিতিতে বা স্বাভাবিক অবস্থায় রাজনীতিক ব্যবস্থার সীমানা যা থাকে, সংকটকালীন পরিস্থিতিতে বা আপৎকালীন অবস্থায় তা অধিকতর সম্প্রসারিত হয়। কারণ সংকটের সময় বা জরুরী অবস্থায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের তৎপরতা বৃদ্ধি পায়।
সাম্প্রতিককালের যে সকল রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রাজনীতিক ব্যবস্থার প্রকৃতি সম্পর্কিত আলোচনায় নতুন তথ্য যুগিয়েছেন এবং রাজনীতিক ব্যবস্থার ধারণাকে সমৃদ্ধ করেছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ল্যাসওয়েল, লুসিয়ান পাই, ম্যারিয়ন লেভি, ব্লন্ডেল প্রমুখ।
Leave a comment