সাবেকী চিন্তাধারায় পার্থক্য ছিল না: সনাতন দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের কাছে রাষ্ট্রদর্শন ও রাষ্ট্রতত্ত্ব ছিল সমার্থক। ঊনবিংশ শতাব্দীর আগে পর্যন্ত উভয়ের মধ্যে কোন পার্থক্য করা হত না। তৎকালীন সময়ে রাজনীতিক তত্ত্ব ছিল রাজনীতিক দর্শনেরই অন্তর্ভুক্ত। উভয়ের মধ্যে যোগাযোগ ছিল গভীর এবং সম্পর্ক ওতপ্রোত। সমকালীন ধারণা অনুসারে রাষ্ট্রদর্শন ও রাষ্ট্রতত্ত্বের ভূমিকা ছিল এক ও অভিন্ন।

পার্থক্যের সূত্রপাত: কালক্রমে রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তাজগতে দৃষ্টবাদ (positivism)-এর উদ্ভব হয়। তার ফলে রাষ্ট্রদর্শন ও রাষ্ট্রতত্ত্বের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণের চেষ্টা শুরু হয়। তারপর অভিজ্ঞতাবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে তাঁদের উপস্থিতিকে আলোড়নে পরিণত করেন। তাঁরা দার্শনিক ধ্যান-ধারণাকে বর্জন করে মূল্যমান-নিরপেক্ষ রাজনীতিক আলোচনায় আত্মনিয়োগ করেন। এই শ্রেণীর রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা ভৌত বিজ্ঞানের পন্থা-পদ্ধতি প্রয়োগের উপর জোর দেন এবং তথ্য ও ঘটনা সংগ্রহের মাধ্যমে অভিজ্ঞতাবাদী আলোচনার কথা বলেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনাকে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের পর্যায়ভুক্ত করার উদ্দেশ্য তাঁরা দর্শনের সঙ্গে সম্পর্করহিত এক বাস্তবভিত্তিক রাজনীতিক তত্ত্ব সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হন। অভিজ্ঞতাবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক আলোচনাকে দর্শনমুক্ত (dephilosophised) করার পক্ষপাতী। আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে এই উদ্যোগ বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়।

বিবিধ পার্থক্য: রাফায়েল রাজনীতিক দর্শন ও রাষ্ট্রতত্ত্বের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণের কথা বলেছেন। মূলত তিন দিক থেকে এই পার্থক্য নির্ধারণ করা হয়। 

(১) উদ্দেশ্যগত পার্থক্য: রাজনীতিক দর্শন ও রাষ্ট্রতত্ত্বের মধ্যে উদ্দেশ্যগত পার্থক্য বর্তমান। রাজনীতিক জীবনের ক্ষেত্রে একটি সর্বজনীন ও সাধারণ তত্ত্ব গড়ে তোলাই হল রাজনীতিক দর্শনের মুখ্য লক্ষ্য। অপরদিকে রাষ্ট্রতত্ত্ব কোন কিছুর কারণ অনুসন্ধান করতে চায়। এ ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতাবাদী গবেষণার উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। উদাহরণ হিসাবে আধুনিক আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের কথা বলা যায়। তারা ঘটনার আলোচনার সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষা-নিরীক্ষা, বিচার-বিশ্লেষণ, অনুসিদ্ধান্ত প্রভৃতির মাধ্যমে তত্ত্ব গড়ে তুলতে চান।

(২) বিষয়বস্তুগত পার্থক্য: রাজনীতিক দর্শনের উদ্দেশ্য হল আদর্শ একটি রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা। এই উদ্দেশ্যে উপনীত হওয়ার পন্থা-পদ্ধতি সম্পর্কেও রাজনীতিক দর্শনে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়। অর্থাৎ রাজনীতিক দর্শনে লক্ষ্য এবং লক্ষ্য পূরণের উপায় সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। দার্শনিক প্লেটো এক আদর্শ রাষ্ট্রের পরিকল্পনা করেছেন এবং তার বাস্তবায়নের জন্য ‘দার্শনিক রাজা’ (Philosopher king)-র কথা বলেছেন। অপরদিকে রাষ্ট্রতত্ত্বে রাজনীতিক বিষয়াদির বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগ করা হয় এবং সমকালীন ঘটনাসমূহ ও ইতিহাস থেকে বিষয়বস্তু নিয়ে বিশ্লেষণাত্মক পর্যালোচনার মাধ্যমে ভবিষ্যতের কথা বলা হয়।

(৩) বৈধতা বিচার বিষয়ক পার্থক্য: রাষ্ট্রনৈতিক তত্ত্বের বৈধতা বিচার করা যায়। কিন্তু রাজনীতিক দর্শনের বৈধতা বিচার করা যায় না। দর্শনের বৈধতা বিচারের ঊর্ধ্বে।

কৃত্রিমভাবে পার্থক্য নির্ধারণ অসঙ্গত: অনেকের মতে রাজনীতিক দর্শন ও রাষ্ট্রতত্ত্বের মধ্যে কৃত্রিমভাবে পার্থক্যের সীমারেখা নির্ধারণ করা সঙ্গত নয়। প্রকৃত প্রস্তাবে রাজনীতিক দর্শনকে একেবারে বর্জন করে রাষ্ট্রতত্ত্ব গড়ে তোলা যায় না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মাত্রেই তাঁর বিশেষ কিছু মতাদর্শ ও ধ্যান-ধারণার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকেন। রাজনীতিক দর্শন ও রাষ্ট্রতত্ত্ব উভয়ই হল রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তার অংশ। তাই উভয়ের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্কের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা যায় না।

স্ট্রাউস কৃত্রিম পার্থক্য নির্ধারণের বিরোধী: স্ট্রাউস তাঁর What is Philosophy? শীর্ষক এক প্রবন্ধে রাজনীতিক তত্ত্ব ও রাজনীতিক দর্শনের সম্পর্ক নির্ধারণ করেছেন। তিনি রাজনীতিক দর্শন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মধ্যে কৃত্রিম পার্থক্য নির্ধারণের বিরোধিতা করেছেন। তাঁর মতানুসারে দর্শনহীন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অস্তিত্ব অসম্ভব। রাজনীতিক দর্শন ও রাজনীতিক তত্ত্ব হল পরস্পরের পরিপূরক। রাষ্ট্রচিন্তারই অংশ হল রাজনীতিক তত্ত্ব ও রাজনীতিক দর্শন। তাঁর মতে রাজনীতিক তত্ত্বে রাজনীতিক বিষয়ের প্রকৃতি পর্যালোচনা করা হয়। আবার রাজনীতিক দর্শনে রাজনীতিক বিষয়ের প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে আদর্শ রাজনীতিক বিষয় অনুধাবনের প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। রাজনীতিক দর্শনের সঙ্গে মূল্যবোধের ধারণা ও আলোচনা ওতপ্রোতভাবে যুক্ত।

উপসংহার: প্রকৃত প্রস্তাবে দর্শন থেকে রাজনীতিক তত্ত্বকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। রাজনীতিক দর্শনের দ্বারা রাজনীতিক তত্ত্ব প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত হয়। রাজনীতিক দর্শনকে উপেক্ষা করে কোন রাজনীতিক তত্ত্ব গড়ে উঠতে পারে না। রাজনীতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে অস্বীকার করে কোন রাজনীতিক তত্ত্ব গড়ে তোলা যায় না। কারণ কোন রকম দার্শনিক অঙ্গীকার ব্যতীত কোন তত্ত্ব ব্যাপক স্বীকৃতি পেতে পারে না।