রাজনীতিক ব্যবস্থার শ্রেণীবিভাজনের ক্ষেত্রে মতপার্থক্য আছে: আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতানুসারে সরকারের শ্রেণীবিভাজনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের অসুবিধা আছে। তাই তাঁরা সরকারের শ্রেণীবিভাজনের পরিবর্তে রাজনীতিক ব্যবস্থার শ্রেণীবিভাজনের কথা বলেন। বর্তমান রাজনীতিক ব্যবস্থার শ্রেণীবিভাজনকে অপেক্ষাকৃত বৈজ্ঞানিক ও বাস্তবসম্মত বিবেচনা করা হয়ে থাকে। কারণ রাজনীতিক ব্যবস্থার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানসমূহ ছাড়াও সব রকম রাজনীতিক কার্যকলাপ এবং সকল অংশের পারস্পরিক সম্পর্ক ও নির্ভরশীলতা বোঝায়। রাজনীতিক ব্যবস্থার সকল অংশ পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত ও নির্ভরশীল। কোন দেশের শাসনব্যবস্থার সামগ্রিক পরিচয় ও প্রকৃতি সম্পর্কে অবহিত হতে গেলে রাজনীতিক ব্যবস্থার শ্রেণীবিভাজনই বাঞ্ছনীয়।
শ্রেণী-বিভাজনের ক্ষেত্রে মতানৈক্য: বর্তমানে রাজনীতিক ব্যবস্থার শ্রেণীবিভাজনের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। আধুনিককালের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে রাজনীতিক ব্যবস্থার শ্রেণীবিভাজনের ক্ষেত্রে ব্যাপক উদ্যোগ-আয়োজন পরিলক্ষিত হয়। তবে বাস্তবে উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনার পরিপ্রেক্ষিতে শ্রেণী-বিভাজনের ক্ষেত্রে মূল্যবোধ ও পদ্ধতিগত পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। বিভিন্ন উপাদানের ভিত্তিতে এই শ্রেণীবিভাজন করা হয়। উপাদানগত ভিত্তির পার্থক্যের জন্য শ্রেণীবিভাজনের প্রকৃতিতে পার্থক্য দেখা দেয়। এই কারণে রাজনীতিক ব্যবস্থার বিচার-বিশ্লেষণ ও শ্রেণীবিভাজনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন অভিমতের অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। বল তাঁর Modern Politics and Government শীর্ষক গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন: “There are many different ways in which political systems have been classified….” তাই রাজনীতিক ব্যবস্থার শ্রেণীবিন্যাস সম্পর্কে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে মৌলিক মতপার্থক্য দেখা যায়।
রাজনীতিক ব্যবস্থার শ্রেণীবিভাজনে দ্যুভারজার:
মরিস দ্যুভারজার তাঁর The Idea of Politics শীর্ষক গ্রন্থে রাজনীতিক ব্যবস্থার শ্রেণীবিভাজন সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তিনি রাজনীতিক ব্যবস্থাকে দু’ভাগে বিভক্ত করেছেন। এই দু’টি ভাগ হল:
-
(১) বহুত্ববাদী রাজনীতিক ব্যবস্থা (Pluralist Systems) এবং
-
(২) কেন্দ্রীভূত নিয়ন্ত্রণমুখী রাজনীতিক ব্যবস্থা (Monolithic Systems )
রাজনীতিক ব্যবস্থার শ্রেণীবিভাজনে অ্যালমন্ড:
অ্যালমন্ড এককভাবে তাঁর Comparative Political Systems শীর্ষক গ্রন্থে রাজনীতিক ব্যবস্থার শ্রেণীবিভাজন করেছেন। তিনি মূলত রাজনীতিক সংস্কৃতি ও কাঠামোর ভিত্তিতে এই শ্রেণীবিভাগ করেছেন। তিনি চার শ্রেণীর রাজনীতিক ব্যবস্থার কথা বলেছেন
-
