রাষ্ট্র ন্যায়বিচারের অভিব্যক্তি তাই আনুগত্য লাভ করে: রাজনীতিক বাধ্যবাধকতার ভিত্তি হিসাবে ন্যায়বিচারের যুক্তির গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। বলা হয় যে ন্যায়বিচারের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত রাষ্ট্রীয় আইন ও কর্তৃত্ব আনুগত্য অর্জনে সক্ষম হয়। অনুরূপভাবে ন্যায়বিচারের সঙ্গে সম্পর্ক রহিত রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব বা আইন আনুগত্য লাভে ব্যর্থ হয়। বার্কার রাজনীতিক বাধ্যবাধকতার ভিত্তি হিসাবে ন্যায়বিচারের কথা বলেছেন। তাঁর অভিমত অনুসারে রাজনীতিক আনুগত্যের সর্বোচ্চ ভিত্তি হল ন্যায়বিচার। রাষ্ট্র হল ন্যায়বিচারের একটি প্রকাশ ও অংশবিশেষ। সামগ্রিক বিচারে রাষ্ট্র এই রকম চরিত্র সম্পন্ন। এই কারণে রাষ্ট্রের শাসক কর্তৃত্বের প্রতি আমরা বাধ্যবাধকতা প্রদর্শন করি। এবং এই কারণেই আমরা রাষ্ট্রীয় শাসক-কর্তৃত্বের আদেশ নির্দেশ মান্য করে চলি এবং তদনুসারে কাজ করি। বার্কার বলেছেন: “It is the fact that the State is the expression and organ of justice. We are obliged to the governing authority of the State, and we obey and perform its command, because the state as a whole is, on the whole, such an expression and organ.” রাষ্ট্র যদি এই চরিত্র থেকে পুরোপুরি বিচ্যুত হয় বা কতকাংশে বিচ্যুত হয়, সে ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতার বিষয়টি ভিত্তিহীন হয়ে পড়ে। এ রকম বাধ্যবাধকতার পিছনে কোন চূড়ান্ত সমর্থন থাকে না। বার্কারের কথায় : “If the State fails to be that, or in so far as it fails to be that, we are left with the obligation which hangs, as it were, in the air, and has no final support.”
এ ক্ষেত্রে বার্কার একটি সমস্যার কথাও বলেছেন। আমাদের আনুগত্য কেবলমাত্র রাষ্ট্র কর্তৃক প্রকাশিত ন্যায়বিচারের প্রতি, নাকি ন্যায়বিচারের সেই দাবির প্রতি যা প্রকাশ করতে রাষ্ট্র পারে নি বা পুরোপুরি প্রকাশ করতে ব্যর্থ হয়েছে। অর্থাৎ রাষ্ট্র প্রকাশিত ন্যায়বিচারের সঙ্গে জনসাধারণের ধারণাসম্ভূত ন্যায়বিচারের পার্থক্য থাকতে পারে। তবে এই সমস্যার সমাধান প্রসঙ্গে বার্কার বলেছেন যে, সামগ্রিক বিচারে রাষ্ট্র হল ন্যায়-বিচারের প্রকাশ ও অঙ্গ। এবং এটাই হল রাজনীতিক বাধ্যবাধকতার চূড়ান্ত উৎস। বার্কারের কথায় “….the State as a whole is on the whole, the expression and organ of justice, and that this is the final source of political obligation.”
রাষ্ট্র হল সর্বোচ্চ রাজনীতিক মূল্যবোধের প্রতীক। জনগণ এই মূল্যবোধকে বাস্তবে কার্যকর করতে আগ্রহী। তাই তাঁরা এই মূল্যবোধের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে। বার্কারের অভিমত অনুসারে এই সর্বোচ্চ মূল্যবোধটিই হল ন্যায়বিচার। যতক্ষণ পর্যন্ত রাষ্ট্র এই ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসাবে অবস্থান করে, জনসাধারণ ততক্ষণ পর্যন্ত রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে।
ন্যায়বিচার কোন রাজনীতিক ব্যবস্থার অংশসমূহের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে এবং সমগ্র রাজনীতিক ব্যবস্থাটিকে নিয়ন্ত্রণ করে। বিভিন্ন ধরনের রাজনীতিক মূল্যবোধ থাকে। ন্যায়বিচার তাদের মধ্যে ঐক্য ও সমন্বয় সাধন করে। তারফলে রাজনীতিক মূল্যবোধগুলির সুষ্ঠু প্রয়োগ সম্ভব হয়। ন্যায়বিচারের এই সমন্বয় সাধনমূলক প্রক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে একটি চূড়ান্ত মূল্যবোধ সম্পর্কযুক্ত। এই মূল্যবোধের উদ্দেশ্য হল সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের ব্যক্তিত্বকে বিকশিত করা। সুতরাং ন্যায়বিচার হল সমন্বয়সাধনকারী একটি ধারণাবিশেষ। এবং এটি হল একটি চূড়ান্ত রাজনীতিক মূল্যবোধযুক্ত। রাষ্ট্র হল এই মূল্যবোধের প্রতীক। এবং রাষ্ট্র এই মূল্যবোধ প্রয়োগ করে। ন্যায়বিচারের প্রতীক হল এই রাষ্ট্র। ন্যায়বিচার কার্যকর করার মাধ্যম হল এই রাষ্ট্র। তাই মানুষ রাষ্ট্রে কর্তৃত্বের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে, রাষ্ট্রের আদেশ-নির্দেশ মান্য করে চলে এবং তদনুসারে কাজ করে।
মূল্যায়ন (Evaluation): রাজনীতিক বাধ্যবাধকতার ব্যাখ্যা হিসাবে ন্যায়বিচারের তত্ত্ব একেবারে ত্রুটিমুক্ত নয়। এরও সীমাবদ্ধতা আছে। বিভিন্ন সমাজব্যবস্থায় ন্যায়বিচারের ধারণাকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা হয়। এ ক্ষেত্রে সমাজতান্ত্রিক ও অ-সমাজতান্ত্রিক চিন্তাবিদদের মধ্যে অনপনেয় মতপার্থক্য বর্তমান। অর্থাৎ ন্যায়বিচারের ব্যাপারে কোন সর্বজনীন ধারণা নেই। এ হল একটি আপেক্ষিক ধারণা। আবার আইন-প্রণয়ন ও প্রয়োগের সঙ্গে ন্যায়বিচারের সম্পর্কের বিষয়টি দেশ-কাল নির্বিশেষে এক রকম নয় এবং এ ক্ষেত্রে কোন স্থায়ী সম্পর্কের কথা বলা যায় না।
Leave a comment