দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ:

রাজনীতিক পরিবর্তন প্রসঙ্গে মার্কসীয় তত্ত্ব হল বৈপ্লবিক তত্ত্ব। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ হল এই বৈপ্লবিক তত্ত্বের মূল প্রেরণা। রাজনীতিক পরিবর্তন সম্পর্কিত মার্কসীয় ব্যাখ্যা হল এককথায় বস্তুবাদী ব্যাখ্যা। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মার্কসীয় দর্শনে রাজনীতিক পরিবর্তন ও বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। সামাজিক বিকাশ ও রাজনীতিক পরিবর্তন ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে শ্রেণী-সংগ্রাম ও রাজনীতিক আন্দোলনের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। মার্কসবাদ অনুসারে বিকাশের কারণ বর্তমান থাকে বৈপরীত্যের সংঘাত ও সক্রিয় দ্বন্দ্বের মধ্যে। মার্কসবাদ অনুযায়ী প্রকৃতিগতভাবে প্রতিটি বস্তু বা ঘটনা সম্পর্কিত ও পরস্পরের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই মতবাদ অনুসারে বস্তুর মত সমাজও গতিশীল এবং পরিবর্তনশীল। সমাজের পরিবর্তন ও বিবর্তন স্বাভাবিক। কোন সমাজব্যবস্থাই স্থিতিশীল নয়। বস্তুত পরিমাণগত পরিবর্তন থেকে গুণগত পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। মানবসমাজেও এই রকম পরিবর্তন ঘটে। একে বিপ্লব বলে। প্রত্যেক বস্তু ও ঘটনার মধ্যে পরস্পর-বিরোধী ধর্ম একই সঙ্গে বর্তমান থাকে। তারফলে বস্তু ও ঘটনার মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব থাকে। এই অন্তর্দ্বন্দ্বের জন্যই সকল পরিবর্তন ঘটে। স্ববিরোধের এই সংঘর্ষ হল বিকাশ। আদিম সাম্যবাদী সমাজের পর প্রত্যেক পর্যায়ে অপরিহার্যভাবে শ্রেণী-দ্বন্দ্ব বর্তমান। পুঁজিবাদী সমাজে সর্বহারা ও বুর্জোয়া শ্রেণী-দ্বন্দ্বের ফলে পুঁজিবাদী সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তন হবে; উদ্ভব হবে শ্রেণীহীন শোষণহীন এক সমাজতান্ত্রিক সমাজের। সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ক্রমে সাম্যবাদী সমাজে রূপান্তরিত হবে। এইভাবে বস্তু বা ঘটনার পারস্পরিক সংঘাত ও ঐক্যই নিম্নস্তর থেকে উচ্চস্তরে উন্নীত হওয়ার মূল কারণ। দ্বান্দ্বিকতার এই নীতিকে বলে ‘Struggle and unity opposites’।

নেতির নেতিকরণ:

পুরাতনের অবসান এবং নতুনের আবির্ভাব কেবল বৈপ্লবিক উপায়েই সম্ভব। বিপ্লব মানে কেবল ধ্বংস নয়। এ হল উন্নততর নতুনের আবির্ভাব এবং বিকাশ। বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মাধ্যমে উন্নততর অবস্থার সৃষ্টি ও বিকাশ সম্ভব হয়। এইভাবে একটি ব্যবস্থার অস্বীকৃতির পর যে নতুন ব্যবস্থার উদ্ভব হয় তা পূর্ববর্তী অবস্থা থেকে সব সময়ই উন্নততর। এই প্রক্রিয়াকে ‘নেতির নেতিকরণ’ বা ‘অস্বীকৃতির অস্বীকৃতি’ (negation of negation) বলে। ক্রমবিকাশের এই সূত্রকে ‘বাদ’, ‘প্রতিবাদ’ এবং ‘সম্বাদ’ হিসাবেও প্রকাশ করা যায়। যেমন, সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলে তাকে অস্বীকার করে উন্নততর ব্যবস্থা হিসাবে পুঁজিবাদের সৃষ্টি হয়। এ হল ‘বাদ’ (Thesis)-এর অস্বীকৃতি বা ‘প্রতিবাদ’ (‘Antithesis)। পুনরায় পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় স্ববিরোধ অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলে তা অস্বীকার করে উন্নততর ব্যবস্থা হিসাবে সমাজতন্ত্রের উদ্ভব হয়। এ হল ‘অস্বীকৃতির অস্বীকৃতি বা সম্বাদ (synthesis)।