(১) ইঙ্গ-মার্কিন ব্যবস্থা: এই শ্রেণীর রাজনীতিক ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য হিসাবে ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের বিকেন্দ্রীকরণ, বিশেষীকরণ, রাজনীতিক উদ্দেশ্য ও দৃষ্টিভঙ্গির অভিন্নতা, বিভিন্ন মূল্যবোধ, ব্যক্তি-স্বাধীনতা প্রভৃতির কথা বলা হয়।
-
(২) মহাদেশীয় ইউরোপীয় ব্যবস্থা: এ ধরনের রাজনীতিক ব্যবস্থায় রাজনীতিক মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি সাধারণত সমজাতীয় হতে দেখা যায় না।
-
(৩) প্রাক্-শিল্প ব্যবস্থা: এ ধরনের রাজনীতিক ব্যবস্থায় রাজনীতিক মানসিকতা ও দৃষ্টিকোণ সাধারণত মিশ্র প্রকৃতির হয়ে থাকে।
-
(৪) সর্বাত্মক রাজনীতিক ব্যবস্থা: এ ধরনের রাজনীতিক ব্যবস্থায় স্বেচ্ছামূলক ও স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব অস্বীকৃত। এখানে সব কিছু সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীনে থাকে।
রাজনীতিক ব্যবস্থার শ্রেণীবিভাজনে অ্যালমণ্ড ও পাওয়েল-কৃত শ্রেণীবিভাজন:
অ্যালমন্ড ও পাওয়েল ‘তুলনামূলক রাজনীতি’ (Comparative Politics) শীর্ষক গ্রন্থে বিভিন্ন দিক থেকে বিচার-বিশ্লেষণ করে রাজনীতিক ব্যবস্থার শ্রেণীবিভাজন করেছেন। তাঁরা আধুনিক রাজনীতিক ব্যবস্থাকে প্রাথমিকভাবে দু’ভাগে বিভক্ত করেছেন।
-
(১) সচল আধুনিক ব্যবস্থা’ (Mobilised Modern System) এবং
-
(২) ‘প্রাক্-সচল আধুনিক ব্যবস্থা (Pre-Mobilised Modern System)।
তাঁরা ‘সচল আধুনিক ব্যবস্থাকে আবার দু’ভাগে বিভক্ত করেছেন। সচল আধুনিক রাজনীতিক ব্যবস্থার এই দুটি ভাগ হল:
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে আবার তিনটি উপ-ব্যবস্থায় বিভক্ত করা হয়েছে। গণতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থার তিনটি উপ-ব্যবস্থা হল:
-
(১) “উচ্চ উপ-ব্যবস্থা স্বাধিকার (High Subsystem Autonomy)– এই শ্রেণীর গণতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থায় গণ-মাধ্যমসমূহ, রাজনীতিক দল ও স্বার্থগোষ্ঠীগুলি পরস্পর স্বতন্ত্র থাকে। এখানে উপ-ব্যবস্থাগুলি ব্যাপকভাবে স্বাধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের অধিকারযুক্ত রাজনীতিক ক্ষেত্রে নীতি নির্ধারণের ব্যাপারে এবং রাজনীতিক কাজকর্মে অংশগ্রহণের ব্যাপারে জনসাধারণ ব্যাপকভাবে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। দৃষ্টান্তস্বরূপ—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের কথা বলা এই ধরনের গণতান্ত্রিক হয়;
-
(২) সীমাবদ্ধ উপ-ব্যবস্থা স্বাধিকার’ (Limited Sub-system Autonomy)— রাজনীতিক ব্যবস্থায় গণ-মাধ্যমসমূহ, রাজনীতিক দল ও স্বার্থগোষ্ঠীগুলি পরস্পর নির্ভরশীল অবস্থায় থাকে। এবং এখানে উপ-ব্যবস্থাগুলির স্বাধিকার ভোগ সীমাবদ্ধ। দৃষ্টান্তস্বরূপ ৪র্থ ফরাসি প্রজাতন্ত্র, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী ইটালী ও হেমার জার্মানীর কথা বলা হয়; এবং
-
(৩) ‘নিম্ন উপ-ব্যবস্থার স্বাধিকার’ (Low Subsystem Autonomy)—এই শ্রেণীর গণতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থায় উপব্যবস্থাগুলি বিশেষভাবে নিম্নগামী স্বাধিকার ভোগ করে থাকে। দৃষ্টান্তস্বরূপ—মেক্সিকোর কথা বলা হয়।
