রাজনীতিক নিয়ন্ত্রণের সীমা সম্পর্কে মতানৈক্য
বর্তমানে ব্যক্তির জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানবজীবনের সকল ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের অপরিহার্য উপস্থিতি এক রকম সর্বজনবিদিত। কিন্তু মানবসমাজে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের এলাকা কতদূর পর্যন্ত সম্প্রসারিত হবে এ বিষয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতপার্থক্যের শেষ নেই। বস্তুত এটি হল আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি অন্যতম জটিল সমস্যা। ম্যাকাইভার (R. M. MacIver)- এর মতানুসারে রাষ্ট্রের কার্যাবলীর নির্দিষ্ট একটি সীমা থাকা বাঞ্ছনীয়। কারণ নির্দিষ্ট সীমার বাইরে কিছু করলে সাফল্যের পরিবর্তে ব্যর্থতা আসে। তিনি বলেছেন: “Certain tasks the instrument can perform but badly and clumsily-we do not sharpen pencil with axe.” সাধারণভাবে মনে করা হয় যে, কতকগুলি কাজে রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ অভিপ্রেত নয়, যেমন—মতামত, ধর্ম, নৈতিকতা, প্রথা, ফ্যাসন, সাহিত্য-সংস্কৃতি প্রভৃতি। সাধারণভাবে বলা হয় যে, এই সমস্ত কাজই হল রাজনীতিক নিয়ন্ত্রণের সীমারেখা।
(ক) মত প্রকাশের স্বাধীনতা: রাষ্ট্র নাগরিকদের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতাকে প্রত্যক্ষভাবে ক্ষুণ্ণ বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। লুথার, লক, ভলটেয়ার থেকে শুরু করে আধুনিক কালের ল্যাস্কি, ম্যাকাইভার পর্যন্ত সকল রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মনে করেন যে, মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা বাঞ্ছনীয়। ম্যাকাইভারের মতানুসারে যে-কোন মতামত রাষ্ট্রের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা মোটেই কাম্য নয়। তিনি বলেছেন: “The state should not seek to control opinion, no matter what opinion may be.” ল্যাস্কির অভিমত হল, অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে মানুষ স্বাধীনভাবে চিন্তার সুযোগ না পেলে চিন্তার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে। এই অবস্থায় ব্যক্তিসত্তার পরিপূর্ণ বিকাশ সাধন সম্ভব নয়। মত প্রকাশের স্বাধীনতা না থাকলে মানুষ ক্রমে চিন্তা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। তখন মানুষ সুনাগরিক হিসাবে গণ্য হতে পারে। না। প্রচলিত রাজনীতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার বিরোধী অভিমতও স্বাধীনভাবে ব্যক্ত হওয়ার সুযোগ থাকা দরকার। নাগরিকদের স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ বা নিয়ন্ত্রণ গণতন্ত্রের ভিত্তিতে কুঠারাঘাত করে।
কিন্তু নাগরিকের কোন মতামতকে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। এ কথা বলা হয় না। মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে কুৎসা রটনা বা চরিত্র হননের স্বাধীনতা স্বীকার করা যায় না। তা ছাড়া ম্যাকাইভারের মতানুসারে প্রচলিত আইনব্যবস্থা বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্ররোচনামূলক মতামত প্রকাশকে দমন করা রাষ্ট্রের কর্তব্য। আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখায় দায়িত্ব পালনের জন্য রাষ্ট্রকেও এ ক্ষেত্রে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শান্তিপূর্ণভাবে ও সংবিধানসম্মতভাবে আইন পরিবর্তনের সুযোগ থাকে। এই অবস্থায় নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি ছাড়া বলপ্রয়োগ বা বিপ্লবের মাধ্যমে আইনের পরিবর্তনের বা রাষ্ট্র-ব্যবস্থাকে আক্রমণের চেষ্টাকে সমর্থন করা যায় না।
