রাজনীতিক দলব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্পর্কে আলোচনার অন্ত নেই। এই আলোচনা আজকের নয়, আবহমান কালের। বস্তুত রাজনীতিক দলব্যবস্থার আবির্ভাবের সময় থেকেই দলব্যবস্থাকে সন্দেহের চোখে দেখা শুরু হয়েছে। এ বিষয়ে বিরূপ বক্তব্য বহু ও বিভিন্ন। দলীয় রাজনীতিক ব্যবস্থায় বর্তমানে সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। এই সংকট বা অবক্ষয়ের সূচক হিসাবে দলীয় সদস্যসংখ্যার হ্রাস, দলের কট্টর অনুগামীর সংখ্যার হ্রাস প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। যাইহোক রাজনীতিক দলব্যবস্থায় অবক্ষয়ের পরিচায়ক হিসাবে কতকগুলি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
(ক) আধুনিক কালের সমাজব্যবস্থা বিশেষভাবে জটিল প্রকৃতির। এ ধরনের সমাজব্যবস্থায় সুষ্ঠু পরিচালনা ক্রমান্বয়ে অধিকতর জটিল হয়ে পড়েছে। রাজনীতিক দলগুলি সরকারি ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে সংশ্লিষ্ট সমস্যাদির সমাধানের এবং বিদ্যমান অবস্থার উন্নতি সাধনের ব্যাপারে তাদের সামর্থ্য সম্পর্কে নিশ্চয়তা প্রদান করে। কিন্তু ক্ষমতাসীন হওয়ার পর রাজনীতিক দল বা জোট প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি রক্ষণ করে না বা করতে পারে না। তার ফলে জনসাধারণের মধ্যে শুভনাস্তিক্য, দোষানুদর্শিতা, মোহমুক্ত অবস্থা প্রভৃতি দেখা দেয়। তারফলে স্বার্থগোষ্ঠীসমূহের সংখ্যা ও সামর্থ্য বৃদ্ধি পায়। আবার দুনিয়াজুড়ে আর্থনীতিক ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের বিকাশ ও বিস্তার ঘটে। তারফলে দলীয় সরকারসমূহ অধিকতর জটিল সমস্যাদির সম্মুখীন হয়।
(খ) সাধারণত বৃহৎ রাজনীতিক দলসমূহ নির্বাচকমণ্ডলীর বৃহদাংশের আশা-আকাঙ্খাসমূহকে সুসংবদ্ধ করে কর্মপরিকল্পনা ও কর্মসূচী নির্ধারণের ব্যাপারে আত্মনিয়োগ করে। সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়েই দলগুলি ব্যতিব্যস্ত থাকে। সে রকম নতুন নতুন বিষয়াদি বা সমস্যাদিকে সুসংবদ্ধ করার জন্য নতুন ও স্বতন্ত্র রাজনীতিক সংগঠন অপরিহার্য প্রতিপন্ন হয়। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে বলা যায় যে, আণবিক শক্তি, পরিবেশ দূষণ, নারীবাদ, পশুকল্যাণ প্রভৃতি বিষয়ে এক বিষয়ভিত্তিক সংগঠন এবং নতুন সামাজিক আন্দোলনের সৃষ্টি হয়। এ রকম পরিবর্তিত পরিস্থিতি পরিমণ্ডলে সরকার ও সমাজের মধ্যে সংযোগ সম্পর্কের মাধ্যম হিসাবে রাজনীতিক দলকে হীনবল করে বা অপসারিত করে বিভিন্ন নতুন সংগঠন বা গোষ্ঠীসমূহের আবির্ভাব ঘটে।
(গ) সাবেকি সামাজিক, ধর্মীয় ও আনুষঙ্গিক সংহতিসমূহ অধুনা অন্তর্হিত হয়েছে। নতুন ধরনের আশা আকাঙ্খা, ন্যায়-অন্যায় বোধ ও ধ্যান-ধারণা রাজনীতিক কর্মসূচীর অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। উত্তর বস্তুবাদের সঙ্গে সংযুক্ত চিন্তাভাবনা পরিস্থিতি-পরিমণ্ডলের পরিবর্তন সাধন করেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাজনীতিক দলের প্রাসঙ্গিকতা কতকাংশে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
(ঘ) প্রাথমিক বিচারে সমকালিন সামাজিক একরূপতা ও ঐতিহ্যগত আনুগত্য-অঙ্গীকারের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিক দলসমূহের উদ্ভব ঘটেছে। সংশ্লিষ্ট সামাজিক একরূপতা ও সাবেকি আনুগত্যে অধুনা টান পড়েছে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে শ্রেণীগত রাজনীতির অবক্ষয়ের কথা বলা যায়।
(ঙ) সাম্প্রতিক কালে রাজনীতিক দলগুলি জনসাধারণের সংগঠন হিসাবে প্রতিপন্ন হয় না। রাজনীতিক অন্তর্দ্বন্দ্বে দলগুলি বর্তমানে ব্যতিব্যস্ত। তদুপরি যেনতেন প্রকারেন ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে দলগুলি নিবেদিত প্রাণ। স্বভাবতই আমজনতার স্বার্থের সঙ্গে রাজনীতিক দলগুলি সম্পর্করহিত হয়ে পড়েছে।