তাঁরা কর্তৃত্বমূলক ব্যবস্থাকে আবার চারভাগে বিভক্ত করেছেন। এই চারটি ভাগ হল:
-
(ক) ‘বৈপ্লবিক সর্বাত্মক ব্যবস্থা’ (Radical Totalitarian System) দৃষ্টান্তস্বরূপ—পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়ন;
-
(খ) ‘রক্ষণশীল সর্বাত্মক ব্যবস্থা’ (Conservative Totalitarian System) দৃষ্টান্তস্বরূপ –নাৎসী জার্মানী,
-
(গ) ‘রক্ষণশীল কর্তৃত্বমূলক ব্যবস্থা’ (Conservative Authoritarian System) দৃষ্টান্তস্বরূপ —ব্রাজিল এবং
-
(ঘ) ‘আধুনিকীকৃত কৰ্তৃত্বমূলক ব্যবস্থা’ (Modernised Authoritative System)।
তাঁরা প্রাক্-সচল আধুনিক ব্যবস্থা’কে দু’ভাগে বিভক্ত করেছেন। প্রাক্ সচল আধুনিক রাজনীতিক ব্যবস্থার দু’টি ভাগ হল:
-
(১) ‘প্রাক-সচল কর্তৃত্বমূলক ব্যবস্থা’ (Pre-Mobilised Authoritarian System) দৃষ্টান্তস্বরূপ —ঘানা এবং
-
(২) ‘প্রাক্-সচল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা’ (Pre-Mobilised Democratic System) দৃষ্টান্তস্বরূপ—নাইজেরিয়া।
রাজনীতিক ব্যবস্থার শ্রেণীবিভাজনে বল কর্তৃক শ্রেণীবিভাজন:
আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বল তাঁর Modern Politics and Government শীর্ষক গ্রন্থে রাজনীতিক ব্যবস্থাকে তিনটি প্রধান শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছেন: “…for the purpose of underlining the difficulties associated with typologies as well as indicating some of the advantages, the following broad typology would be sufficiently representative. ” বল যে তিন ধরনের রাজনীতিক ব্যবস্থার কথা বলেছেন, সেগুলি হল:
-
(ক) ‘উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা’ (Liberal Democratic Systems),
-
(খ) ‘সর্বাত্মক ব্যবস্থা’ (Totalitarian Systems) এবং
-
(গ) ‘স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা’ (Autocratic Systems)।
বল এই তিন ধরনের রাজনীতিক ব্যবস্থার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের সরকারের অস্তিত্বের কথাও বলেছেন।
উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার যুক্তরাষ্ট্রীয় বা এককেন্দ্রিক এবং পার্লামেন্টীয় বা রাষ্ট্রপতি-শাসিত হতে পারে। সর্বাত্মক ব্যবস্থায় সরকার সাম্যবাদী বা ফ্যাসিবাদী হতে পারে। স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার সরকার ঐতিহ্যগত বা আধুনিকীকৃত হতে পারে। আধুনিকীকৃত সরকার আবার সামরিক বা অসামরিক হতে পারে।
রাজনীতিক ব্যবস্থার শ্রেণীবিভাজন সম্পর্কিত উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিক ব্যবস্থাকে মূলত চারভাগে ভাগ করা যেতে পারে। এই চারটি ভাগ হল:
-
(১) উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা’ (Liberal Democratic System),
-
(২) ‘স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা’ (Autocratic System),
-
(৩) ফ্যাসিবাদী সর্বাত্মক ব্যবস্থা’ (Fascist Totalitarian System) এবং
-
(৪) ‘সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা’ (Socialist System)।
Leave a comment