মার্কসবাদীরা কিন্তু এই যুক্তি মানেন না। তাঁদের মতে উদারনীতিক গণতন্ত্রে রাষ্ট্রশক্তি মুষ্টিমেয় পুঁজিপতি শ্রেণীর স্বার্থরক্ষার জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের বিরুদ্ধে প্রযুক্ত হয়। ধনবৈষম্যমূলক সমাজে শাসক শ্রেণী প্রতিপত্তিশালী শ্রেণীর স্বার্থে সংখ্যাগরিষ্ঠের অধিকার হরণের জন্য কাজ করে। শ্রেণীহীন, শোষণহীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত জনসাধারণের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা সার্থক হতে পারে না। আর শ্রেণীহীন, শোষণহীন, সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজ ও রাষ্ট্রের আমূল পরিবর্তন দরকার।
(খ) ধর্ম: অনেকের মতে ধর্মের ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ অনুচিত। ধর্ম হল মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার; ব্যক্তির নিজের বিশ্বাস ও বিবেকের বিষয়। ধর্মীয় ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় নির্দেশ বা নিয়ন্ত্রণ সমর্থন করা যায় না। কোনো ধর্মের প্রতি পৃষ্ঠপোষকতা বা প্রতিবন্ধকতা রাষ্ট্রের দিক থেকে অনভিপ্রেত। তাই বর্তমানে অধিকাংশ রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ গ্রহণ করেছে। লিপসন-এর মতানুসারে রাষ্ট্র ও ধর্মীয় সংগঠন একেবারে আলাদা প্রতিষ্ঠান হিসাবে থাকবে। বার্কারের অভিমত অনুসারে আইনের দ্বারা ধর্মমত প্রচারে রাষ্ট্র বাধা দিলে হয় রাষ্ট্র ব্যর্থ হবে, না হয় তার ফলাফল ভয়াবহ হবে।
কিন্তু সমাজের সামগ্রিক বা বৃহত্তর স্বার্থের বিরোধী ধর্মীয় প্রচারে রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ না করে পারে না। ধর্মীয় স্বাধীনতার নামে কুসংস্কার, সংকীর্ণতা, সামাজিক শৃঙ্খলাভঙ্গ বা অন্যান্য মানবতাবিরোধী কার্যকলাপকে রাষ্ট্র সহ্য করতে পারে না। এই সমস্ত ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ কাম্য।
(গ) নৈতিকতা: রাষ্ট্রীয় আইনের দ্বারা ন্যায়-অন্যায় বোধকে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত নয়। অর্থাৎ নৈতিকতার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ অনভিপ্রেত। ন্যায়-অন্যায়বোধই হল মানুষের নৈতিকতার ভিত্তি। এই বোধ ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে পারে। আইন কিন্তু সকল ক্ষেত্রে সমান। সুতরাং একই আইন বিভিন্ন ধরনের নৈতিকতাকে কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তা ছাড়া রাষ্ট্রীয় আইনের পরিধি এবং নৈতিকতার পরিধির মধ্যে পার্থক্য আছে। রাষ্ট্রীয় আইন কেবল বাহ্যিক কার্যকলাপকেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। মানুষের নীতিবোধ কিন্তু বাহ্যিক আচরণ ছাড়াও আভ্যন্তরীণ চিন্তা-চেতনাকেও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ম্যাকাইভারের মতানুসারে আমরা আইন মান্য করি আইন সঠিক বা যথার্থ এই কারণে নয়, রাষ্ট্রীয় আইন মান্য করা সমীচীন বলেই আমরা আইন মান্য করি। এই কারণে নৈতিকতা কখনই রাষ্ট্রীয় আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে না। তবে রাষ্ট্র নৈতিকতার পরিবেশ সৃষ্টির ক্ষেত্রে ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে।
(ঘ) প্রথা: প্রথার ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ অনুচিত বলে মনে করা হয়। সুদীর্ঘকাল ধরে সমাজে প্রচলিত রীতিনীতি ও আচার-ব্যবহারকে প্রথা হিসাবে গণ্য করা হয়। এই সমস্ত প্রথা রাষ্ট্রের সৃষ্টি নয়। তাই প্রথাকে নিয়ন্ত্রণ বা বাতিল করার এক্তিয়ার রাষ্ট্রের থাকতে পারে না। ম্যাকাইভারের মতানুসারে সমাজে প্রচলিত প্রথাসমূহকে রাষ্ট্র স্বীকৃতি দিতে পারে। তা ছাড়া সংশ্লিষ্ট পরিবেশের পরিবর্তন করে রাষ্ট্র প্রথাকে পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করতে পারে।