(চ) সর্বসাধারণের সমক্ষে রাজনীতিক দলসমূহের ভাবমূর্তি অধুনা অতিমাত্রায় মলিন হয়ে পড়েছে। রাজনীতিক দল অর্থে আজকাল সরকারি ক্রিয়াকর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং পেশাদার রাজনীতিকদের নিয়ে গঠিত একটি সংগঠনকে বোঝায়। দলগুলি রাজনীতিক ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত। ক্ষমতা, দূর্নীতি এবং মাত্রাতিরিক্ত উচ্চাশার অশুভ প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার পরিণামে রাজনীতিক দলগুলি কলঙ্কিত হয়ে পড়েছে। দলের উচ্চ পদাধিকারীদের বিরুদ্ধে আজকাল দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপিত হতে দেখা যায়।
(ছ) একক ইস্যুভিত্তিক বা বিষয়মূলক প্রতিবাদী গোষ্ঠীসমূহ বর্তমানে বিশেষভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। সদস্য-সমর্থন অর্জনের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীসমূহ আজকাল অত্যন্ত সফল। বিশেষত যুবসম্প্রদায়কে এই সমস্ত গোষ্ঠী বিশেষভাবে আকর্ষণ করেছে। এর পিছনে কারণ হিসাবে বলা হয় যে, সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীসমূহ আঞ্চলিক বিষয়ভিত্তিক এবং শিথিলভাবে সংগঠিত। তা ছাড়া এই সমস্ত গোষ্ঠী সদস্যদের অংশগ্রহণ এবং অতিসক্রিয়তার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে।
(জ) আধুনিক কালে রাজনীতিক দলসমূহ অনেকাংশে অভিজাততান্ত্রিক প্রকৃতিপ্রাপ্ত হয়েছে। রাজনীতিক দলগুলি এখন আমলাতান্ত্রিক রাজনীতিক যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। তারফলে দলের তৃণমূল স্তরের সদস্যরা অনেকাংশে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে অথবা মিটিং-মিছিলে যোগ দেওয়ার মত নিষ্প্রাণ কর্মসূচীর সামিল হচ্ছে।
(ঝ) উপরিউক্ত পরিবর্তনসমূহের কথা বাদ দিলেও রাজনীতিক দলের প্রাসঙ্গিকতার বিরুদ্ধে প্রবণতার সৃষ্টি হয়েছে। এই প্রবণতাকে রাজনীতি-বিরোধিতা (anti-politics) হিসাবে অভিহিত করা যায়। বর্তমানে বিভিন্ন রাজনীতিক আন্দোলন ও সংগঠনসমূহের সৃষ্টি হয়েছে। এই সমস্ত আন্দোলন ও সংগঠনের অভিন্ন মূল বিষয় হল প্রচলিত ক্ষমতা কেন্দ্রসমূহের এবং ক্ষমতাভিত্তিক মর্যাদাসমূহের ব্যাপারে বিদ্বেষ-বিরোধিতা। তারফলে নতুন রাজনীতিক আন্দোলনসমূহ সংগঠিত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট আদোলনসমূহ ক্ষমতার অধিকারের সঙ্গে সম্পর্করহিত।
(ঞ) নতুন সামাজিক আন্দোলনসমূহের উদ্ভবও রাজনীতিক দলের উপযোগিতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে। নতুন সামাজিক আন্দোলনের উদাহরণ হিসাবে পরিবেশ আন্দোলন, নারী আন্দোলন, মানবাধিকার আন্দোলন, যুদ্ধবিরোধী শান্তি আন্দোলন প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এই সমস্ত আন্দোলন রাজনীতিক ক্ষমতা দখলজনিত স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্করহিত। কখনো কোথাও রাজনীতিক সংগঠনের মাধ্যমে এরকম কোন সামাজিক আন্দোলনের অভিব্যক্তি ঘটলেও রাজনীতিক স্বার্থ ও দলনিরপেক্ষতা অব্যাহত থাকে।
দলীয় রাজনীতির সংকট অন্যভাবেও অভিব্যক্ত হয়েছে। রাজনীতিক দলের সদস্যসংখ্যা বা দলের অন্ধ অনুগামীর সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে; দলীয় সংযোগ সম্পর্কের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন ঘটেছে। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে গ্রেট ব্রিটেনের দলীয়ব্যবস্থার কথা বলা যায়। বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে ইংল্যাণ্ডের রাজনীতিক দলগুলির সদস্যসংখ্যা ছিল সর্বাধিক। তারপর এই সদস্যসংখ্যা হ্রাস পায়। শ্রমিকদল হারায় তার দলের সদস্য সংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ এবং রক্ষণশীল দল অর্ধেকের অধিক সদস্যসংখ্যা হারায়। আর একটি বিষয় এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। নতুন প্রজন্মের মধ্যে রাজনীতিক দলের সদস্যপদ গ্রহণের ব্যাপারে অনীহা প্রকাশ পায়। এই বিষয়টি একটি পরিসংখ্যান থেকে প্রকাশ পায়। ১৯৯৮ সালে ইংল্যাণ্ডের রক্ষণশীল দলের সদস্যদের গড় আয়ু ছিল ৬৩ বছর। তারফলে ক্ষমতাসীন দলগুলির বিরুদ্ধে প্রদত্ত ভোটের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। অ্যান্ড্রু হেউড এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন: “Modern concern about parties, however, stems from evedence of their decline as agents of representation and as an effective link between government and the people.”
Leave a comment