ঐতিহাসিক বস্তুবাদ:

দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ একটি রাজনীতিক দর্শন হিসাবে চূড়ান্তভাবে সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদী ধারণার সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে। এই তত্ত্ব-চিন্তার ভিত্তিতে দাস-সমাজ, সামস্ত-সমাজ, পুঁজিবাদী সমাজ প্রভৃতি সামাজিক বিবর্তনের বিভিন্ন স্তর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হয়েছে। মানবসমাজ ও তার ইতিহাসের প্রকৃতি আলোচনার ক্ষেত্রে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী তত্ত্বের প্রয়োগকেই ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বা ইতিহাসের জড়বাদী ব্যাখ্যা বলা হয়। ঐতিহাসিক বস্তুবাদ অনুসারে

  • (১) সমাজের পরিবর্তন ও বিকাশ প্রকৃতির মতই সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক নিয়মের নিয়ন্ত্রণাধীন;
  • (২) রাজনীতিক তত্ত্ব, ভাবাদর্শ, সংস্কৃতি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি হয় সমাজের বৈষয়িক জীবনযাত্রার বিকাশের ভিত্তিতে এবং
  • (৩) বাস্তবে বৈষয়িক জীবনযাত্রার পদ্ধতি কর্তৃক সৃষ্ট মতবাদ ও প্রতিষ্ঠান সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে।

মার্কসের মতানুসারে অর্থনীতিই হল সমাজের ভিত ইতিহাস মূলত আর্থনীতিক অবস্থার দ্বারা আবর্তিত ও বিবর্তিত হয়। ধনোৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থার বিধানগুলিই এই বিবর্তনের প্রধান কারণ। মানবসমাজের রাজনীতিক, সামাজিক ও অন্যান্য দিকগুলি আর্থনীতিক ব্যবস্থার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। আর্থনীতিক বনিয়াদ উপরিকাঠামো (super structure)-কে প্রভাবিত করে। সমাজ পরিবর্তন ও শ্রেণী সম্পর্কের মূল কারণ হল সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থা। সমাজ বিবর্তনের প্রতিটি অধ্যায় পরস্পর-বিরোধী স্বার্থযুক্ত ও শ্রেণীসমূহের অস্তিত্ব সমকালীন আর্থনীতিক বাস্তবতা অর্থাৎ উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের ফলশ্রুতি। মানুষের সামাজিক ও রাজনীতিক জীবনধারা হল তার আর্থনীতিক জীবনধারারই প্রতিবিম্ব।

মূল্যায়ন: রাজনীতিক পরিবর্তন সম্পর্কিত মার্কসীয় ধারণাও বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। মার্কসীয় ব্যাখ্যায় আর্থনীতিক উপাদানের উপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু আর্থনীতিক উপাদানই এককভাবে রাজনীতিক পরিবর্তন সাধন করে না। শ্রেণীভেদ ও শ্রেণী-সংঘর্ষের তত্ত্বও সমালোচনাযোগ্য। মানব ইতিহাসে দ্বন্দ্ব-বিরোধ ছাড়াও সহযোগিতার সম্প্রীতির নজিরও কম নেই। তা ছাড়া অর্থনীতি যেমন দার্শনিক তত্ত্ব, আদর্শ প্রভৃতিকে প্রভাবিত করে, তেমন দার্শনিক তত্ত্ব, আদর্শ প্রভৃতিও অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে। আর্থনীতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন ছাড়াও অনেক সময় নতুন ভাবধারা ও মতাদর্শের ভিত্তিতে নতুন রাজনীতিক ব্যবস্থার উদ্ভব হয়। আবার সংস্কার ও বিবর্তনের মাধ্যমেও কাম্য রাজনীতিক পরিবর্তন ঘটে। তেমনি আবার উৎপাদন ব্যবস্থাই সমাজ ও রাজনীতিক ব্যবস্থার একমাত্র নির্ধারক নয়। তবে মানবসমাজের বিবর্তনের ধারায় আর্থনীতিক শক্তির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ভূমিকার গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। তবে অন্যান্য উপাদানের ভূমিকাকেও অগ্রাহ্য করা যায় না। এঙ্গেল্সও পরবর্তীকালে এ কথা স্বীকার করেছেন।