কিন্তু কুপ্রথা বা সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর প্রথাগুলিকে আইনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ বা বিলোপ করা রাষ্ট্রের উচিত। এর ফলে সমাজের অশেষ কল্যাণ সাধিত হয়। ভারতে রাষ্ট্র আইনের মাধ্যমে বাল্যবিবাহ, সতীদাহ, দেবদাসী প্রভৃতি কু-প্রথাগুলিকে বিলুপ্ত করেছে। তার ফলে ভারতীয় সমাজজীবনের যথার্থ কল্যাণ হয়েছে। তবে জনসমর্থন না পেলে রাষ্ট্র কেবলমাত্র আইনের দ্বারা কু-প্রথার বিলোপ করতে পারে না। সর্বোপরি, ম্যাকাইভারের মতানুসারে, সমাজের মৌলিক প্রথাগুলির উপর রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করতে বা প্রথাগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।
(ঙ) ফ্যাশন: ফ্যাশনের ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ অকাম্য বিবেচিত হয়। ফ্যাশন একান্তভাবে ব্যক্তির ব্যক্তিগত রুচির বিষয়। রাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। প্রকৃত প্রস্তাবে রাষ্ট্র এ বিষয়ে একেবারে অসহায়। কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তির আদবকায়দা বা ফ্যাশন অনুকরণের ব্যাপারে সাধারণ মানুষকে বিশেষভাবে আগ্রহী হতে দেখা যায়। কিন্তু এইরকম আগ্রহ রাষ্ট্রীয় আইনের ক্ষেত্রে সঞ্চারিত হয় না। পশ্চিমী কোনো দেশের কোনো বিশেষ ফ্যাশন সংস্থা কর্তৃক প্রবর্তিত ফ্যাশন বা রূপালি পর্দার কোনো নায়কের হাল ফ্যাশনের অনুকরণ বা গ্রহণের ব্যাপারে ব্যক্তিকে অতিমাত্রায় উৎসাহী হতে দেখা যায়। কিন্তু রাষ্ট্র কোনো রীতিনীতি বা আদবকায়দা প্রবর্তন করলে সে বিষয়ে ব্যক্তির তেমন আগ্রহ দেখা যায় না। পোশাক-পরিচ্ছদ, আদব-কায়দা, রীতিনীতির মাধ্যমে ব্যক্তির ফ্যাশনের যে প্রকাশ ঘটে তার উপর রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ মোটেই কাম্য নয়। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ নিতান্তই অপ্রয়োজনীয়। এবং হস্তক্ষেপের ফলে বিক্ষোভ-বিদ্রোহের সৃষ্টি হতে পারে। তবে কোনো কুরুচিপূর্ণ বা শালীনতাহীন ফ্যাশন সমাজের নীতিবোধকে আহত করলে বা নৈতিক পরিবেশকে দূষিত করার আশংকা দেখা দিলে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ জরুরি হয়ে পড়ে।
(চ) শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতি: শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ করা উচিত নয় বলে বলা হয়। শিল্পকর্ম ও সাহিত্য সৃষ্টি হল ব্যক্তির সৃজনধর্মী চিন্তার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র বাধানিষেধ আরোপ করলে শিল্প সাহিত্যের বিকাশে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হবে এবং দেশ ও জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হবে। স্বাধীন ও সুস্থ জীবনধারার ভিত্তিতে যে সমাজসচেতন সাহিত্যকর্ম বা মৌলিক ও সৃজনধর্মী শিল্প সৃষ্টি সম্ভব, রাষ্ট্রীয় আইনের ঘেরাটোপের মধ্যে তা অসম্ভব। এই কারণে বলা হয় যে, শিল্প-সাহিত্য-সংগীত প্রভৃতি জাতীয় সংস্কৃতির বিভিন্ন অঙ্গনে রাষ্ট্রীয় অনুপ্রবেশ অবাঞ্ছিত।
কিন্তু অপসংস্কৃতির প্রাদুর্ভাব আটকানোর ব্যাপারে রাষ্ট্রের দায়িত্ব আছে। সুস্থ জীবনধারার ও মানবতা বিরোধী কুরুচিপূর্ণ শিল্প-সাহিত্য সমাজ ও সমাজবাসীদের স্বাভাবিক ও স্বাচ্ছন্দ্য বিকাশে বাধার সৃষ্টি করে এবং জাতীয় জীবনের নৈতিক অপমৃত্যু ঘটে। এ ক্ষেত্রে সামাজিক স্বার্থে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য।
উপসংহার: তবে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের সঠিক সীমারেখা নির্ধারণের সমস্যা রাষ্ট্রবিজ্ঞান এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এই কারণে রাজনীতিক ব্যবস্থাভেদে এবং দেশ ও কালভেদে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের সীমারেখার মধ্যে পার্থক্য দেখা যায়। তবে সাধারণভাবে বলা যায় যে বর্তমান প্রবণতা হল রাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্রের উত্তরোত্তর বৃদ্ধির দিকে। স্বাভাবিক কারণে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণমূলক ক্ষমতা ও তার পরিধি ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছে।
Leave a comment